মোনালিসা দেখতে দারুণ সুন্দর। চোখগুলো ক্রিস্টালের মতো স্বচ্ছ। মণিটা গভীর। চোখের তারা জ্বলজ্বল করে সবসময়। এত সুন্দর মেয়ে বলে বাবা নাম রেখেছিলেন মোনালিসা। বলতেন, আমার মেয়ে সিনেমার নায়িকা হবে। নায়িকার নামে গ্ল্যামার থাকা চাই। মোনালিসার ঘুম ভাঙলো অ্যালার্মের শব্দে। ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছে। বাড়ির পাশের ডোবায় ব্যাঙের একটানা ঘ্যাঙ ঘ্যাঙ ডাক শোনা যাচ্ছে৷ আরামদায়ক আবহাওয়ায় ইচ্ছে করছে কাঁথার নিচে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয় সকালটা। কিন্তু বের হতেই হবে।
শৈশবের দিনগুলো কি ভালোই না ছিল! স্মৃতিপটে ভেসে উঠল বহুদিন আগের ছবি। সেগুলোতে কেউ চাইলেও ফ্যাকাসে রঙ ঢালতে পারবে না। কিছু বিষয় সবসময় সৌন্দর্য্যে মোড়া থাকে। একটু বৃষ্টি পড়লেই স্কুল কামাই করা, মায়ের হাতের ভুনা খিচুড়ি। জিভে জল চলে এল। তবে আজ চাইলেও খিচুড়ি রাঁধা যাবে না। টোস্ট কফি দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারতে হবে। কফিতে চুমুক দিয়ে মুখটা তেতো হয়ে গেল মোনালিসার। চিনি না দিয়ে লবণ দিয়েছে! কফিটা রেখে জামাটা বদলে ছাতা হাতে বের হয়ে গেল স্কুলের উদ্দেশ্যে। মোনালিসার মা-বাবা মারা গেছেন। বিয়ে হয়েছিল, তবে স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। এখন একাই কাটছে দিনকাল। স্কুলের চাকরি আর বই পড়ে সময় কেটে যায় দিব্যি। অনেকে বিয়ের জন্য প্রপোজ করলেও সংসার করতে ইচ্ছে হয় না।
কাছাকাছি পৌঁছে মোনালিসা দেখলো স্কুলের মাঠটা লোকে লোকারণ্য। ছাতা হাতে অনেকে জড়ো হয়েছে। বৃষ্টির দিনে এত লোক কেন? ভিড় কাটিয়ে স্কুলঘরের ভেতরে চলে গেল সে। এখানেও অনেক লোক। হলরুমের দিকে বেশি ভিড়। সেদিকে যেতেই কেউ একজন তাকে দেখে আর্তনাদ করে উঠল। সেই লোকের দেখাদেখি অনেকেই তার দিকে তাকালো। চাপা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। সবাই এমনভাবে তাকালো যেন ভূত দেখছে! মোনালিসা একটু গুটিয়ে গেল। হয়েছে কী? সে সামনে এগিয়ে দেখল একটা লাশ মেঝেতে শুইয়ে রাখা হয়েছে। প্রচন্ড জোরে হৃৎপিণ্ড লাফাতে শুরু করলো তার। হলঘরের সবগুলো চোখ তার দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মোনালিসা সেটা আপাতত উপেক্ষা করে লাশের দিকে এগিয়ে গেল। লাশটা দেখেই চিৎকার করে উঠল সে। লাশের মুখটা থেঁতলে গেছে। কে তা চেনার উপায় নেই। কিন্তু তারচেয়ে বড় কথা লাশের শরীরটা দেখতে পুরোপুরি মোনালিসার মতো। সে গতদিন যে শাড়িটা পরে স্কুলে এসেছিল লাশের পরনে সেটাই। অনামিকা আঙ্গুলের আংটিটাও তারটার মতোই।
মোনালিসা ধপ করে বসে পড়ল মাটিতে। দুই হাতে মুখ ঢেকে ফেলল। এতক্ষণে সবার যেন মনে হলো আগত মেয়েটা ভূত নয়, স্বয়ং মোনালিসা ম্যাডাম। স্কুলের সহকারি টিচার রাজীব এগিয়ে এসে মোনালিসার কাঁধে হাত রাখলেন। মোনালিসা ঝট করে তাকালো তার দিকে। চোখদুটো রক্তলাল। রাজীব স্যার সরে গেলেন সাথে সাথে। কী যেন আছে চোখে! তদন্তপ্রাপ্ত অফিসার সোহরাব হোসেন গোল টেবিলের অপর পাশের বিধ্বস্ত মেয়েটার দিকে পানি এগিয়ে দিলেন। অপেক্ষা করলেন পান করা শেষ হওয়া পর্যন্ত। তারপর বললেন, “আপনি বলতে চাইছেন লাশটা আপনার জমজ বোনের?”
“হ্যাঁ।”
“কী নাম তার?”
“অঙ্গনা।”
“আপনি তার সাথে থাকতেন না কেন?”
“অঙ্গনা নিরুদ্দেশ ছিল অনেক বছর। আমাদের আঠারোতম জন্মদিনের দিন সে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল। তারপর আর দেখা হয়নি।”
“কেন চলে গিয়েছিল?”
“মায়ের সাথে ঝগড়া করে।”
“ডিটেইলসে বলুন।”
“অঙ্গনার গলায় সমস্যা ছিল।
প্রায় সব কথাই জড়িয়ে যেত। মা এটা নিয়ে সবসময় আফসোস করতেন। অনেক কথা শোনাতেন অঙ্গনাকে। অঙ্গনা চাইলেও সেসব কথার ঠিকঠাক জবাব দিতে পারতো না। সেই সাথে সে ছিল প্রচন্ড অভিমানী। মা আমাকে বেশি আদর করতেন সেটা সহ্য করতে পারতো না সে। এসব নিয়েই শেষ পর্যন্ত মায়ের সাথে ভয়ানক মনোমালিন্য হয়ে গেল তার। এক বাড়িতে থেকেও মুখ দেখাদেখি বন্ধ। জন্মদিনের দিন মা আমাকে উইশ করে আদর করে দিয়ে গেলেও ওর সাথে কথা বললেন না। আর তারপর থেকেই সে হুট করে গায়েব হয়ে গিয়েছিল। বাড়ি ফেরেনি আর কখনো।”
“আপনার মা মারা গেছেন কত বছর আগে?”
“আগস্টে পাঁচ বছর হবে।”
“বাবা?”
“মা-বাবা একসাথেই মারা গিয়েছিলেন রোড এক্সিডেন্টে।”
“এতদিন যে নিরুদ্দেশ ছিল সে হঠাৎ করে আপনার স্কুলের পেছনের পুকুরে কী করে মৃত অবস্থায় পড়েছিল?”
“জানি না।”
“সত্যি জানেন না? নাকি না জানার ভান করছেন?”
মোনালিসা সোহরাবের দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “আমি সত্যি জানি না। আপনি কী ভাবছেন আমি আমার বোনকে মেরে রেখেছি?”
“তা বলছি না, ভিক্টিমের মৃত্যু হয়েছে শ্বাসরোধ করে। তার আগে তাকে রেপ করা হয়েছিল। সেটা আপনার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে মৃত্যুর সাথে আপনার কোনো না কোনো যোগাযোগ অবশ্যই আছে।” সোহরাব দেখল তার কথা শুনে সামনে বসা মেয়েটা কেঁপে উঠল। সম্ভবত পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা তার জানা ছিল না। এত সুন্দর একটা মেয়ের পক্ষে এত বিভৎসভাবে খুন করা কি আদৌ সম্ভব? সোহরাব বলল, “আপনার বোনের সাথে যোগাযোগ না থাকলে সে আপনার মতো শাড়ি, আংটি কী করে পরল?” “শাড়ির ব্যাপারটা জানি না, তবে আংটিটা বাবা কিনে দিয়েছিলেন। দু’জনকে একরকম।” মোনালিসা শক্ত গলায় বলল, “দেখুন, বোনের খুনের সাথে আমার কোনোই সম্পর্ক নেই। তবে আশা করব আপনি আসল খুনিকে বের করতে পারবেন।”
“চেষ্টা করব মিস মোনালিসা।” সোহরাবের ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি দেখা গেল। এত বেশি সুন্দর কেন মেয়েটা? গোলাপের কাটার মতো কোথায় যেন একটা সমস্যা আছে এরও। সেটা ঠিক কোথায়? স্কুলটা বেশ বড়সড়। দুই তলা দালান। সামনে বিশাল মাঠ। মাঠের দুইধারে লাগানো চারটা রেইনট্রি গাছ, দুটো শিমুল ফুলের গাছ, যেগুলো লাল টকটকে ফুলে ছেয়ে আছে। স্কুলের পেছনে পুকুর। সেই পুকুরেই পাওয়া গেছে অঙ্গনার লাশ। ডিনএনএ টেস্টে মেয়েটার ডিএনএ মোনালিসার সাথে মিলে গেছে। তাই ধরে নেয়া যায় সে অঙ্গনা। সোহরাব অনেকের সাথেই কথা বলল একে একে। প্রথমেই গেল দপ্তরী হারুনের কাছে। হারুনের দাঁত পান খেয়ে লাল টকটকে হয়ে আছে। আধময়লা শার্ট, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। চশমার কাচ সামান্য ঘোলাটে দেখাচ্ছে। সোহরাব জিজ্ঞেস করল, “যেদিন খুন হয়েছে তার আগের দিন আপনি সবার শেষে স্কুল থেকে বের হয়েছেন?”
“জ্বি। তালা মেরে আমিই সবার শেষে গেছি।”
“আপনার আগে কে গিয়েছে?”
“আমার আগে বের হইছে রাজীব স্যার।”
“তার আগে?”
“জানকী ম্যাডাম আর হেডস্যার।”
“মোনালিসা ম্যাডাম কখন গেছেন?”
“হেয় কখন গেছে আমি দেখি নাই স্যার।”
“লাশটা তো সবার আগে আপনিই দেখেছেন তাই না?”
“হ স্যার।”
“দেখে কী মনে হয়েছিল?”
“আমি ভাবছিলাম ওইডা মোনালিসা ম্যাডাম।”
“খুনের আগের দিন স্কুলে অস্বাভাবিক কিছু লক্ষ্য করেছেন?”
“না স্যার।”
“কোনো আগন্তুককে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছেন?”
“স্কুল মাঠে অনেক মানুষই আসে। বইসা থাকে, বাউন্ডারি নাই তো, অনেক পোলাপান খেলে৷ আলাদা কইরা কাউরে দেখি নাই।”
“আপনি কি চোখে কম দেখেন?”
“হ স্যার চশমাটা পুরান হইছে। আগের মতো ভালা দেখি না।”
“সময় থাকতে বদলে ফেলুন। নইলে অনেক কিছু চোখের সামনে হবে, টের পাবেন না।”
পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে হারুন বলল, “স্যার, আমার চোখে সবই ধরা পড়ে।” সহকারী শিক্ষক জানকীর সাথে কথা হলো। তার সাথে মোনালিসার ভালো সম্পর্ক। কয়েক কথার পর সোহরাব জিজ্ঞেস করলেন, “মোনালিসাকে কি কখনো অস্বাভাবিক মনে হয়েছে?” জানকী একটু অবাক হলেন যেন। বললেন, “তা হয়েছে। মেয়েটা মাঝে মধ্যেই আনমনা হয়ে যায়। এমন ভাব করে যেন ধরাধামে নেই। কারো সাথে কথা বলে না। আবার হুট করেই ঠিক হয়ে যায়। হয়তো একা থাকে বলে এমন হয়। এছাড়া সব ঠিক আছে।” আরও কিছু কথাবার্তা, তদন্ত শেষে সোহরাব স্কুল ছেড়ে বের হওয়ার সময় দপ্তরী হারুনের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “স্কুলে কি শুধু পড়াশুনা হয় হারুন মিয়া?” হারুন ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল, “জ্বে না স্যার। আরও অনেক কিছু হয়।”
“কেন হয় বলেন তো?”
“চান্দের কলঙ্ক থাকে। মানুষেরও তেমন থাকা লাগে তাই।”
“বাহ, আপনি তো বেশ রহস্য করে কথা বলতে পারেন!”
হারুন পুলিশের প্রশংসায় একটু লজ্জা পেয়ে গেল। রাজীব স্যারকে স্কুলে পাওয়া যায়নি। তিনি অসুস্থ বলে ছুটি কাটাচ্ছেন। সোহরাব তার বাড়ির দিকে রওনা হলো। বাড়িটা মফস্বলের ঘিঞ্চি এলাকায়। একতলা টিনশেড বাড়িতে থাকেন রাজীব সাহেব। তাকে দেখে সোহরাবের অসুস্থ মনে হলো না মোটেও। কথাবার্তা শুরু হলো।
“রাজীব সাহেব, কতদিন স্কুলে চাকরি করছেন?”
“দেড় বছর।”
“মোনালিসা ম্যাম?”
“উনি দুই বছর হয়তো।”
“আপনি গতকাল সবার পরে স্কুল থেকে বের হয়েছিলেন। অস্বাভাবিক কিছু দেখেছিলেন কি?”
“নাহ। পরীক্ষার খাতা দেখতে দেখতে দেরি হয়ে গিয়েছিল। বের হয়ে দেখি কেউ নেই। অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়েনি।”
“লাশটা দেখে আপনার কি তাকে প্রথমবার মোনালিসা মনে হয়েছিল?”
“হ্যাঁ, একদম তার মতোই ছিল। আমি ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। তবে এটাও মনে হয়েছিল এটা মোনালিসা ম্যামের জমজ বোন হতে পারে।”
“আপনাকে উনি জমজ বোনের ব্যাপারে বলেছিলেন?”
“হ্যাঁ প্রায়ই দুঃখ করতেন।”
“অথচ জানকী ম্যামকে কখনো এই বিষয়ে বললেননি।”
“সবাইকে সব কথা কি আর বলা হয়?”
সোহরাব উঠে পড়লেন। টেবিলের ওপর রাখা দামি ঘড়িটা হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখলেন। বুকশেলফের দামী দামী বিদেশী বইগুলোর দিকে তাকিয়ে বললেন, “বই পড়তে পছন্দ করেন বুঝি?”
“হ্যাঁ।”
“এগুলো নিজে কেনেননি নিশ্চয়ই?” রাজীব জবাব দিল না৷ সোহরাব একটা বই টেনে নিলেন। প্রথম পাতায় লেখা,
“জানি উপহার পেতে ভালোবাসো। হুটহাট তোমাকে কিছু দিতে আমারও খুব ভালো লাগে। ভালোবাসি রাজীব।
-তোমার নায়িকা”
সোহরাব হেসে বললেন, “মোনালিসা মেয়েটা নায়িকার মতোই। চেষ্টা করলে সিনেমায় নামতে পারতেন। তবে আপনি দেখতে শুনতে এবং কাজেকর্মে একেবারেই ভিলেন। আপনার সাথে তার যায় না ঠিক।”
“কী বলতে চাইছেন?”
“কিছু না৷ আসি। ভালো থাকবেন।”
সোহরাব দাঁড়িয়ে আছে বিশাল একটা এপার্টমেন্টের সামনে। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে এখানেই থাকতো অঙ্গনা। এপার্টমেন্টটা তার নামে যেটা কিনেছিলেন রবিউল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি। যে কিনা অঙ্গনা-মোনালিসার বাবা। রবিউল ইসলাম তার সমস্ত সম্পত্তি অঙ্গনার নামে করে দিয়ে গিয়েছিলেন। স্ত্রীর যতটা অবজ্ঞা ছিল দুর্বল মেয়েটার প্রতি, তার ততটাই মমতা ছিল। তিনি ভাবতেন মোনালিসাও মায়ের সাথে মিলে অঙ্গনাকে তাড়াতে সাহায্য করেছে। তাই তাদের দুজনকে সম্পত্তির কানাকড়িও দেননি। মা মেয়ে কিছু না জানলেও অঙ্গনার খবর বাবা ঠিকই রাখতেন।
সোহরাব এবার গেল অন্য শহরে। মোনালিসার প্রাক্তন স্বামীর সাথে কথা বলতে। লোকটা বেশ ভদ্র। সত্যি যা কিছু ছিল সবই বলে দিল। এটাও বলল যে মোনালিসাকে হারিয়ে সে অনেক বড় ভুল করেছে। সেজন্য ক্ষমাও চেয়েছে বহুবার। কিন্তু মোনালিসা ক্ষমা করেনি। সোহরাবকে বিজয়ীর ভঙ্গিতে অফিসে ঢুকতে দেখে জুনিয়র অফিসার তন্ময় জিজ্ঞেস করল, “কেস সলভ স্যার?”
“হ্যাঁ!”
“একটু বলবেন সব?” সোহরাব ঘটনা সব খুলে বললেও আসল খুনির বিষয়ে বলল না। জিজ্ঞেস করল, “তোমার কী মনে হয়? খুনি কে?”
“সিম্পল, মোনালিসা।”
“কী করে বুঝলে?”
“ও বাবার সম্পত্তির জন্য বোনের খুন করেছে।”
“হা হা। খুব ভালো বুঝেছ। ধরে আনা হচ্ছে অপরাধীদের। তাদের সামনেই কথা হোক।”
রাজীব, মোনালিসা পাশাপাশি বসে আছে। মোনালিসা চিৎকার করে বলল, “আমি কী করেছি যে ধরে এনেছেন? এহেন অসভ্যতামির কোনো মানে হয় না।” সোহরাব হাসল। পুলিশের সাথে চোটপোট! বলল, “বলছি সব। মিলিয়ে নেবেন নিজেদের সাথে। এবার সে তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “শোনো তবে, রাজীব মোনালিসার সাথে চাকরি করছে দেড় বছর ধরে। মোনালিসা দারুণ সুন্দরী৷ রাজীবের চোখে যায় সহজেই। লোকটা কথা বলতে পারে মিষ্টি মিষ্টি। তাই পটাতে সময় লাগেনি মোনালিসাকে। শুরু হয়ে যায় তাদের মধ্যে প্রেম। এদিকে অঙ্গনা সারাজীবনই নিজের অবস্থার জন্য দায়ী করেছে মোনালিসাকে। মোনালিসার প্রতি তার ছিল সবসময় নজর। মোনালিসাকে সে উড়ো চিঠি, হুমকি ধামকি প্রায়ই দিতো।
ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি করে মোনালিসার প্রাক্তন স্বামীর সাথে ডিভোর্সও অঙ্গনাই করিয়েছে। রাজীবের সাথে মোনালিসাকে সম্পর্কে জড়িয়ে যেতে দেখে সে সেটা কিছুতেই সহ্য করতে পারেনি। রাজীবের সাথে নিজেও জড়িয়েছে। রাজীব লোভী। তাকে টাকাপয়সা দিয়ে, দামী দামী গিফট দিয়ে হাত করেছে অঙ্গনা। এদিকে যে সে নিজেও রাজীবের জালে ফেঁসে যাচ্ছে তা বুঝতে পারেনি মোটেও। রাজীবকে সে সব বলেছে। বোনের প্রতি তার অজস্র ক্ষোভ! সুযোগ পেলেই সে মোনালিসার খুন করবে। বোনকে মারার জন্য সে রাজীবের সাথে বসে প্ল্যানও করে ফেলে দারুণভাবে। সন্ধ্যার দিকে মোনালিসাকে ফোন করে তাকে স্কুলে দেখা করতে বলে অঙ্গনা। মোনালিসা ভীষণ খুশি হয় এতদিন পর বোনকে পেয়ে। সে ছুটে চলে আসে স্কুলে।” এটুকু বলে থামলো সোহরাব। তন্ময় বলল, “পরেরটুকু আমিই বলি। রাজীব দু’মুখো সাপ। সে মোনালিসাকে আগেই সব বলে দিয়েছিল। দুজন মিলে অঙ্গনাকে খুন করে ফেলে দেয় পানিতে।”
“তুমি বড্ড বেশি সহজভাবে ভাবো তন্ময়। আরো গভীরে ভাবতে হবে। সেদিন মোনালিসাকে রাজীব আর অঙ্গনা মিলে মেরে ফেলেছিল গলায় দঁড়ি পেঁচিয়ে। অঙ্গনা লাশটা রাজীবের ভরসায় রেখে কোনো কারনে চলে গিয়েছিল সেদিন। একটু ভুল হয়েছিল আমাদের। রেপ মৃত্যুর আগে না, পরে করা হয়েছিল। রাজীব একা সেদিন মোনালিসার দেহটা পেয়ে লোভ সামলাতে পারেনি। রেপ করে মুখটা থেঁতলে দিয়ে পানিতে ফেলে দিয়েছিল দেহটা। কিন্তু বড্ড কাঁচা কাজ হয়ে গিয়েছিল। লাশটা সরিয়ে ফেললেই কেউ আর টের পেতো না।” তন্ময় বিষ্ময়ে হা হয়ে বলল, “তার মানে মোনালিসা মারা গিয়েছিল? তবে এই মেয়েটা “ও অঙ্গনা।” অঙ্গনা বনবেড়ালীর দৃষ্টিতে তাকালো সোহরাবের দিকে। বলল, “কাঁচা কাজ অঙ্গনা করে না। এই রাজীবের বাচ্চার দোষে সব হয়েছে। ওকে বলেছিলাম লাশটা মাটিতে পুতে দিতে। দেয়নি। ওর কাছে রেখে আসাই ভুল হয়েছিল আমার।” “তাই তো! কেন লাশ পোতেননি রাজীব সাহেব?” রাজীব কিছুতেই কিছু স্বীকার করবে না। সে বলল, “আমি কিছু করিনি।” সোহরাব তার সামনে গিয়ে চোয়াল শক্ত করে চেপে বলল, “বলবি নাকি অন্য ব্যবস্থা নেব?”
রাজীবকে কথা বলাতে আরো দু’চারটে থাপ্পড়ের প্রয়োজন হলো। শেষ পর্যন্ত সে বলল, “যা ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়েছিল! অত ঝামেলা করতে ইচ্ছে হয়নি। পুকুরে ফেলে দিয়েছি, ডুবে গেছে। তখন মাথায়ও আসেনি যে পরে লাশ ফুলে ভেসে উঠতে পারে। যখন মনে হয়েছে ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে অনেক।” সোহরাব চুক চুক শব্দ করে বলল, “আহারে বেচারা। চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে।” সে এবার অঙ্গনাকে জিজ্ঞেস করল, “সেদিন আপনি চলে গিয়েছিলেন কেন?” “রাজীব বলেছিল আবহাওয়া ভালো না। তাই যেন চলে যাই। আমি কি জানতাম ওর মনে অন্যকিছু চলছে! সরল মনে চলে গিয়েছিলাম।” সোহরাব মাথা দুলিয়ে বলল, “ইশ্ আপনার মনটা একটু বেশিই সরল।” তন্ময় জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু স্যার, আপনি কী করে শিওর হলেন এটা অঙ্গনা?”
সোহরাব মোনালিসার একটা ছবি বের করে তন্ময়কে দেখিয়ে বলল, “দেখে বলো ওর সাথে এই মেয়ের পার্থক্য কী?”
তন্ময় বেশ খানিক্ষন পর্যবেক্ষণ করে বলল, “চোখ!” “ঠিক ধরেছ। মোনালিসার চেখদুটো খুবই সুন্দর আর ঝকঝকে ছিল। অঙ্গনার চোখ ঘোলাটে, আর লালচে। প্রথমে ধরতে পারিনি। ভেবেছি রিসেন্ট ঘটনার প্রভাবে হয়েছে এমন। পরে খবর নিয়ে জানতে পারি বিষয়টা। তারপরেই শিওর হই এটা অঙ্গনা।” “কিন্তু অঙ্গনার গলা?” জবাবটা অঙ্গনাই দিল, “একটা অপারেশন করাতে হয়েছে।” “সেটা আগে করাননি কেন?” “একটু জটিল ছিল, আঠারো বছরের আগে করাতে মানা করেছিল ডাক্তার।” সোহরাব এবার অঙ্গনাকে জিজ্ঞেস করল, “আপনি মোনালিসা সেজে কেন ছিলেন ওর বাড়িতে?”
“শুধু ওর না, ওটা আমারও বাড়ি। বাড়িটা মায়ের নামে ছিল বলে মোনা পেয়েছিল। কিন্তু ওই বাড়িতে আমার শৈশব কেটেছে। কত স্মৃতি আছে! বাবার ঘ্রাণ পাই আমি ওখানে। ভেবেছিলাম মোনাকে মেরে আমার নাম করে চালিয়ে দেব। আমি মোনা সেজে থেকে যাব এখানে। আমি না থাকলে সম্পত্তিগুলো এমনিতেই মোনার হয়ে যেতো। সমস্যা হতো না। “তা আর হলো কোথায়! ভুল মানুষকে বিশ্বাস করে ধরা পড়েই গেলেন। তা রাজীব সাহেব, আপনি দুটো গার্লফ্রেন্ড কী করে হ্যান্ডেল করতেন? আমরা তো একজনই পারি না।” হাসতে হাসতে বলল তন্ময়। সোহরাব বলল, “সেই রহস্যও ধরে ফেলেছি। মোনা-অঙ্গনা গুলিয়ে যেন না যায় তাই দুজনকেই নায়িকা বলে ডাকতেন ভদ্রলোক!”
হেসে উঠল দুই অফিসার। এদিকে খুনি দুজন মাথা হেট করে বসে আছে। অঙ্গনা হঠাৎ প্রচন্ড আক্রোশে গলা চেপে ধরো রাজীবের। চিৎকার করে বলতে লাগলো, “তোর জন্য সব হয়েছে শয়তান। তুই এইটা সাপ। তুই আমাকে ধোঁকা দিয়েছিল। তুই আমার হাতেই মরবি সোহরাব, তন্ময় মিলে ছাড়িয়ে নিল অঙ্গনাকে। সোহরাব অঙ্গনার হাতদুটোতে হ্যানকাফ পরিয়ে ফেলল। কাছে এসে বলল, “ম্যাম, আপনার সাথে ছোটবেলায় অন্যায় হয়েছে মানছি। কিন্তু এতটাও হয়নি যার জন্য বোনকে মেরে ফেলবেন। মানুষের মন এত সংকীর্ণ হতে হয় না। একটু সমঝোতা করে নিলে, রাগটা পুষে না রেখে একটু ছাড় দিলেই আজ দু’বোন সুখে থাকতে পারতেন। মোনালিসা নির্দোষ ছিল। তাকে মেরে ফেলার শাস্তি আপনি ভালোভাবেই পাবেন।”
সোহরাব থানা থেকে বের হয়ে এল। কেমন বদ্ধ, গুমোট আবহাওয়া ভেতরে। গোধুলী লগ্ন শুরু হয়েছে। আকাশ আজ হালকা কমলা আর সোনালী রঙে রঙিন হয়েছে। একটু পরই আঁধার নামবে। কবরের ভেতর থেকে এই আকাশটা দেখা যায় না৷ শুধু কালো আঁধার দেখা যায়। সোহরাবের চোখের সামনে মোনালিসার মুখটা ভেসে উঠল। শেষ পর্যন্ত মেয়েটাকে ন্যায়বিচার পাওয়াতে পেরে ভালো লাগছে খুব!
গল্পের বিষয়:
গল্প