এ্যাংরি রিয়্যাক্ট

এ্যাংরি রিয়্যাক্ট
রিজু আমার দিকে ডায়নোসরের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হায় খোদা যেখানে পৃথিবীর সব প্রেমিক-কুল রোমান্টিক দৃষ্টিতে প্রেমিকার দিকে চেয়ে থাকে সেখানে আমার কাঠ লাভার আমার দিকে ডায়োসরের মত আগুন নিক্ষেপ করছে। পার্থক্য একটাই, ডায়নোসর মুখ দিয়ে আগুন ছুড়ে আর রিজু চোখ দিয়ে ছুড়ছে। জানি না কি ঘটেছে আর আমার কপালে আজ কি আছে! রিজু সিগারেট ফেলে দিয়ে বললো-
–নীলান্তা তোমার আব্বা আমার প্রতিটা গল্পেই এ্যাংরি রিয়্যাক্ট দেয় ক্যান?
–সেটা আব্বুকে জিজ্ঞেস করলেই পারো।
–আমি কি গাঁজা খাইছি নাকি যে ঐ পাগলকে এই সব জিজ্ঞেস করবো?
–কিহ আমার আব্বু পাগল?
–না হলে কি?
–দেখো আমার আব্বু তোমার উডবি( Wouldbe) শ্বশুর তাই সম্মান দিয়ে কথা বলবা।
–ঐ ভিলেনের সাথে আমি কথাই বলতে চাই না।
–কিহ আমার আব্বু ভিলেন? দেখো এই ভাবে আমার আব্বুকে অসম্মান করলে কিন্তু আমি তোমার সাথে আর কথাই বলবো না।
–সেদিন ইনবক্সে তিনি আমাকে নক দিয়ে কি বলেছেন জানো?
–কি বলেছেন?
–বলেছেন “ঐ বেদ্দপ আমার মেয়ের পিছনে ঘুরঘুর করিস তোর লজ্জা করে না?”
–তুমি কি বলেছো?
— আমি বলেছি “হবু জামাইকে এই সব বলতে আপনার লজ্জা করে না? আর আমি মোটেও আপনার মেয়ের পেছনে ঘুরঘুর করি না। বরং আপনার মেয়েই আমার পেছনে ঘুরঘুর করে।”
–কিহ আমি তোমার পেছনে ঘুরঘুর করি?
–কই না তো।
–তাহলে আব্বুকে ঐ সব কেনো বলেছো?
–উনার ভাব নেয়া বন্ধ করার জন্য।
–তাই বলে তুমি আমাকে ছোট করবা?
–এতে ছোট করার কি হলো?
–মেয়েরা কখনো ছেলেদের পেছনে ঘুরঘুর করে না। ঘুরঘুরটা ছেলেরাই করে।
–ও এতে ছেলেরা ছোট হয় না তাই না?
–না হয় না।
–কেনো?
–কারণ এটাই প্রকৃতির নিয়ম।
–বাহ এই ঐতিহাসিক নিয়মটা কোন সর্বনাশী আবিষ্কার করেছে?
–আমি তাকে চিনি না গো।
–শোনো তোমার আব্বাকে বলবা তিনি যেন আমার পোস্টে ফালতু কমেন্ট না করে।
–আমার আব্বু ফালতু কমেন্ট করে? এই সম্মান দিয়ে কথা বলবা বলছি।
–তোমার আব্বা যদি বলতে পারে তবে আমি কেনো পারবো না?
–উনি মুরব্বী, তাই তিনি যা-ই বলুক তুমি সম্মান করবা।
–তারও উচিত আমাকে ছোট জামাই হিসেবে আদর করা।
রিজুকেই বা কি বলবো? সেদিন দেখি রিজুর গল্পে আব্বু কমেন্ট করেছে, “এই সব ফালতু উদ্ভট কাহিণী তুই কই থাইকা আমদানী করস?” রিজু রিপ্লাই দিয়েছে, “পৃথিবীতেই পাইছি শ্বশুরজী” আব্বু পাল্টা রিপ্লাই দিয়েছে, “আমাকে যদি আর শ্বশুর ডাকিস তবে তোকে ফুটবল বানিয়ে বিশ্বকাপ খেলবো।”
“সে আমার সৌভাগ্য শ্বশুরজী”
“তুই আসলেই একটা এলিয়েন”
“আর আপনার মেয়ে একটা রোবটের বাচ্চা। আপনি রোবট বলেই নীলান্তাও রোবট হয়েছে।”
আব্বুর ভয়ে আমি তো রিজুর পোস্টে কমেন্ট করার সাহসই পাই না। চুপি চুপি কমেন্ট পড়ে চলে আসি। সত্যি বলতে কি আব্বু রিজুর পেছনে সারাক্ষণ লেগে থাকে। আব্বু নিজেও জানেন যে রিজু খুব ভালো লেখে। এক দিন দেখি আম্মাকে আব্বু চুপি চুপি রিজুর লেখা গল্প পড়ে শোনাচ্ছে। আমি আড়াল থেকে শুনেই সরে এসে ছিলাম। কারণ আমাকে দেখলেই আব্বুর মন্তব্য উল্টে যাবে। রিজু যে আব্বুকে ব্লক করবে সে উপায়টিও নেই। আব্বু আগেই বলে দিয়েছেন যে, রিজু বা আমি যদি আব্বুকে ব্লক লিস্টে রাখি তাহলে আব্বু আমাকে গৃহ বন্দী করে রাখবে। ভয়ে রিজু সব সহ্য করে। কয়েক দিন আগে ভুল করে রিজুর পোস্টে আমি লাভ রিয়্যাক্ট দিয়ে ফেলে ছিলাম। আব্বু সেটা দেখে আমাকে ডেকে বললো-
–তুই ঐ ব্যক্কল পোলার পোস্টে লাভ রিয়্যাক্ট দিছস ক্যা?
–আসলে আব্বু ভুল করে ক্লিক হয়ে গেছে।
–এখন ঐটা সরাইয়া এ্যাংরি রিয়্যাক্ট দিয়ে দে।
–আব্বু ঐ গল্পটা তো আসলেই একটা কষ্টের গল্প, ওটাতে এ্যাংরি রিয়্যাক্ট দেয়া কি ঠিক হবে?
–ঐ বেক্কলের বানাইনা দুঃখে এ্যাংরি রিয়্যাক্ট দিলে কিচ্ছু হইবো না। তুই নিশ্চিন্তে দে।
–আচ্ছা ঠিক আছে।
সেদিন আব্বু বাধ্য করে ছিল রিজুর ইমোশনাল গল্পটাতে এ্যাংরি রিয়্যাক্ট দিতে। সেদিন জানি না কেনো এ্যাংরি রিয়্যাক্ট দিতে আমার চোখ ছলছল হয়ে গেছিল। সাত সকালে ফোনের টোন শুনে ঘুম ভাঙলো। স্ক্রীণে দেখলাম “সাহেব” লেখা। আমি রিজুকে সাহেব বলে ডাকি। এত সকালে সে তো ফোন করে না। অনেক আগে কোনো এক সময় অবশ্য করতো। তার ভয়েস শুনেই আমার দিন শুরু হতো। কত মধু মাখিয়ে বলতো-“আমার বাবুই পাখিটার কি ঘুম ভেঙেছে?” আমি ঘুম ঘুম চোখে ভাঙা ভাঙা কন্ঠে বলতাম, “না টিয়াপাখি, আরো একটু ঘুম বাকী আছে, এখন রাখো।” সে আদর জড়ানো স্বরে বলতো- “আলসে নয় সে উঠে রোজ সকালে রোজ তাই চাঁদ মামা টিপ দেয় কপালে।”
–“চাঁদ মামা নয় চাঁদা ভাই হবে।”
–“শোনো নিজের ভাই ছাড়া ভাই জাতির কেউ ভাই নয় তাই কোনো ভাইকেই আমার বাবুই পাখির কপালে টিপ দিতে দেবো না।”
অবাক হতাম তার বিস্ময়কর বিশ্লেষণ গুলো শুনে। সেই দিন গুলো রূপকথা হয়ে গেছে। এখন এই কাঠ লাভারকে দেখলে কেউ বলবে না যে একদিন এই মানুষটা কতটা রোমান্টিক আর আবেগে ভরপুর ছিল। তার সাথে সাথে আমিও বদলে গেলাম। কখন যেন আমার টিয়া পাখিটা সাহেবে বদলে গেলো। আব্বু আমাদের রিলেশনের কথা জেনে যাবার পর থেকেই সব কিছু উলট পালট হয়ে গেছে। এর মধ্যে রিজু একটা জব পেয়ে গেলো। তারও সময় নেই যখন তখন আমাকে ফোন করে বাবু সোনা ডাকার। অবশ্য কোনো কালেও সে আমাকে বাবু সোনা বলে ডাকেনি। তার একটাই ডাক ছিল ‘বাবুই পাখি’, এর বাহিরে তার আর কোনো আদুরে ডাক ছিল না। আর এখন তো সে সারাদিন এতটাই বিজি থাকে যে, মনে রোমান্টিকা উকি দিলেও তাকে পাত্তা দেবার সময় নেই তার। একদিন বলে ছিলাম-
–সাহেব আমাকে এক বার বউ বলে ডাকবে?
–কেনো তুমি কি আমার বউ নাকি?
–একদিন তো হবো।
–যখন হবে তখন ডাকবো।
–না এখন থেকেই ডাকবা।
–কাজের বউ না উনি নামের বউ হুহ।
–থাক ডাকতে হবে না। সে বউ বলে আমাকে ডাকেনি। এতে অবশ্য আমি দুঃখ পাইনি। কারণ খড় কাঠ বউ ডাকবে কি করে? সে এখন ডাকে রানী সাহেবা আর নীলান্তা। সাত সকালে আমার কাঠ লাভার কারণ ছাড়া যে ফোন দেয়নি তা আমি জানি। ফোন রিসিভ করলাম।
–কি ব্যাপার সাহেব এত সকালে ফোন করলে যে? সূর্য্য কি আজ উঠবে না বলে আবহাওয়া অধিদপ্তর ঘোষণা দিয়েছে নাকি?
–এটা কি রূপ কথার রাজ্য মনে হচ্ছে রানী সাহেবা?
–মনে হচ্ছেই তো। মনে হচ্ছে রূপকথার রাজ্যে আমি এক রানী সাহেবা আর তুমি প্রেমে উদাস এক দুখী প্রজা।
–কিহ? তুমি রানী আর আমি প্রজা?
–হ্যা গো সাহেব।
–তাহলে রাজাটা কোন হারামী?
–রাজা নেই।
–আমাকে প্রজা ভাবার কারণ কি?
–কারণ তোমার ভেতরে প্রেম নেই। আর আমি তো প্রেমের বৃন্দাবনের রানী।
–আর সেই বৃন্দাবনের সেনাপতি হলো তোমার আব্বা। যিনি সারাক্ষণ তলোয়ার হাতে তোমাকে পাহারা দেয়। আর মনে মনে ভাবে কিভাবে রিজুকে এ্যাংরি রিয়্যাক্ট এর বোমা মারা যায়।
–বাবা তো মেয়েকে পাহারা দেবেই।
–যুগ যুগ তোমার আব্বা হুজুর তোমাকে পাহারা দিক আর আমি কোনো প্রজীকে বিয়ে করে বিবাহিত হয়ে যাই।
–প্রজী কি?
–ঐ হলো, প্রজার বিপরীত জেন্ডার প্রজীই হবে হয়ত।
–দাড়াও গুগলে সার্চ দিয়ে দেখি।
–কি দেখবা?
–প্রজার বিপরীত জেন্ডার।
–ধুর ছাড়ো তো। ফোন করলাম এক কারণে আর কথা হচ্ছে রূপের রাজ্যের।
–আচ্ছা বলো সাত সকালে কাকের মত কা কা কেনো করছো?
–কিহ আমি কা কা করছি?
–এত সকালে কাক ছাড়া কিছুই ডাকে না। আগে তুমি ডাকতে, সেই কবেই ডাকা ছেড়ে দিয়েছো। এখন শুধু কাক ডাকে।
–পরিস্থিতি সব বদলে দেয় রানী সাহেবা। বাকী টুকু নাই বা বললাম।
–থাক বলতে হবে না। এখন বলো কেনো ফোন করেছো?
–নীলান্তা এক মাস হলো দেখা করো না। এমন হলে তো তুমি আমাকে ভুলে যাবে ময়না। রিজুর কথা শুনে হতবাক হয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। এমন আবেগ প্রবন কথা ২০১৮ সাল এবং বিগত ২০১৭ সালে এক বারও বলেনি। তার কথার কি প্রতি উত্তর দেবো তা ভুলে গেছি।
–কি হলো নীলান্তা চুপ করে কেনো আছো?
–কি করবো? তোমার আর আব্বুর সাপ্তাহিক ছুটি তো এক দিনেই। ছুটির দিনে আব্বু বাহিরে যেতে দেয় না।
–এই তোমার আব্বা এত ভিলেন ক্যা?
–আবার আব্বুকে ভিলেন বলছো?
–তোমার আব্বা কি আমাকে হিরো ভাবেন? উনি তো আমাকে দুই চোখে দেখতেই পারেন না।
–কবে যে তোমাদের মিল হবে?
–ওপারে গেলেও হবে না।
–কি সব অলক্ষুণে কথা বলো?
–উনার দুঃখে আমি এক দিন সন্ন্যাসী হয়ে হক মাওলা, হক মাওলা করবো দেখে নিও তুমি রানী সাহেবা।
–আমি কি করবো বলো তো?
–ধুর তোমার কিচ্ছু করতে হবে না।
–আচ্ছা।
–আমি কিচ্ছু বুঝতে চাই না। আজ বিকেলে তুমি কফিশপে দেখা করবা।
–তোমার অফিস শেষ হয় সন্ধ্যার পরে, বিকেলে আসবে কি করে?
–ছুটি নেবো। দরকার হলে চাকরীই ছেড়ে দেবো। আমি পুনরায় বাকরুদ্ধ হলাম। আমার লেখা কোনো গল্পের নায়কের নাম রিজু দিতে পারি না। আব্বু আমার সব গল্প খুঁটে খুঁটে পড়েন। কোনো পাঠক ইমোশনাল কমেন্ট করলে আব্বু সেখানে রিপ্লাই দেন, “ঘরে মা বোন নাই? জানি মেস এ থাকো কিন্তু দেশের বাড়িতে তো মা বোন আছে। বোন না থাকলেও মা তো অবশ্যই আছে। তা না হলে দুনিয়ায় আইছো ক্যাম্নে?” এই একটা কমেন্ট আব্বু কপি করে রেখেছে। সবাইকেই এই একই রিপ্লাই দেন।
আব্বুর দুঃখে পাঠকরাও আমার গল্পে কমেন্ট করতে ভয় পায়। শুধু তাই নয় কোনো ছেলে আমার গল্পে লাভ রিয়্যাক্ট দিলে আব্বু তার ইনবক্সে নক করে উক্ত কমেন্ট কপি করে সীন্ড করেন। একটা গল্প লিখলাম তবে গল্পটাতে হিরোর নাম রিজু দেবার সাহস পেলাম না। মনের দুঃখে হিরোর নাম দিলাম আলম। আব্বু গল্পটা পড়ে কমেন্ট করলো- “আলমটা কি ঐ বেক্কলের ছদ্মনাম?” আমি রিপ্লাই দিলাম- “না আব্বু” “তাহলে এই আলমটা কে?” “এটা হিরু আলম” “হিরু আলমটা আবার ক্যাডা?” হায় আল্লাহ এখন কি বলি! আর রিপ্লাই না দিয়ে আগে রিজুকে ফোন দিয়ে সব বললাম। সে বললো-
–বলো “আমি রিজুর সাথে ব্রেকাপ মেরেছি। এখন আলমকে তোমার জামাই হিসেবে কবুল করো।”
–এটা আব্বুকে বলা যায় নাকি?
–আরে হিরু আলমের পিক দেখে তোমার আব্বা জ্ঞান হারাবে তারপর তোমাকে আমার সাথেই বিয়ে দিতে রাজী হবে।
–তাই বলে জামাই বানানোর কথা বলবো? আমার কি লজ্জা শরম নেই নাকি?
–তাহলে ঐ লজ্জা শরমকেই বিয়ে করো, অযথা আমাকে ফোন করবা না।
–ঠিক আছে বলছি। আমি রিপ্লাই দিলাম- “আব্বু সে একজন বিখ্যাত নায়ক। আমি রিজুর সাথে ব্রেকাপ মেরেছি। আলম বেশ ভালো ছেলে আব্বু।” আব্বু রিপ্লাই দিলো- “তাড়া তাড়ি আমার রুমে আয়।” “কেনো?” “দরকার আছে।” হুড়মুড় করে আব্বুর রুমে গেলাম। আব্বু বললো-
–হিরু আলমের ছবি দেখা। গুগল করে হিরু আলমের ছবি দেখালাম। তাকে দেখে আব্বু কিছুক্ষণ হা করে থেকে চিৎকার করে বললেন-
–নীতার আম্মা তাড়াতাড়ি ঘরে আসো। আম্মা হন্ত দন্ত হয়ে ছুটে এলো। আব্বু হিরু আলমের ছবি আম্মার সামনে ধরে বললেন-
–জামাই দেখো
–কার জামাই?
–তোমার আর আমার জামাই।
–কি যে বলো না! এমন তক্তা আমার জামাই হবে কি করে?
–নীতার পছন্দ তাই এর সাথেই নীতাকে বিয়ে দেবো। আমি টাস্কিত হয়ে হা হয়ে গেলাম। আব্বু বেশ খুশি খুশি মুখ করে বললেন-
–নীতা কাল আলমকে বাসায় ডাকিস বিয়ে পাকা করবো। মরজ্বালা! আমি এখন হিরু আলমকে কোথায় পাবো? রাতে ফোন করে রিজুকে সব বললাম। সব শুনে রিজু তো রেগে ফায়ার। আমার হয়েছে যত জ্বালা। এক দিকে আমার আব্বু আর আরেক দিকে আমার কাঠ লাভার। বললাম-
–চলো আমরা পালিয়ে যাই।
–হ্যা পালাই আর তোমার ভিলেন আব্বা আমাকে গুন্ডা দিয়ে ধোলাই করুক তারপর গুম করুক।
–প্রেমের জন্য না হয় একটু মার-ই খেলে।
–চুপ করো। আমি সিনেমার হিরো নই আর মার গুলোও নকল মার হবে না।
–তাহলে কি হবে?
–হিরু আলমকেই বিয়ে করো।
–প্রবঞ্চক প্রতারক বেঈমান।
–এই এই এসব কবে করলাম?
–এত বছর প্রেম করে এখন বলছো হিরু আলমকে বিয়ে করতে। আসলেই তুমি বেঈমান।
–তোমার ভিলেন আব্বা রাজী হলেই তো সব ল্যাটা চুকে যায়।
–এত বছরে আমার বাবাকে তো পটাতে পারোনি অপদার্থ। আজ তোমার বুদ্ধি শুনে আব্বু আমাকে হিরু আলমের সাথে বিয়ে দিতে চাইছে। সব দোষ তোমার। আমি ভেউ ভেউ করে কাঁদতে শুরু করলাম। আমার এখন কি হবে রে।
–এত কাঁদার কি আছে? মেয়েদের কাঁন্না বোধ হয় চোখের কোণে এসেই থাকে। প্রেমিকার কাঁন্না শুনে এমন মন্তব্য করার লাভার পৃথিবীতে বিরল। আমি ভীষণ ভাগ্যকপালে তাই রিজুর মত একটা কাঠ লাভার কপালে জুটেছে। আব্বু আমার বিয়ে ঠিক করলো। এটা জানার পর রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করলাম সুইসাইড করার হুমকিও দিলাম। আম্মা কয়েক বার দরজা ধাক্কাতেই আব্বু বললেন-
–টেনশন করো না। সে কিচ্ছু করবে না। আম্মুও আর দরজা ধাক্কালো না। মরজ্বালা আমিও যে মরতে পারি এটা কেউ বিশ্বাসই করলো না! পৃথিবীতে আমিই বোধ হয় এক মাত্র নারী যে কখনো সুইসাইড করার কল্পনাও করতে পারি না। কত জন প্রেমে পড়ে হাত পা কাটলো। শুধু আমিই পারলাম না। আমাদের পাশের বাসার টুকটুকি একদিন তার হাতের শিরা কেটে ফেললো। হসপিটাল থেকে বাসায় ফেরার পর আমি হন্তদন্ত হয়ে টুকটুকিকে দেখতে গেছিলাম। আমাকে দেখে টুকটুকি খুব লজ্জা পেয়ে ছিল। আমি বললাম-
–টুকটুকি আমি তোর হাত দেখতে এসেছি। দেখি শিরা কাটলে কেমন দেখায়? আসলে সিনেমাতে ছাড়া বাস্তবে আমি কখনোই হাতের শিরা কাটা দেখিনি। আমার কথা শুনে টুকটুকি তার হাত দেখালেও লজ্জাতে নুয়ে পড়ে ছিল। প্রেমের অবদানে এখন শীত গ্রীষ্ম সারা বছরই টুকটুকি ফুলহাতা জামা পরে। ঐ ঘটনার কয়েক মাস পরে শুনলাম টুকটুকি নাকি নারদ নদের ব্রীজে গেছে ঝাঁপ দেবার জন্য। আর সেই খবর তার প্রেমিক পাবার পরে বাইক নিয়ে হু হু করে ছুটে গিয়ে টুকটুকিকে ঝাঁপ দেয়া থেকে উদ্ধার করে বাসায় পৌছে দিয়ে গেছে। এমন একটা নিউজ শুনে যতটা হাসি পেয়ে ছিল তার চেয়েও বেশি হাসি পেয়ে ছিল নারদ নদের কথা শুনে। অমন একটা মরা চিকনা নদীতে সে সুইসাইড করতে গেছিল। যার পানিতে নাটোর সুগার মিলের বজ্র পদার্থ ছাড়া কিছুই নেই।
টুকটুকির জীবনের লাভ স্টোরী এখনো চলছেই। আর আমি এতটাই অপদার্থ যে নিজের জন্য কিছুই করতে পারছি না। রিজুকে ফোন করে বললাম চলো পালিয়ে যাই। সে তো গুম হবার ভয়ে আতঙ্কিত আছে। তাকে বলা না বলা একই কথা। বিয়ের দু’দিন আগে একটা চিঠি লিখে ভার্সিটির বান্ধবী নিতুর দেশের বাড়িতে গেলাম। রিজুকে ছাড়া অন্য কারো বউ হবার চেয়ে নিরুদ্দেশ থাকাই বেটার। রিজু নিতুকে ফোন করে বললো আমার আব্বু নাকি রিজুকে পুলিশে দেবার হুমকি দিচ্ছে। আমার জন্য রিজুর জীবনটা বরবাদ হতে দিতে পারি না। তাই বাসায় ফিরলাম। আমাকে দেখে আম্মা আর কাজলাদি হু হু করে কাঁদলেও আব্বু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। আমি বেশ সাহস নিয়েই বললাম-
–বিয়ে করতে চাই না বলে বাসা থেকে চলে গেছিলাম। রিজুর হাত ধরে যাইনি। রিজু মহাপুরুষ তাই পালিয়ে যাওয়া তার কর্ম নয়। এর চেয়ে বেশী কিছু বলতে চাই না। শুধু চাই বিয়েটা যেন আজকেই হয়। আমি বাবা মায়ের অধ্যায়টা আজকেই শেষ করতে চাই। বিয়ের পরে আমি তোমাদের সাথে কোনো সম্পর্ক রাখতে চাই না। এবার পাত্রকে ডাকো বিয়ে করি।
আব্বু কিছু না বলে কাজলাদিকে ইশারা করলো আর দি আমাকে রুমে নিয়ে গেলো। দি সাজাচ্ছে আর আমি সাজছি। আমার বুক ফেটে যাচ্ছে কিন্তু আপ্রাণ চেষ্টা করে কাঁন্না আটকে রেখেছি। কাঁন্না আটকে রাখার কষ্টটা হলো পৃথিবীর সব চাইতে সেরা ভয়ানক কষ্ট। মনে হচ্ছে কেউ আমার বুকের ভেতরে আতুড়ী দিয়ে পেরেক মারছে, আমার ভেতরটা ক্ষত বিক্ষত হয়ে রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছে। আর আমি দাঁতে দাঁত চেপে এই কষ্টটাকে বিনা অশ্রুতে উপভোগ করছি। বিয়ে পড়াতে কাজী সাহেব আমার রুমে এলেন। উনাকে দেখেই আমার ভেতরে তোলপাড় শুরু হলো। ভেতরের সত্ত্বাটা বার বার বলছে, “একটু পরেই তুই তোর রিজুকে চিরকালের মত হারিয়ে ফেলবি নীলান্তা।”
এটা মনে হতেই আমার শ্বাসরোধ হয়ে যাচ্ছে। হুট করেই চার পাশটাকে ঝাপসা দেখতে পেলাম। মনে হলো রাজ্যের ঘুমে আমার চোখ বুজে আসছে। আমি আর চেয়ে থাকতেই পারলাম না। যখন আমি চোখ মেলে তাকালাম তখন দেখি রিজু আমার পাশে বসে আমার হাত ধরে আছে। চারপাশে সবাই আমার দিকে চেয়ে আছে। আব্বুর চোখটা জলে ভিজে আছে। রিজুকে দেখে অবাক হলাম। কি সুন্দর সেজে গুজে প্রেমিকার বিয়ে খেতে এসেছে সে। সে আসলেই আজব একটা মানুষ। কাজী সাহেবের তাড়া আছে বলেই তিনি আবার রেডী হলেন বিয়ে পড়ানোর জন্য। কি সৌভাগ্যবতী আমি যে, প্রেমিকের পাশে বসে এখন কবুল পড়বো।
কাজী সাহেব যখন বরের নাম রিজু বললেন তখন হুট করেই আমার হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে গেলো। আমার বিয়ে রিজুর সাথে হচ্ছে? ভুল শুনিনি তো? ভাগ্যিস তিন বার বলার নিয়ম আছে তাই দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বারে রিজু কি না তা শিওর হয়ে নিলাম। না হলে তো লাজ লজ্জা ভুলে কাজী সাহেবকে জিজ্ঞেস করতে হতো। তিন বার কবুল বলার পর মনের আনন্দে আমি আবার জ্ঞান হারালাম। বিদায় লগ্নে আব্বু আমার হাত রিজুর হাতে মিলিয়ে দিয়ে বললেন-
–বেদ্দপ আজ তোর হাতে আমার রাজকন্যাকে তুলে দিলাম যদি অযত্ন করছস তাইলে তোকে গুলি করে গুম করে ফেলবো। আর তোর লেখা ঐ আলতু ফালতু গল্পের নায়িকা এখন থেকে যেন নীলান্তাই হয়। যদি অন্য মেয়েকে নায়িকা বানাইছস তাহলে তোর জীবনটাকে এ্যাংরি রিয়্যাক্টে আতঙ্কময় করে ফেলবো।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত