কখনোই আমার মাকে আমি ভালোবাসতাম না। বা অন্যভাবে বলা যায় এই মহিলাকে আমি যথেষ্ট ঘৃনা করি। ঘৃনা মানুষকে কোথায় নিয়ে পৌছায় সে ব্যাপারে আমি অজ্ঞত। মাঝে মাঝে অনুধাবন করি এই মহিলার নিকট আমার প্রতি কোন রকমের মায়া/ ভালোবাসা কাজ করে কিনা। যদিও করে থাকে সে বিষয়ে বিন্দু মাত্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেও আফসোস বোধ করি না। এই মহিলার ছায়া টুকুও আমার চোখের সামনে পড়ুক সেটা ঘুনোক্ষরেও আমি চাই না। আমার বাবা ছিল ঘর জামাই।
সেই সুবাধে উনার কথার মধ্যে গাম্ভীর্য কিংবা যা বলি তাই করতে হবে এই টাইপের শক্তি প্রকাশের ভাব বিরাজ করতো না। ঘর জামাই হলে সব পুরুষের মাঝে একটা স্বাধীনতা কাজ করে না। যে স্বাধীনতার মাঝে তার কথার গুরুত্ব প্রথমে প্রাধান্য দিবে তারপর বাকি অন্যসব। আমার বাবার সাথেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। মা মরা মেয়েকে নিজের কাছ থেকে দুরে থাকতে দিবে না বিধায় নিজের অফিসের সহজ সরল একাকীত্ব জীবনে সংগ্রাম করে বেচেঁ থাকার আসিফ সাহেবের সাথে নিজের মেয়ে তামান্নার বিয়ে দেয়। আমি সেই হতভাগ্য আসিফ সাহেব, তামান্না ম্যাডামের ছেলে।
বিয়ের পরেই আমার বাবাকে বাসা থেকে অফিস অব্দি ঘর জামাই কথাটা বাধাবিহীন তার শরীরে মিশে গিয়েছিল। বেদনাহীন জীবনে ঝুম বারান্দায় বাতাসের স্পর্শে তার শরীরে ঘর জামাই নামক এই শব্দটার যন্ত্রনা জমানো জলের স্রোতের মত প্রবেশ করে। আমার বাবার প্রতিটা দীর্ঘশ্বাসের মাঝে কি পরিমান কষ্ট ছিল তার হিসেব আমি এখনো মিলাতে পারি না। দরজাটায় কয়েকটা টোকা দিয়েই আমজাদ সাহেব আমার রুমের ভিতরে প্রবেশ করে। আমি উনার দিকে তাকিয়ে এমন একটা লুক দিলাম যার অর্থ বুঝায়… কি ব্যাপার আমজাদ সাহেব আবার কি মনে করে আমার রুমে এসেছেন? উনি ঠিক ঠিক আমার না বলা বাক্য গুলা বুঝতে পেরে পাঞ্জাবীর পকেট থেকে একটা লাল খামের চিঠি বের করে বলে… তোমার একটা চিঠি এসেছে।
আমি অন্য দিকে তাকিয়ে চুল গুলা এপাশ ওপাশ করে বলি টেবিলের উপর রাখেন। উনি চিঠিটা টেবিলের উপর রেখে আমার কাছে একটু আসে। এসেই কান্না টাইপের ঘোঙ্গরানী দিয়ে যেই আমাকে ছুতে যাবে তখনি আমি বললাম এতো মায়া ভাল্লাগেনা আমার, আপনি জানেন না আই হেইট মায়া। প্লিজ দয়া করে এইসব কান্নাকাটি আমার সামনে করবেন না। আমি এতো সস্তা না ওকে? আমজাদ সাহেব কিছু বলার আগেই পাঞ্জাবীর হাতাটা দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে আমার রুম থেকে বের হয়। সেই তামান্না ম্যাডামের বাবাই হলো আমজাদ সাহেব। আমার বাবার শ্বশুর বা আমার নানা হয়। কিন্তু আমি এইসবের কোন কিছু উচ্চারন করি না। আমজাদ সাহেব বলেই উচ্চারন করি বা ডাকি। ঘর জামাই মানেই কি একটা পুরুষের কোন কিছুর উপর অধিকার থাকবে না। আসলেই থাকে না। আমার বাবারও কোন কিছুর উপর অধিকার ছিল না। সত্য বলতে কি আমার বাবাও কোন কিছুর উপর অধিকার খাটায় নি।
বাসায় কোন বিষয়ে যখন সিদ্ধ্যান্তের জন্য আলোচনা হতো আমার বাবাকে চুপ করিয়ে আমার মা বলতো তুমি ঘর জামাই তুমি চুপ থাকো। দুজনের মাঝে যখন কোন কিছু নিয়ে কথা কাটাকাটি হতো আমার মা, খুব কঠিন স্বরে বলতো… খাচ্ছো, থাকছো, আমার বাবার টাকায় আবার আমার সাথেই বড় বড় কথা বলো। আমার বাবা চুপ করে থাকতো। তখন আমার বয়স নয়। এতো বছর কিভাবে কাটিয়ে দিল ঘর জামাই হয়ে সত্যিই আমি এর সূত্র মিলাতে পারি না। এক রাতে আমাকে নিয়ে খোলা আকাশের নিচে ছাদের মাঝে বসে বলেছিল… জাহেদ মনে কর তোর বাবা একদিন বাসা থেকে বের হয়ে আর আসলো না, তখন কি তুই আমাকে খুঁজবি? আমার এখনো মনে আছে আমি তখন চুপ করে বাবার দিকে তাকিয়েছিলাম। এই কথার উওরে আমার কি বলা উচিত্ ছিল আমি জানতাম না।
বাবা আমায় জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিল আমি দুহাত দিয়ে বার বার চোখের পানি মুছে দিচ্ছিলাম আর বলেছিলাম তোমার কি অনেক কষ্ট বাবা? এর কয়েক দিন পরই আমজাদ সাহেব মানে আমার নানার সহিত আমার বাবার অনেক কথা হয়েছিল। পর্দার আড়ালে আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনেছিলাম বাবা বলেছিল… আমি আর এইভাবে থাকতে চাই না। ঘর জামাই নামক শব্দটা আমাকে আকড়ে ধরেছে। প্লিজ আমাকে মাফ করবেন আমি আমার বউ ছেলে নিয়ে অন্য বাসায় উঠবো। তখন আমজাদ সাহেব হাত জোর করে বাবাকে যেতে নিষেধ করে। আমি তখন এসবের কিছুই বুঝতাম না তেমন। ফের বাবা আর মার সাথে আগের মত পুনরায় যে কোন বিষয় নিয়ে কথাকাটি হয়। এর পর দিনই বাবাকে আমি আর দেখিনি। দেখিনি বললে ভুল হবে আমাকে দেখতে দেওয়া হয় নি। বাবার মুখটা নাকি থেতলে গিয়েছিল। পুরো শরীরে রক্ত মাখা। অন্যমনস্ক হয়ে রাস্তা পার হতেই বাবা দুঘর্টনায় ঐ খোলা আকাশের বুকে জায়গা করে নেয়।
এর একবছর পরেই তামান্না ম্যাডামের বিয়ে দিয়ে দেয় অন্য একজনের সাথে আমজাদ সাহেব। তখন আর আমজাদ সাহেব ঘর জামাই হিসেবে চায় নি। আমাকেও আমার মার সাথে পাঠানো হয়, কিন্তু আমার মনে হতো বাবা আমাকে খুঁজতে আসবে। আমাকে যদি আমার বাবা দেখতে না পেয়ে চলে যায়? আমি চলে আসি সেই নতুন ঘর ছেড়ে আমজাদ সাহেবের বাড়ি। এখানে চলে আসি বলাটা কেমন জানি বেমানান। আসলে আমি নতুন বাসায় গিয়ে কান্নাকাটি করতাম আর বলতাম এইখানে আমি থাকবো না, আমাকে দিয়ে আসো। যার কারণে আমাকে দিয়ে যায়। এর পর কয়েক বছর কেটে যায়। সেই তামান্না ম্যাডাম আমাকে মাঝে মাঝে দেখতে আসতো আমার সহ্য হতো না। আমার মনে হতো এই মহিলার কারনেই আমার বাবা হারিয়ে গেছে। এই মহিলার কারণেই আমার বাবা মানসিক ভাবে ভালো ছিল না। তাকে তাড়া করে বেড়াতো ঘর জামাই নামক শব্দটা।
আমি রেগে মেগে একদিন বলেছিলাম তুমি কেন আমায় দেখতে আসো? তুমি এই বাসায় আর আসবে না। তোমাকে আমার সহ্য হয় না। সেদিন আমার মা কয়েক ফোটা চোখের পানি ঝড়িয়ে আমার সামনে থেকে বিদায় নিয়েছিল। আমার বয়স এখন বলা চলে পচিঁশ। ক্যালেন্ডারের পাতা ক্রমান্বয়ে বদলাতে থাকে। টেবিলের উপর থেকে চিঠিটা হাতে নিলাম এই তিন চার মাস ধরে কেউ একজন আমাকে চিঠি লিখছে। অথচ আমি তাকে চিনি না জানি না। একদম প্রথম চিঠিটা এসেছিল বিশিষ্ট কয়েকটা শব্দ দিয়ে। বলেন তো আকাশের রং নীল না হয়ে লাল হলে কেমন হতো? … এক লাইন বিশিষ্ট এই টাইপের চিঠি কেউ লিখবে তাও আবার আমার কাছে। বিষয়টা আমার কাছে কেমন জানি লেগেছিল। এই চিঠিটার প্রেরক কে ছিল তা চিঠির খামের উপরে লিখা ছিল না। আমি ছিড়ে ফেলে দি। দু দিন পর আবার এর পুনরাবৃত্তি ঘটে যেখানে লিখা ছিল…
কী মিঃ নিশ্চয় আমার চিঠিটা ছিড়ে ফেলে দিয়েছেন? সে যাই হোক, জানেন আমার উড়তে ইচ্ছা করে, আমার যেখানে যাওয়ার ইচ্ছা হবে আমি উড়ে সেখানে উড়ে চলে যেতে পারবো। উড়ে চড়া কাক, পাখিরা আমাকে দেখে ভয়ে গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকবে আর ওরা একে অপরকে বলে বেড়াবে দেখ দেখ মানুষও আমাদের মত উড়তে পারে। আচ্ছা মানুষরা যদি উড়তে পারতো কেমন হতো?
কে এই উদ্ভট চিঠি লিখতো আমি কিছুই জানি না। ঐদিন চিঠিটা নিয়ে আমজাদ সাহেবের কাছে গিয়ে বলি এই কাগজ পত্র কে লিখে আমায়? উনি একটু ইতস্তত হয়ে মাথা নাড়িয়ে বলেন… আমি জানি না। তবে পোষ্ট অফিস থেকে একজন লোক এসে দিয়ে যায়। আমি দাঁতে দাঁত চেপে বলি… মজা না ব্যাপারটা? মজা নেয় আমার সাথে মজা? প্রেরকের কোন কিছু উল্লেখ নেই অথচ পোষ্ট অফিস থেকে দিয়ে যায়? চিঠিটা আমজাদ সাহেবের সামনে ছিড়ে কয়েক টুকরা করে ফেলে দিয়ে আমি বাহিরে বের হয়ে যাই।
এর কয়েকদিন পর পুনরায় হলুদ খামের একটা চিঠি আসে। আমি বিরক্ত ভাব নিয়ে চিঠিটা না খুলেই সোজা পোষ্ট অফিস যাই। গিয়ে একজনকে বললাম … এই যে ভাই, এই চিঠিটাতে প্রেরকের কোন নাম ঠিকানা কিছু নেই অথচ আমাকে কিছুদিন যাবত্ চিঠি লিখে যাচ্ছে। আমি তো কোন কিছু বুঝছি না। উনি আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে হাত দিয়ে ডান পাশের কিছুটা দুরে একজনকে দেখিয়ে বললেন… চশমা পড়া চাচার কাছে যান। আমি চাচার কাছে গিয়ে বিষয়টা বলতেই উনি চোখের চশমা খুলে চশমাটা মুছে আবার চোখে পড়ে বললো… কে এই চিঠি তোমার কাছে লিখে সেটা তো বলা যাবে না। বিশেষ একজন মানুষ।
আমার মাথার মেজাজটা একটু খারাপ হলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে বললাম তার পরিচায় না দিলে এইসব প্রেরকবিহীন চিঠি আপনারা নেন কেন? উনি অন্য চিঠি গুলাতে সিল মারতে মারতে বলেন… বললাম না বিশেষ কেউ একজন। আমি কি বলবো বা কি করবো কিছুই বুঝতেই পারি নি। তারপর চিঠিটা খুললাম আচ্ছা আপনি কি জানেন আপনি একটা বোকা টাইপের ছেলে। সিগারেটের প্যাকেটে লিখাই আছে ধুমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তারপরো এটা কেন খান? বোকা না হলে এমনটা কেউ করে? সিগারেট আমার একদম পছন্দ না বলে দিলাম। চিঠিটা পড়েই সেই চাচা মিয়াকে বললাম একটা কলম আর একটা কাগজ দিবেন? উনি একটু ভেবে কি মনে করে আমাকে একটা কলম আর একটা কাগজ দেয়। আমি লিখলাম সিগারেট আমি কারো বাবার টাকা দিয়ে খাই না। তাছাড়া আপনি কে হ্যা? ফাযলামো করেন? চড়াইয়া দাঁত ফালায় দিব ফের যদি আমার কাছে চিঠি লিখেন।
এই কয়েকটা লাইন লিখে চাচাকে বললাম.. প্রেরকের নাম তো নাই। এই পোষ্ট অফিস থেকেই তো চিঠি আসে আমার কাছে তাই না। তাছাড়া যে পাঠায় সে স্পেশাল ম্যান, সুতরাং দয়া করে তাকে এটা দিয়ে দিবেন। এইটা বলেই আমি চলে আসি। আমজাদ সাহেব কে বলি প্রবলেম সমাধান, সাহসে কুলাবে না আর চিঠি দিতে। কিন্তু দুদিন পর আমজাদ সাহেব বা আমার নানা আমার রুমে এসে বলে সমস্যা এখনো সমাধান হয় নাই। আমি কিছু না বলে চিঠিটা খুলি আমি এতো ভীতু না। আপনার সামান্য কথায় আমি ভয় পাই না। অসভ্যের মত কথা বলেন কেন হ্যা? অসভ্য একটা। আর আমি কে জানতে চেয়েছেন না? আমি আধার, যাকে দেখা যায় না। হুম বা আবার বলা যেতে পারে আমি অধরা যাকে ছোয়া যায় না, যাকে অনুভব করা যায় না। অদ্ভুত না? আচ্ছা এবার বলেন পৃথিবীতে কোন বাসা ভাড়া দেওয়া যায় না?
আমি চিঠিটা পড়ে একটু অবাক হয়েছিলাম। এই মেয়ের মাথা নিশ্চয় নষ্ট। কিছুক্ষন বাদে আমি আমজাদ সাহেবের কাছে গিয়ে বলি.. শোনেন মিঃ আমজাদ সাহেব আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে। উনাকে কিছু বলতে না দিয়েই আমি আবার বললাম.. পৃথিবীতে কোন বাসা ভাড়া দেওয়া যায় না? উনি একটু অবাক হয়ে বললেন এটা তো একদম সহজ। নিজের বাসা। আমি একটু চুপ করে বললাম দুর নিজের বাসা তো অনেকে ভাড়া দেয়। আপনি তো কিছুই জানেন না, শুধু আমার বাবারে কিভারে ঘর জামাই হিসেবে ঘর বন্দি করে রেখেছিলেন সেটা জানতেন। বলদ একটা। এইটা বলেই আমি চলে যাই। চিঠির কোন জবাব দি নাই। এর পরদিনই আবার চিঠি আসে… আমার কাছে পৃথিবীটা কেমন জানি। মানুষ গুলাও কেমন। সবাই স্বার্থপর।আচ্ছা আমিও কি স্বার্থপর? আষাঢ়িয়া জলে কখনো ভিজেছেন? আমি না এক ভেজা কাব্য। যাকে মুছেই দিলেই এর ছায়া আশে পাশে থাকে না। ও হ্যাঁ আমার প্রশ্নের উত্তর পেয়েছেন? আর একদিন সময় দিলাম। প্রশ্নের উত্তর কিন্তু দিতে হবে।
আমি এই উত্তর না পেয়ে সেই অধরা যাকে ছোয়া যায় না, বা আধার যাকে দেখা যায় না তাকে লিখলাম আপনি আমাকে চিঠি লিখেন কেন বলেন তো? আর আপনার উত্তর আমার জানা নেই। এর পরদিনই আবার আমার কাছে চিঠি আসে। সেই প্রশ্নের উত্তর সে আমাকে বলে দেয়… যে বাসা কোন দিন ভাড়া দেওয়া যায় না সেটা হলো ভালোবাসা। সেদিনের পর থেকেই নাম না জানা অধরা বা আধার নামক কোন এক মেয়ের সাথে চিঠি বিনিময় হয়। কেমন অদ্ভুত প্রকৃতির মেয়ে। মাঝে মাঝে ভাবি এই মেয়ের চিঠির উত্তর কেন দি আমি? আজকেও চিঠি দিয়েছে। সিগারেটের প্যাকেট , একটা খাতা, কলম আর চিঠি টা নিয়ে ছাদে যাই। ছাদে এসে রেলিং এর চারপাশ হাটতে থাকি আর সিগারেটের ধোয়া মুখ দিয়ে উপরের দিকে ছেড়ে দি। হঠাৎ কান্নার শব্দ পেয়ে ডান পাশে গিয়ে দেখি তিয়ানা ছাদের কোনার মেঝেতে বসে আছে।
আমাদের বিল্ডিংটা আর ওদের বিল্ডিংটা একদম কাছাকাছি। আমি সিগারেট ফেলে ওরে ডাক দিয়ে বলি… কি আজকেও গালিগালাজ করেছে? আমার শব্দ পেয়ে ও আমার দিকে তাকিয়ে চোখ গুলা মুছতে থাকে। সেই ছোট বেলা থেকেই ওর এই কান্নার নিয়ম টা আমি দেখে আসছি। লম্বা চুল। চোখে চশমা পড়ে। চেহাড়ায় কোন মায়া মায়া ভাব নেই। গায়ের রং শ্যামলা। কথা বলতে পারে না। ছোট বেলায় হৃদ রোগে ওর মা মারা যায়। তারপর ওর বাবা আরেকটা বিয়ে করে। সাজানো আলোর পরিবারে নেমে আসে কালো মেঘের ছায়া। শুরু হয় তার সৎ মায়ের আচার আচারণ। মাঝে মাঝে ওর গায়েও হাত তুলতো। যার কারণে ছাদে এসে চুপ করে বসে বসে কান্না করতো। আমি ওকে ছিঁচকাঁদুনী বলেই সম্মেধন করি। আমি ওকে বলি “কি ছিঁচকাঁদুনী এইভাবে আর কত? তুই কি একবারো প্রতিবাদ করতে পারিস না? বুঝলি নারীরা আসলেই খারাপ। ফাউল একটা।
আমার কথাটা শুনে তিয়ানা উঠে দাঁড়ায়। চুল গুলা ঠিক করে আমাকে আকার ইঙ্গিতে বুঝায়… চুপ বেয়াদব। সব নারীরা এক না বুঝলি? আর তুই আমাকে কথায় কথায় ছিঁচকাঁদুনী ডাকবি না। ওর আকার ইঙ্গিতে বলা কথা গুলা বুঝে আমি হাসি। দীর্ঘ চলে যাওয়া এই বছর গুলোতে ওর সব ভাষা আমি বুঝতে সক্ষম। তারপর বলি. আচ্ছা তুই বিয়ে করবি না? তুই তো বুড়ি হয়ে যাচ্ছিস। ও এদিক ওদিক তাকিয়ে একটা ইটের টুকরা হাতে নিয়ে ওদের ছাদ থেকে আমার দিকে ছুড়ে মারে। আমি সরে যাই। ও আমাকে বুঝাতে থাকে হাতের ইশারায় আমি বিয়ে করবো না। এই বাড়িতেই লাথি উষ্ঠা খেয়ে বাকি জীবন পার করে দিব তাতে তুর কি? আমি আবারো একটা হাসি দেই। এই মেয়েটা কিভাবে এতো অত্যাচার সয্য করে এখানে পড়ে আছে বুঝি না। একদিন ওর এই প্রতিনিয়ত কান্নার দৃশ্য দেখে আমার কাছে স্বাভাবিক লাগছিল না।
সোজা ওদের বাসায় গিয়ে ওর সত্ মাকে বলি সমস্যা কি আপনার? যে মেয়েটাকে দিয়ে সারাদিন রাত খাটান তার সাথেই এইসব ব্যবহার করেন। আপনার না নিজের মেয়ে আছে। ওর সাথে এমন করেন ক্যান? … উনি আমাকে বলে তুমি কে? আমার পরিবারের বিষয়ে তুমি নাক গলার কে? আমি ওরে মারবো, খাওয়াবো, পড়াবো, যা ইচ্ছা তাই করবো। তোমার এতো জ্বলে কেন? এই এলাকায় আর মানুষ থাকে না? তোমার একাই দরদ লাগছে? নিজের পরিবার ঠিক নেই অন্যজনের পরিবার নিয়ে মাথা ঘামাতে আসছে। আমি কিছু বলতে যাবো ঠিক তখন তিয়ানা এসে আমার সাথে হৈচৈ শুরু করে আমাকে একটা থাপ্পর দিয়ে বে বে করে বের করে দেয়। এরপর অনেক দিন ওর সাথে কথা বলি না। দেখলে না দেখার ভান করতাম। তারপর একদিন ছাদে হাউ মাউ করে চিল্লাতে থাকে। আমাকে পাথরের টুকরা ছুড়ে মেরে কান ধরে বুঝায়… তুই আমার সাথে কথা বলবি না? দেখ কানে ধরছি। স্যরি তো।
তিয়ানা আমার হাতের চিঠিটা দেখে ইশারা দিয়ে বলে তোর হাতে এটা কি? আমি বলি প্রেম পত্র হা হা হা। তোরে সবি বলছি। ওর মুখটা কেমন জানি হয়ে গেল। আমার এই চিঠির কথা শুনলে বা দেখলেই ও মুখটা কালো করে ফেলে। আমি ওকে বলি ছিঁচকাঁদুনী প্রেম পত্র পড়বি? ও মুখ কালো করে আমাকে বুঝায় এইসব বস্তা পচাঁ প্রেমের পত্র আমি পড়ি না। তুই পড়। এইটা বলেই ও চলে যায়। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলি। চুল গুলা চুলকিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আরেকটা সিগারেট ধরাই। সিগারেট টানতে টানতে চিঠিটার খাম ছিড়ে পড়ি। পড়েই আমি হাসতে থাকি। এই কয়েকটা মাসে ওর সাথে আমার অনেক চিঠি বিনিময় হয় সে লিখে “তেলাপোকাকে ভয় পান? অনেক মেয়ে ভয় পায় আমি পাই না। আমি লিখি “তেলাপোকাকে তো ভয় পাই না তবে আপনাকে ভয় পাই। এই যে চিঠি লিখে আমার মাথা নষ্ট করে দিচ্ছেন। আচ্ছা আপনার খেয়ে দেয়ে কাজ নেই? সে লিখে “কখনো প্রেম করেছেন? আমি লিখি…
“প্রেম? হাসালেন। মেয়েদের সাথে প্রেম করা প্রশ্নই আসে না।
“মেয়েদের নিয়ে বুঝি অনেক গবেষনা করেন?
“বাদ দিন। আপনি আমার বড় না ছোট?
“কেন বলুন তো।
“বড় হলে তেমন কিছু করবো না। ছোট হলে আপনার সাথে যদি আমার দেখা হয় আমি নির্ঘাত আপনার গালে একটা থাপ্পড় লাগাবো। এই যে আমাকে দিয়ে চিঠি লিখাচ্ছেন।
“আপনি জানেন আপনি একটা কি?
“জানি একটা অসভ্য।
এইভাবে ওর সাথে আমার চিঠির মাধ্যমে কথা হয়। মানুষ অনেক বিশাল বিশাল লেখা লিখে চিঠি আদান প্রদান করে কিন্তু সেই নাম জানা অধরা মেয়ের সাথে আমার এক দুইলাইনের চিঠি আদান প্রদান হয়। আর আজকের চিঠিটা পড়ে কেন জানি নিজের মাঝে প্রফুল্লতার কাজ করে। ওকে বেশ কয়েকদিন ধরে বলছি দেখা করতে। রাজি হয় নি। আর আজকে চিঠিতে লিখে জানিয়েছে দেখা করবে।
আমি চিঠিতে লিখা সেই ঠিকানা অনুযায়ী সেই নাম না জানা অধরা বা আধার একজনের সাথে সাক্ষাত করার জন্য বসে থাকি। তার উপস্হিতির জন্য আমার রংহীন জীবনে শূন্যতার হঠাত্ পূর্ণতার ছোয়া পেতে থাকে। কেন এমন হচ্ছে তাও আমি জানি না। আমি বসা থেকে একবার পায়চারি করি আর একবার হাটি। এর কিছুক্ষন পর হিজাব পড়া একটা মেয়ে এসে আমার সামনে দাঁড়ায়। ওকে দেখা যায় না চোখ গুলা ছাড়া। আমি ওর চোখের দিকে তাকালাম চোখ গুলা কেমন যেন। আমি একটু ইতস্তত হয়ে বললাম… আপনি সেই চিঠি? ইয়ে মানে আমাকে চিঠি লিখেন। ও মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক দেয়। আমি বলি চলেন বসি। তারপর কিছু খাবারের অর্ডারের দিতে বললে ও মাথা নেড়ে বুঝায় কিছু খাবে না। বার বার চোখ টিস্যু দিয়ে মুছছে। আমি একটু চুপ করে রইলাম। চিঠিতে তো আমায় নানান কথা বলে কিন্তু এখানে ওর চুপ চাপ দেখে আমার কাছে একটু বেমানান লাগলো। আমি কি বলবো কিছু ভেবে না পেয়ে সরাসরিই বললাম এখনো কি আধার হয়ে থাকবেন? না মানে আপনার সাক্ষাত পেলেও এখনো আধার রয়ে গেলেন। তারপর কিছুক্ষন সে চুপচাপ থাকে।
এরপর ও আস্তে করে তার আধারে ঢাকা চেহারাটা দেখায়। আমি থমকে যাই। বসে থেকে উঠে দাঁড়াই। কি করবো কিছু বুঝি না। ও চুপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি মাথায় হাত দিয়ে বলি আমি আসলেই একটা বলদ। শালা নারী জিনিসটা কি আমি বুঝি না। তারপর ওকে দাঁড় করিয়ে বলি… তুই আমার সাথে এমন করলি ক্যান? ক্যান করলি এমন? তোরা মেয়েরা নিজকে কি মনে করিস? এই তোদের জন্যই না ছেলেরা অন্য পথে হাটে। আমি ভুলে গিয়েছিলাম নারীদের বিশ্বাস করতে নেই। ও চুপ করে থাকে। চুপ করাটাই স্বাভাবিক। ও তো কথা বলতে পারে না। আর কথা না বলা মেয়েটাই হলো তিয়ানা। যাকে আমি ছিঁচকাঁদুনী বলে ডাকি। আমি আবার বলি এই তোর চশমা কইরে? ও মুখ গোমড়া করে হাত দিয়ে ইশারা করে বুঝায় ব্যাগের ভিতর।
ও আমার হাত ধরে বুঝায়… আমাকে ভুল বুঝিস না। আমি কখনো তোর সামনে এইভাবে আসতে চাই নি। কিভাবে কি হয়ে গেল দেখ। তোর প্রতি আমার ভালো লাগা সেই ছোট বেলা থেকেই। আর এই ভালো লাগটা আমার কখনো সাহস হয়নি তোকে বুঝাতে। আমি কি করবো ভেবে না পেয়ে ওর হাত থেকে হাত ছাড়িয়ে চলে আসি। ওরা নিজেকে কি ভাবে? কি মনে করে?
এক সপ্তাহে পার হয়ে যায় আমি ছাদে যাই না। নিজেকে খুব একা মনে হয়। মনে হয় আমি খেলার পাত্র। আমি শুয়ে শুয়ে সিগারেট টানি। আর হাসি। উপরে ঐযে একজন আছে বিধাতা তাঁকে বলি… তোমার খেলা গুলা আজব হা হা হা। এরপর একটু পর দরজায় টোকা দিয়ে আমজাদ সাহেব ভিতরে আসে। আমি সেই আগের বাক্যটা বললাম… কি আমজাদ সাহেব আবার কি মনে করে আমার রুমে আসলেন? উনি একটু ইতস্তত করে বলে… তোমার মা তোমার সাথে দেখা করতে আসছে। আমি বলি আমার দেখা করার ইচ্ছা নাই। এইটা বলার পরেই দরজার ভিতরে সেই তামান্না ম্যাডাম আমার রুমে ঢুকে। আমি শোয়া থেকে বসে বলি এই আপনি আমার রুমে ঢুকছেন কেন? উনি আমায় বলে… নিজে থেকে না আসলে আমি জানি তুমি আমার সাথে দেখা করবে না। আমি এটাও জানি তুমি আমাকে অনেক ঘৃনা করো। তারপর উনি উনার বাবার দিকে তাকায়। আমজাদ সাহেব রুম থেকে বের হয়ে যায়।
আমার মা তামান্না ম্যাডাম আবার বলতে থাকেন… তোমার বাবাকে আমিও অনেক ভালোবাসি। সে ঘর জামাই হয়ে থাকতো। শুধু মাত্র আমার বাবার কথা মত। বাবা আমায় খুব ভালোবাসেন তো তাই কখনো চায় নি আমি তার কাছ থেকে দুরে চলে যাই। তোমার বাবাকে বাহির থেকে শুরু করে অফিস পর্যন্ত অনেকে ঘর জামাই বলে আখ্যায়িত করতো। মানুষটা খুব সহজ সরল ছিলো। তুমি তখন অনেক ছোট। মানুষটাকে যখন কেউ ঘর জামাই বলতো আমারো খুব খারাপ লাগতো। তোমার বাবাকে প্রথম প্রথম বুঝাতাম আলাদা একটা বাসা নেও। তুমি আমাকে যেভাবে রাখবে সেভাবেই থাকবো। কিন্তু মানুষটা কোন গুরুত্বই দিল না আমার কথা। আমি কি করবো ভেবে না পেয়ে অন্য মানুষের মত কথায় কথায় ঘর জামাই বলতাম।
এইটুকু বলে উনি কাঁদতে থাকে। আমি চুপ করে রইলাম। হাতের জ্বালানো সিগারেট শেষ হয়ে গেছে। চুল গুলা চুলকালাম। উনি আবার বলতে লাগলো… হ্যাঁ আমি মানছি এটা আমি ভুল করেছি। কিন্তু কি করবো বলো আমি মনে করতাম মানুষটাকে এইভাবে কথা বললে রাগ করে অন্য বাসায় উঠবে। নতুন করে নতুন ঘর সাজাতাম। বাবার সাথে ঘর জামাই থেকে চলে যাবে বলে কথাও বলেছিল। আমি না পারছিলাম আমার বাবাকে কিছু বলতে আর না পারছিলাম তোমার বাবাকে বুঝাতে যে নতুন বাসা নাও।
আর কত মানুষের এইসব কথা শুনবে তুমি। তোমাকে এইসব কথা কেউ বললে আমার ভালো লাগে না। আর আমি তোমার বাবাকে বলতাম এই কারণে যেন মনের ভিতর জেদ আসুক। কিন্তু মানুষটাকে তো আল্লাহ আমার কাছ থেকে কেড়েই নিল। তারপর আমি একে বারে ভেঙ্গে যাই। মনে হতো তোমার বাবার কাছে আমি চলে যাই। আমিতো মানসিক ভাবে দূর্বল হয়ে পড়ি। কিভাবে যেন একটা বছর কেটে যায়। তোমার কথা ভেবে তোমার না আমাকে আবার বিয়ে দেয় বিশ্বাস করো আমি রাজি ছিলাম না। কিন্তু তুমিই আমার সাথে থাকলে না।
এরপর উনি একটু থামে। আমি বলি আপনারা নারীদের না বুঝা একদমি মুশকিল। আপনারা এতো ছদ্মবেশি কেন বলেন তো? এমন আচরণ করবেন আপনারা বুঝা যায় এক রকম কিন্তু আপনাদের মনের ভিতর চলে অন্যরকম। এতো ছদ্মবেশি ক্যান আপনারা হ্যাঁ? উনি চোখের পানি মুছতে মুছতে বলে… নারী হলো একজন বোন, একজন বউ, একজন প্রেমিক আর একজন মা। আসলেই নারীদের বুঝা খুব কষ্ট। কারণ একজন মা কখনো তার কষ্ট গুলো তার সন্তান তার স্বামী কাউকে বুঝতে দিবে না। আমার শরীরটা ভালো নেই। তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছিল তাই আসা। তোমার সব খোঁজ খবর আমি রাখি। মেয়েটা সত্যিই তোমাকে ভালোবাসে। যদি ভালো না বাসতো তাহলে এই রকম পাগলামো কেউ করতো। ওর দিকটা ভেবে দেখিও।
এরপর উনি আমার কাছে এসে একটু দাঁড়ায়। তারপরো আমার মাথায় হাত বুলিয়ে চলে যায়। যখন স্পর্শ করলো আমার সমস্ত শরীর কেমন যেন শীতল হয়ে গেল। আমার কি মা বলে ডাকা উচিত্ ছিল? একবার কি বলা উচিত্ ছিলো মা আমি যে একা একা কত বছর কাটিয়েছি। আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাবে? আমি আরেকটা সিগারেট ধরাই। সিগারেটে ধোয়া ফু দিয়ে ছেড়ে দিয়ে তিয়ানার কথা ভাবি। তোমরা নারীরা আসলেই ছদ্মবেশী। আমি জানি না আমার কি করা উচিত্। আমাকে ভাবতে হবে অনেক ভাবতে হবে। কারণ নারীদের বুঝা যায় না, নারীরা ছদ্মবেশী…
গল্পের বিষয়:
গল্প