হঠাৎ করে পেছন থেকে কেউ ওড়নাটা টেনে ধরলো বলে মনে হয়েছে রুনার। হ্যাঁ, যেই ভাবা সেই কাজ। প্রতিদিনের মতো আজো রাস্তার পাশের ঝোপে লুকিয়ে ছিল রায়ান। গত তিনমাস যাবৎ রুনাকে রাস্তায় বিরক্ত করে আসছে সে। তার একটাই কথা, ‘আমি তোমাকে পছন্দ করি, তোমাকে বিয়ে করতে চাই’। এতদিন তো সে শুধু মুখেই বলে আসছিল আর আজ একেবারে ওড়না টেনে ধরলো! ‘ছেড়ে দিন আমার ওড়নাটা। কি করছেন এটা। ছাড়ুন বলছি। কেউ দেখে ফেললে আমার বদনাম হয়ে যাবে। দয়া করুন আমায়। আমার জীবনটা নষ্ট করে দিবেননা এভাবে’
-কথাগুলো বলতে বলতে কেঁদেই ফেললো রুনা। ‘এতদিন তোমার পেছনে ঘুরঘুর করেছি। আর নয়। আজ তোমার সব লুটে নিব আমি। তোমার কিসের এতো অহংকার যে আমাকে একদম পাত্তাই দাওনা’। -বললো রায়ান।
সন্ধা নেমে আসছে। অর্থাভাবে সংসারের আর নিজের পড়াশোনার খরচ ও বাবা-মায়ের ঔষধ সহ সবকিছুর যোগান দিতে রুনাকে একাই যুদ্ধ করতে হয়। পরিবার অসচ্ছল থাকলে, দুবেলা না খেয়ে থাকলে, পড়াশোনা না করলে কেউ এসে ঘরে টাকা দিয়ে যাবেনা। কেউ বলবেনা কেন সবাই না খেয়ে আছে। কেউ খবর নেবেনা বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়েটা পড়াশোনা করছে কিনা। তবে, একটু খুঁত পেলেই মানুষের সমালোচনার বিষাক্ত ঝড়ো হাওয়া বইতে শুরু করবে। মুহুর্তের মধ্যেই রুনার মনে হাজারো দুশ্চিন্তা এসে জড়ো হতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত কিনা আজ তার অমূল্য রত্ন নিজের সতীত্বটাই হারাতে হয়!
এবার রুনা নিজেকে সামলে নেয়। ‘শুনুন, আমি আপনার প্রস্তাব বিবেচনা করে দেখবো তবে একটি শর্তে’ -রায়ানকে রুনা। কথাটি শোনা মাত্রই রুনার ওড়নাটা ছেড়ে দেয় রায়ান। ‘কি শর্ত বলো আমায়!’ রায়ান জানতে চায়। ‘আপনি এখন এখান থেকে সোজা মসজিদে যাবেন। পাকসাফ হয়ে মাগরিবের নামাজ আদায় করবেন। এভাবে আগামী একসপ্তাহ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ নিয়মমাফিক আদায় করবেন। তারপর এসে যদি আমাকে প্রস্তাব দেন তখন আমি জবাব দিব আপনার প্রস্তাবের।’ কথাগুলো একটানা বলে দেয় রুনা। রায়ানও রাজি হয়ে যায় তার শর্তে। সে চলে যায় এবার। রুনাও তার বাড়ি ফিরে।
একসপ্তাহ পর ঠিক সেরকম এক সময়েই রুনা তার টিউশনি শেষ করে বাড়ি ফিরছে। এবার আর আড়াল থেকে নয়। সরাসরি রাস্তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে রায়ান। পরনে পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি। মুখে হালকা দাড়ি! রুনা সেদিকে আড়চোখে তাকালেও ঠিক চিনতে পারেনি ওকে। রায়ান এবার বুজতে পারে রুনা তাকে চিনতে পারেনি। পেঁছন থেকে এবার সালাম দিল রায়ান। ‘আসসালামুআলাইকুম, দয়া করে একটু দাড়াবেন!’ রায়ান বললো। সেদিনের কণ্ঠটা ভূলতে পারেনি রুনা। থমকে দাড়ায় সে। রায়ান এবার তার সামনে এসে দাড়ায়। আমতাআমতা করে এবার সালামের জবাব দেয় রুনা। ‘আসলে, আমি আমার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত। আপনার সাথে গত কয়েকমাসে যা করেছি তার জন্য আমি খুবই লজ্জিত। আপনি আমাকে সঠিক পথের দিশা দিয়েছেন। আমি এখন নিজেকে আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছি এবং সেটাও আপনার জন্যেই। আমি আর কখনো আপনাকে বিরক্ত করবনা। আর কোনদিন আপনার পথ আগলে দাঁড়াবোনা। তবে আমার এই এতবড় উপকার করার জন্য আমি আপনাকে কিছু দিতে চাই।’ কথাগুলো বলে রায়ান এবার তার হাতে থাকা শপিং ব্যাগটা এগিয়ে দেয় রুনার দিকে।
‘এতে কি আছে?’ জানতে চায় রুনা। ‘আপনার জন্য একটা বোরকা কিনে এনেছি। কাল থেকে আপনি এটি গায়ে দিয়ে রাস্তায় বেরোবেন।’ জবাব দিলো রায়ান। নিজের মুখটা এবার লাজে চেপে ধরে রুনা। সে স্বপ্নেও ভাবেনি একসপ্তাহের ব্যবধানে এমন একটি কয়লার টুকরো হীরেয় রূপান্তরিত হয়ে যাবে! ‘ধন্যবাদ আপনাকে আমার জন্য এরকম একটি সুন্দর উপহার আনায়। তবে আমায় মাফ করবেন। আমি এটি নিতে পারবনা। আপনি দোকানে এটি ফেরত দিয়ে দিয়েন ।’ নিচু স্বরে বললো রুনা। রায়ান আর কোন জোর জবরদস্তি করেনি। চলে যাবে এমন সময় সে বলে, ‘আমি যাচ্ছি, তবে মনে রাখবেন, এটি আমি দোকানে ফেরত দিবনা। এটি একদিন আমি আমার নিজের বিয়ে করা বউকে পরাবো।’ এই বলে রায়ান চলে যায়।
একবছর কেটে গেল। এই একবছরে রায়ানকে এলাকার কোথাও দেখেনি রুনা। হঠাৎ একদিন সন্ধায় বাড়ি ফিরে দেখে একজন বয়স্ক পুরুষ মানুষ এবং সাথে একজন মহিলাও। সৌজন্যতা শেষে নিজের মাকে আড়ালে নিয়ে তাদের পরিচয় জানতে চায় রুনা। ‘ওরা তোকে দেখতে এসেছেন মা। খুব ভালো পরিবার। পাশের গ্রামেরই। উনাদের একটাই ছেলে। ছেলেটা চাকরীর করে। বেতনও পায় ভালো। ছবিও নিয়ে এসেছে সাথে। অনেক কথা হয়েছে। তুই বললে ছেলেকে ফোন করে বলবেন আসার জন্য। আমাদের তো পছন্দই হয়েছে। এখন তুই কি বলিস মা?’ -এসবকিছু বলে রুনার মা জানতে চান তার কাছে।
কিছুক্ষণ চুপ করে দাড়িয়ে থাকার পর ছেলেকে আসতে বলে রুনা। আলাদা রুমে সামনাসামনি বসা দুজন। রুনা নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। ‘আমার মনে হয় আপনি সবকিছু শুনেছেন। যেমন শুনেছেন তেমনই। তবে একটা বিষয় ছাড়া। আমি গত একবছর আগেও এমন ছিলামনা। হুট করেই নিজেকে পাল্টে ফেলি। আর তার পেছনে যার অবদান সে হলেন আপনি।’ কথাগুলো শুনে চমকে ওঠে রুনা। এতদিনে গলার স্বরটা অনেকটাই পাল্টে গেছে রায়ানের। ‘তাহলে আপনিই সে!’ অবাক হয়ে জানতে চায় রুনা। ‘জ্বী, আমিই সে। বোরকাটা ফেরত দিইনি। এবার আপনি যদি রাজি থাকেন তাহলে সেটা আপনাকে পরানোর অধিকারটুকু আমি পেতে চাই। আমাকে দিবেন সে অধিকারটুকু?’ রায়ান বললো। চুপ করে রইলো রুনা। এবার সামনে থেকে উঠে চলে গেল সে। পাশের রুমেই ছিলো রায়ান ও রুনার বাবা-মায়েরা। নিজের মাকে আড়ালে নিয়ে সবকথা সেরে ফেলতে বলে রুনা। বিয়ে হয়ে যায় দুজনের।
জোৎস্নাভরা রাত। দুজনে পাশাপাশি বসে আছে নদীর দ্বারে। ‘মনে আছে তোমার সেই দিনের কথা যেদিন তুমি পেঁছন থেকে রাস্তায় আমার ওড়না টেনে ধরেছিলে?’ রায়ানকে রুনা। ‘হুমমম, মনে থাকবেনা কেন? মনে আছে মহারাণী।’ জবাব দেয় রায়ান। ‘সেদিনের করা অপরাধের শাস্তি স্বরূপ আজ এখন দশবার কান ধরে উঠবস করো এখানে!’ রুনা বলে। ‘নিজের স্বামীকে কান ধরে উঠবস করতে দেখলে কি ভালো লাগবে তোমার?’ মুচকি হেসে বলে রায়ান। ‘ভালো লাগবেই তো। উঠে দাড়াও এবার’ -রায়ান উঠে দাড়াবে কি! উল্টো রুনার কোলেই মাথা রেখে শুয়ে পড়ে ঘাসের গালিচায়।
গল্পের বিষয়:
গল্প