আম্মা ও আমাদের সাদাকালো জীবন

আম্মা ও আমাদের সাদাকালো জীবন
আব্বার সাথে আম্মার প্রচন্ড ঝগড়া শুরু হলে, আমরা ভাইবোনরা পড়া বাদ দিয়ে আয়োজন করে ঝগড়া দেখতে বসতাম। আমাদের বাসায় তখনও টেলিভিশন আসেনি। পুরো গ্রামে দু’জনের বাসায় দুটো টেলিভিশন। সাদা কালো, ১৪”। শুক্রবার বিকেলে বিটিভিতে বাংলা ছবি হতো। একটাই চ্যানেল। রাতে কলকাতার একটি চ্যানেল ধরতো। আমরা পুরো সপ্তাহে একদিনই ঐ সিনেমা দেখার অনুমতি পেতাম।
টিভিওয়ালারা ঐদিন বিকেলে বাড়ির বারান্দায় একটি চেয়ারে সেই ১৪” টিভি রাখতেন। পুরো গ্রামের সব নারী-পুরুষ বাড়ির উঠোনে নিজ নিজ বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া খেজুর পাতার পাটি পেড়ে বসে যেতেন। কেউ কেউ পানের বাটায় পান, সুপারি নিয়ে গিয়ে পা ছড়িয়ে বসতেন। একটা হৈ হৈ ব্যাপার হয়ে যেতো শুক্রবারে। টিভিওয়ালাদের বাড়ির ছেলেমেয়েদের বিশেষ কদর করতো অন্যরা। একদিন একটু ভালো পজিশানে জায়গা পাওয়ার লোভে, পুরো সপ্তাহ তাদেরকে তোয়াজ করতো সবাই। আমরা লুডু খেলার সময়, তারা চুরি করে ধরা পড়লেও বিশেষ কিছু বলতাম না। নিজেদের গাছের পাকা বেল চুরি করে তাদের খাওয়াতাম। বাড়ির ভেতরে ধানের খড় রাখার একটা ঘর ছিলো। সে খড়ের মধ্যে কলা পাকতে দেওয়া থাকতো। পাকা কলা চুরি করে টিভিওয়ালা বাড়ির বাচ্চাদের খাওয়াতাম।
টিভিকেন্দ্রীক বিনোদনের ঐ যুগে আব্বা-আম্মার ঝগড়াটাও আমাদের কাছে বিশেষ আনন্দের ছিলো। আম্মা বলতেন, “চুল পড়ে তো মাথা ফাঁকা স্টেডিয়াম হয়ে গেছে তবু উনার হুশ বুদ্ধি হলো না।” আম্মার কথার জবাবে আব্বা তার মোক্ষম অস্ত্রটি ব্যবহার করতেন। বলতেন, “শোন, আমার মাথায় সামনের দিকে একটু চুল কমেছে বটে তবে তোমার তিন ভাইয়ের মাথা মিলে যত চুল আছে, আমার একার মাথাতে এখনও তার ডাবল আছে। তুমি জানো, এখনও রাস্তায় কত মহিলা আমার সাথে আলাপ করার জন্য লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে!” আম্মা বলতেন, “হুম জানবো না কেন! খুব জানি। তবে তারা কেউ চক্ষুষ্মান নন। অন্ধের গুষ্টি সব। চোখ থাকলে কি আর ঐ স্টেডিয়াম দেখতে আসে কেউ!”
ক্রমান্বয়ে ঝগড়া জমে উঠতো। ঝগড়া করতে করতেই আম্মা গিয়ে পান বানাতেন। নিজেরটা মুখে পুরে আরো একটা মোক্ষম অপমানজনক কথা বলতে বলতে আব্বার হাতে পান ধরিয়ে দিতেন। আব্বাও “কে জানে, পানের মধ্যে আবার কিছু মিশায় টিশায় দিছে কিনা” বলতে বলতে মুখে পান চালান করে ঝগড়া অব্যাহত রাখতেন। আম্মা এক সময় ক্লান্ত হয়ে, মুখ ফুলিয়ে, না খেয়ে বিছানায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়তেন। আব্বা তখন আমাদের ডেকে কাছে নিয়ে বসতেন। তারপর এই সংসারের জন্য আম্মার কি কি অবদান তা তুলে ধরতেন। “তোমাদের আম্মাকে যখন বিয়ে করে আনি, তখন আমার কিছু ছিলো না।
শুধু ঐ নাম মাত্র মাস্টারির চাকুরী। একমাস বেতন পাই তো পরের তিন মাসের খবর নেই। তোমার মা বাড়ির আশেপাশে পুঁই শাক লাগিয়ে, কুমড়া লাগিয়ে ঠিক তরকারীটার ব্যবস্থা করে ফেলতো। হাঁস-মুরগী পুষে ডিমের ব্যবস্থা রেখেছে সব সময়ই। কিভাবে কিভাবে যে সংসারটা চালায়, আল্লাহ তায়ালাই জানেন। ঐ যে লাল গাভিটার দুধ তোমরা খাও ঐটাও তোমার মায়েরই অবদান। একবার একটা বাছুর কিনেছিলো। তারপর কত গরু যে বেঁচেছি! গরু আর শেষ হয় না। বিয়ের গহনাগুলি পর্যন্ত বিক্রি করে দিয়েছে উত্তর মাঠের জমিটা কেনার সময়। আজকের সংসারে যা কিছু আছে, সবই তোমাদের মায়ের কষ্টের ফল। কখনো তোমরা তোমাদের মাকে কষ্ট দিবা না।” আমরা চুপচাপ আব্বার কথা শুনতাম। এক সময় অনেক রাতে খাবার সময় হলে, আব্বা বড় আপাকে বলতেন, “তোমার আম্মাকে জাগাও। খেতে আসতে বলো।”
বড় আপা যেতেন। আম্মার রাগ তখনও কমেনি। বড় আপাকে বলতেন, “তোরা খেয়ে নে। আমি খাবো না। এ সংসারে আমি না খেলে কারো কিছু যাবে আসবে না। সংসার সংসার করে আমি নিজের জীবন শেষ করে দিলাম, বিনিময়ে লাত্থি-ঝাঁটা ছাড়া কিছুই পেলাম না। আমি খাবো না। তুই এখন যা।” বড় আপা ফিরে আসতেন। আমরা সবই শুনেছি। আম্মা শোনানোর মতো করেই বলতেন। তবু বড় আপা ফিরলে তার দিকে তাকাতাম। আম্মা কি বললো, তার মুখে শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকতাম। বড় আপার কথা শেষ হলে আব্বা আস্তে আস্তে আম্মার কাছে যেতেন। বিছানার কোণায় অপরাধীর মতো বসে বলতেন, “পান্না বেগম ঘুমাচ্ছো নাকি।”
আম্মা জবাব দিতেন না। আব্বা আরো কয়েকবার একই কথা বলে, আম্মার কাঁধে হাত রেখে মৃদু ঝাঁকি দিয়ে বলতেন, “এই পান্না বেগম উঠো। চলো খেয়ে নিবে চলো। রাতের বেলা না খেয়ে ঘুমাতে হয় না। উঠো, চলো।” আম্মা মুখ ভার করে ধীরে ধীরে বলতেন, “আমি না খেয়ে মরলে কার কি! মরলেই তো ঝামেলা চুকে যায়। আজ মরলে কাল নতুন বৌ হওয়ার জন্যে তো কত জন রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের ভাইদের মাথায় তো আর আমার তিন ভাইয়ের মতন টাক নাই। মাথা ভর্তি চুল সবার।”
আমরা বুঝতাম বরফ গলা শুরু হয়েছে। আব্বা আরো কাচুমাচু হয়ে বলতেন, “তাদের ভাইদের মাথায় চুল থাকলে কি হবে বলো, একেকটা পেত্নীর পেত্নী। ওদের দিকে তাকানো যায় না। তাছাড়া আমি মাস্টার মানুষ। আমার কি দ্বিতীয় বিয়ে করা সম্ভব বলো? তুমি ছাড়া আমি অচল। একদিনও আমার চলবেনা। আর চুলের কথা বলছো। এই দ্যাখো, কান ধরে বলছি তোমার ভাইদের টাক মাথা নিয়ে আর একটা কথাও বলবো না। টাক হবে না তো কি হবে বলো। ওরা শহরে থেকে পড়াশুনা করেছে। ট্যাপের পানিতে চুল থাকে! আমরা পুকুরের পানিতে সাঁতার কেটে গোসল করেও তো চুল থাকছে না। আচ্ছা যাও, কাল সকালে উঠেই একটাকা দিয়ে একটা বলাকা ব্লেড কিনে আনবো। তুমি নিজে হাতে আমাকে ন্যাড়া করে দিও। হলো তো। এবার চলো। ক্ষুধা লেগেছে। চলো খেতে দাও।” আম্মা এবার নরম হতেন। তারপরও মুখে গোমড়া একটা ভাব রেখে বলতেন, “তোমরা খেয়ে নাও। আমি আজ রাতে কিছু খাবো না।”
আব্বা জানতেন, এখন তার শেষ অস্ত্রটি বের করলেই আম্মা কুপোকাত হবেন। বলতেন, “ঠিক আছে। তোমার খেতে হবে না। আমারও ক্ষুধা নেই। আমিও খাবো না।” তারপর আমাদের উদ্দেশ্যে বলতেন, “তোমরা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। আর আমাকে এক গ্লাস পানি দিয়ে যাও কেউ।” আম্মা ধড়মড় করে লাফিয়ে উঠতেন। “আমি একটু শান্তিতে মরতেও পারবো এদের যন্ত্রণায়” বলতে বলতে খাবার রেডি করতেন। আব্বাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতেন, “পানি খেয়ে থাকতে হবেনা, খাবারটা খেয়ে আমাকে উদ্ধার করা হোক।” আমরা আব্বা-আম্মার এই মধুর ঝগড়া খুব উপভোগ করতাম। দু’একদিন ঝগড়া না হলেই আমাদের মন খারাপ হয়ে যেতো।
একদিন শুক্রবারে দেরিতে টেলিভিশন দেখতে গিয়ে আমি আর বড় আপা জায়গা পেলাম না। আমাদের জন্য সাধারণত টিভিওয়ালারা সামনের দিকে জায়গা রাখতেন। সেদিন কোন কারণে জায়গা না পেয়ে বাড়ি ফিরে এলাম আমরা। দু’ভাইবোনই বাড়ির উঠানে বসে কাঁদছিলাম। আম্মা ঘটনা শুনে মন খারাপ করে আমাদের ভাই-বোনকে বুকের সাথে চেপে ধরে রাখলেন। আমরা বাংলা সিনেমা না দেখতে পাওয়ার শোকে কেঁদে কেঁদে অস্থির হয়ে গেলাম।
পরেরদিন আব্বা আমাকে ডেকে বললেন, “রেডি হয়ে নাও। শহরে যেতে হবে।”
আমার তো খুশি আর ধরেনা। আব্বার সাথে ঘোরার মজাই আলাদা। তিনি যেখানেই যেতেন, আমাকে সঙ্গে নিতেন। কেন যাচ্ছি জানিনা, তবে শহরে তো যাচ্ছি, এটাই মহা আনন্দ। আব্বা কাজের লোককে ডেকে একটা লম্বা বাঁশ কেটে আনতে বললেন। আমরা রওয়ানা দিলাম। বাজারে গিয়ে দেখলাম, আব্বা একটি স্বর্ণকারের দোকানে ঢুকলেন। পকেট থেকে রুমালে জড়ানো দুটো সোনার বালা বিক্রি করলেন। সে টাকা নিয়ে আমরা শহরে গেলাম। আব্বাকে টেলিভিশনের দোকানে ঢুকে শহরে আসার উদ্দেশ্যটা ততক্ষণে বুঝতে পেরেছি।
বিকেলে আমরা টেলিভিশন নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। বড় আপাকে কখন বলবো যে আমাদের টেলিভিশন হয়েছে, সেটার জন্য শহর থেকেই ছটফট করছিলাম। বাড়ি আসতেই গ্রামের লোক ভেঙে পড়লো আমাদের বাড়িতে। লম্বা বাঁশের মাথায় এন্টেনা টাঙানো হলো।আমরা ভাইবোনরা আনন্দে আত্নহারা হয়ে লাফাতে লাগলাম। মনে মনে বললাম, “আমরাও এখন থেকে টিভিওয়ালা।” আব্বা রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় আমাদের সব ভাইবোনকে ডাকলেন। আমাদের কান্না সহ্য করতে না পেরে আম্মার শেষ গহনাটি বিক্রি করার ঘটনাটি আব্বা বুঝিয়ে বললেন। আমরা ভাইবোনরা আবার কাঁদলাম। আম্মা আবার আমাদের সবাইকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “আরে বোকা, তোরাই তো আমার গহনা। তোরা কাঁদবি আর আমি সোনা পরে বসে থাকবো তা কি হয়!”
আমরা পাঁচ ভাইবোন আম্মার বুকের সাথে জড়াজড়ি করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকলাম। আম্মার ঐটুকু বুকে কিভাবে ওতোগুলো মুখ গোঁজার জায়গা হয়েছিলো এখনও ভেবে পাই না।” আসলে মায়ের বুক বোধ হয়, এরকমই চওড়া হয়! আম্মা জীবনে প্রতিটি প্রয়োজনে সামনে এসে দাঁড়াতেন। আব্বাকে কখনো বিচলিত হতে দেখিনি। যে কোন সমস্যায় তিনি আম্মার দিকে তাকাতেন। আম্মা একটা প্রশ্রয়ের হাসি দিতেন। যে কোন আর্থিক সংকটে আব্বা আম্মার দিকে তাকিয়ে বলতেন,”গভর্ণর সাহেব, কোন ব্যবস্থা কি করা যাবে?” আম্মা তার মাটির ব্যাংকটির দিকে এগিয়ে যেতেন। সেটা কখনো তাকে নিরাশ করতো না। আব্বার সামান্য অসুখও আম্মা সহ্য করতে পারতেন না। সেবা করতেন আর কাঁদতেন। যেদিন আব্বা হঠাৎ করেই আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন, সেদিন আত্নীয় স্বজনরা কেঁদে কেঁদে অস্থির হয়ে গেলেন।
বাড়ির লাল গাভিটির চোখ দিয়ে অবিরাম পানি পড়তে থাকলো। কালো কুকুরটি হাঁটু গেড়ে লাশের পাশে বসে থাকলো। কেউ কেউ ওটাকে তাড়াতে চাইলো। সে নড়লো না। তার চোখ পানিতে ভেসে যাচ্ছে। বাড়ি ভর্তি লোকজন সবাই কাঁদছে। আম্মা এক ফোঁটা পানিও ফেললেন না। একটুও কাঁদলেন না। আমি গিয়ে পাশে দাঁড়াতেই বললেন, “বাজারে যাও। সবচেয়ে ভালো কাফনের কাপড়টি কিনে আনো। তোমার আব্বাকে তুমি নিজে হাতে কবরে নামাবা। দেখবা যেন তার কোন কষ্ট না হয়।” আমি এখনো চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই, আব্বা আমাকে বলছেন, “তোমার আম্মা সারাজীবন কষ্ট করেছেন আর যেন কষ্ট না পায়, সেটা খেয়াল রেখো।” আম্মাকে নিয়ে আমাদের পাঁচ ভাইবোনের কাড়াকাড়ি চলে। একজনের কাছে থাকলে বাকি চারজনের মন খারাপ। নাতি নাতনিদের ক্ষেত্রেও তাই। আম্মা এখন মাকড়সার মতো। পাঁচ দিক থেকে আমরা তার কোমরে দড়ি বেঁধে টানছি। উনি একেক সময় একেক দিকে যাচ্ছেন।
আমার বাসায় যখন থাকেন, আমার মনে হয় আমার বাড়িটা বেহেশত হয়ে গেছে। আমি মাঝ রাতে আম্মার রুমে আসি। তিনি ঘুমান। আমি তার পায়ের পাতায় চুমু খাই। তার পায়ে গাল ঠেকিয়ে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকি। আম্মা আমার বাসায় টেলিভিশন দেখেন। আমি আম্মাকে দেখি। টেলিভিশনের পর্দার ভেতর দিয়ে আমি অতীত দিনগুলোতে ফিরে যাই। বাংলা সিনেমা দেখি। আম্মার হাতের বালা বিক্রি করে কেনা টেলিভিশনের সেই সাদা কালো সিনেমা।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত