আদা, পেয়াজ, রসুন সবকিছু রান্নাঘরে রাখা আছে। সেগুলো কেটে বেটে রাখবে। ঠিক তখনি আমি বাসায় গিয়ে ঢুকলাম। আমাকে দেখে ই ভাবী বললেন, রিয়া এসেছিস বস। কি গরম পরেছে। ভাবী একদম ফ্যান এর নিচে ফ্লোরে বসে আছে। আমি একটু বসলাম। ভাবী কুলসুম খালাকে কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছেন। উনি আমাদের টুকটাক কাজ করে দেন। কাজ করে আবার চলে যান। মাস শেষে কিছু একটা দেওয়া হয় তাকে। ঠিক কত তা আমি জানি না। বেশিক্ষণ না বসে গোসলের জন্য রুমে চলে গেলাম। গোসল সেরে কাপড় গুলো মেলে দেওয়ার জন্য ছাদে যাচ্ছিলাম। হটাত ভাবী ডেকে বললেন, কাপড় গুলো রেখে দিতে।
একটু পরে কুলসুম খালা উপরে যাবে আরো কাপড় নিয়ে। এত গরমে উপরে যাওয়ার দরকার নেই। তখন দিয়ে দিবে। আমিও রেখে দিলাম। নামাজ শেষ করে রান্নাঘরে গেলাম। ভাবী সবজি কাটছিল। ভাবীকে বললাম, আরিয়ান কান্না করছে তুমি যাও আমি সবজি কাটছি। ভাবী চল গেলেন। কুলসুম খালা আনমনে আদা বেটে যাচ্ছেন। কোনো কারণে হয়ত মন খারাপ নাহলে এত চুপচাপ উনি কখনো ই থাকেন না। একটু পরো ই পাশের রুম থেকে কিসের আওয়াজ আসল। গিয়ে দেখি ড্রয়িংরুমের বড় ফুলদানি টা আরিয়ান ভেঙ্গে ফেলছে। ভাবী কুলসুম খালাকে ডেকে বললেন কাঁচ গুলো যাতে তাড়াতারি পরিষ্কার করতে। কারো হাত পায়ে লেগে যাবে। খালা সেটা দ্রুত পরিষ্কার করলেন। ভাবী আরিয়ানকে ঘুম পাড়ানোর জন্য রুমে নিয়ে গেলে।
আমি সবজি কেটে ফ্রিজ থেকে মাং বের করলাম। তার মধ্যে ই ভাবী এসে জোরে বলে গেলেন, এখনো ভেজা কাপড় গুলো ছাদে দেওয়া হয়নি কেন। কুলসুম খালা হাতের কাজ তাড়াতারি শেষ করে। কাপড় নিয়ে ছাদে গেলেন। ভাবীকে বলে আমি রান্না বসালাম। ভাবী এসব রেখে আমাকে বললেন, যা রুমে যা এসব করা লাগবে না। আমি আছি করে নেব। আসলে মা মারা যাওয়ার পর ভাবী যেন একটু বেশি আগলে রেখেছেন আমায়। আমার খাওয়া থেকে পড়ালেখা সবকিছু ভাবীর খুব নজর। ভাইয়া ব্যবসার কাজে তেমন একটা সময় না পেলেও ভাবী উনার ষোল আনা দিয়ে পূরণ করেছে। আমিও আর কিছু না বলে চলে এলাম। খুব ক্লান্ত লাগছিল তাই আর ওখানে থাকিনি।
রুমে এসে চোখ বুজে শোয়ে রইলাম। যদিও টিউশন করার এত দরকার নেই তবুও করি। আর এই রমজানেও করতে হচ্ছে ইদ পরে ই স্টুডেন্টের পরিক্ষা তাই। চোখ টা লেগে আসছিল। হঠাৎ আবার ভাবী আসলেন। উনার চাচাতো বোন ভিডিও কলে। তাঁর বেবি হয়েছে। এসব নিয়ে গল্প করা শুরু হয়ে গেল। আমিও তাদের মাঝে যোগ দিলাম। মাঝখানে আমি চুলায় তরকারি দেখে আসলাম। ভাবীর আর হুশ নেই। আরিয়ান কান্না করছে । কিন্তু এখনো তার খাবার রান্না করা হয়নি। আমি যাব ঠিক তখনি ভাবী বললেন, আরে রাখ। কুলসুম খালাকে বলে এসেছি উনি করছে। আমার কেমন জানি খারাপ লাগল। কিছু না বলে চুপ করে রইলাম। ভাবীর কথা শেষ হলে আরিয়ানকে নিয়ে চলে গেলেন। আমিও গেলাম কারণ আর ঘুম আসবে না। ভাবী খাবার নিয়ে আরিয়ানে পিছন পিছনে দৌড়তে দৌড়তে ব্যস্ত। ঠিক তখনি কুলসুম খালা এসে বললেন। উনার কাজ শেষ চলে যাবেন।
তখনি আবার ভাবী বললেন, খালা একটু পরে যাও ইফতারির পেয়াজ মশলা গুলা একটু কেটে দিয়ে যাও। দেখছো তো আরিয়ান এর পিছনে আমার সময় শেষ। খালা কিছু না বলে আবার রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন। ভাবী বলেন, ভালো লাগে না রোজা রেখে সব কাজ করতে। কেমন জানি আলসেমি লাগে । একটু পরে ই ভাবীও রান্নাঘরে গিয়ে বাকি কাজ করছিলেন। কুলসুম খালাকে মশলা কেটে বেসিনের বাসনগুলোও পরিষ্কার করার কথা বললেন। খালা মশলা কেটে বেসিনে যেতে ই হাত থেকে পিছলে মশলার থাল টা নিচে পড়ে যায়। তা দেখে ভাবী একদম রেগে আগুন। এত গুলো মশলা তাও ময়লা ফেলার ঝুড়িতে পড়ে নষ্ট হয়ে গেল। খালা কিছু না বলে চুপ করে দাড়িয়ে আছে। আমি ভাবী কে থামাতে চাইলাম এটুকু তে তো আর এত ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে না। কিন্তু না কে শুনে কার কথা। ঠিক তখনি আমি ধমক দিয়ে উঠলাম।
ভাবীকে বললাম, তুমিও তো রোজা রেখেছো সেই রমজান মাস মোতাবেক সবাই রোজা রেখেছে। তোমার যেমন শরীর আছে ক্লান্তি লাগে ঠিক একই এরকম ভাবে এইসব মানুষগুলোরও লাগে শুধু তারা বলতে পারে না কারণ তারা বাঁচার জন্য কাজ গুলো করে। তুমি তোমার নিজের ঘরের কাজ করতে ই আজ ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছ। অথচ উনাদের দেখো একটু ভালো থাকার জন্য নিজের ঘরের কাজ তো আছে ই আরো বাইরের কয়েকটা ঘরের কাজ করেন। কাজ করতে আসেন বলে ভুলে যেও না উনারাও মানুষ। কাজে একটু ভুল ত্রুটি থাকতে ই পারে। তাই বলে ব্যবহারে একটু সংযত হও। ভাবী কিছু না বলে চুপ করে আছে। একটু পরে ই বললেন, এত গুলা মসলা তার জন্যে ই বলছি। ভাবী আল্লাহ আমাদের যথেষ্ট অবস্থা দিয়েছেন। সেটা তুমিও জানো আমিও জানি। এটুকুতে কিছু হবে না।
— এতগুলো মশলা অপচয় হল কিনা?!
— ভুল করে হয়েছে ভাবী। আর ভুল করে হলে সবকিছু তে ধরতে নেই।
খালার জায়গায় যদি আজ আমি করতাম এমন আমি হলফ করে বলতে পারি তুমি কখনো আমাকে এত ধমক দিয়ে কথা বলতে পারতে না। কারন আমার জন্য তোমার সফ্ট কর্ণার আছে । তাহলে ভুলে যাও কেন উনারাও কোন এক ঘরে মেয়ে বা বউ শুধু মাত্র নিজেদের একটু চাহিদা পূরণে অভাব থেকে মুক্তি পেতে তারা আজ অন্যের বাসায় বাসায় কাজ করে। তুমি চাইলে ই পারতে আদা পেয়াজ রসুন গুলো ব্লেন্ডার করে নিতে। জানি ভাইয়া বাটা মসলা খেতে পছন্দ করে তাই এরকম করেছ। কিন্তু আমাদের এই সামান্য পছন্দের জন্য একটা রোজাদার মানুষকে আদাঘন্টা পাটায় বসে মশলা বাটতে হচ্ছে যা আদৌ না করলেও হয়ত হত। অন্তত এই মাসের জন্য। টাকা দিচ্ছি বলে তো আর উনাদের জান কিনে নেইনি আমরা।
ভাবী আর কিছু না বলে একদম চুপ করে আছে। কুলসুম খালা ছলছল নয়নে আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিলেন। মাগো, কেউ বুঝে না আমাদের কষ্ট। আমরাও বলতে পারিনা। কারণ আমাদের যে ‘ অভাব ‘ নামের সঙ্গি সাথে থাকে। টাকা লাগে না মা’গো মানুষের এরকম দু- একটা কথা শুনলে মনটা ভরে যায়। ভিতরটা ঠান্ডা হয়ে যায়। সবকিছু টাকা দিয়ে হয়না মা। মানুষের এরকম কিছু কথাবার্তা বুঝা যায় না বুঝার মত কিছু লোক আছে দুনিয়ায়। কান্না করে করে কথাগুলো বলছিলেন। মাঝে মাঝে আমার কাছে টাকা থাকলে উনাকে দেই এমনি ই দেই নিতে না চাইলেও জোর করে দিয়ে বলতাম পান সুপারী খেয়ে নিও। তখনও আমি সেই চোখ জোড়া দেখেছি। যেখানে কাতরতা নম্রতা চোখের ভাষায় প্রকাশ পেত।
একটা মানুষকে টাকা দিয়ে যে আন্তরিকতা পাবে তার থেকে তোমার ভালো ব্যবহারে তার থেকে দ্বিগুণ আন্তরিকতা লাভ করতে পারবে। শুধু আমরা ই ভুল করি। কাজের লোক গুলো যে মানুষ সেটা অনায়াশে ভুলে যাই কয়টা টাকার বিনিময়ে। খালা মন ভরে দোয়া করছিলেন, মা’গো মন দিয়ে মানুষ বিচার করো তাহলে জগতে তুমি মানুষ হবা। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। কতটা মূল্যবান কথা বলে ফেললেন তিনি এত সহজে…!!!!
গল্পের বিষয়:
গল্প