তিন বছরের মেয়েটার গালে ঠাস করে একটা চড় দিলাম। এক দেড় ঘন্টা ধরে জ্বালিয়ে খাচ্ছে। বিকাল থেকে রান্নাবান্না ঝড় লেগেছে। আজকে বাবা-মা ভাইয়া আর ভাবি আমাদের সাথে ইফতার আর রাতের খাবার একসাথে খাবে। তার মানে কাজের প্রচুর চাপ। আমি রান্না করছি ফুফি আর রহিমা খালা সাহায্য করছে। আর মেয়েটা মাঝে মাঝে এসে “আম্মু টুলু ঘুমাচ্ছে না।
চলো ঘুম পাড়িয়ে দিবে।” একটা পুতুলের ঘুম পাড়ানো নিয়ে আমাকে বার বার জালাচ্ছে, শাড়ির আচল ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এমনিতেই কাজের এমন চাপ,তার উপর মেয়ের অসহ্য আবদার মেজাজটাকেই যেন আগুন করে দিয়েছে। তাই শেষমেষ না পেরে দিলাম একটা চড়। কান্না করতে করতে ঘরের দিকে হাটা দিচ্ছিলো, ফুফি কোলে নিলো কিন্তু কান্না থামলোনা। কারুন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে যখন দেখলো আমি নিজের কাজে ব্যস্ত তখন আর নিজের দাদির কোলেও থাকলোনা। কোল থেকে নেমে ঘরের দিকে গেলো কান্না করতে করতে।
-এটা কি ঠিক করলি সাথী? ছোটো মেয়ে, এই ভাবে না মারলে কি হতো না?
-তুমিই তো দেখছো ফুফি কি শুরু করেছে। এতো কাজ রেখে কি এখন তার পুতুলকে ঘুম পাড়াতে যাবো?
-তাই বলে মেরে কাজটা ঠিক করিস না। আমার উপর রাগ দেখিয়ে উনিও নিজের ঘরে চলে গেল। মেয়েকে আদর করতে করতে সায়ন আমার কাছে এলো।
– সায়নীকে মেরেছো কেন?
-সেটা তোমার মেয়েকেই জিজ্ঞাসা করো।
আমার এখন অনেক কাজ যাওতো আমাকে ডিস্টার্ব করো না। আমার কথা শুনে কি হলো কিছুই বুঝলাম না। মেয়েকে কোল থেকে নামিয়ে আমার সামনে এসে ঠাস করে আমার গালে একটা চড় বসিয়ে দিল সায়ন। আমি কিচ্ছু বললাম না। কান্না দমিয়ে রাখলাম। নিজের কাজে মন দিলাম। চড়ের শব্দ শুনেই হয়তো ফুফি চলে আসলো।
-এটা কি করলি সায়ন মেয়েটাকে মারলি কেন?
– তুমি জানো না মা! আমার মেয়েটাকে ও মেরেছে।
-বলি, মেয়েটা কি তোর একার? ওর না? দশ মাস গর্ভে ধরেছে। শখ করে কেও নিজের মেয়েকে মারে!
-মেয়েটা একটা ভুল করতেই পারে তাই বলে ওকে মারতে হবে? তুমিই বলো মা? ওর কি কোনো কিছু বোঝার ক্ষমতা হয়েছে?
-হ্যা মারতে হবে। ওকে যখন চড় দেয় আমি এখানেই ছিলাম। মেয়েকে মারার কারণে সাথীর সাথে রাগ দেখিয়ে ঘরে চলে গেছিলাম। আর এসেই দেখলাম এরকম গাধার মত একটা কাজ করে বসে আছিস। এখন আপসোস হচ্ছে কেন যে ঘরে গেলাম! না গেলে তোর ভুল কাজটা থামাতে পারতাম। তোর মেয়েটা দুই ঘন্টা ধরে ওকে জালিয়ে যাচ্ছে। আর কত ধৈর্য ধরবে ও? সারাটাদিন বিশ্রাম আছে ওর? সকাল থেকে সন্ধ্যা কাজ আর কাজ।
-ফুফি চলে গেলে সায়ন আমাকে কিছু বলতে গেলো আমি টলমলে চোখে ওকে এড়িয়ে চলার জন্য অন্যদিকে চলে এলাম। ও হয়তো কিছুটা লজ্জিত তাই আর কথা বাড়ালো না। আমি রান্না বান্নার কাজ করতেই লাগলাম। কিন্তু রাগে দুঃখে আমার মাথা ফেটে যাচ্ছে। নিজের মেয়েকে মারার কোনো অধিকার আমার নেই?
ও বাড়ির সবাই আসলে। ইফাতার আর রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমি মাকে বললাম যে তাদের সাথে আমিও যাবো। মা সায়নীর কথা বলতেই সায়ন বললো ” সাথী যাক পাশাপাশিই তো বাসা। ও কান্না করলে আমি নিয়ে যাবো। এখন ঘুমিয়েছে ঘুমাক।” আমি কিছুই বললাম না। বাবা মেয়ে থাক তোরা। আমি দুইদিন মায়ের কাছে থেকে আসি। দেখবো মজা তোদের। ( মনে মনে বললাম) মা বাবার সাথে চলে আসলাম। রাতে ঘুমি আছি। মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলো, আমি কেদে উঠলাম। দরজায় নক পড়াই ঘোর কাটলো। তাড়াতাড়ি দরজা খুলে মাকে দেখে জড়িয়ে ধরে খুব কান্না করলাম। মা বুঝতে পারলো কোনো দুঃস্বপ্ন দেখেছি। মায়ের কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছি।
– কি হয়েছে মা? আজকে দেখলাম। আমার নানুটা তোর কাছে এলোই না। তোর উপর কি ও রাগ করেছে।
-আমি আজকে ওকে চড় দিয়েছি। কেন দিয়েছি এটা না জেনেই সায়ন আমাকে মেরেছে মা।
-তো রাগ দেখিয়ে এসেছিস তো। তাহলে কাদছিস কেন?
-আমি তো জানতাম না আমার কলিজাটা ছেড়ে থাকতে এতো কষ্ট হবে। কোনোদিন কাছছাড়া হয়নিতো তাই বুঝতাম না। ও মা। আমি ওই বাড়ি যাবো। আমার মেয়েকে ছাড়া আমার রাত কাটবেনা।
-খুব তো বলতিস মা হওয়া কষ্টের কিছু না! আজ বুঝতে পারছিস সন্তানের মূল্য কত মায়ের কাছে? তুই যখিন ট্যুরে যায়তিস আমি কান্না করলে বিরক্ত হতিস। বলতিস এতো ইমোশন ভালো না তাহলে এখন কাদছিস কেন? মেয়ের সব দুঃখ মা বোঝে কিন্তু মায়ের দুঃখ মেয়ে বুঝতে চায়না। তাছাড়া তোর মেয়ে তার বাবার কাছেই আছে তাহলে কাদিস কেন?
– আমার ভুল হয়েছে মা। আমাকে তুমি আর বাবা একটু ও বাড়ি দিয়ে আসো। না জানি মেরেছি বলে কত কষ্টোই না পাচ্ছে আমার মেয়েটা। মা বাবা আমাকে বাসায় দিয়ে গেলো। ফুফি দরজা খুলে দিয়ে বলল,
-যত চেষ্টাই করিস না কেন, নিজের সন্তান থেকে আলাদা থাকতে পারবিনা। খুব তো আমাকে চুপিচুপি বলে গেছিলি।
দুইদিন আসবিনা। কিন্তু এখনো তো একরাতই পার হলোনা?
আমার মা আর এই মানুষটার কোনো পার্থক্যই নেয় আমার কাছে দুটোই আমার মা। ফুফিকে শাশুড়ী হিসেবে ভাবিই নি কোনোদিন। যায়হোক, নিজের ঘরের দিকে গিয়ে দেখলাম মেয়েটা ঘুমিয়ে গেছে। সায়ন টেবিল লাইট জ্বালিয়ে গল্পের বই পড়ছে। মেয়েটার পাশে গিয়ে যেই গালে চড় দিয়ে ছিলাম। সেখানে চুমু খেয়ে আলতো করে গালে হাত দিয়ে ডাক দিলাম। সায়ন মানা করছিলো ডাকতে। কিন্তু আমি আমার কলিজার সাথে কথা না বলে ঘুমাতে পারবোনা। তাই আবার ডাক দিলাম। মেয়েটা ঘুম ঘুম চোখে আলতো করে চোখ মেলে আমাকে দেখে বলল, আমি আমি আর তোমাকে জ্বালাতন করবো না। প্রমিস। তুমি আমাকে ছেড়ে যেওনা কেমন? নাহলে আমি ঐ আকাশের তারা হয়ে যাবো।
মেয়ের এই কথা শুনে নিজের কান্না থামিয়ে রাখতে পারলাম না। বুকের সাথে মিশিয়ে নিলাম। মনের আগুনটা যেন নিভে গেলো। নিজের অস্তিত্ব দুরে রেখে চলা অসম্ভব। সায়নের উপর রাগটাও নেয়। আমার মনের আকশের কালো মেঘগুলো উধাও হয়ে গেলো। সায়নের হাতের উপর মাথা দিয়ে সুয়ে আছি। মেয়েটা আমার বুকের সাথে লেপ্টে ঘুমিয়ে আছে। যেন মনেই হচ্ছেনা ও আলাদা শরীর। আসলেই তো আমার সায়নী আলাদা শরীর না, আমার অস্তিত্ব, আমার সুখ,আমার-সায়নের ভালোবাসার চিহ্ন।
গল্পের বিষয়:
গল্প