আমাদের বিয়ে হয়েছে প্রায় ছয় মাস হতে চলল। ওর নাম স্বর্ণা। আমার বউ। বউ শব্দের মাঝে কেমন যেন একটা আদর আদর ভাব আছে। বউ বলে ডাকতে খুব ভালো লাগে। সুযোগ পেলেই ওকে বউ বলে ডাকি। স্বর্ণা আমাকে খুব আদর করে। মাঝে মাঝে আমি যেন ওর কাছে একটা ছোট্ট হরিণ ছানায় রুপান্তরিত হই। এতোটা নিবিড় তার ভালোবাসার ধরণ। আমি অফিস থেকে যখন বাসায় ফিরি। ও আমাকে নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আমার কি লাগবে, আমি কি খাবো, কি করবো। ইত্যাদি ইত্যাদ। আমাকে নিয়ে ওর এমন সচেতনতা। মনে হয় পৃথিবীতে ও ছাড়া এমন আপন আমার আর কেউ নেই। আমি ওর কাছে একটা অন্য পৃথিবী। এ বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের খুব কম মানুষই পারে অন্যের পৃথিবী হতে। এমন ভাগ্যবান মানুষের সংখ্যা লাখে বা কোটিতে একজন। আমি সেই ভাগ্যবান দলের একজন।
আমি খুব খেয়াল করে লক্ষ্য করেছি, প্রায়ই গভীর রাতে সে আমার মাথাটা ওর বুকের মধ্যে টেনে নেয়। চুলে, গালে, ঠোটে, কপালে আলতো করে চুমু দেয়। সে খুব সতর্কতার সাথে কাজ গুলো করে। যেন আমার ঘুম না ভেঙ্গে যায়। আমি সারাদিন অফিস করি। ওর ভীষণ মায়া আমার প্রতি। আমার ঘুম ঠিকই ভেঙ্গে যায়। তবে ওকে বুঝতে দেই না। নিঃসাড় হয়ে পড়ে থাকি ওর বুকের উপর। তখন মনে হয় বিশ্ব চরাচরে আমি আর ও ছাড়া আর কেউ নেই। এই সুন্দর পৃথিবীটা আমাদের জন্য তৈরি। শুধুমাত্র আমরা দুজন এর বাসিন্দা। আমি খুব ভালো করেই জানি, চোখ খুললে বা নড়াচড়া করলে ও ভীষণ লজ্জা পাবে। ও ভীষণ লাজুক। ভালোবাসার তীব্রতা মাপতে হলে স্বাধীনতা প্রয়োজন। ভালোবাসা পরিমাপের যন্ত্র হল স্বাধীনতা। আমি নানান উপায়ে ওকে সহজ করে নেওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কেন যেন ও পুরোপুরি সহজ হতে পারে না। তাই যখন ঘুমিয়ে থাকি ও সেই ঘাটতি গুলো পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। তবে মাঝে মাঝে বোধ হয় ও বুঝতে পারে আমি হয়তো জেগে গেছি! তবে ওর ওই সচেতনতায় আমি আরো সুলভ হয়ে ওর হাতে ধরা দেই।
আপন বউয়ের কি আর গুণগান করবো বলুন! বউকে নিয়ে কিছু বললেই আপনারা হয়তো বলে বসবেন, ‘নিজের দই কখনও টক হয় না’। কেউ কেউ আবার মুখ বাকিয়ে বলবেন, ‘কত্ত ঢং! এ জন্মে বোধ হয় আর কারো বিয়ে হয় নি! যত্তসব!’ আমার এক দূরসম্পর্কের দাদি একদিন আমার মুখের উপরে বলেই ফেললেন, ‘এতো আহ্লাদ ভালো না বাপু! বলি আমরাও তো বিয়ে করেছি! নাকি!’ সেদিন আমি খুব হেসেছিলাম। আমার হাসিটাও নাকি ওই দূরসম্পর্কের দাদির কাছে ভিষণ বিশ্রি দেখাচ্ছিল! এ তে আমার কিছু যায় আসে না।
আমি যে কপাল গুণে স্বর্ণার মতো বউ পেয়েছি, সেই গল্প বলার জন্য আমি উৎসুক হয়ে আছি। ওকে নিয়ে কিছু বলতে পারলে আমার বুকটা হালকা হবে। সকালের শিশিরের মতো যে মেঘ আমার বুকের ভেতর বাসা বেঁধেছে। কিছুটা হলেও সে মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়বে আমার উঠোন জুড়ে। ঘন কালো মেঘে কিন্তু সবসময় বৃষ্টি নাও হতে পারে। রৌদ্রজ্জ্বল আকাশ অনেক সময় কেঁদে বুক ভাসায়। ভিজিয়ে দেয় হাজারো কষ্ট বয়ে চলা পৃথিবীর বুক। স্বর্ণা আমার পুরো শরীর জুড়ে মিশে আছে। আমার নিঃশ্বাসে, বিশ্বাসে, প্রতিটি চোখের পলকে। এই মেয়েটা টলটলে জলের মতো ধুয়ে দিয়েছে আমার জীবনের সকল দুঃখবোধ।
দীর্ঘ দুই বছরের সম্পর্কের ইতি টেনে একদিন ইলা আমাকে ছেড়ে চলে গেল। বুকের ভেতর ইলাকে নিয়ে গড়ে তোলা স্বপ্নের রাজ্যটা সেদিন কালবৈশাখী ঝড়ে দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছিল। সেই অমানবিক ব্যথা আমার পক্ষে সহ্য করা খুব দুরুহ হয়ে পড়েছিল। এইতো সেদিনের কথা। আমি একটা রাত ভালো মত ঘুমাতে পারতাম না। খেতে পারতাম না। শরীরের প্রতি চরম অবিচারের ফলস্বরুপ আমি একমাস অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে ছিলাম। সেইসব দিন গুলোর কথা মনে পড়লে আজো শিউরে উঠি। ইলা যেদিন আমাকে ছড়ে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলো। সেদিন ছিল বুধবার। আকাশে মেঘ ছিল।
সন্ধ্যার পরে ওর সাথে আমার দেখা হয়েছিল টিএসসিতে। ইলা খুব নির্ভার ভঙ্গীতে আমাকে বলেছিল, ‘শোনো রোহান, আজকে একটা কঠিন সত্য কথা বলার জন্য তোমাকে এখানে ডেকেছি। আমি চাই তুমি আমার কথা গুলো মন দিয়ে শুনবে’। আমি কিছুটা অবাক হয়েছিলাম। গতকালই তো আমরা একসাথে ঘুরলাম। রাতে ডিনার করলাম। বসুন্ধরায় একগাদা শপিংও করেছিলাম আমরা। হঠাত করে ওর কি হল! আমি দু’চোখ ভরা কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে ছিলাম ওর দিকে। কোন কথা বলি নি। ওকে ভীষণ অন্য রকম লাগছিল সেদিন। একদম অচেনা অতিথির মতো।
‘রোহান আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। ছেলে বাইরে পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরেছে। এখন বাবার বিজনেস দেখাশোনা করছে। ওর বাবার বিশাল গার্মেন্টসের বিজনেস। আমি খবরটা গতকালই জানতে পেরেছি। কিন্তু গতকাল তোমাকে বলতে পারি নি। গতকাল আমরা অন্য মুডে ছিলাম। তোমার মন খারাপ করতে চাই নি। আজ বললাম। আগামী পরশু আমার বিয়ে। বিয়ের পর আমি পারমানেন্টলি চিটাগং চলে যাচ্ছি। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও’।
আমি ইলার কথা গুলো ঠিক বিশ্বাস করতে পেরছিলাম না। আমার খুব কান্না পাচ্ছিলো। বুকের ভেতরটা হটাত কেমন যেন শূণ্য শূণ্য লাগছিল। আমি অনেক কষ্টে ওকে বললাম, ‘ইলা তুমি কি আমার সাথে ফান করছ? দেখো এরকম বাজে ফান আমার একদম পছন্দ না। সেটা তুমি ভালো করেই জানো! ইলা আর কথা বাড়ায় নি। চলে যাওয়ার আগে শুধু বলেছিল, দেখো রোহান তুমি এমন একজনকে জীবন সঙ্গী হিসেবে পাবে। যে তোমাকে খুব খুব ভালোবাসবে।
স্বর্ণা আমার সকল দুঃখ ভুলিয়ে দিয়েছে। আমি যে প্রচন্ড মানসিক ট্রমার মধ্যে ছিলাম। দিন দিন আমি যে উন্মাদ হয়ে যাচ্ছিলাম। সেই ভয়ানক অবস্থা থেকে সে আমাকে বাঁচিয়েছে। আমি এখন প্রচন্ড রকমের সুখি একজন মানুষ।
স্বর্ণার গায়ের রঙ দুধে আলতা। আমি ওর ঠোটে, গালে বা শরীরে খুব সাবধানে স্পর্শ করি। আলতো করে ছুঁয়ে দেই। কারণ, ওর শরীরের যেখানেই হাত দেই গাঢ় সিঁদুরের মতো রক্ত ভেসে ওঠে। মনে হয়, এই বুঝি চামড়া ভেদ করে বেরিয়ে আসবে রক্ত। ও লম্বায় আমার প্রায় আমার কান ছুঁয়ে ফেলে। আমি স্বর্ণার কোন জিনিসটা সবচাইতে বেশি ভালোবাসি নির্দিষ্ট করে বলতে পারবো না। আমি ভালোবাসি ওর ঘন কালো চুল। যা ওর কোমর অবধি পৌঁছে গেছে। আমি যখন ওর চুল দেখি তখন আকাশের কথা ভুলে যাই। মেঘেদের কথা ভুলে যাই। পার্থিব সকল কিছু কেমন যেন আমার কাছে ঠুনকো মনে হয়।
আমি ভালোবাসি ওর কাজল চোখ। ও চোখে কোনদিন কাজল পরে না। হরিণীর মতো চঞ্চল চোখজোড়া কাজল বর্ণের। আমি ওর কাজল কালো চোখের পূজারি হয়ে গেছি। মাঝে মাঝে মনে হয়, ওর কাজল চোখের দিকে চেয়ে থেকে বোধ হয় একটা জনম পার করে দেওয়া যায়। ওই মায়াভরা চোখের বর্ণনা গল্প, উপন্যাসে পড়েছি অনেকবার।
আমি ভালোবাসি অর ঠোঁট, কান, নাক সবকিছু। আমি স্বর্ণার সবকিছু ভালোবাসি। ওর নির্মল হাসি চাঁদের আলোকেও হার মানিয়ে দেয়। কি শুভ্র জ্বলজ্বলে হীরক খণ্ডের মতো ওর হাসি!
আমি দুই বছর আগে ঢাকার একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ, এমবিএ সম্পন্ন করেছি। রেজাল্ট খুব ভালো ছিল। চাকরি পেতে খুব বেশি দেরিও হয় নি। অল্পদিনের মধ্যে একটি প্রাইভেট ব্যাংকে জয়েন করলাম। আমরা দুই ভাই। বড়ভাই আমেরিকায় থাকে। বড়ভাই এবং ভাবী দুজনেই আমেরিকার সিটিজেন। ভাইয়া স্কলারশিপ নিয়ে গিয়েছিলেন। এখন ওখানকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। ভাবীও ছোটখাটো একটা জব করে। বাংলাদেশ থেকে গিয়ে প্রথম প্রথম ভাবী কিছুদিন কোন চাকরিতে জয়েন করে নি। ও দেশের প্রতিটি নারী পুরুষ কোন না কোন কর্মে নিয়জিত। বেকার সময় ওদের হাতে নেই। অনেকটা সমাজ রক্ষা এবং অলস সময় পার করার জন্যই ভাবী চাকরি জীবন শুরু করে।
চাকরিতে জয়েন করার পর মা আমার বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লাগলেন। গোপনে তিনি আমার জন্য পাত্রি দেখা শুরু করলেন। মা ইলার কথাটি জানতো। মা যখন জানতে পারলেন ইলা আমার সাথে সম্পর্ক ছেদ করেছে। তখন মনে মনে খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। মা ইলার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টাও করেছিলেন কয়েকবার। কিন্তু ইলা মায়ের ফোন রিসিভ করে নি। মা তখনই পণ করেছিলেন ইলার চাইতে দ্বিগুণ সুন্দরী মেয়ের সাথে আমার বিয়ে দেবেন। তবে তখনও আমি বিয়ের জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত ছিলাম না। যতবার আমার বিয়ের কথা উঠেছে আমি সোজা না বলে দিয়েছি। কিন্তু কোন কাজ হয় নি। কারণ পরোক্ষভাবে বাবা মাকে সাপোর্ট দিচ্ছিলেন। আর বাবার মুখের উপর কথা বলা পৃথিবী উলটে গেলেও আমার পক্ষে সম্ভব না।
যেই কথা সেই কাজ। মা আমার বিয়ের জন্য মেয়ে দেখা শুরু করলেন। মেয়ে খোঁজার দায়িত্ব দেওয়া হল আমার মামার কাঁধে। তিনি কোন প্রফেশনাল ঘটক না। তবে আত্মীয় স্বজনদের বিয়ে দিতে দিতে তিনি প্রায় ঘটকে পরিনত হয়ে পড়েছেন। আমরা প্রায় মামাকে ঘটক মামা বলে সম্বোধন করি। মামা কোন রাগ করেন না। তিনি নাকি হাদিসে পড়েছেন মুসলিম নরনারীর বিয়ে দেওয়া অনেক সওয়াবের কাজ।
পূর্বের বেশ কিছু বিয়েতে মামা তার সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি কোথা থেকে যেন সুন্দর সুন্দর মেয়ের খোজ পান। কিন্ত এ যাত্রায় তিনি মায়ের মন রক্ষা করতে ব্যর্থ হলেন। প্রায় ছয় জন মেয়ে দেখালেন। কাউকেই নাকি মায়ের পছন্দ না। মেয়ে পছন্দ হলে ঘর পছন্দ হয় না। আবার ঘর পছন্দ হলে মেয়ে পছন্দ হয় না। মা এবার মামার উপর আর ভরসা রাখতে পারলেন না। সেদিন আমার সামনেই বললেন, ‘খালি মুখে বড় বড় কথা! কাজের বেলায় ঠনঠনাঠন!’
এই কথা গুলো বোধ হয় মামার প্রায় ঘটক স্বত্বায় বেশ জোর আঘাত হেনেছিল। কোন আত্মীয় তাকে বিয়ের ব্যপারে এমন কড়া কথা শোনাতে পারেন নি। আর সেনাবাহিনী থেকে অবসরে যাওয়ার পর থেকেই তিনি এই কাজটি মনযোগ দিয়ে করছেন। দূর সম্পর্কের আত্মীয় থেকে শুরু করে শালী, শালা, শালার ছেলে মেয়েদেরও তিনি বিয়ে দিয়েছেন। মামা অনেকটা গাম্ভীর্যের স্বরে বললেন, ‘দেখিস আপা এবার এমন মেয়ে তোকে দেখাবো। তুই পছন্দ না করে থাকতেই পারবি না। যেমন রাজকন্যার মতো মেয়ে তেমন বনেদী ঘর’।
মা তার ছোট ভাইয়ের কথায় বোধ হয় খুব একটা আস্থা রাখতে পারলেন না। আমি মায়ের ব্যাজার মুখ দেখে সেটা অনুমান করে নিলাম। আমি তাদের কথার ভেতর ঢুকতে চাচ্ছিলাম না। তাই পত্রিকায় চোখ রাখলাম। কিন্তু কান খাড়া রাখলাম। পত্রিকার পড়ার এই এক সুবিধে। পড়াও হয় আশপাশের কথাবার্তা শোনাও হয়। মা বললেন, ‘ আচ্ছা দেখি তুমি কেমন বনেদী ঘরে আমার ছেলের বিয়ে দাও!’
আরো একটি মেয়ে দেখানোর পর মামা হাত গুটিয়ে নিলেন। তিনি নিরাশ হয়ে মাকে বললেন, ‘আপা আমাকে মাফ কর। আমি তোর ছেলের বিয়ে দিতে পারবো না। ‘কেন? তুই না রাজকন্যার মতো মেয়ে এনে দিবি আমাকে?’ মায়ের কন্ঠে তাচ্ছিল্য। ‘মেয়ের দাদা রাজাকার ছিল না কি ছিল সেটা দেখে কি করবি আপা? মেয়ে তো ভালো। উচ্চশিক্ষিত। ঘর ভালো’। ‘ওই পরিবারের কথা আর একবারও মুখে আনবি না। যে মেয়ের দাদা ছিল রাজাকার সেই পরিবার কেমন হবে তা বুঝতে বাকি থাকে না।’ মামা অনেকটা নিরাশ হয়ে ফিরে গেলেন। পরের এক সপ্তাহ মায়ের ফোন রিসিভ করলেন না। তার কিছুদিন পর আমার অফিসের এক কলিগ লাঞ্চের পর আমার টেবিলের কাছে এসে বললেন, ‘কি খবর ছোট ভাই। বিয়ে করছো নাকি শুনলাম?’
আমি বেশ আশ্চর্য হলাম এই লোক আবার আমার বিয়ের খবর পেলো কি করে! এই জন্যই বোধ হয় মুরুব্বীরা বলেন, যার বিয়ে তার খবর নাই। পাড়া পড়শির ঘুম নাই। আমি তেমন আগ্রহ দেখালাম না। এই ভরা অফিসে কেউ আমাকে নিয়ে অতিমাত্রায় রসিকতা করুক তা চাচ্ছিলাম না। তিনি আমার প্রতিউত্তরের অপেক্ষায় না থেকে পুনরায় বললেন, ‘আমার কাছে একটি ভালো মেয়ের সন্ধান আছে। তারপর পকেট থেকে একটা ছবি বের করে আমার সামনে রেখে বললেন, ‘সময় করে দেখে নিও। যদি পছন্দ হয় আমাকে খবর দিও’। পরে আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম আমার মামার পাশের ফ্ল্যাটেই সেই কলিগের বাসা। মামার কাছেই তিনি আমার বিয়ের বিষয়ে বিস্তর শুনেছেন। হাতে অনেক কাজ জমেছিল। ছবি দেখে মহামূল্যবান সময় নষ্ট করার কোন কারণ থাকতে পারে না।
রাতে যখন ডিনার করে ঘুমাতে যাবো তখন আমার ছবিটার কথা মনে পড়লো। ব্যাগ থেকে ছবিটা বের করলাম। এক পলক দেখার পর আবার দেখলাম। তারপর আবার। তারপর আবার। কেমন যেন কৌতুহলে ভরা সেই স্থিরচিত্রটি। একটা সাধারণ শালোয়ার, কামিজ পরা একটি মেয়ে আমার দিকে বড় বড় চোখে চেয়ে আছে। চোখদুটো ভীষণ মায়াবী। কেমন যেন ভীতি ভীতি চেহারা। কপালের কালো টিপটা দেখে মনে হচ্ছিল কেউ যেন চাঁদের গায়ে সুনিপুণ হাতে কাজলের ফোটা এঁকে দিয়েছে। এতটা উজ্জ্বল। চেহারায় সাজসজ্জার বাড়াবাড়ি নেই। সদ্য স্নান সেরে বের হওয়া মেয়েটিকে কেউ বোধ হয় সামনে বসিয়ে ছবি তুলেছে। জীবনে আর একটিবার প্রেমে পড়লাম। তাও আবার একটি স্থিরচিত্রের। শুনতে হাস্যকর লাগতে পারে।
রাতেই ছবিটা মাকে দেখালাম। বাবাও দেখলেন। মা প্রথমে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। যেই আমি কদিন আগেও বিয়ে করব না বলে বাড়ি মাথায় তুলেছিলাম। সেই আমি একটি মেয়ের ছবি পকেটে নিয়ে ঘুরছি। মা ছবিটা বেশ কয়েকবার দেখে বললেন, ‘ছবিতে তো ভালোই দেখাচ্ছে। সামনাসামনি না দেখে কিছুই বলা যাবে না’। রাতেই ছবিটা ভাইয়াকে মেসেঞ্জারে পাঠালাম। ভাইয়া ভাবী দুজনেই পছন্দ করলেন। পরদিন ছিল শুক্রবার। অফিস না থাকায় আমার সেই কলিগকে ফোন দিয়ে বললাম, ‘ভাই, আমি মেয়েটিকে দেখতে চাই। আপনি ব্যবস্থা করুন। প্রয়োজনে আমি তাদের বাসায় যাতে পারি। আর আগামীকাল বাবা-মা গিয়ে দিনক্ষণ ফাইনাল করবেন’।
কলিগ বিকেলে আসতে বলে ফোন রেখে দিলেন। আমি কিছুটা অবাক হলাম। ছবি দেওয়ার সময় যে উত্তেজনা তার ভেতরে দেখেছিলাম। কথায় তার ছিটেফোঁটাও ছিল না। বিষয়টা আমার কাছে কেমন যেন ঘোলাটে মনে হল।
বিকেল তিনটার পরে আমরা বাংলামোটরে মিলিত হলাম। রাস্তার পাশের টংয়ের দোকানে দুটো চায়ের অর্ডার দিয়ে একটা আধাভাঙ্গা চেয়ারে আমরা বসলাম। আমি প্রথম থেকেই লক্ষ করছিলাম কলিগের চেহারায় কেমন যেন বিমর্ষতার ছাপ। তিনি বোধ হয় আমাকে কিছু বলতে চাচ্ছেন। কিন্তু বারবার বলতে গিয়েও থেমে যাচ্ছেন। আমি তাকে বললাম, ‘ভাই আপনি কি আমাকে কিছু বলতে চান? বলতে চাইলে বলেন। আমি তো আপনার ছোট ভাইয়ের মতো। আমার কাছে সংকোচ কিসের।
উনি বারবার এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলেন। এর মধ্যে চা এসে গেল। তিনি এবার আমার দিকে তাকালেন। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। তিনি চায়ে ছোট্ট করে একটা চুমুক দিয়ে নিচু স্বরে বললেন, ‘রোহান মেয়েটিকে দেখতে যাওয়ার আগে আমার একটি কথা তোমাকে বলা উচিত’। ‘একটা কেন হাজারটা কথা বলুন। কোন সমস্যা নেই’। ‘আসলে কথাটা তোমাকে গতকালই বলা উচিত ছিল। কিন্তু বলি নি। সে জন্য প্রথমেই তোমার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি’। আমি উনার কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। কি এমন কথা যা বলার জন্য এতো ভণিতার প্রয়োজন! উনি বললেন, ‘মেয়েটির নাম স্বর্ণা। আসলে স্বর্ণা আমার দূর সম্পর্কের কাজিন। খুব ভালো মেয়ে। শান্ত স্বভাবের। তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি স্বর্ণা কথা বলতে পারে না। জন্ম থেকে বোবা।
কথা গুলো আমি ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। ছবির উপর জীবন্ত হয়ে ভেসে ওঠা সেই মেয়েটি কথা বলতে পারে না! আমি কিছুতেই এই নির্মম সত্য কথাটি মেনে নিতে পারছিলাম না। তিনি আবার বললেন, ‘এই মেয়েটি জনম দুঃখী। আজ পর্যন্ত অনেক জায়গায় ওর বিয়ে ঠিক হয়েছে। কিন্তু কোথাও শেষ পর্যন্ত বিয়ে হয় নি। সেদিন ওর মা আমার সামনে কান্না জড়িত কন্ঠে বললেন যদি আমার স্বর্ণার বিয়েটা দিয়ে যেতে পারতাম তাহলে মরে শান্তি পেতাম। একজন মায়ের কান্না দেখতে কারই বা ভালো লাগে! এখন ওর বাবা মা হাল ছেড়ে দিয়েছেন।
সেদিন আমরা আর স্বর্ণাদের বাসায় যায় নি। বিষাদাক্রান্ত মনে বাসায় ফিরে আসি। বাসায় ফিরে মা-বাবার সাথে বিষয়টি শেয়ার করলাম। মা এক কথায় বলে দিলেন, ‘ওই মেয়ের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। একজন বোবা মেয়েকে বড়োজোর করুণা করা যায়। ঘরের বউ করা যায় না’ আমি মাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, ‘মেয়েটি কথা বলতে পারে না এতে ওর কি দোষ বলো মা! সৃষ্টিকর্তা তো সবাইকে সবকিছু দিয়ে পৃথিবীতে পাঠান না। আমি যে মনে মনে ওই মেয়েকে বিয়ে করবো বলে ঠিক করেছি মা বোধ হয় সেটি বুঝতে পেরেছিলেন। মা আবার বললেন, দেখ বাপ, আমি মা। জেনেশুনে তোমার ভবিষ্যত নষ্ট হতে দিতে পারি না। আমি কোন মতেই এই বিয়েতে রাজি হবো না।
সেদিন আরো বিস্তর কথা বার্তা চললো। ভাইয়া ভাবীর সাথে কথা বললাম। ভাইয়াকে বোঝাতে সক্ষম হলাম। ভাইয়া ভাবী মাকে ফোনে বোঝালেন। শেষে বাবা বললেন, ‘আচ্ছা আগে আমরা মেয়েটিকে দেখে আসি। তারপর না হয় সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। মায়ের ঘোর আপত্তি স্বত্বেও পরদিন আমরা স্বর্ণাদের বাসায় গেলাম। তারও দুই সপ্তাহ পরে আমাদের বিয়ে হল। ভাইয়া অনেক দিন থেকে মা-বাবাকে আমেরিকা নিয়ে যাওয়ার জন্য চেষ্টা তদবির করছিলেন। শেষ পর্যন্ত সফল হলেন। আমাদের বিয়ের এক মাসের মাথায় বাবা-মা আমেরিকা চলে গেলেন। আমি বরাবরই বিদেশ যাওয়ার বিপক্ষে। মাতৃভূমি ছেড়ে বিদেশ যাওয়ার কথা আমি চিন্তাই করতে পারি না। আমি ভাইয়াকে স্পষ্ট বলে দিয়েছি আমি ইউএসএ যাচ্ছি না। যদিও ভাইয়া খুব করে চাচ্ছিলেন আমাদের পুরো পরিবার যেন আমারিকায় সেটেল হই।
স্বর্ণার মাঝে আমি একটা সমুদ্র পেয়েছি। ভালোবাসার সমুদ্র। সেই সমুদ্রে বৈঠাহীন নৌকা নিয়ে নিশ্চিন্তে ভেসে যাওয়া যায়। যেখানে ভয়ের বিন্দুমাত্র ছায়া নেই। যেখানে আচানক সুনামিতে ভেসে যাওয়ার আশংকা নেই। একটা আশ্চর্যের বিষয় হলো এই ছয় মাসে একদিনের জন্য আমার মনে হয় নি স্বর্ণা কথা বলতে পারে না। আমি অল্প দিনেই ওর চোখের ভাষা রপ্ত করে ফেলেছি। বিধাতা ওকে কথা বলার ক্ষমতা না দিলেও চোখে এক অদ্ভুত ক্ষমতা দিয়েছেন। আমি ওর সাথে চোখের ভাষায় কথা বলি। ও দারুণ রান্না করতে জানে। বিয়ের দ্বিতীয় দিন ওর হাতের রান্না খেয়ে বাবা তো বলেই ফেললেন জীবনে এমন ভালো রান্না এই প্রথম খেলাম। মায়ের সাথে খুনসুটিও করলেন, বোউ মার কাছ থেকে রান্নাটা ভালোমতো শিখে নিও।
ও মাঝে মাঝে চিরকুট লিখে আমার শার্টের পকেটে রেখে দেয়। ছোট ছোট অক্ষরে নানান অনুভূতির কথা লিখে রাখে। মাঝে মাঝে মজার মজার কথা লেখে। কয়েকদিনের লেখা এরকম, ‘তুমি খুব ভালো’ ‘লাঞ্চ পিরিয়ডে পুরো খাবার শেষ করবা’ ‘তুমি খুব দুষ্টু’। আমি ওর চিরকুট কখনও বাসায় পড়ি না। অফিসে গিয়ে পড়ি। ওর লেখা গুলো পড়ে মাঝে মাঝে চোখে পানি এসে যায়। আবার মাঝে মাঝে নিজের অজান্তে হাসে উঠি।
গল্পের বিষয়:
গল্প