পারুর হাতের গরম চায়ে অল্প ঠোঁট ভিজিয়ে বইয়ের পাতা নাড়িয়ে বললাম, সাতসকালে গরীবের বাসায়!” পারু তার শাড়ির আঁচল আঙুলে মুচড়িয়ে বলল, যে শাড়ি পরে ট্যুরে যাবো ভাবলাম৷ ছোটবোন শাড়িটা পরে বেড়াতে গেছে বুঝলি৷” মাথা নাড়িয়ে বললাম,
-ও আচ্ছা৷” বলে বইয়ের পাতায় চোখ বুলোয়৷”
-তুই হাসলি কেন? এদিকে তাকা!” কড়া গলায় বলল পারু৷ আমি তাকালাম৷ পারু ভ্রু কুচকালো৷ সরু নাকটা আরেকটু সরু হল৷ ভ্রু কুচকালে স্নিগ্ধ চেহারার মিষ্টি মেয়েটাকে আরেকটু অদ্ভূত মিষ্টি লাগে৷ এই মিষ্টি লাগার নাম নেই, ব্যাখা নেই৷”
-তুই ভাবছিস আমি তোরে দেখতে চলে আসছি?”
-হু৷ তা নয়তো কী?” আমি ভাবলেশহীণ মাথা নাড়ালাম৷”
-তোর দেয়া এই গা গুলিয়ে আসা সবুজ রঙের শাড়ি পরে কোথাও যাওয়া যায় নাকি? তাই তোর কাছেই চলে এসেছি৷” আমি চোখের চশমা নেড়ে পারুর শাড়িটা আগাগোড়া তাকিয়ে বললাম,
-আমি দিয়েছি নাকি?”
পারু দাঁত কিড়মিড় করে বলল, আমার বড্ড ভুল হয়েছে বুঝলি৷ তোর এই চায়ে বিষ মিশিয়ে তোকে মেরে না ফেলে আমি বড্ড ভুল করেছি৷ তোর আসলে দুনিয়াতে বেঁচে থাকা উচিত৷ বুঝলি?” আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম, অবশ্যই আমার মরে যাওয়া উচিত৷” পারু আরেকটু রাগলো দেখলাম৷ নাকের ডগা লাল হচ্ছে৷” রান্নাঘর থেকে আমার মায়ের ডাক “পারুল”৷ পারু যাওয়ার আগে আরেকবার চোখেচোখে বলে গেল, দেখে নিবো৷” আমি দাঁত বের করা হাসি দিয়ে বললাম,
-শোন! চায়ের সাথে তোর চেহারার একটুও মিল নেই৷”
পারু কানে নেয়না৷ পারু রুম ছাড়তেই আমি রান্নাঘরে উখি দিলাম৷ আম্মা পারুকে রান্না শেখাতে ব্যস্ত৷ আব্বাকে দেখলাম রান্নাঘরের দরজায় চেয়ার পেতে বসে আছে৷” সপ্তাহখানেক ধরে আমি পারুর সাথে দেখা করিনা, কথা বলিনা৷
শ’খানেক ফোনকল এসেছে৷ আমি ধরিনি৷ প্রতিটা ফোন কলই আমার জন্য বিভীষিকা৷ আমি চেপে রেখেছি৷ পারুর সাথে আমার আগে ঠুকঠাক পরিচয় ছিল ভার্সিটির প্রথম দিন থেকেই৷ তা কখনো ঠুকঠাক “ভালো আছো? হ্যা! তুমি?” এর মধ্যেই৷ কখনো তাও না৷ আবার কখনো চোখ উল্টিয়ে সম্মতি৷” শুধু পারু না৷ সবার সাথেই আমার এমন৷ ক্লাসের শুরুর মিনিটখানেক আগে দৌঁড়ে ক্লাসে ঢুকা বা মিনিটখানেক পরে গিয়ে “আমি কী আসতে পারি?” টাইপের ছাত্র আমি৷ বরাবরই মুখচোরা৷” পারুকে ক্যাম্পাসের বড়ভাই প্রেম প্রস্তাব জানালো৷ চড়-থাপ্পরের বদলে সূক্ষ্ম হাসির সূক্ষ্ম অপমান করে ছেড়ে ছিল৷ আমি হুটহাট আগে চলে যেতাম৷ আমি দেখতাম, এই পারুকে প্রেমিকা বানাতে আমার ব্যাচমেটদের নায়ক সাজার চেষ্টাগুলৌ৷
হাহ! এই মেয়ে এমন কি! যে তারে পটাতেই হবে৷” এমন ভাবের যে আমি ছিলাম৷ তাও না৷ আমিও চাইতাম, পারু আমার হোক৷ আমার দিকে চেয়ে মিষ্টি হাসুক৷ আমরা ঘুরবো ফিরবো৷” সেদিন! ঝলসানো রোদ৷ শার্টের পেছনটা ঘামে ভেজা৷ এই গরমে চা খাওয়ার স্বাদ জাগলো আমার ক্যাম্পাসের পাশের টঙ দোকানে৷ বন্ধু বান্ধবের অভাবে এক হাতে চায়ের কাপ আরেকহাতে ফোন৷ ভাবখানা আমি মহাব্যস্ত৷” কে যেন এসে ঘামে ভেজা শার্টে হাত রাখলো৷ আমি লজ্জায় পেছন ফিরছিনা৷ পাশে তাকালাম সাহস করে৷ ভ্রু কুচকে পারু বলল, খাটাস কেন তুমি?” আমি কাচুমাচু একটা হাসি দিয়ে টিস্যুর প্যাকেটটা এগিয়ে দিলাম৷” হাত মুছে পারু বলল, চায়ের সাথে সিগারেট কই?” আমি মাথা নেড়ে বললাম,
-অভ্যাস নেই৷
-অভ্যাস করতে হবে৷ এই দেখো আমি টানছি বলেই সিগারেট ধরালো পারু৷”
আমার ভেতরে খারাপ লাগা নাড়া দিল৷ এই মিষ্টি চেহারার মেয়েটা সিগারেট টানবে কেন? সে হবে মসৃণ৷ সে আইসক্রিম খাবে, ঝাল ফুচকা খাবে৷” সিগারেটে প্রথম টান দিতেই পারু কেশে উঠলো, তারপর নাজেহাল অবস্থা৷” আমি সামলে নিলাম৷ সেদিন পারুর সাথে হাঁটা হলো৷ মুখচোরা আমি হয়ে গেলাম বাছাল৷ সেই থেকে পারু মেয়েটার সুখ দুঃখের সঙ্গী আমি৷ যেমনটা আমি তেমনটা সেও৷” আমি এখনো ভাবি৷ পারুর চুল টেনে বলি, তুই হুট করে আমার কাছে আসলি কেন?” পারু উদাস হয়ে বলে,
-তুই হলি আমার পাংখা বুঝলি!”ৃ
-পাংখা কী?
-এই ধর, আমার হুট করে উড়তে ইচ্ছে হলো৷ তোরে নিয়া উড়াল দিবো৷ রাত বিরাতে ঘুরবো তোর সাথে৷
আমার প্রেমিকা হতে ইচ্ছে করলে৷ তোর সাথে প্রেম করলাম৷ তুই আমারে শাড়ি-চুড়ি কিনে দিবি৷ আলতা লাগাই দিবি পায়ে৷” পারুর কথা শুনে আমি কিন্ঞ্চিৎ লজ্জা পায়৷ পারু আমার চুল টেনে বলে,
-আমার ইচ্ছে হলে বলেছি৷ শুধু আমার ইচ্ছে হলেই৷ নিজেরে রাজকুমার ভাবতে বলিনাই৷” আমি মূহূর্তেই মুখ শক্ত করে স্বাভাবিক হয়ে যাই৷” সপ্তাহখানেক ধরে আমার ভেতরটা ভালো নেই৷ এই ভালো না থাকার কারণটা পারু৷ পারুর কাছে থাকতে পারার ভালো না লাগা আমার৷” গত সপ্তাহে ট্যুরের কথা হচ্ছিলো৷ আমার খুব ইচ্ছে পারুকে নিয়ে ঘুরবো, ছবি তুলবো৷ টাকার দরকার৷ মাসের মাঝামাঝি৷ বুঝলাম আমার হবে না যাওয়া৷ পারু সবার মাঝে৷ নেতৃত্ব দিচ্ছে৷ আমার খারাপ লাগে৷ আমি ভাবি, পারু শুধু আমার৷ পারুকে একপাশ করে বলি,
-আমি যেতে পারবোনা!
-এটা বলতে এখানে আনলি?
-তুইও যাবিনা৷”
পারুর হাত ধরে বললাম আমি৷ পারু তাকালো আমার দিকে৷ আমার হাত ধরে রাখার সাহস হয়নি৷” আমি ছেড়ে দিলাম৷ আমার কেন জানি আর দাঁড়াতে ইচ্ছে করেনি৷” আমি বাসায় ফিরেছি৷ দিন দুয়েক পারুর খবর নেই৷ আমিও নিইনি৷ সূর্যের আলো দেখিনা আমি৷ সকাল দেখিনা, সন্ধ্যার গৌধূলী দেখিনা৷ উদাস হয়ে সিলিং ফ্যানের ঘুরা দেখি৷”
তিনদিন পর পারুর ফোন আসে৷ আমি ধরিনা৷ পারুর কন্ঠ শুনলে আমার ভালো লাগে না৷ আবার শুনতে আমার হাসফাঁস করি৷ তবুও দমিয়ে রাখি নিজেকে৷ আব্বা বলতো, তুই বড্ড ছটফটে, অধৈর্য্য ছেলে বুঝলি!” কিন্তু আমি এবার ধৈর্য্যের চূড়ান্ত পরীক্ষা দিলাম৷” আজ পারু এসেছে৷ আমি অবাক হয়েছি৷ আজ ট্যুরের ডেট৷ মেয়েটা আমাকে রেখে যাইনি৷ তা আমি জানি৷ মনে প্রশান্তি খেলা করে৷ উৎফুল্লতা টিকরে পড়ে আমার৷ তবুও দমিয়ে রাখি নিজেকে৷” পারুর সবুজ পাড়ের শাড়িটা আমার দেয়া৷ চুড়িজোড়াও আমার দেয়া৷ পারুর গত জন্মদিনের উপহার৷ আমি ব্যাগে নিয়ে ঘুরছিলাম দিনকয়েক৷ জন্মদিন গত হয়েছে দিনকয়েক আগে৷ পারু কথাচ্ছলে বলেছিল,
-ভেবেছিলাম তুই কিছু দিবি৷ কিছুইতো দিলিনা! আমি ইতস্তত করে শাড়ি আর চুড়ি জোড়া পারুর দিকে এগিয়ে মাথা নিচু করে বলেছিলাম, তিনদিন ধরে নিয়ে ঘুরছি সাথে৷ কেমন দেখাবে ভেবে দেইনি৷ আমার পছন্দ করা সবই জগন্য, শুধু তুই বাদে!” মাটির দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, পারু আমার দিকে অবাক হয়ে তাকাবে৷ আমি প্রস্তুত হয়ে তাকালাম৷ হতাশ হলাম! পারু শাড়ি নেড়ে দেখছে৷ শেষে বলল,
-কি যেন বলেছিলি? আবার শোনা৷ খেয়াল করিনি আমি৷ আমি কোনোমতে বললাম, না থাক৷” শেষবিকেল! পারুর যাওয়ার পালা৷ বেরোতে হবে৷ পারু রুমে উখি দিয়ে বলল,
-আমার দেয়া পান্জাবীটা পড়বি৷ বন্ধু হিসেবে তোর সাথে আমার শেষদিন৷” পারু আর দাঁড়ালোনা৷ আমার ভেতরটা হু হু করে উঠলো৷ আমার এখন ধুপ করে বসে পড়া উচিত৷ ওয়াশরুমের ট্যাপ ছেড়ে হাউমাউ করে কাঁদা উচিত৷ কিংবা বন্ধ করে জোরেশোরে সিলিং চালিয়ে হাত পা ছাড়িয়ে উদাস ভঙ্গিতে শুয়ে থাকা দরকার৷” আমি তা করলাম না৷ সামলে নিলাম৷ শেষটা সুন্দর হোক৷” আমি হাঁটছি৷ একটু পেছনে পারু৷ আমি ঠান্ডা গলায় বললাম,
-তুই সবার সাথে যাসনি কেন?
-তুই কি ভাবছিস? আমি তোর জন্য যাইনি? বলল পারু৷ আমি মৃদ্যু হেসে মাথা নাড়িয়ে বললাম,
-নাহ! তা কেন ভাববো!”
-ভাববিনা কেন? টঙ দোকান, ঘামে ভেজা তোর শার্ট, সিগারেট নিয়ে আমার পন্ডিতি৷ হুট করে আমাদের এক হওয়া!
সবকি শুধুই অপ্রয়োজনে, অকারণে?” বলল পারু৷
-অপ্রয়োজনে, অকারণে এই পৃথিবীতে কিছু হয়না পারু৷ আমরা সবাই ভালো থাকতে চাই, ভালো থাকার প্রয়োজনে, কারণে এত আয়োজন৷” মেঘহীন শূন্য আকাশে তাকিয়ে বললাম আমি৷”
-এই যে আজ আমাদের বন্ধুত্বের শেষ৷ এর কারণ বা প্রয়োজনের ব্যাখ্যা দিতে পারবি?”
বলল পারু৷”
-গলা ধরে আসা ভাঙা কন্ঠে বিশারদবিদ হতে পারবোনা পারু৷ আমাকে ক্ষমা কর৷ নিশ্চুপ হাঁটি বরং শেষটায়৷”
-আচ্ছা৷”
বলে ছোট্ট জবাব দিল পারু৷” ক্যাম্পাসের কোণের টঙ দোকানে থামলো পারু৷ আমিও দাঁড়ালাম৷ দৃষ্টি ঝাপসা হওয়ার আগে চশমাটা খুলে পানি মুছলাম আমি৷ পারু মৃদ্যু হেসে তাকিয়ে আছে৷ আমি পানি লুকোলাম না৷” কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ খুলে শার্ট বের করলো পারু৷ আমি অবাক হলাম৷ পারুর সাথে প্রথম পরিচয়ে শার্টটা পরা ছিলাম আমি৷ সেই ঘামে ভেজা শার্ট৷ মাসকয়েক ধরে খুঁজে পাইনি৷” শার্টখানা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে পারু বলল,
-যত্ন করিস!”
আমি মাথা নাড়ালাম৷” পারু বিদায় জানালো৷” আজ পারুর সাথে শেষ দেখা আমর৷ পারু জানেনা৷ মেয়েটা ভেবেছে আমি তার বিয়েতে যাবো৷ তোঁড়জোড় করে স্বামীর হাতে তুলে দিবো৷” পারুর ফোনে ঘুমটা ভেঙেছে৷ বিয়র কার্ড আনবে আমর জন্য৷ স্পেশাল কার্ড৷ আমি যেন সেই শার্টটা পরে আসি৷ সেই অনুরোধও করে রেখেছে৷ শেষ বেলায় এসে স্মৃতিগুলো কাতর করার দরকার আমি বুঝিনা৷” পারু আসে৷ আমার পিঠে হাত রাখে৷ খেয়াল করলাম, সেই প্রথম দিনের সেলোয়ারটা পড়ে এসেছে৷” হাতে বড় একটা ব্যাগ৷
-ব্যাগে কী?
-শাড়ি, চুড়ি৷
-কেন?
-এই তোরসাথে ঘুরবো৷ ছবি তুলবো, ফুচকা গিলবো!”
-এসব সিনেমাতে মানায় পারু!” বললাম আমি৷
-শুনলাম সপ্তাহখানেক ধরে কেঁদে মরে যাচ্ছিস৷ সিগারটও টানছিস৷
আমি বিয়ে করে ফেললে মরেও যেতে পারিস৷ তাই চলে এসেছি জানোয়ার৷ এখন বিয়ে তুই করবি? নাকি আমি করবো?” রেগে বলল পারু৷ আমি মিনমিন করে বললাম,
-চল বিয়ে করবো৷”
গল্পের বিষয়:
গল্প