ফারাহর ঝুলন্ত লাশ দেখে সদ্য মা হারা শোক ভুলে যায় রক্তিম! কঠিন কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে! দুজনের শোকে পাথরে পরিনত। অথচ গতকাল রাতেও ফারাহর সাথে কথা হয়েছিল রক্তিমের….
– রক্তিম, তুই ধর্ষিতা নারীর হৃদস্পন্দন শুনেছিস ?
– আমার বুকে মাথা রেখে অনুমান করে নে! সদ্য মা হারা সন্তানের হৃদস্পন্দনের চেয়ে বেশি হবে না। হওয়ার কথা না।
– সরি রে রক্তিম, তোর মা হারানো নিয়ে আমি কিছু মনে করাতে চাই নি!
– তুই মনে করানোর সুযোগটা কোথায় পাবি! ভুলে যাওয়া জিনিষটাকে মনে করানো যায়। কিন্তু আমিতো মাকে কখনো ভুলিনি। মা তো আমার হৃদয়ে লেপটে থাকে সব সময়।
– যে চলে গেছেন তাকে বাদ দিয়ে, যারা আছে তাদের বুকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে হবে তোকে।
– মা, আমার স্বর্গ। স্বর্গ শোকে শোকাতুর আমি !
যেখানে প্রতিটি মানুষ স্বর্গ লাভের তাড়নায় মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লড়াই করে যায়, সেখানে আমি স্বর্গটাকেই হারিয়ে বসে আছি!
– টেইক ইট ইজি! শুভ রাত্রি দোস্ত! ঘুমিয়ে যা। আমিও গভীর ঘুমে মগ্ন হবো।
এই কথাগুলো যে ফারাহর সাথে শেষ কথা হবে রক্তিম কখনো ভাবে নি। কথা শেষ করেই ঘুমিয়ে যায় রক্তিম।
ফারাহ ছোট বেলা থেকেই বাবা মা হারিয়েছে! বড়বোন রাজিয়ার কাছেই সে বড় হয়েছে! আপন বলতে বোন আর দুলাভাই মিরাজ। মিরাজের সাথে রাজিয়ার বিয়ে সেটাও একটি দুর্ঘটনা মাত্র। ঢাকা কুর্মিটোলার আশ পাশ এলাকায় জঙ্গিদের সাথে পুলিশের পাল্টাপাল্টি গোলাবর্ষণ চলছিল। রাজিয়াদের পুরো বাসা দখল করে নিয়েছিলো জঙ্গিরা। মিরাজের দুঃসাহসী অভিযানে জঙ্গিদের কে ধরলেও বাঁচাতে পারেনি রাজিয়ার বাবা মা ও বড় ভাইকে। শত চেষ্টা করেছিল মিরাজ।
– চারপাশে তোমাদের ঘিরে ফেলা হয়েছে! তোমরা আত্মসমর্পণ করো!
– আত্মসমর্পণ? ভুলে যাও, আমরা শহীদ হতেও রাজি তবুও আত্মসমর্পণ নয়, আমাদের জন্য হেলিকপ্টার ব্যবহার কর শালা, নয়তো প্রতি ৩০মিনিট পরপর একেকটা লাশ পড়বে।
এভাবেই একের পর এক ভেতর থেকে গুলির আওয়াজ শোনা ছাড়া কোন প্রকার সমাধান ছিলো না সেদিন। অভিযানের রুপরেখা বাস্তবায়ন হতে হতে রাজিয়া ও ফারাহ ছাড়া বাকি সবার লাশ সেদিন বের করে এনেছিল।
সে দিন দুইবোনকে মিরাজ সাথে করে বাসায় নিয়ে এসেছিল। এবং বড় বোন রাজিয়াকে বিয়ে করে দুইজনেরই দায়িত্ব নিয়েছিল। তাদের সংসার দশ বছরে গড়ালো। পরের দিন সকালে রক্তিম ঘুম থেকে উঠে মোবাইল হাতে নিতেই দেখলো ফারাহর একটি মেসেজ। যেখানে লিখাছিল “যে পৃথিবীতে নারীদের সম্মান করে ভক্তি করার কথা সে নারীকেই হতে হয় ধর্ষিত। এসব সহ্য করতে না পেরে ঝুলে থাকতে হয় ফাঁসির দঁড়িতে।
হুম আমি রোজ নিয়ম করে ধর্ষিত হচ্ছি। আমি ধর্ষিতা ফারাহ! যা কাউকে মুখ ফুটে বলতে পারছি না, সহ্যও করতে পারছি না! তাই নিজেই নিজে সিদ্ধান্ত নিয়েছি আত্মহত্যা করার। জানি এটি মাহাপাপ! একজন ধর্ষিতার কষ্ট মনে হয়না দোজখবাসীর মত কষ্টের হবে। যাওয়ার আগে তোকেই সব জানিয়ে গেলাম। রুদ্রাক্ষের কাছে কিছুই লুকিয়ে রাখিস না নয়তো মরার পরও তার কাছে অপরাধী হয়ে থাকবো। বালিশের নিচে একটা ডায়েরী আছে ওটা পড়ে নিস। সেখানে সব বলা আছে। চাইলে মোবাইলেও বলতে পারতাম কিন্তু তুই আমাকে যেভাবেই হোক বাঁচিয়ে রাখবি তা জানি। কিন্তু এই বেঁচে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। “
রুদ্রাক্ষ তার হুব বর। কয়েকজন নামিদামি ডাক্তারের মধ্যে একজন। দুলাভাই ও বোনে মিলেই বিয়ে ঠিক করেছিলো। আগামীকালই তাদের গায়ে হলুদ হওয়ার কথা। কিন্তু সবই শেষ করে ফারাহ চলে গেল। রক্তিম মেসেজ দেখার পরপরই ফারাহার বাড়িতে পৌঁছে গেল। গিয়ে দেখতে ফেল সে শুয়ে আছে, সাদা কাপন মোড়ানো। রক্তিম মেসেজ দেখতে দেখতে দেরী হয়ে যাওয়াতে তার চেহারাটাও শেষ বারের মত দেখতে পারলো না। তার দুলাভাই ও প্রতিবেশীদের নিয়ে দাফনকার্য শেষ করে রক্তিম ফারাহর রুমে গেল। আত্মহত্যার মুল কারণ বের করাটা রক্তিমের জন্য ফরজ হয়ে দাঁড়ালো। একের পর এক সব জিনিসপত্র ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছিল।
বালিশের নিচ থেকে একটা ডায়েরিও পেয়েছিল। প্রথম পেইজ উল্টিয়েই রক্তিম বাকশক্তি হারিয়ে ফেলে ” আমার মৃত্যুর জন্য দুলাভাই দায়ী! জানি ডায়েরীর লেখা পড়ে তোর বিশ্বাস হবে না! শুধু তুই না কেউই বিশ্বাস করবে না। কারণ দুলাভাই সবার কাছে ফেরেশতার মত! এবং একজন আইপিএস অফিসার। এসব আমি বললেও উনার পক্ষে ধামা চাপা দেওয়ার মত ক্ষমতা আছে। বরং বলার পর উনার হাতেই আমার মৃত্যু হতো। রোজ দুলাভাই ও তার বন্ধুদের হাতে ধর্ষনের চেয়ে আত্মহত্যাই ভালো। আমি এখন অন্তঃসত্ত্বা! বেঁচে থাকলে এই সন্তানের বাবার পরিচয় দুলাভাই হবে নাকি তার বন্ধুদের মধ্যে কেউ হবে তা আমিও জানি না। তাই পৃথিবীকে বিদায় জানালাম।” রক্তিমের দুচোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছে। কারণ ফারাহ’ই রক্তিমকে সব সময় আগলে রাখতো। একজন ভালো বন্ধু ছিল সে। মাকে হারানোর পর তার এই একাকী জীবনে ফারাহ একটা মাত্র সঙ্গী ছিল।
সব ঘটনা রক্তিম রুদ্রাক্ষকে বলেছিল। ফারাহর বারণ থাকা সত্ত্বেও, তার বোনের সাথেও বিষয়টি পরিষ্কার করে বলেছিল। তারপর নিজ ঘরেই ফিরে এলো রক্তিম। পরের দিন সকালে টিভিতে নিউজে দেখতে পেল “দেশের সাহসী আইপিএস অফিসার মিরাজ মিল্টন তার বাসভবন এন্তেকাল করেন! মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল। মৃত্যুর আগে তার বয়স ছিল ৪৫ বছর, তার মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সহ আরো অনেকে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন” খবর শোনা মাত্রই ফারার বড়বোনকে ফোন দেয় রক্তিম…
– আপু দুলাভাই রাতে মারা গেছে শুনলাম?
– হ্যাঁ, নিজ হাতেই তাকে বিশ খাইয়ে মেরেছি আমি, নিজের বোনের চেয়ে একজন দুশ্চরিত্র স্বামী আমার কাছে বড় নয়। যে বোনের সাথে এসব করতে পারে তার কাছে আমার মেয়েও নিরাপদ নয়। মেয়ে বড় হচ্ছে।
– কিন্তু আসনি যে ফরেনসিক রিপোর্ট এ ধরা পড়ে যাবেন।
– শুনতে পাওনি যে এটা স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল।
রক্তিম এ নিয়ে আর কোন কথা না বাড়িয়ে সব হজম করে নিলো। আর একটা শুকরিয়ার ঢেকুর তুলল। এখন সব শেষ। বেশ কিছুদিন পর রুদ্রাক্ষের সাথে দেখা হওয়ার পর রক্তিম জানতে পারলো যে। মিরাজের ডেড বডির ফরেনসিক রিপোর্টের দায়িত্ব তার কাছে এসেছিল সে রিপোর্ট পজেটিভ পেস করেছিল। যার কারনেই মিরাজের মৃত্যুটা স্বাভাবিক ভাবে ফুটে উঠেছিল।
গল্পের বিষয়:
গল্প