এইবার নিয়ে চতুর্থ বারের মত বাচ্চা নষ্ট হলো আমার। বয়স পয়ত্রিশ, ডাক্তার বলেছেন এতবার নষ্ট হওয়ার পর আমার এই বয়সে আবারও গর্ভধারণ করতে পারার সম্ভাবনা ৩০ শতাংশ। আমি ডাক্তারের সামনে স্বাভাবিক হয়ে বসে থাকতে পারছিনা, বুকের ভিতর টায় কে যেন চাকু বসিয়ে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। চোখ বেয়ে অনবরত পানি টপটপ করে পরছে। আমার স্বামী সৌরভ অতি কষ্টে পাথর হয়ে গিয়েছে। আমাদের নিরবতা ভেঙে ডাঃ সালমা নাসরিন বলেন,
-“মিসেস খাঁন, আপনার সমস্যা টা জরায়ুতে। বাচ্চার বয়স যখন তিন মাস পেরিয়ে চার মাসে পড়ে তখন তা হালকা ওজন হয়, আর এই ওজন টাই আপনার জরায়ু নিতে পারেনা। তার মুখ খুলে যায় আর বাচ্চাটার এবর্সন হয়ে যায়।
সৌরভ কৌতুহলি হয়ে প্রশ্ন করে,
-“ম্যাম, এটার কোন সমাধান নেই?”
-“দেখুন মি. খাঁন, প্রথমত আপনার স্ত্রী একজন হাইপো থায়রোয়েডের রোগী, তার উপর ৪ বার এবর্সন এবং বয়স ৩০+।
ত্রিশ বছরের পর নারীর গর্ভধারণ ক্ষমতা এমনিতেই কমে আসে, এখন যদি আপনি অপারেশন করাতে চান তবে করাতে পারেন তাতে হয়তো আর এবর্সন হবে না কিন্তু বাচ্চা ধারণ করতে পারবে কিনা এ বিষয়ে আমি শতভাগ নিশ্চয়তা দিতে পারছিনা। সৌরভ বলার মত আর কোন কথা পায়না, ডাঃ সালমা আবারও বলেন,
-“আল্লাহর উপর ভরসা করুন, আগামী এক বছরের মধ্যে উনি আর কন্সিভ করতে পারবেন না, করলে এটা উনার আর উনার সন্তান দু’জনের জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে। আর যখন কন্সিভ করবেন তখন প্রথম চার মাস যেন নাড়াচাড়া টুকুও না করেন। আমি ঔষধ লিখে দিচ্ছি চালিয়ে যান।
কথা শেষ করে একটা শত টুকরায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া হৃদয় নিয়ে বের হয়ে এলাম গাইনী বিশেষজ্ঞ ডাঃ সালমা নাসরিনের চেম্বার থেকে। অপারেশন কখনোই করাবো না, যদি এরপর আর বাচ্চা না ই হয়! সমবয়সী বান্ধুবিদের বাচ্চারা স্কুলে পড়ে, আর আমার যোগ্যতাই নেই ‘মা’ ডাক শোনার। অভিমানে চোখ ফেটে পানি গড়িয়ে পড়ছে, সৌরভ আমার হাত ধরে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছে ওর চোখেও পানি। গাড়ি চলছে কিন্তু তবুও কোথায় একটা গিয়ে যেন থেমে গেছে পথ। এত পথ পেরিয়ে যায় তবুও যেন ফুরায় না, এটা যে অপেক্ষার পথ, এর দৈর্ঘ্য অসিম।
ক্যালেন্ডারের হিসাব অনুযায়ী আজ নয় মাস চার দিন বারো ঘন্টা। আমার গর্ভে আমার পঞ্চম সন্তান। বাচ্চাটার উপস্থিতি অনুভব করার পর থেকে একটা টোকাও লাগতে দেইনি ওর অবয়ব টায়। আমাকে এখন আর চেনা যায়না, রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে থাকতে থাকতে চোখের চারিপাশ টা কালো হয়ে গর্তে ঢুকে গেছে। ঘুমাবো কি করে? যদি ঘুমের ঘোরে বাচ্চাটার গায়ে আঘাত লাগে? আমার জান বাচ্চাটাকে বাঁচিয়ে রাখতে আমি সারাজীবন না ঘুমিয়ে থাকলেও আফসোস হবে না। রাতের বেলায় ঘুমটা সৌরভের অনেক দরকার, ছেলেটা সকাল থেকে রাত অবধি অফিসে খাটে। বাড়িতে এসে আমার পাশে বসে আমি ওর হাত ধরে দু’ঘন্টা ঘুমাই, সে চেয়ে থাকে, কড়া নিরাপত্তায় রাখে। এবার আর কোন ভুল হতে দেওয়া যাবেনা। পাঁচ মাসের পর থেকে আমি একেবারে খেতে পারিনা বললেই চলে, ভাতের ঘ্রান টাও নিতে পারিনা বমি চলে আসে।
সবার প্রেগন্যান্সিতে নাকি ওজন বাড়ে, আমার এখনো পর্যন্ত ওজন কমেছে সাত কেজি। বাবুটা যখন হাত পা নাড়ে, ভেতর থেকে বেরিয়ে আমার কোলে আসার জন্য যখন সজোরে লাথি দেয়, এই ব্যাথাটা যে আমার কি সুখের লাগে যদি কেউ বুঝতো। মাঝে মাঝে মাথা দিয়ে টোকা দেয়, আমি ওর মাথায় আলতো করে ছুঁই, তখন ভেতর টা যেন শান্তিতে ভরে যায় আমার। এখন শীতের সময়, সৌরভ আমাকে কুশি কাটা এনে দিয়েছে। বাচ্চা টার জন্য এই নয় মাসে ছয় টা সোয়েটার আর দুই জোড়া মোজা বানিয়েছি। ও আগে মায়ের বানানো পোষাক গায়ে তুলবে, তারপর বাজারের গুলো। ভাবতেই মন টা কেমন ভরে যায় সুখে। আজ সকাল থেকেই পেট টা কেমন চিনচিন ব্যাথা করছিল, সন্ধ্যা হতেই ব্যাথাটা বেড়েছে৷ সৌরভ রাস্তায় আটকা পড়েছে, জ্যামের ভিরে হেঁটে আসছে। পেটের ভেতর টা কেমন মোচড় দিয়ে দিয়ে ব্যাথা করছে। ঘর ঘুটঘুটে অন্ধকার , বিছানা থেকে উঠে সন্ধ্যায় বাতি টুকু ও জ্বালাতে পারিনি।
সৌরভের সাথে কথা বলতে গিয়ে ফোনটা হাত থেকে ফ্লোরে পড়ে গিয়েছে, নেমে এসে তোলার শক্তি টুকুও নেই। বেচারা অনবরত কল করে যাচ্ছে, কি দুশ্চিন্তা ই না জানি করছে সে। ব্যাথা মূহুর্তে মূহুর্তেই বাড়ছে , কপাল বেয়ে ঘাম পড়ে সারা শরীর ভিজিয়ে দিচ্ছে। বাবুটা মাত্র লাথি দিলো, আজ কেন যেন আর সহ্য হলোনা ব্যাথাটা। লাগছে যেন পেটের ভেতর সব নাড়ি এক করে কেউ একজন খামচে ধরে টেনে ছিড়ে ফেলছে। পুরো ঘরটার মধ্যে একা আমি, প্রচুর ভয় করছে হঠাৎ । আম্মার চেহারা টা চোখের সামনে দিব্যি স্পষ্ট হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে, ইসস আম্মা…! যখন খুব বেশি দুঃখ পাই আম্মাকে ভীষণ মনে পড়ে। আজ আম্মাকে খুব ছুঁতে ইচ্ছা করছে, কতদিন ছুঁই না তারে! আম্মা মারা গিয়েছে কয়েক বছর আগে, মারা যাওয়ার আগেও ভাইয়ার হাত ধরে বলছিল,
-“বাবা, আমার নীরু রে বুকে রাইখো আজীবন, দুঃখ দিও না!” মরতে মরতেও আমার জন্য তার সে কি দুশ্চিন্তা! আহারে সন্তান! অথচ রেগে গিয়ে কি জঘন্য আচরণ টাই না মাঝে মাঝে করতাম। কলিজা টা ফেটে যাচ্ছে আমার! “মা গো এত কষ্ট বুঝি করছিলা আমাকে জন্ম দিতে? মাফ কইরা দাও না মা আমায়! এত অন্যায়ের ভার নিয়া আমি মৃত্যুমুখে যাইতে চাইনা রে মা! একবার আসো, শুধু একবার! তোমার নীরুর যে খুব কষ্ট হচ্ছে।”
আমার চিৎকার গুলো চার দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে আমার কানে এসে লাগছে। ধীরে ধীরে চোখ টা লেগে আসছে আমার, ব্যাথা টা ক্ষানিক টা বুঝি কমলো। কপালের উপর যেন খুব শীতল একটা স্পর্শ, একটা পরিচিত ঘ্রাণ ঘর টা মোহিত করে ফেলেছে। আচ্ছা কিসের ঘ্রাণ এটা? এত নেশা ঘ্রাণ টায়! হালকা হালকা হয়তো চিনতে পারছি সুভাস টাকে। হ্যাঁ ঠিক ধরেছি, এটা তো আম্মার কাপড়ের ঘ্রাণ। এই কাপড় জড়িয়ে ধরে কত রাত ঘুমিয়েছি,খুব চেনা এই ঘ্রাণ আমার খুব বেশি চেনা। আম্মা আমার খুব কাছেই আছে, এইতো আর একটু হলেই ছুঁতে পারছি তার গা। ইসস কি মমতা! সব ব্যাথা ভুলিয়ে দেয়। দরজা খোলার আওয়াজ হলো, সৌরভের গলার স্বর কানে আসছে সে “নীরু নীরু” করে চিৎকার করছে। এ কি স্পর্শ টা কোথায় হারিয়ে গেলো? ঘ্রাণ টা সরে যাচ্ছে যে! বুকের ভেতর টা হু হু করে কেঁদে উঠলো, মা যে চলে যাচ্ছে! আমি আবারও ঋণী হয়ে গেলাম রে মা তোমার কাছে, ক্ষমা করে দিও আমায়।
(“মা” শব্দটা কেবল একটা শব্দ নয়, এটা একটা জীবন, একটা দুনিয়া, আট টা জান্নাত! এই মুখ টা যেদিন হারিয়ে যাবে, আর বকাবকি করবে না, আপনার মন মত চলাতে বাঁধা দিবেনা, আপনার খাওয়া নিয়ে চিন্তা করবেনা, আপনার ধমক সহ্য করবে না, আপনাকে আগলাতে আসবেনা সেদিন বুঝবেন জীবন টার অর্থ আসলে কী। প্লিজ এই মানুষ টার ছবি দিয়ে আজকের দিন টায় ফেসবুকের ওয়াল টা ভাসাবেন না। বরং প্রতিজ্ঞা করুন আজকের দিন থেকে আর মায়ের সাথে রাগ দেখাবেন না, একবার গিয়ে বলুন “মা আমায় মাফ করে দাও!” দেখবেন তার সন্তুষ্টির হাসিতে জান্নাতের প্রতিটা ছবি কেমন সচ্ছ হয়ে ভাসছে।)
গল্পের বিষয়:
গল্প