স্মার্টফোন বিড়ম্বনা

স্মার্টফোন বিড়ম্বনা
আম্মা সেহেরির সময় উঠেই ডিরেক্ট আমার রুমে চলে আসায় উপর্যুপরি মোবাইল খানা বালিশের তলায় ঢুকিয়ে একটা ঘুমের ভান ধরলাম। আম্মা লাইট না জ্বালিয়েই ডাকছেন;
– রবিন
– হুম
– এহ্! হুমমম মারাচ্ছেন উনি! হইছে, অভিনয় খুব সুন্দর হইছে। উঠ বিছানা থেকে। অসহায়ের মত মুখটা তুলে বললাম;
– আম্মা সত্যিই ঘুমাইতেছিলাম।
– বালিশের তলায় আলো দেখা যাচ্ছে।
এটা দেখে আমিও বুঝেছি আপনি সত্যিই ঘুমাচ্ছিলেন। বেহায়া দেখেছি, আপনার মতো বেহায়া আমি আর কোথাও দেখি নাই। এখন মোবাইল খাবেন নাকি সেহেরি খাবেন দেখেন। এই বলে মিনমিন করে উনি প্রস্থান করিলেন। এই কোয়ারান্টাইনে আসার পর থেকেই আম্মার শুরু হলো সেই আগের মতো আবার আমার আর আমার মোবাইলের পিছনে লাগা। এতো নির্যাতন আমি আর নিতে পারছি না। যদি বলি;
– আম্মা খিদে লাগছে। আম্মা বলতো;
– মোবাইল খা। আমি বলতাম;
– মোবাইল কেমনে খায়? আম্মা বললো;
– মোবাইলে খাবার দেখে কয়েক গ্লাস পানি খেয়ে নে,
তাহলে মোবাইল হাত থেকে রেখে কষ্ট করে ডাইনিং এ এসে ভাত মাখিয়ে খেতে হবে না। সিম্পল। এটা আম্মা খুব ভালো আইডিয়া দিয়েছিলো। সুলতান ডাইন’স এর বিরিয়ানীর কিছু ছবি ভালো করে দেখে আমি পানি খেয়ে দেখেছি কয়েকদিন। বেশ ভালো কাজ করে। সেদিন আম্মাকে বললাম আম্মা মাথা ব্যাথা করছে। আম্মা বললো, মোবাইল টিপা। আরেকদিন বললাম, আম্মা হতাশ লাগছে, আমার জানি কেমন কেমন করতেছে। আম্মা বললো, মোবাইল টিপা। বললাম, পেট ব্যাথা। আম্মা বললো, মোবাইল টিপা, ঢুকে যা এটার ভেতর। আম্মাকে বললাম, আম্মা আমার জ্বর। আম্মা বললো, মোবাইল টিপা। আম্মাকে বললাম, করোনায় তো সব ধংস করে দিচ্ছে। আম্মার একটাই কথা, মোবাইল টিপা।
এখন আমি ‘টু’ সাউন্ড করলেই আম্মা বলে, মোবাইল টিপা। অসহ্য যন্ত্রণায় শেষ পর্যন্ত মোবাইল বন্ধ করে ফেললাম। ভাবলাম কিচেনে হেল্প করবো। সবজি কেটে দিতে গেলাম, আম্মা বললো তুমি গিয়ে মোবাইল টিপাও। বললাম আজকে বাজার করবো টাকা দাও। আম্মা আরো কয়েকজনকে ডেকে বললো এই তোমরা এসে একটু হেসে যাও, উনি মোবাইল না টিপে বাজার করবে নাকি বলছে। সবাই চিরিয়া দেখার মত আমার দিকে তাকিয়ে হুহু করে হেসে দিলো। অপমানে আমি আবার মোবাইল হাতে নিলাম। কানে কপালে আর দিচ্ছে না, স্বপ্নেও দেখি আম্মা বলছে, মোবাইল টিপা।
অনেক চিন্তা ভাবনা করে একটা সলোশন বের করলাম। একমাত্র আম্মা ছাড়া এই ঘরে সবাই স্মার্ট ফোন ইউজ করে। আম্মা করে না। আম্মাকে বরং একটু স্মার্ট করে দেই। এটলিস্ট তাও যদি এর প্রয়োজনীয়তা কিছু বুঝতে পারে।
সীমিত আকারে লকডাউন খুলে ফেলায় দৌড়ে টাউনে এসে একটা ওয়ালটনের ফোন কিনে ফেললাম। সুন্দর করে প্যাকেট করে আম্মাকে গিফট করলাম। আম্মা তো দেখে সেই খুশি। বলতেছে আজকে যে তর বাপ আর আমার ম্যারেজ এনিভারস্যারি জানতাম-ই না। আমি বললাম আম্মা এনিভারস্যারি আরো তিন মাস পর আজকে না। এটা মনে করো অগ্রিম গিফট তোমার জন্য। আম্মা সেই খুশি।
পাঁচ জিবি ফ্রি আছে। তাই আম্মাকে একটা ফেসবুক আইডি খুলে দিলাম ‘ঘসেটি বেগম’ নাম দিয়ে। তারপর আমার সাথে ফ্রেন্ডশিপ করে দিলাম। কিছু হাদিসের, নিউজের, সিরিয়ালের, আর রান্নার রেসিপি জাতীয় পেজে সি-ফার্স্ট দিয়ে লাইক করে দিলাম। ইউটিউবেও সেইম কাজটা করে দিলাম। দুই ঘন্টা বসে দেখালাম কীভাবে এটা ইউজ করতে হবে। প্রথমে ক্যালকুলেটরের মতো প্রেসার দিচ্ছিলো টাচে, এটা একটু কন্ট্রোল করে দিলাম। সেদিন আর রান্না হয়নি। রাতের খাওয়া বাদ। ফেসবুকে লগইন করিয়ে আমি আমার রুমে চলে আসলাম। মুভি দেখতে দেখতে দেখি সেহেরির সময় হয়ে গিয়েছে। আম্মার উঠার খবর নাই। একটু উঠে আম্মার রুমে গিয়ে দেখি আম্মা সজাগ! তাও মোবাইল টিপছে! গলা কাশি দিতেই উপর্যুপরি মোবাইল বালিশের তলায় ঢুকিয়ে নিলো। আমি ডাক দিলাম;
– আম্মা
– হুম
– হুমমম না! হইছে উঠো খিদে লাগছে, বলে চলে আসলাম।
রুমে এসে চিন্তায় পড়ে গেলাম। বিপদ টিপদ ডেকে আনছি নাতো? তারপর ভাবলাম; নাহ্ প্রথম অভিজ্ঞতা তো, এটা ব্যাপার না ঠিক হয়ে যাবে। পরেরদিন সকালে আম্মা দৌড়ে চিল্লায়া আমার রুমে আসলো। আমি তো ভয় পেয়ে গেছি। বললাম;
– কী হইছে আম্মা?
– দুনিয়ার খবর রাখস?
– রাখি তো।
– বলতো ডোনাল্ট ট্রাম্পের নাম কী?
– আম্মা এটা কেমন কথা, ওর নাম-ই তো ডোনাল্ট ট্রাম্প।
– ওর নাম আর এখন ডোনাল্ট ট্রাম্প না, ও মুসলমান হয়ে গেছে।
এখন ওর নাম ‘দেলোয়ার হোসেন টেনু।’ দেখ ইউটুভে। আলহামদুলিল্লাহ্ বল। ইশ! কাঁদবো না হাসবো বুঝতেছিনা। অনেক চেষ্টা করেও বুঝাতে পারিনি এটা ভূয়া নিউজ। এসবের কোন ভিত্তি নেই। উফফ! কী মুশকিলে পড়লাম। দুপুরে দেখি আম্মা এক দৌড়ে কিচেনে যাচ্ছে আবার দৌড়ে ডাইনিং এ ফ্রিজ থেকে কী কী বের করে নিচ্ছে। কিচেনে গিয়ে দেখি ইউটিউব দেখে রান্না করতেছে। কী যে রান্না করছে বুঝেই উঠতে পারছি না। তাও ভাবলাম ভালো মন্দ খাওয়া যাবে আজ।
ইফতারে খেতে বসলাম। কীসবের ঘাটা প্লেটে দিলো আম্মা বুঝলাম না। আব্বু এক চামচ মুখে দিয়ে বোনের দিকে তাকালো। ও এক চামচ মুখে দিয়ে ছোটবোন ফৌজির দিকে তাকালো ও তাকালো আমার দিকে। আমি ভয়ে এক চামচ মুখে দিয়ে কেঁদে ফেললাম, আম্মার দিকে তাকালাম আম্মা কিছুক্ষণ এদিক ওদিক তাকিয়ে উঠে গেলো। চোখ দিয়ে সবাই এখন আমাকে শাসাচ্ছে, বলছে সব দোষ তর তর তর! কী এক অদ্ভুত সমস্যায় পড়লাম আম্মা চব্বিশ ঘণ্টা মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকে। কোন কাজ প্রপারলি করছে না। এসবের চিন্তায় আমি মোবাইল টিপানো ভুলে গিয়েছি। গতকাল রাতে এতো ঝাল দিয়ে তরকারী রান্না করলো ঝালের চোটে গ্লাস বাড়িয়ে আম্মাকে বললাম, পানি ঢালো তাড়াতাড়ি। উনি মোবাইলের দিকে তাকিয়ে গ্লাসে পানি না ঢেলে টেবিলে পানি ঢাললো। চিল্লায়া বললাম, আম্মা! আম্মা উলটো বললো, পানি কীভাবে ফেললি? হুস করে খাওয়া যায় না?
এই মহিলা গেলো। অবশেষে আজকে রাতে হঠাৎ দেখি আম্মা আমার একটা পোস্ট শেয়ার করেছে। আবার ক্যাপশনে কীসব বানান যে লিখলো দাঁত ভেঙে যাওয়ায় মতো! অনেকটা এমন ছিলো; ‘মনে পরে যাচ্চে রবেনের আববার আর আমার সিরিতি’ উফফ! আম্মা কীভাবে তার ছেলের পোস্ট এভাবে শেয়ার করে! উল্টো আমার পোস্টের কমেন্টে গিয়ে লিখছে ‘নায়েস বলেছেন ভাই, আমার সাথে মিলে গেছে।’ ওরে আল্লাহরে নিজের পোলাকে ভাই ডাকছে! আমারে কেউ মারো। ভাগ্যিস ‘ঘসেটি বেগম’ নামে আইডি’টা খুলে দিছিলাম। তা না হলে পোলাপান আমার ইজ্জত খুলে নিতো। সব কমেন্ট ডিলিট করলাম। কিছুক্ষণ পর পর-ই কমেন্ট করতেছে। উফফ যন্ত্রণা। ইদানীং আর ভালো মন্দ খাওয়া দাওয়া নেই। শুকিয়ে যাচ্ছি। আব্বু কিছু বলতেও পারছে না। আমি কিছু বললে মোবাইল নিয়ে তেড়ে এসে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল করে বলে, ‘নে নে নে নিয়ে যা। আমি তো চাকরানী। আমি ক্যান মোবাইল চালাবো। নিয়ে যা।’
ঘরে আর এক ফোটা শান্তি নাই। আম্মার দিন নাই রাত নাই উনি মোবাইল নিয়েই পড়ে আছেন। আমার ফেসবুকের সব মেয়েদেরকে নক করে ওদের বাপের নাম্বার খুঁজতেছে। সবাইকে বলতেছে আমি রবিনের আম্মা। মেয়েরা স্ক্রিনশট দিয়ে পাঠাচ্ছে। ইজ্জত! সেটা কী এখন আমি ভুলেই গিয়েছি। ব্লক করলাম আম্মাকে। আরেকটা ফেইক আইডি দিয়ে চেক করতে গিয়ে দেখি প্রোফাইলে আমার ছবি দিয়ে একদম ভরে ফেলছে। খালি গতরে ফ্লোরে বসে কাঠাল ভাঙছিলাম এটা কখন যেনো ছবি তোলে প্রোফাইলে দিয়ে রাখছে। চিল্লায়া আমার কাঁদতে ইচ্ছে করছে। ‘না পারছি সইতে না পারছি কিছু কইতে’ এই হাল হলো আমার।
হঠাৎ আজ একটা মিরাকল ঘটে গেলো। আম্মার হাতে মোবাইল নাই। মোবাইল সুন্দর করে বিছানায় রাখা। আম্মা কিচেনে। সেই আগের মত রান্নার ঘ্রান আসতেছে। ঘরে আজকে যেনো ঈদ। সবাই খুশি। বাট আম্মা কারো সাথেই কথা বলতেছে না। আমি গেলাম কিচেনে, খুশিতে জড়িয়ে ধরলাম। ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে দিলো। বললো, ‘ঢং করিস না। আমি কে? আমি তো চাকরানী এই ঘরের। আমি কারো কিছু হই নাকি? আমার কিছু লাগে নাকি? আমার কিছু না থাকলে কেউ খুঁজ করে এনে দিয়েছে? আমার চাহিদা কেউ বুঝে? আমি কেউ না মানে আমি কেউই না। আমার কিছুই নাই। যা এখান থেকে।’ সবার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। সত্যিই এতোদিন আম্মাকে নিয়ে আমরা একটু বেশিই অন্যায় করে ফেললাম। গিলটি ফিল হচ্ছে সবার। অনুশোচনায় কাতর। আব্বু একটা শাড়ি কিনে এনে দিলো। আরো কী কী নাই দেখে যার যার সাধ্য মতো কিছুনা কিছু আম্মাকে কিনে দিলো। কিন্তু কিছুতেই আম্মা আর স্বাভাবিক হচ্ছে না। রান্না করতেছিলো কাজ করতেছিলো। কথা নেই মুখে।
আজকে আবার রান্না-ই বন্ধ। সব কাজ লকডাউন। কোন কথা নেই নোটিশ নেই। কী এমন ঘটলো, সবাই তো উনার প্রতি দুঃখিত হয়েছে। তাও ক্যানো সমস্যা? আল্লাহ কী যে হলো। আমরা তো সুখের মুখ দেখেছিলাম। সবই তো স্বাভাবিক। আম্মার শখ ও তো শেষ। তাও ক্যান এমন হবে? চিন্তা করতে করতে শেষমেশ এক সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করলাম ছোটবোন ফৌজিকে প্রধান করে। ও তিন ঘন্টা তদন্ত করার পর এক লাইনের একটি রিপোর্ট পেশ করলো। রিপোর্ট দেখে আমার মাথা ঘুরতেছে। প্রেসার বেড়ে যাচ্ছে। আমি যেনো সর্ষে ফুল দেখছি চারপাশে। রিপোর্ট’টিতে লিখা ছিলো; ‘আম্মার মোবাইলের ডাটা শেষ ডাটা লাগবে, ইট’স আর্জেন্ট।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত