সম্মানবোধ

সম্মানবোধ
বিয়ের পরে প্রথম রোজা আমার শ্বশুড়বাড়িতে।হুট করে দেখলাম একদিন আমায় না জানিয়ে,আমার বাবা ইফতারি,ফল,খাবার,উপহার সব কিছু নিয়ে হাজির।আমার বাবা নিতান্তই খুব সাদাসিধে মানুষ।চাকরির অবসরের পর সে বাইরে কোথাও ঘুরতে যেতেও পছন্দ করেন না।সারাদিন বইয়ে মুখ গুঁজে থাকতে পছন্দ করেন মানুষটি।সেই মানুষটা আজ রোজা রেখে এই রোদের মধ্যে বাড়ি বয়ে খাবার নিয়ে এসেছেন।বাবা ঘরে উঠতে উঠতে হাঁপাচ্ছেন।
বাবার ক্লান্ত মুখখানা দেখে আমার ভিতরটা ফেঁটে চৌচির হয়ে যাচ্ছিল।
অন্য কেউ হলে হয়তো এটাকে ঐতিহ্য বা সৌজন্য ভেবে মন কে হালকা করতো বা অন্যকেউ হলে নিজের মাথা শ্বশুরঘরে বড় হবে তাই ভেবে আনন্দিত হত।তবে যেখানে আমার বাবার মাথা হেইট হয়ে যায় সেখানে আমি নিজের মাথা উঁচু আসনে রাখার পক্ষপাতিত্ব করিনা। বাবা এতকিছু কেন এনেছো? বাবা ক্লান্ত মুখে উত্তর দিলেন,বোকা মেয়ে,প্রতি বছর তুই আমাদের সাথে থাকিস আজ এত দূরে বাবার বুঝি ইচ্ছে করেনা? সারাঘর ভর্তি মানুষ এত এত বাজার দেখে খুব খুশি।আমার শ্বাশুড়ি পাড়া প্রতিবেশিকেও তা থেকে খাবার দিবেন বলে ইতিমধ্যে ভেবে রেখেছেন।কারণ, তা দিয়ে নতুন প্রক্রিয়ায় ঢাক ঢোল পিটানো যাবে।
বিয়েতে কোন যৌতুক নেয় নি নিলয়।ভালোবাসার বিয়ে ছিল এবং মানুষটাও আমায় ওয়াদা করেছিল,যৌতুক বা অতিরিক্ত কাবিনের চাপ এ বিয়েতে থাকবেনা।হয়েছিল ই তাই।কাবিন নিয়ে আমার চাচারা ঝামেলা করলেও আমার বাবার এক কথা ছিল।আমার মেয়ের ইচ্ছে।আমি ফেলতে পারবো না। যৌতিক আনিনি তাই শ্বাশুড়ি প্রায় ই তার মেয়েকে দেয়া কত শত যৌতুকের কথা আমায় গর্বের সাথে শুনান।তবে আমি তা মাথায় তুলিনা।কাউকে কিছু দিয়ে সুখী করা যায়না। আজ এই বাবাটাকে আমার কারণে বাড়ি বয়ে সৌজন্যতা বহন করতে হল বেপারটা আমার মনে শান্তি দিচ্ছেনা।বৃদ্ধ বয়সে আমার তার ঢাল হবার কথা। বাবার পাশে বসে ফুঁপিয়ে কাঁদছি।বাবা বার বার জিজ্ঞাসা করছে কী হয়েছে মা?আমি ছোট বেলার মতই কষ্ট লুকিয়ে বললাম,কিছুনা।তুমি আজ থাকবে তো?
-না রে মা।ওদিকে তোর মা অপেক্ষা করছেন।
ঘরে নিলয় প্রবেশ করেই আমার মুখের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে বাবাকে সালাম দিল।শ্বাশুড়ি মা নিলয়কে খুশি হয়ে খাবার, উপহার দেখাতে ছিলেন।নিলয় বার বার আড়চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছে।সে জানে আমি কী চাই।কী বলতে চাই। কিছুটা নিস্তব্ধতা নিয়েই,বাবাকে বললো,এসব কেন আনলেন বাবা? শ্বাশুড়ি মা উঠে বললেন,আহ এসব ভালোবেসেই আনছেন।দশ টা না পাঁচ টা না একটা জামাই বলে কথা।কী বলেন বেয়াই মশাই?তাও তো কম ই।আমার মেয়ের শ্বশুরবাড়ি আমরা এর চেয়েও অনেক বেশি পাঠাই।মেয়ের সম্মান রাখা আমাদের ই দায়িত্ব তাইনা বেয়াই? বাবা হেসে বললেন,একদম ঠিক।
শ্বাশুড়ি মা বাবাকে কথার জালে অপদস্ত করছেন। তা বেয়ান আমি আজ উঠি এই বলে বাবা বিদায় নিতে নিলেন।নিলয় ছাড়া বাসার কেউ ই তেমন অনেক অনুরোধ করলেন,কিন্তু বাবা থাকার জন্য নারাজ।মায়ের কড়া হুকুম,মেয়ের শ্বশুড়বাড়ি একদম থাকা যাবে না।শত হলেও তো ওটা মেয়ের বাড়ি না।কী অদ্ভুত দুনিয়ার নিয়ম।মানুষগুলোকে আমি ভালো রাখার প্রতিজ্ঞা করেছি তবে সেই জায়গার প্রতি আমার অধিকার নাই। আমার শ্বাশুড়ি মা উঠে বললেন,বেয়াই এই পাঞ্জাবি আপনার বেয়াই পরেনা এটা বরং নিয়েই যান।শুধু শুধু রেখে দিয়ে লাভ আছে যদি কেউ না ব্যবহার করে তার চেয়ে ওটা কাউকে দিতে পারবেন। বাবার মাথায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে।মলিন মুখে বললেন,বেয়াই কী পছন্দ করেন আমায় বলেন।আমি না হয় ইদের আগে পাঠিয়ে দিব। শ্বশুর মশাই চিবিয়ে বললেন,আরেহ না ঠিক আছে। মা উঠে বললেন,এত লজ্জা পাও কেন?আপন মানুষ ই তো। এই রঙ পরেনা বুঝলেন বেয়াই।এই বলে পাঞ্জাবি টা বাবার হাতে তুলে দিলেন।
প্রথম যেদিন স্কুলে গিয়েছিলাম বাবা চলে যেতে নিলেই আমার বাবার বৃদ্ধাঙ্গুল ধরে অনুনয় করেছিলাম,বাবা আমায় এখানে রেখে যেওনা।নিয়ে চলো।আজ অনেকদিন পর বাবার বৃদ্ধাঙুল ধরে বললাম,আমিও যাব বাবা। নিলয় বার বার আলাদা রুমে নিয়ে আমায় বুঝিয়ে চলেছে এতে তার কোন হাত নেই।সে এসব কখনই চায়নি। আমি শুধু একটা কথাই বলেছি,বিয়েটা ভালোবেসে করেছিলাম।সংসার করার লোভে।তবে কোন মেয়ের জীবনে বিয়েটা একমাত্র মুক্তির পথ নয় তাইনা?আমার সন্তান হিসেবে বাবা মায়ের প্রতিও দায়িত্ব আছে কী বলো?তারা আমায় এতকাল লেখাপড়া করিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।মেয়ে বলে অবহেলা করেন নি।ভালাবাসার মানুষকে আবদার করেছি তাও ফেলেন নি।আজ বাবাকে একা কী করে যেতে দেই?
-আমি এগিয়ে দিয়ে আসি? না নিলয় আমাদের দুজনকে একটু একা ছেড়ে দেও। বাবার সাথে বাসায় চলে এলাম।বাবা-মা বুঝিয়ে চলেছেন আমার ভুল।আমার এমন উচিৎ হয়নি কিন্তু আমি জানি,আমার বাবার মন কিছুটা হলেও বড় হয়েছে।তার মেয়ে তার অপমান হজম করেনি।তার মেয়ে আর দশটা মেয়ের মত মুখ বুজে অন্যায় সহ্য করেনি। নিলয়ের কথা বার বার মনে পরলেও আমি বাবা মায়ের সাথে হাসিখুশি থাকতে চেষ্টা করছি।হঠাৎ কলিংবেলের শব্দ।দরজা খুলে দেখি উপহার হাতে নিয়ে নিলয় হাজির বাবা মা তা দেখে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পরলেন।
-নিলয় বার বার বলে চলেছেন জামাই না হয়ে ছেলে হলেও তো এমন করতো। নিলয়ের পাশে গিয়ে বললাম,উপহার নয় সম্মান দিলেই হবে।সন্তানের কাছ থেকে বাবা মা সম্মানটুকুই চায়। এরই মাঝে শ্বাশুড়ি মায়ের কল।ওপাশ থেকে ঝাড়ি দিচ্ছেন তা আমি খুব বুঝতে পারছি।নিলয়কে শুধু বলতে শুনলাম,তোমার মেয়ে বার বার ইফতার,উপহার দাবি করে সেটা গর্ব করে শুনাচ্ছো কেন মা?ও তো তোমাদের সম্মানের কথা ভাবেনা।বাবার কষ্টের কথা ভাবেনা।তোমার মেয়ে জামাই তার শ্বশুরবাড়ির কষ্টের কথা না বুঝতে পারে তাই বলে তোমার ছেলেও বুঝবেনা?তুমি আমায় এমন করে মানুষ তো করো নি মা! আমার কান্না পাচ্ছে।খুব কান্না পাচ্ছে চিৎকার দিয়ে কান্না করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে আমি অনেক ভাগ্য করে মনের মানুষ পেয়েছি।
নিলয় ফোন রেখে চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বললো,দোয়া করি আমাদের একটা মেয়ে হোক,যার সম্মানবোধ পুরোটাই তার মায়ের মত হোক। মনে মনে ভাবলাম,তোমার মত ছেলে যে মায়ের আছে তার আর কী লাগে!আমার বাবা-মা কত ভাগ্য করে এমন ছেলে পেয়েছেন।তাদের ছেলে না পাবার অপূর্নতা এবার ঘুচবে বলে। কী অদ্ভুত! দরজার আড়ালে থাকা বাবাটা চোখ মুছতে মুছতে ভিতরে চলে গেলেন।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত