বোনের গুরুত্ব

বোনের গুরুত্ব
আজকে লকডাউনের কারণে ৫০ দিন হলো বাসায় একপ্রকার বন্দী জীবন পার করছি। তার মধ্যে এক্সের পুরনো স্মৃতিগুলো বারবার আমাকে ডিপ্রেশনে ফেলে দিচ্ছে। ঠিক যেমন এখন আমার খুব ওর কথা মনে পড়ছে। ওর সেই মধুর কণ্ঠ আর হঠাৎ,
~ এই ভাইয়া আজ ইফতারিতে তোকে একটু চিড়া বেশী দি? খেয়ে নিস ঠিক আছে?
– কিরে হঠাৎ এত্তো ভালুপাশা আমার উপর? (মজা করে)
~ আরে চিড়া একটু বেশী ভিজিয়ে ফেলেছি তাই।
– ওরে বাটপার! আচ্ছা দিস সমস্যা নেই।
~ তুই আর আমি সমান করে নিব নি যাহ। টেনশন নিস না। কিন্তু..
– কিন্তু কী আবার?
~ হালিম আমি একটু বেশী নিব। হিহি।
বলেই মিলির সেকি দৌঁড়। আমি হাসছি। মানে বাটপারির একটা লিমিট আছে। বোনের এই বাচ্চাপানা দেখে আমি হাসছি। হাসতে হাসতে অবাক হলাম। আরে আমি হাসছি? হ্যাঁ সত্যিই আমি হাসছি। একটু আগেও কী দুঃখ বিলাস করছিলাম। কিন্তু বোনের জন্য এখন আমি হাসছি। মনটা ভালো লাগছে। কীভাবে হালিম বেশী খাবো মনের মধ্যে সেই চিন্তা ঘুরছে। এক্সের কথা আর মনে নেই। বোনটা হঠাৎ করে এসে মনটা ভালো করে দিল।
বোন, শব্দটায় কেমন জানি এক মায়া জড়িয়ে আছে। মিলি একটু আগে চিড়ার বাহানায় বলে গেল ও হালিম বেশী খাবে। অথচ ও কিন্তু না বলেও বেশী নিতে পারতো। কিন্তু না, আমাকে জ্বালিয়ে তারপর খাবে। এতেই ওর শান্তি। কখনো বোনটাকে নিয়ে ভাবা হয়নি। আমরা আসলে কেমন জানি। কাছের আপন মানুষগুলোকে রেখে দূরের মানুষগুলো নিয়ে সারাদিন পড়ে থাকি। কাছের মানুষগুলোকে নিয়ে কেন জানি একটু ভাবতে আমাদের কষ্টই হয়।
ভাবছি, মিলি কি আমাকে জ্বালিয়ে সত্যিই মজা পায়? নাকি অন্য কিছু? আসলে এটা জ্বালানো না। এটা ভাইয়ের প্রতি যত্ন কিংবা ভালবাসা। মিলি অবশ্যই বলে গিয়েছে আমাকে কম দিবে আর ও বেশী নিবে৷ কিন্তু বাস্তবে ওই কম নেয় আর আমাকে বেশী দেয়। শুধু তাই নয়, আমার খাবার সবসময় ওর আগে শেষ হয়ে যাবে। ওর চেয়ে বেশী খেয়েও যখন মন ভরে না তখন নিজের খালি বাটি থেকে মুখ উঠিয়ে যখন ওর দিকে আস্তে আস্তে তাকাবো ও সবার আগে ওর বাটিটা লুকিয়ে বলবে,
~ একটুও দিব না। এমনিতেই তোমাকে বেশী দিছি। আমিতো অসহায়ের মতো মুখ ঘুরিয়ে ফেলি। কিন্তু পরক্ষণেই আমার মুখের সামনে খাবার এসে পড়ে। বোন আমার হাতে খাবার নিয়ে মুখে মুচকি হাসি দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি দ্রুত খাবারটা খেয়ে নি। তারপর আবার কি বলে জানেন?
~ নে হা কর। একবার খেলেতো নদীতে পড়ে যাবি। সাঁতার তো জানিস না। হা কর। আবার একবার খাইয়ে দিবে। সত্যি বলছি, আমি নিজের হাতে যদি ১০০ বারও খাই আমার মন ভরেনা। কিন্তু ওর হাতে এই দু লোকমা যেন আমার মন প্রাণ সব ভরিয়ে দিয়েছে। এভাবে প্রতি বেলায় ওরপাতের খাবারে ভাগ না বসালে যেন আমার খাওয়া হয়না।
এইতো গেল খাওয়া। এবার আসি কাজ। বোন আমার ইন্টারে পরে। তবে ক্লাসের তুলনায় অনেকটাই ছোট ও। তাই মা আমাদের দুজনকে দিয়েই কাজ করায় এখন। কারণ সারাদিন বাসায় পড়ে থাকি। মজার কথা হলো আমাকে যে কাজ দেওয়া হয় তার অর্ধেক আমার বোনটা নিজেই করে দেয়। আর যে বাকি অর্ধেক থাকে তা আমি করি। যাতে বাবা মা বুঝে হ্যাঁ আমি কাজ করেছি। নাহলে বকা একটাও আমার বাদ যাবে না। এভাবে বোনটা আমার কাজ করে দেয়।
ফোন, সারাদিন ফোন নিয়ে পড়ে থাকি। কারণ কাজ নাই কোন। আমার এই ফোন চালানো আমার কলিজার বোনটা বাদে বাসায় অার কারোই পছন্দ না। বাবা মাঝে মাঝে আমার ফোন গায়েব করার জন্য মিশন চালায়। কিন্তু বোনের জন্য পারে না। ও স্পাইয়ের মতো এসে দ্রুত আমাকে সর্তক করে যায়। আমি ফোন চার্জে দিয়ে ভদ্র ছেলের মতো এটা ওটা কাজে লেগে যাই। বাবা এসে দেখে আমি কাজ করছি ফোন চালাচ্ছিনা৷ আহ! বিশ্বাস করুন তখন মনে হয় যেন বিশ্ব জয় করেছি। বোনটা দূর থেকে মিশন কমপ্লিট বলে আর হাসে। আমিও হাসি।
হাসি, আমার অধিকাংশ সময় বিষন্নতায় কাটতো, যদি বোনটা আজ সাথে না থাকতো। বোনটাকে এটা ওটা বলে প্রচুর হাসাই। ও হাসে আমিও হাসি। আমার হাসাতে ভালো লাগে। বোনটা হাসলে আমিও হাসি। আর এই হাসির ফলে বিষন্নতা আমাকে দুর্বল করতে পারে না। সারাদিন যখনই ও আমার কাছে আসে অনেক হাসাই ওকে৷ ও অনেক হাসে। মানে লকডাউনের সব মানসিক প্যারা নিমিষেই শেষ হয়ে যায় এই হাসাহাসির ফলে। আমাদের ভাই বোনের হাসাহাসি দেখে বাবা এসে কতক্ষণ ঝেড়ে যায়। আমরা সেটা নিয়েও কতক্ষণ হাসি।
মানে বোনটা আমাকে কখনো একাকী থাকতেই দেয় না। এটা ওটা নিয়ে উড়ে এসে জুড়ে বসে। আর অনেক হাসাহাসি হয়। মন যেন একদম চাংগা হয়ে যায়। আজ বোনকে নিয়ে ভেবে আমি অবাক। কতো যত্ন করে ও আমার। রাতে সেহেরির সময় এসে আস্তে আস্তে করে ডেকে দিবে, আমার ফোনটা চার্জ দিয়ে দিবে, আমার জামা কাপড় ধুয়ে বা গুছিয়ে দিবে, পানি চাইলে পানি এনে দিবে, আমার কাজ করে দিবে, বাবার কাছ থেকে বাঁচাবে, আমাকে হাসাবে। এমনকি আমরা ডিপ্রেশন নিয়েও হাসাহাসি করি মাঝে মাঝে। সত্যিই বোন না থাকলে মনে হয় ঠিক মতো বাঁচাই হতো না।
যাদের বোন আছে না আমার মতে তারা দুনিয়ায় সবচেয়ে লাকি একটা ভাই। একটা ছেলে না বোন ছাড়া একদম অসম্পূর্ণ। বোন যেন এক সুখের নাম। আমার বোনতো আমার সিক্রেট ডাইরি। আমার সব ও জানে৷ মাঝে মাঝে ভাবি, কেউ যদি এই সিক্রেট ডাইরিটাকে একবার পড়ে ফেলে আমার সব জেনে যাবে। তবে বোনকে বিশ্বাস করি ও কখনো কাউকে কিছু বলবে না। বোন আমার সিক্রেট নিয়ে কখনো ব্ল্যাকমেইল করে নি। কিন্তু আমি দুষ্টটা এর কোন সিক্রেট পাইলে হইছে। হাহা। যাই ইফতারির সময় হয়েছে করে আসি। আজ ইফতারিতে মা চিকেন ফ্রাই করেছে। সবাই একটা বড় পিছ করে পেয়েছে। যথারীতি আমারটা অলরেডি খাওয়া শেষ। মিলিকে পরীক্ষা করার জন্য বললাম,
– এই টুনটুনি আমাকে চিকেনটা দে না। খুব মজা লাগছে। আমারটা তো শেষ দেখ। খুব মজা লাগছে। তোর চিকেনটা দে না প্লিজ। আমি আবার সেই অভিনয় পারি। এত্তো অসহায় ভাবে বললাম বোনটা কিছু সময় আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
~ অভিনয় করছো জানি। কিন্তু তোমার চিকেন প্রিয় তাও জানি। নেও খাও। আমি একটু রাখছি। বাকিটা তোমাকে দিলাম। খাও।
বুঝলাম না আমার প্লেটে ওর চিকেনের টুকরোটা দেখে না চোখে অশ্রুর বিশাল বড় এক ঢেউ এসে পড়লো। চিকেনটা ওর পাতে আবার দিয়ে ওর কপালে একটা চুমু দিলাম। দিয়ে উঠে আসলাম। হাত ধুতে ধুতে ভাবছি, এই কলিজাটাকে কীভাবে অন্যের হাতে তুলে দিব? কীভাবে ওকে বিয়ে দিয়ে বিদায় দিব? পারবো বলে মনে হচ্ছে না।
সবশেষে বলতে চাই, বোনরা না ঠিক মায়ের মতো করে যত্ন করে ভাইয়ের। একটা বোনের ভাই হয়ে বুঝতে পারছি জীবনে বোনের গুরুত্বটা কত। আমার চেনা-জানা, পরিচিত কিংবা অপরিচিত সকল বোনকে আমার পক্ষ থেকে অসংখ্য সম্মান আর ভালবাসা জানাচ্ছি। যা খুবই অসামান্য। আর সকল ছেলেকে বলছি, অপরিচিত একটা মেয়ে তোমার বোনের মতো। তার দিকে কখনো কুনজর দিও না। তাকে নিয়ে খারাপ কিছু ভেবো না। তার কোন ক্ষতি করো না। পারলে তাকে সাহায্য করো একজন ভাই হিসেবে।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত