পরিনতি

পরিনতি
“কেমন রক্ত পঁচা গন্ধ আসছে তাইনা?” “প্রতিদিন এমন তালবাহানার কথা বইলো না তো। কাজে যাও।” স্ত্রী জোর করে হাসেম মিয়াকে কাজে পাঠায়। গত কয়েকদিন ধরেই সে এসব কথা বলে যাচ্ছে। একটু অলস স্বভাবের জন্য স্ত্রী বিশ্বাস করতে পারে না তার কথা। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। রাতের ডিউটি করে যাচ্ছে গত দুই সপ্তাহ ধরে। প্রতিদিন দেরি করে কাজে যায়। স্ত্রী খোসামোদ করে কাজে পাঠায়। কাজে গিয়ে পরিবেশ নিরব হলে আঁইল এর মাঝে বসে সিগারেট জ্বালায়। কাজ কীভাবে চুরি করতে হয় এ বিষয়ে পাকাপোক্ত হাসেম। সবাই যেখানে মনোযোগ দিয়ে কাজ করে হাসেম সেখানে বারবার সিগারেটের নামে কাজ ফাঁকি দেয়।
হাওর এলাকায় সুতো রঙ করে হাসেম। হেঁটে যেতে আধ ঘন্টা সময় লাগে। সেখানে পৌঁছিয়ে অস্থিরতা দেখিয়ে আরো আধ ঘন্টা বিশ্রাম নেয়। দশ ঘন্টার ডিউটি তার এক ঘন্টা এমনিতেই চলে যায়। মালিক রোজ হৈচৈ করে তাতেও কাজ হয়না। দীর্ঘ তিন ঘন্টা কাজ করার পর হাসেম প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে যায়। একবার বেরুতে পারলে কম পক্ষে বিশ মিনিট সময় উধাও হয়। আবার এসে কাজে যোগ দেয়। এমন সময় মালিক উঁচু শব্দে বললো,
“এভাবে আর কতোকাল কাজ ফাঁকি দিবে?
হাসেম জানে মালিক যতোই চেঁচামিচি করুক কোনো লাভ হবে না। তাকে যে কাজে রাখবেই। এই জায়গায় সবচেয়ে পুরাতন ও দক্ষ হচ্ছে হাসেম। সবাইকে হাতে ধরে কাজ শিখিয়েছে সে। খুব বিশ্বস্ত ছিল হাসেম। বললো, “একটু আধটু তো দেরি হবেই। প্রাকৃতিক সমস্যা হলে আপনি বাঁধা দিতে পারবেন?” এই বলেই হাসেম মালিককে থামিয়ে দেয়। হাসেমের রাগ অন্যের উপর ঝেরে মালিক চলে যায়। পাশ থেকে রহমান আলী মিশকাত’কে বললো, “হাসেম ভাই কাজ না করলেও সমস্যা হয়না। আমরা একটু বিশ্রামের কথা বললেই মালিক চিল্লাচিল্লি লাগায় দেয়। “এইখানে আর কাজ করা যাবো না। স্বজনপ্রীতির জন্য আমরা না খাইয়া মরুম।” পাশ থেকে হাসেম মুচকি মুচকি হাসছে।
মধ্য রাত, সবাই মিনিট দশেক বিশ্রাম করে আবার কাজে লাগে। এমন সময় হাসেমের নাকে সেই রক্ত পঁচার গন্ধ আসে। তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না। ধারণা হয়তো রঙের এমন বিশ্রি গন্ধ আসছে। ক্রমেই বাড়তে থাকে। অবাক হয়ে গন্ধ কোথা থেকে আসছে উপলব্ধি করতে চাচ্ছে। কিন্তু টের পাচ্ছে না। মিশকাতের সাথে ব্যাপারটা শেয়ার করলেও সবাই কাম চোর ভেবে উড়িয়ে দেয়। একটা সিগারেট জ্বালিয়ে গন্ধটার উৎপত্তি কোথায় খুঁজতে বের হয়। শুনশান পরিবেশ। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। যতদূর চোখ যায় কুয়াশার মতো দেখতে পেল হাসেম। সামনে এগুতেই আরো বিশ্রি গন্ধ আসছে।
সিগারেট অর্ধেক প্রায় শেষ। ধান ক্ষেতের পাশেই বহু পুরানো এক কবর। প্রতিনিয়তই রাত হলে এখানে দেয়ালের পাশে বসে সিগারেট খায়। ভয় কাজ করছে না তার। কবরস্থানে পৌঁছাতেই দেখতে পেল একটা বৃদ্ধা মহিলা বসে বসে কি যেনো করছে। মহিলার শরীর দিয়ে সুগন্ধি আতরের ঘ্রাণ। ঘ্রাণে হাসেমের মাথাটা ধরে যাচ্ছে। এতোক্ষণ বিশ্রি গন্ধ আসলেও আতরের ঘ্রাণে তা বিলিন হয়ে যায়। মহিলার পাশে গিয়ে পেছন থেকে বললো, “এতো রাতে আপনি এখানে কি করেন?” বৃদ্ধা মহিলা জবাব দিলেন না। কিন্তু হাসেমের কথা শুনে তিনি বাচ্চা মানুষের সুরে কান্না করতে লাগলো। অবাক হয়ে আবার হাসেম বললো, “কান্না করেন কেনো এখানে? কিছু হয়েছে আপনার?” মহিলাটি এবার কান্না থামিয়ে চুপ হয়ে যায়। বললো, “আমার মেয়ে আত্মহত্যা করেছে। ফাঁসির দড়িতে ঝুলছে। আমি বয়স্ক মানুষ একা কি করবো বুঝতেছি না।”
মহিলাটি খুব অনুরোধ করে বললো তার সাথে যেতে। হাসেম নির্দ্বিধায় তার পেছন পেছন যায়। যেতে যেতে হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখলো। মাত্র পনেরো মিনিট হয়েছে। কাজ করতেও ভালো লাগছে না। এর মাঝে যদি কারো উপকার করতে পারি ব্যাপারটা ভালোই হয়। এই ভেবেই হাসেম তার পেছন পেছন যাচ্ছে। যেতে যেতে কয়েক ক্ষেত পারি দিয়ে এক উঁচু জায়গায় গিয়ে মহিলাটি দাঁড়ায়। হাসেম অবাক হয়ে চারিদিকে তাকাতে লাগলো। কোথাও গাছ নেই। তাহলে তার মেয়ে কীভাবে ফাঁসি নিবে? পরক্ষণের মহিলাটি বললো, “দেখো বাবা আমার মেয়ে দড়িতে ঝুলে আছে।” হাসেম মহিলাকে পাশ কাটিয়ে সামনে যায়। যা দেখতে পেলো তা দেখে হাসেম হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। পুরো শরীর বেয়ে বেয়ে ঘাম পড়তে লাগলো। দেখে তার স্ত্রী গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছে। তখন মনে হলো এটা শুভনীয় কিছু না। স্ত্রীকে সে বাড়িতে রেখে আসছে।
এখানে এসেই বা কেনো ফাঁসি নিবে? আর তার শ্বাশুড়িও মারা গেছেন প্রায় পাঁচ বছর আগে। কিন্তু মহিলাটি তো ঠিকই দাবী করছে এটা তার মেয়ে। ভাবতে ভাবতেই হাসেমের গায়ের পশম দাঁড়িয়ে যায়। হঠাৎ ঝুলন্ত মেয়েটি বলে উঠে, “হাসেম আমাকে নামাও। খুব কষ্ট হচ্ছে ঝুলে থাকতে। নিচে নামাও আমাকে।” হাসেম চিৎকার করতে চাচ্ছে, কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ আসছে না। দম যেনো কাটার মতো হয়ে গলায় গেঁথে আছে। বৃদ্ধা মহিলা তখন হাসেমের দিকে তাকায়। হাসেম আরো ঘাবড়ে যায়। দেখে তার স্ত্রীর চেহারার সাথে পুরোপুরি ভাবে মিল। আবার ঝুলে থাকা মেয়েটির দিকে তাকায়। কিন্তু সে ওখানেই ঝুলছে। পেছন দিকে দৌড় দিবে, কিন্তু পা চলছে না। দু’পা অবশ হয়ে যায়। চিৎকার করে দৌড় দিল। বৃদ্ধা মহিলাটাও পেছন পেছন দৌড়াতে লাগলো আর বললো, “দাঁড়াও বাবা, আমার মেয়েকে নামিয়ে দিয়ে যাও। তার কষ্ট হচ্ছে। দাঁড়াও বাবা।” দৌড়ানো অবস্থায়-ই হাসেম জ্ঞান হারা হয়।
দুই দিন পর জ্ঞান ফিরে দেখে সে তার বাড়িতে বিছানায় শুয়ে আছে। শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা। হাত পা নাড়াতে পারছে না। মনে হচ্ছে কেউ ভারী রড দিয়ে আঘাত করেছে। শরীরে ক্ষতর চিহ্ন গুলো কালচে দাগ হয়ে আছে। মনে মনে বলছে, এসব ঘটনা স্ত্রীকে বললে সে কিছুতেই বিশ্বাস করবে না। স্ত্রীকে ডাক দিলেন। স্বামীর কণ্ঠ শুনে স্ত্রী দৌড়ে আসে। হাসেম বললো, “আমাকে এখানে কে নিয়ে এসেছে?” “তোমার চিৎকার শুনে তোমার সাথের লোকজন খুঁজতে গেলে দেখে তুমি কবরের উপর শুয়ে আছো। অজ্ঞান অবস্থায় রাতেই বাড়িতে নিয়ে আসে।” হাসেমের গলা শুকিয়ে চৌচির। পেটে ক্ষুধা। স্ত্রীর কাছে পানি চায়লে স্ত্রী পানি দিয়ে বললো, “তোমাকে কতোবার বললাম, কাজ ফাঁকি দিতে যেও না। যারা এরকম করে তাদের ফল ভালো হয়না। প্রমাণ পেলে তো এবার?” অসুস্থতার জন্য এক সপ্তাহ ছুটি নেয়। কিন্তু মালিক তিন দিনের জন্য ব্যবসার কাজে শহরে যাবে। যাবতীয় কাজ হাসেমের উপর ছেড়ে দেয়।
একদিন যেতে না যেতেই হঠাৎ সন্ধ্যা বেলায় রহমান আলী কাজে যাওয়ার সময় বললো মালিক এসেছে। কাজে যেতে বলেছে আজ। কয়েকটা দিন ছুটি কাটিয়ে ভাবলো, কাজে যাওয়াই ভালো মনে করি এখন। না গেলে বেতন কাটতে পারে। এই ভেবেই রহমান আলীর সাথে কাজে যায়। কিছুদূর যাওয়ার পর সামনে চায়ের দোকানে হাসেম দাঁড়ালো চা খাওয়ার জন্য। রহমান আলী বিরক্তি কণ্ঠে বললো, “ভাইজান, আর কতোকাল এভাবে কাজ ফাঁকি দিবেন?” “তুমি যাও, আমি চা খেয়েই আসছি।” রহমান আলী চলে যায়। চা খেয়ে হাসেম হাঁটা শুরু করে। কিছুদূর যাবার পর খেয়াল করে রহমান আলী দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ও তো চলে গেল? বললো, “তুমি যাওনি কেনো?”
“মালিক আপনাকে খুব দ্রুত যেতে বলেছে। সে নাকি অসুস্থ। খারাপ লাগছে তার। বাড়িতে চলে যাবে।” হাসেম দ্রুত চলছে। চলতে চলতে শেষমেশ রঙের ফ্যাক্টরিতে পৌঁছায়। কিন্তু রহমান আলী ফ্যাক্টরির ভিতরে গেলেন না। আবার হাসেম বাহিরে আসে মালিক কোথায় জিজ্ঞেস করতে। রহমান আলী বললো, “মালিক মনে হয় নদীর ধারে খোলা আবহাওয়ায় বসে আছে।” দু’জনে হাঁটা শুরু করে। চলতে চলতে সেই কবরটার কাছে পৌঁছাতেই হাসেমের মাঝে ভয় কাজ করলো। সাথে রহমান আলী থাকায় প্রকাশ করলেন না। নদীর ধারে পৌঁছাতেই হাসেম দেখতে পেলো ওখানে একজন লোক বসে আছে। রহমান আলী বললো,
‘ঐ তো মালিক বসে আছে। আপনি কথা বলেন, আমি কাজ করি গিয়ে।” হাসেম মালিকের পেছন গিয়ে দাঁড়িয়ে বললো,
“এতো সন্ধ্যা বেলায় এখানে একা বসে আছেন কেন?” জবাবে কিছু বললো না। এবার হাসেম পাশে গিয়ে বসে পড়লো। গায়ে ধাক্কা দিয়ে আবার বললো,
“শরীর খারাপ আপনার? বাসায় চলে যাবেন?”
মালিক তার দিকে তাকালো। দেখা মাত্রই হাসেম আকাশ থেকে ছিটকে পড়ে। দেখে রহমান আলী বসা। মুখ থেকে সেই পঁচা রক্ত বের হচ্ছে। খিলখিল করে উদ্ভট অট্ট হাসি দিচ্ছে। সামনে তাকিয়ে দেখে সেই ফাঁসির দড়িতে ঝুলে থাকা মহিলার লাশের একাংশ চিবিয়ে খেয়েছে। হাসেমের জবাব বন্ধ হয়ে যায় সাথে সাথে। কথা বলার মতো শক্তি পাচ্ছে না। উঠেই দৌড় শুরু করলে সামনে পড়ে সেই বৃদ্ধা মহিলাটি। তিনিও বলতে লাগলো, “বাবা, আমার মেয়েকে নামিয়ে দাও। তার কষ্ট হচ্ছে ঝুলে থাকতে।” হাসেম সাথে সাথেই অজ্ঞান হয়ে যায়।
সকাল হলেই হাসেমের জ্ঞান ফিরলো আজ। আগের মতো আজ শরীরে ব্যথা নেই। মাথায় যন্ত্রনা নেই। কিন্তু বাড়ি ভর্তি লোকজন। তার পাশে রহমান আলীও বসা। রহমান আলীর কাছে জানতে চায়লে সে বলে, আমার তো আজ ছুটি ছিল। হাসেম থ হয়ে চুপচাপ বসে রইলো। তাহলে কে এসে আমাকে নিয়ে গেল? মালিক এসেছে এই কথাটাই বা কে বললো? আমি কাজ ফাঁকি দেই এটাই বা কে বলবে? উত্তর খুঁজে পেলো না। বিস্তারিত সব কিছু খুলে বললো। গ্রামের এক বিজ্ঞ আলেম এনে তাবিজ, ঝারফোঁক করলে কিছুটা সুস্থ হয়। শরীর বন্ধ করে দিয়ে হাতে তাবিজ পেছিয়ে বললো, “অশরীরী আত্মা ভর করেছিল।
একা একা কাজে যাওয়ার দরকার নাই। সাথে যারা কাজ করে তাদের সঙ্গে যাবেন।” হাসেম এর ব্যাখ্যা জানতে চায়লে আলেম বললো, “আপনি কাজ ফাঁকি দিতে যেয়ে নিজের বিপদ ডেকে এনেছিলেন। অদৃশ্য আত্মার শরীরের উপর হাঁটাচলা করেছিলেন তার জন্যে তারা আপনার উপর প্রতিশোধ নিতে চায়। কাজ ফাঁকির ফল কখনই ভালো হয়না। যেটা আপনার জন্য মঙ্গল মনে করেন সেটা অন্যের ক্ষতিকারক।” হাসেম জবাবে কিছু বললো না। নিজের মাঝে বোধ আসে। সত্য পথে চলার এক স্বাদ আর মিথ্যে বলে টাকা উপার্জন করার ভিন্ন স্বাদ।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত