এক টুকরো ভাবনা

এক টুকরো ভাবনা
বড় আপার যখন তৃতীয় সন্তানটিও মেয়ে হলো তখন আপা খুব ভেঙে পড়লো। হসপিটালের বিছানায় শুয়ে থেকে সদ্য জন্ম নেয়া মেয়েটির কপালে আলতো চুমু এঁকে দিয়ে আপা কান্নায় ভেঙে পড়লো।এ কান্না নিরব এবং নিভৃতের কান্না।এ কান্নার আওয়াজ আর কেউ শুনতে পায় না। কিন্তু টপটপ করে গড়িয়ে পড়া চোখের জল কণা দেখলেই অনুভব করা যায় কতটা দুঃখের কান্না এটা।আপা মেয়ের দিকে বড় মায়াময় চোখে তাকিয়ে ভেজা গলায় বললো,’মারে, তুই তো দুনিয়ায় আসছস ঠিকই কিন্তু আমার জন্য যে কতটুক দুঃখ নিয়ে আসছস তা আল্লাহই ভালো জানেন!’
বলে ডুকরে কেঁদে উঠলো আপা।পাশে থাকা আম্মা তখন আপার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,’বিপাশা,কান্দস কেরে মা,আর কি সব অলক্ষুইনা কথাবার্তা কস!এই মাইয়া তোর লাইগা দুঃখ নিয়া আসবো কিসের লাইগা?এই মাইয়া তোর লাইগা সুখ নিয়াই আসছে।দেখ তাকাইয়া দেখ,তোর মাইয়া কেমন কইরা হাসে!’
বড় আপা তার মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলো তার মেয়েটার দু ঠোঁটে হাসি হাসি ভাব। মাত্র ঘন্টা খানেক আগে জন্ম নেয়া শিশুর মুখে এমন হাসি ভাব থাকবে কেন?বড় আপা আম্মার কাছে কেঁদে কেঁদে বললো,’এইটা হাসি না আম্মা,এইটা আমার দুঃখের লক্ষন। মাইয়ার বাপের কত শখ ছিল এইবার ছেলে সন্তান হবে।সে মনে মনে নামও ঠিক করে রেখেছিল।ওমর।সে রোজ দিন রাতে ঘুমানোর আগে আমার পাশে শুয়ে তার অনাগত সন্তান নিয়ে কথা বলতো।সে বলতো,’ বিপাশা, আমাদের ওমর ঠিক খলিফা ওমরের মতো সাহসী আর নেকবান্দা হইবো।বাপ মার খুব ইচ্ছে ছিল আমি আলেম হবো। সেই ইচ্ছে আমি পূরণ করতে পারলাম না। কিন্তু আমার ছেলে ঠিক আলেম হবে। ওরে আমি মাদ্রাসায় পড়াবো।’ আম্মাগো, মাইয়ার বাপে খবর পাইয়া বোধহয় ভীষণ রাগ করছে! সেই রাগের কারনে বোধহয় এখনও হসপিটালে আসে নাই।আর আসবোও না মনে হয়।’
কথাগুলো বলে ফের কান্নায় ভেঙে পড়লো আপা। নার্স এসে নিষেধ করে গেলো কান্না করতে। কিন্তু বড় আপা কান্না থামাতে পারলো না মোটেও। সন্ধ্যা হয়ে গেলেও যখন দুলাভাই কিংবা তাদের বাড়ির কেউ হসপিটালে এলো না তখন আমরাও ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়লাম। আম্মাকে দেখলাম একেবারে চুপ হয়ে যেতে। মাগরিবের নামাজ পড়ে আমি মসজিদ থেকে এসে দেখলাম আম্মার চোখও কেমন ভেজা।কার কাছে নাকি সংবাদ পেয়েছেন দুলাভাই এই সন্তানের মুখ দেখবেন না।কথাটা কে বলেছে কে জানে। এইসব কথাকে উড়া কথাও বলা যায়। কিন্তু দুলাভাই কিংবা তাদের বাড়ি থেকে যেহেতু মেয়ে জন্মাবার পাঁচ -ছয় ঘন্টা পরেও কেউ এলো না তখন এই কথাকে অনেকটা সত্যিই ধরে নেয়া যায়। আম্মা বড় অস্হির হয়ে আমার কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন,’আসলাম, ভালো ঠেকতাছেনারে বাপ, আমার মাইয়ার কপালে কী কলঙ্কই লাগলো নাকি আল্লাহ জানে!’
আম্মার কথা শেষ হতে পারলো না এর মাঝেই দুলাভাই এসে উপস্থিত হলেন।তার চোখ মুখ কেমন লাল হয়ে আছে।তার উপস্থিতি আমাদের আরো ভয় পাইয়ে দিলো।আমরা আশঙ্কা করতে লাগলাম না জানি দুলাভাই কী না কী বলেন এখন!বড় আপাকেও দেখলাম শুকনো মুখে এলোমেলো হয়ে তাকিয়ে থাকতে। এইসময় দুলাভাই বড় আপার দিকে এগিয়ে গেলেন দ্রুত পায়ে।আমরা ভীত সন্ত্রস্ত চোখে তাকিয়ে থাকলাম শুধু। দুলাভাই গিয়েই বিছানা থেকে একটানে মেয়েকে কোলে তুলে নিলেন। আমার বুকটা যেন মুহূর্তের জন্য কেঁপে উঠলো ‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌হঠাৎ। ভাবলাম কী জানি কী ঘটে এখন। কিন্তু দুলাভাই এক অদ্ভুত কান্ড করলেন। মেয়ের কপালে আলতো করে চুমু খেয়ে দুলাভাই তার পকেট থেকে একটা সোনার চেইন বের করলেন। সেই চেইন নিয়ে হুট করে বড় আপার গলায় পড়িয়ে দিয়ে মৃদু হেসে বললেন,’এটা গড়াতে অনেকটা সময় চলে গেল। তাছাড়া আমার কাছে টাকাও ছিল না।টাকা ম্যানেজ করতে অনেক দেরি হয়ে গেল।আমার দেরি করে আসার জন্য সরি!’
আপা বড় অবাক হয়ে বললো,’আপনি হঠাৎ এটা গড়াতে গেলেন কেন? আচ্ছা আপনি কী রাগ করেননি?’ দুলাভাই হু হু করে হেসে উঠে বলেন,’ধুর বোকা।রাগ করবো কেন আমি।এতো বড় পুরস্কার পাওয়ার পরেও যে রাগ করে সে তো আহাম্মক!’ আপা বললো,’আপনার যে ছেলে সন্তানের খুব শখ ছিল!ছেলে তো হলো না। হয়েছে মেয়ে!’ দুলাভাই তার মেয়ের কপালে আবার একটা চুমু খেয়ে বললেন,’এটাই তো আমার পুরষ্কার। আমার জান্নাত। আমাদের নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,যার তিন মেয়ে আছে তার জন্য জান্নাতের দরজা খোলা। আমি জান্নাত পেয়েও রাগ করবো কেন?’
বড় আপা দুলাভাইর এমন সুন্দর কথাগুলো শুনে ফের কেঁদে উঠলো।আম্মাকেও দেখলাম আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে।আর আমি জানলা দিয়ে তাকিয়ে দূরের পথচারীদের হাঁটাচলা দেখতে দেখতে ভাবলাম, পৃথিবীর সকল পিতাগুলো যদি এমন করে ভাবতে পারতো তবে সমাজ সুন্দর না হয়ে কী করে এমন নোংরা থাকতে পারতো!
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত