জাউরা বেডায় মরেও না, সারাদিন শুধু হোতায় থাকে। কাম কাইজের কোন খরব নাই। ঘরে যে কোন দানা পানি নাই, তার কোন চিন্তা আছে ? চিল্লাইবিনা মাগী, জানোসনা লক ডাউনে রিকশা লইয়া বাইরাইলে পুলিশ পিডায়?
পিডায়লে পিডায়বো, তবুও ঘরে খাওন চাই। তরে যে কইছিলাম মেন রাস্তায় যা, কত মানুষ ত্রান দেয়, গিয়া নিয়ায়। হ তারা তো তোমার বাপ লাগে, ত্রান নিয়া আমার জন্য বইসা রইছে? দেখ মাগী তুই কিন্তু বেশি উল্টা পাল্টা কইতাছত। উল্টা পাল্টার দেখছত কি বেডার পো, দুপুরের আগে খাওন না পাইলে তোরে চাবাইয়া খামু। কথাটা বলা শেষ হয়নি, তার আগেই রশিদ মিয়া বউয়ের চুল ধরে, ঘুমুর ঘুমুর দুইটা কিল বসিয়ে দিয়েছে বউয়ের পিঠে। ঘটনার আকস্মিকতায় সালেহা কাঁদতে ভুলে গেছে। যখনই পিঠে ব্যাথা অনুভূত হলো, তখনই চিৎকার দিয়ে বলতে লাগলো, কেডা আছ আমারে বাঁচাও আমারে মাইরা ফালাইলো।
মুখ কালা করে রিকশার গ্যারেজে বসে আছে রশিদ মিয়া। মন মেজাজ সাংঘাতিক বিগরে আছে, তবে বউকে মারা ঠিক হয়নি। এতো চোপা করলে মাথা ঠিক থাকে নাকি আর বউরে দোষ দিয়াই বা লাভ কী, পেটে খাওন না থাকলে কারোই মাথা ঠিক থাকে না। কিরে রশিদ্দা, প্যাঁচার লাহান মুখ কইরা এখানে বইসা রইছত ক্যান ? রিকশার চাবি দেন, রিকশা লইয়া বাহির হমু। আমারে তো পাগলায় কুত্তায় কামড়াইছে, তোরে চাবি দেই আর পুলিশে আমার রিকশাটা ভাঙা দেক। কিচ্ছু হইবো না মহাজন, ঘরে এক ফোটা দানা পানি নাই, সকাল থেকে কিছু খাই নাই। রাগে বউরে উল্টা মাইরা থুইয়া আইছি। পারবি তো এই কামডাই করতে। বউ পিডানি ভালো মানুষের কাম না। আচ্ছা যা পুলিশ দেইখা শুইনা গাড়ি চালাইছ আর শোন, জমাডা ঠিক মতো দিছ, চুধুর ভুধুর কিন্তু করিছ না।
সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পরলেও রোদের তীব্রতা কমেনি। পিঠের চামড়া গুলো যেন বাষ্পায়িত পানির মতো ফুটছে। রাস্তায় তেমন লোকজন নেই, আর যাও দুই একজন আছে, নেয্য ভাড়া দিতে চাইছে না। যাত্রী থেকে রিকশার সংখ্যা অনেক বেশি। পঞ্চাশ টাকার ভাড়া বিশ ত্রিশ টাকা মূলাচ্ছে। কোন উপায় না পেয়ে সেই ভাড়াতেই দুইটা খেপ মেরেছে রশিদ কিন্তু এখনও রিকশার জমার টাকাই উঠেনি, বাজার সদাই করবে কী দিয়ে, অথচ বেলা বয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে দুইবার পুলিশের দৌঁড়ানি খেয়েছে, ভাগ্যিস লাঠির বারি পিঠে পরেনি। খালি রিকশা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে রশিদ, সামনেই একটা ভ্যানকে ঘিরে জটলার মতো দেখতে পায় সে । সম্ভবত ত্রান দিচ্ছে। কিছুটা আশান্বিত হয় রশিদ, যদি কিছুটা ত্রান পাওয়া যায় তবে আজকের মতো চলে যাবে হয়তো। যারা ত্রান দিচ্ছে তারা চাচ্ছে সিরিয়াল মতো দেওয়ার জন্য কিন্তু কেউ কারো কথা শুনছে না। কার আগে কে নেবে এই নিয়ে এক প্রকার হুলুস্থুল বেধে গেছে। কারন ত্রান অপ্রতুল, মানুষ অনেক বেশি।
হাত বাড়িয়ে রশিদ যারপরনাই চেষ্টা করছে এক প্যাকেট ত্রান সংগ্রহ করার জন্য, কারণ ত্রানের প্যাকেট গুলো দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। সর্বশেষ প্যাকেটটিতে হাত পরেছে তিন চারজনের। জোরাজুরির এক পর্যায়ে ছিঁড়ে গেছে ত্রানের প্যাকেট । মুক্তোর দানার চাল গুলো ছড়িয়ে গেছে রাস্তায়। পিংপং বলের মতো আলু পেঁয়াজি গুলো লাফাচ্ছে।
রাস্তার পরে যাওয়া চাল গুলো কুড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে রশিদ মিয়া। ঘাড়ের গামছায় কিছু চাল উঠাতে পেরেছে, সাথে দুই চারটা আলু। হয়তো একবেলা হয়ে যাবে কিন্তু বালু মিশ্রিত চালের ভাত মুখে রুচবে কিনা রশিদের জানা নাই।
মুখ গুমরাহ করে মহাজনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে রশিদ মিয়া। একটা একটা করে টাকা গুলো গুনছে রিকশার মহাজন। টাকা গোনা শেষ হতেই চোখ তার কপালে উঠে গেছে। কিরে আর কই ? এখানে তো মাত্র ষাইট টেকা ! সারাদিনে এই ষাইট টেকেই খেপ মারছি। আমার কাছে আর এক টাকাও নাই। রাস্তা ঘাটে কোন মানুষজন নাই আর এই চাউল গুলো রাস্তা থেকা কুড়াইয়া আনছি। মিথ্যা কথার জায়গা পাস না হারামজাদা। এর লাইগাই তগো রিকশা দিবার চাইনা। রিকশা একবার নিতে পারলেই ধানাই পানাই শুরু হইয়া যায়। মিথ্যা কথা কই না মহাজন, বিশ্বাস না হইলে শরীল তালাশ কইরা দেখেন? আরে যা, ভাগ এখান থেইকা, কাল আবার আসিস, রিকশা পাছায় ভইরা দিমু।
ঘরের খুঁটিতে হেলাল দিয়ে বসে আছে সালেহা। মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে পেটে দানা পানি পরে নাই সারাদিনে । রশিদ মিয়াকে দেখেও এক বিন্দু নড়েনা সালেহা। যেন নির্জীব কোন মৃত কঙ্কাল। এই খানে কয়টা চাউল আর আলু আছে রাইন্দা ফালা। চাউল গুলা ভালো করে ধুইয়া নিছ। ত্রানের চাউল, রাস্তার থেকা কুড়াইয়া আনছি। সালেহা কোন কথা বলে না, গামছায় পুঁটলি করা চাউল গুলো নিয়ে রান্না করার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠে, কিন্তু একি চাউলে এতো পাথর আর বালু ক্যান ? এগুলা কি আনছেন আপনে, চাউলের থেকা তো বালুই বেশি। একটু কষ্ট কর বউ, ভালো কইরা বাইছা তারপর রান্না কর। তিন চাইর জনের সাথে মারামারি কইরা ত্রানের চাউল গুলা রাস্তা থেকা কুড়াইয়া আনছি। রিকশা চালাইয়া সারাদিনে কোন খেপ পাই নাই, আর যা পাইছি তা জমার টাকাই উঠে নাই। একটু কষ্ট কর বউ, দেখি আগামীকাইল অন্য কোন কাম পাইনি।
আলু ভর্তা আর ভাত নিয়ে দুইজন মুখোমুখি খেতে বসেছে কিন্তু কারো মুখে কোন কথা নেই। অজানা এক কারনে সালেহা ভাত চিবিয়ে না খেয়ে গিলে খাচ্ছে, তার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পরছে কিন্তু রশিদ, সালেহার চোখের পানির হেতুটা ঠিক বুঝতে পারছে না। কারণ সে এখনও ভাত মুখে তুলেনি। রশিদ মিয়া যখনই ভাত মুখে তুলেছে তখনই দাঁতের নিচে কিচকিচ করে করে উঠেছে বালি। না পারছে ফেলে দিতে পারছে গিলতে। না, পেটে ক্ষুধা থাকলে পাথরও চিবিয়ে খাওয়া যায়, আর এ তো সামান্য বালু মিশ্রিত ভাত। সেও সালেহার মতো ভাত গুলো গিলতে শুরু করেছে। সালেহার মতো হয়তো তার চোখে পানি নেই কিন্তু হৃদয়ের গভীরে কষ্টের নদী বয়ে যাচ্ছে। কেন তারা গরিব হয়ে জন্মালো ?? কেন তাদের বাঁচার মতো খাবার নাই ??
গল্পের বিষয়:
গল্প