পরিশোধ

পরিশোধ
— এসব অনুষ্ঠানে অরণীর কখনোই আসা হয় না। বন্ধু রিমার অনুরোধে এসেছে। অথচ আসার পর দেখে রিমা কোথাও নেই। ফোন দিয়ে জানা গেল,রিমা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। অরণী ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু সামনের দিকটায় ভালো একটা সিটে বসার ব্যবস্থা হয়ে যাওয়াতে সিদ্ধান্ত বদলালো সে । অনেক নামী শিল্পীরা এসেছেন কনসার্টটিতে। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার পর অরনীর বেশ ভালোই লাগছিল। প্রিয় শিল্পীদের গাওয়া গানগুলো মোহিত হয়ে শুনছিল। বেশ কয়েকটি গান পরিবেশনের পর আধঘন্টার ব্রেকের একটি ঘোষণা দেওয়া হলো। এতক্ষণ একা অপেক্ষা করা বিরক্তিকর ভেবে অরনী চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিল আর তখনই ঘটল অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটি….
– অরণী যাবার জন্য সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই একটা ছেলে হুট করে অরনীর ঠিক পেছনে এসে ওর গা ঘেষে দাঁড়ালো। এত কাছে যে তার নিঃশ্বাস এসে অরনীর পিঠে লাগছিল। ছেলেটি অরনীকে বলল, ‘ আপনি এখন দয়া করে উঠবেন না, কিছু বলার আছে আপনাকে। অরনী ঝট করে ঘুরতে গেলেই বাধা পেল। ছেলেটি অরনীর হাত ধরে বলল, ‘ঘুরে দাঁড়াবেন না প্লিজ।’
অপরিচিত কোনো পুরুষ এভাবে ওর হাত চেপে ধরায় ভয়ানক রাগে অরনীর মাথা ঝাঁ,ঝাঁ করে উঠল। ও একটু ঘুরেই চটাস করে চড় বসিয়ে দিল ছেলেটির গালে। ইতিমধ্যেই ব্যাপারটি বোঝার জন্য অনেক দর্শকই ওদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিতে শুরু করেছে। তবু ছেলেটি তার জায়গা থেকে নড়ল না। অরনী অসহায় হয়ে পড়ল। চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হল ও । কিন্তু হাঁটতে শুরু করার আগেই অরনী টের পেল, ছেলেটি তার দুহাত দিয়ে ওর কোমরে কিছু একটা বেধে দিল তড়িৎ গতিতে আর মুখে শুধু বলল, ‘এটা রাখুন।’ ছেলেটির দুঃসাহস দেখে অরনীর জ্ঞান হারাবার মত অবস্থা। সে চিৎকার করে উঠল! আশেপাশের কিছু জনগণ ততক্ষণে চলে এসেছে ছেলেটির উপর ঝাপিয়ে পড়তে।
অরনী লজ্জায় মরে যাচ্ছিল।
কাঁদতে কাঁদতে তখুনি স্থান ত্যাগ করল ও। যেতে যেতে টের পাচ্ছিল গনপিটুনির ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে পেছনে। ওর আফসোস হল না মোটেই। এসব ছেলেদের এমন শাস্তিই হওয়া উচিত। কনসার্ট থেকে বের হয়েই নিজের দিকে তাকাল অরনী। খুলে নিল ছেলেটির বেধে দেওয়া কাপড়। খুলতে গিয়ে বুঝল ওটা ছেলেটির পরনের টিশার্ট । অবাক হলো অরনী। তার চেয়েও তাকে অবাক হতে হল, রাস্তায় লোকজন ওকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করেছে । একটু দূরে দাঁড়ানো কয়েকটি ছেলে তো বিশ্রীভাবে হাসতে লাগল। অরনী এবার ব্যাপারটা গভীর ভাবে ভাবতে গিয়েই হোঁচট খেল, আর তখনই টের পেল তার শারীরিক বিশেষ প্রক্রিয়া। একটুখানি আড়াল খুঁজে নিয়ে দ্রুত ও ছেলেটির দেওয়া টিশার্টটি আবার বেধে নিল পেছন দিকটায় ঝুলিয়ে।
– ভেবে কুল কিনারা পেল না অরনী। মেনস্ট্রেশন তার এক মাস পর পর নির্দিষ্ট তারিখেই হয়। অথচ শেষবার হওয়ার তারিখ থেকে মাত্র পনেরো দিন পার হয়েছে এবার। তাই এই সম্ভাবনাটি এতক্ষণ তার মাথায় আসেইনি। ইতিপূর্বে এমনটি কখনো হয়নি। তাই কি করেই বা ও জানবে এমনটি ঘটেছে ওর সাথে? এতক্ষণ শারীরিক অনূভূতিটাও ওভাবে আসেনি ওর। অসহায় দৃষ্টিতে অরনী চারদিকে তাকাল।
এরপর ট্যাক্সিতে উঠে পড়ল। চোখ ভিজে উঠছিল বার বার ওর। নিজের এমন লজ্জাজনক প্রকাশ মানুষের সামনে! অন্যদিকে ওর জন্য কনসার্টের ছেলেটির দুরবস্থা ভেবে দিশেহারা আর পাগল পাগল লাগছিল অরনীর। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল কনসার্টে ফিরে গিয়ে ছেলেটির অবস্থা দেখতে আর দুঃখপ্রকাশ করে তার কাছে নতজানু হয়ে ক্ষমা চাইতে। কিন্তু এই অবস্থায় কোথাও তো যাওয়া সম্ভব নয় ওর। এমন দূর্বিষহ অসহায় অবস্থা যেন কোনো মেয়ের কখনো না হয়! মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠল অরনী…..
একটা খোলা ময়দানে অনুষ্ঠিত হয়েছিল কনসার্ট। আজ সেখানে গিয়ে গতকালের অনুষ্ঠানে আসা কোনো ব্যক্তির হদিস পাওয়া একেবারেই অসম্ভব। তবুও অরনীর মন মানছিল না। পরদিন সকাল হতেই স্থানটিতে পৌঁছালো ও। একদম ফাঁকা সুনসান একটি মাঠ মৃতের মত নীরব হয়ে আছে। কালকের জমজমাট আসর, বিপুল সংখ্যক মানুষের সোরগোল,প্রাণে প্রাণে আনন্দের সঞ্চার – এসবের ছিটেফোঁটা ও আজ নেই। কি অসহ্য নীরবতা! অরনীর বুকের ভেতরে হঠাৎ কেউ যেন নিষ্ঠুর হস্তক্ষেপে দুমড়ে মুচড়ে ফেলছিল! না জানি কতগুলো লোক ছেলেটির উপর চড়াও হয়েছিল! কতটা আঘাত করে তবে ক্ষান্ত হয়েছে!
কেন যে একবার ছেলেটির কথা শুনল না, বোঝার চেষ্টা করল না ও ! এত বড় পৃথিবীতে কোথায় খুঁজবে এখন ছেলেটিকে ও। নিজের প্রতি এই মুহূর্তে খুব ঘৃণা জমা হচ্ছিল অরনীর। মনে হচ্ছিল, অতিশয় ক্ষুদ্র কীট পতঙ্গের মত তার সত্ত্বা। মনে হল, তার মত মানুষেরা যখন পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে , তখন এই পৃথিবীর কিছুই যাবে আসবে না। কিন্তু একজন নারীকে লজ্জাজনক অবস্থার হাত থেকে বাঁচাতে যে মানুষটি নিজের অসম্মানিত আর আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার সম্ভাবনাটুকুকেও তাচ্ছিল্যভরে উড়িয়ে দিতে পারে, সেরকম মানুষগুলোর প্রস্থানে এ জগত ক্ষতিগ্রস্ত হয়….তিন মাস পরের কথা……
– পৌষের এক পড়ন্ত বিকেল। সকাল থেকেই কুয়াশা ঘেরা অন্ধকারাচ্ছন্ন সমস্তটা দিন। তাপমাত্রা অনেক নীচে নামছে কদিন থেকে। আজ ও কনকনে ঠান্ডা। জীবনের স্বাভাবিক কাজকর্ম কিছুটা ব্যহত হচ্ছে। খুব দরকার না হলে কেউ বাইরে যাচ্ছে না। অথচ এমন একটি দিনে অরনীর বাবা আর মা একটি চক্ষু হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারের সামনে অপেক্ষমান ! ক্রমাগত কেঁদে চলেছেন অরনীর মা। বাবা তাকে সামলাতে চেষ্টা করছেন। ভেতরে তাদের একমাত্র মেয়ে, যে স্বেচ্ছায় ঘন্টাখানিক আগে অপারেশনের মাধ্যমে তার চোখ দুটোর অন্ধত্ব বরণ করেছে। নিজের চোখ সে দান করেছে কোনো এক অসহায় রোগীকে। একার সিদ্ধান্তে কাজটি করেছে সে। এর জন্য তাকে প্রচুর মিথ্যে বলতে হয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। মিল্টন নামে ওর এক বন্ধুকে একমাত্র এটেন্ডেন্স সাজিয়ে হাসপাতালের পুরো ব্যাপারটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়েছে। এ কাজে বন্ধুটিকে রাজী করাতেও অবশ্য খুব কম ঝামেলা হয়নি। অপারেশনের পর হাসপাতাল থেকে একজন নার্স অরনীর বাবা মাকে ফোন করেছিল, আর সেটা করার জন্য অরনীই তাকে অনুরোধ করেছিল।
– অরনীর কাছে যাবার সুযোগ হলে মা ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বার বার আহাজারি করতে লাগলেন। ও কেন এমন একটি কাজ করল, সে প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করতেই থাকলেন। বাবা কান্না সংবরণ করে ওর হাত দুটো ধরে শুধু একটা কথাই বললেন, ‘প্রত্যেকটা মানুষেরই তার নিজের ব্যাপারে নিজ সিদ্ধান্তে কিছু করার আগে একবার ভেবে নেওয়া উচিত, তার জীবনটা শুধু তার একার বাঁচার জন্য নয়, তার জীবনটা তার পরিবারের সদস্যদের ও বাঁচা মরার একটি অংশ।’
গত এক মাস ধরে অরনী অন্ধের জীবন যাপন করছে। আজকাল আর কিছুই করার নেই তার । কোথাও যাবার নেই। চার দেয়ালের ভেতরেই জীবন কাটছে। তবে কেন যেন খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে না এসবে ওর। খুব অবাক হয় অরনী এসব ভাবলে। সে এমনটা ছিল না কখনোই। সেও আর দশটা স্বাভাবিক মানুষের মতই জীবনের রঙগুলো উপভোগ করতে ভালোবাসত, অন্ধকারকে বর্জন করে ঝলমলে আলোতেই উদ্ভাসিত হতে চাইত। কাউকে চোখ দান করার মত উদারতা তার স্বপ্নেও ছিল না।
শুধুমাত্র একটি মোটিভেশনাল স্পিচ তার চিন্তাকে একদিন নাড়িয়ে দিয়ে গেল আর সে বদলাতে শুরু করল। অরনীর ইদানীং মনে হয়, ঐ স্পিচটা আসলে বোধহয় কোনো স্পিচ ছিল না, বরং ছিল এক সাইকোথেরাপি, যা ব্যক্তিকে মোহাচ্ছন্ন করে তার ব্রেনকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং তখন তাকে দিয়ে যা খুশি করানো হয়। ফলে অরনীও সেই থেরাপীর সামিল হয়ে চোখ দিয়ে দিল। তারপর আবার ভাবে, আচ্ছা শুধুই কি একটা বক্তব্য শুনেই ও এমনটা করেছে? তাহলে তো আরো অনেকেই চোখ হারিয়ে বা কিডনী হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে আনন্দ পেত ! তবে যেটাই হোক, জাহিদ স্যারের সাথে একবার দেখা করা দরকার। তার মানব সেবামূলক মোটিভেশনাল ক্লাসটা কতটা মূল্যবান বা কার্যকরী ছিল, তা তাকে দেখানো দরকার……
– পরদিন অরনী বাইরে যাওয়ার জন্য রেডি হতে শুরু করলে, মা ক্রমাগত একই কথাই বিভিন্নভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলে যাচ্ছেন, যে তার একা বাইরে যাওয়া ঠিক হবে না, সেও যেতে চায় সাথে। অরনী কোনো কথার জবাব দিচ্ছিল না বলে মা ক্ষেপে উঠলেন। শেষমেষ অরনী শুধু একটা কথাই বলতে বলতে বের হল , ‘ মা, রফিক রয়েছে আমার সাথে,তাহলে আবার আমি একা হলাম কি করে? ‘ মাকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে অরনী রিকশায় উঠে বসল, রফিকের সাহায্যে। রফিক রিক্সা চালায়। বয়স সতেরো আঠারো হবে। রফিকের মা অরনীদের বাড়িতে বহু বছর ধরে কাজ করছে। রফিককে তাই ছোট থেকেই চেনে অরনী।
বিশ মিনিটের মধ্যে ওরা পৌঁছে গেল মোটিভেশনাল ক্লাবে। আগে যেহেতু অরনী এখানে নিয়মিত আসত,তাই সবাই ওকে চেনে। সবার সাথে অনেক দিন পর কথা হবে ভেবে খুব ভালো লাগছিল অরনীর। কিন্তু কোনো কারণে আজ ক্লাবটি বন্ধ। তাই কারো সাথেই দেখা হল না। খুব খারাপ লাগছিল অরনীর। ভেবেছিল জাহিদ স্যারের সাথে কথা বলে ও নিজের মধ্যে আরো শক্তি সঞ্চয় করতে পারবে,বেঁচে থাকার মনোবল বাড়াতে পারবে। জাহিদ স্যারের বাসার ঠিকানা জানত অরনী। কয়েক মুহূর্ত ভেবে তার বাসায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল ও। রফিক ঠিকানা শুনে শুনে সে মোতাবেক পৌঁছে ও গেল সঠিক স্থানে। কিন্তু জাহিদ সাহেবের বাসার সামনে গিয়ে দেখা গেল,সেখানেও একটি বড় তালা ঝুলছে।
মন আরো বেশি খারাপ হল অরনীর । চোখ হারানোর পর এই প্রথম সে বাইরে বেরিয়েছে। বাড়ি ফিরতেও এই মুহূর্তে ইচ্ছে হচ্ছিল না। স্যারের বাসা থেকে একটু দূরেই একটা পার্ক রয়েছে। সেখানে যেতে বলল ও রফিককে । রফিক ওকে একটা বেঞ্চে বসিয়ে দিয়ে বের হয়ে পার্কের গেটে রিকশার সিটে গা এলিয়ে দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।
অরনীর খুব ভালো লাগছিল। পাখির কিচিরমিচির, কিছু বাচ্চাদের কোলাহল, বাদামওয়ালার হাঁক, সব মিলিয়ে ওর সেই পরিচিত দুনিয়া। ও এমন ভাবে অনুভব করছিল ব্যাপারগুলোকে যে এক মুহূর্তের জন্য ভুলেই গেল যে ওর চোখ নেই। যেন সব কিছু ওর দৃষ্টির সামনেই ঘটছে। বুক ভরে শ্বাস নিল অরনী।
প্রকৃতিকে অনেকটা বেশিই ভেতরে ধারণ করা ওর খুব দরকার! খুব! অরনী ঠিক করল, এখন থেকে প্রায়ই সে এখানে এসে কিছুটা সময় কাটাবে। এতে ওর জীবন যাপনের একঘেয়েমি দূর হবে! পার্কে এভাবে কিছুক্ষণ বসে থাকার পর হঠাৎ কারো কথায় অরনীর বিমোহিত ভাবটা কাটল, ‘এক্সকিউজ মি,আমি কি একটু আপনার সাথে কথা বলতে পারি? ‘ অরণী চমকে উঠল। গলাটা পরিচিত লাগছিল। তবে এখন আর চট করে কাউকে সন্দেহ করে না সে। সবার কথা মন দিয়ে শোনার পর সিদ্ধান্ত নেয়। তাই তাকে কথা বলার সুযোগটা দিল অরনী, ‘জ্বি বলুন।’
— আমি শিপন, আপনি ?
— অরনী।
— আমি কি বসব আপনার পাশে একটু ?
— আমি জানি,আপনি কথা শুরু করার আগেই এখানে বসে পড়েছেন। বসুন।
— ধন্যবাদ। আচ্ছা, আপনি মোটিভেশনাল ক্লাস কেন করতেন? ইউ হ্যাড ডিপ্রেশন ? বিস্মিত হলো অরনী, ‘ আপনি কিভাবে জানলেন আমি ওখানে যেতাম?’
— আমি দেখেছি মাঝেমধ্যে আপনাকে ওখানে।
— ওহ! আপনি কি করেন?
— এম,বি,এ কমপ্লিট করে বেকার জীবন যাপন।
— টাফ টাইম! স্ট্রেস অব জব ইন্টারভিউ!
শিপন মৃদু হাসল, ‘ জ্বী না, সে অভিজ্ঞতা অর্জন করার সৌভাগ্য বোধহয় হবে না। বাবার বিজনেসগুলো ওয়েলকাম করার জন্য মুখিয়ে আছে, সেগুলোতেই ইনভলভ হতে হবে!’
— ওহ আচ্ছা!
— আপনি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছিলেন না। কিভাবে হলেন?
— দুঃখিত। আমাকে এখন যেতে হবে।
— আপনাকে একটু এগিয়ে দেই আমি ?
— ধন্যবাদ! তার দরকার হবেনা। আমি চলে যেতে পারব।
– অরনী হাঁটতে হাঁটতে টের পেল শিপন তার পাশেই হাঁটছে। অরনী অবাক হল, ‘নিষেধ করলাম, তাও এসছেন?’
শিপন কিছু বলল না। মাত্র কয়েক কদম হাঁটার মধ্যে উঁচু নীচুতে অরনী দুবার হোঁচট খেল, দুবারই শিপন ওর হাত ধরে ওকে সামলে নিল। পার্কের বাইরে চলে এল ওরা। রিকশায় উঠতে উঠতে অরনী বলল, ‘ ধন্যবাদ শিপন । আপনার সাথে পরিচিত হয়ে ভালো লাগল। চলি।’
– রিক্সা কিছুদূর যাওয়ার পর রফিক হঠাৎ বলে উঠল, ‘আপা একটা কথা বলব?’
— হুম বল।
— ঐ লোকটাকে আপনি চেনেন?
— আজই প্রথম পরিচয় হল। কেন বলতো?
— আমি উনাকে কয়েকবার আপনাদের বাড়ির সামনে দেখেছি।
— কবে?
— গত কিছু দিন ধরে।
— হুম।
— আপা,আর একটা কথা। উনার নাম শিপন বললেন না আপনি, কিন্তু উনার নাম এটা নয়।
— তুই কিভাবে বুঝলি?
— উনার সাথে কেউ একজন ছিল, সে উনাকে অন্য কি যেন নামে ডেকেছিল।
— হুম হতে পারে। এক মানুষের দুটো নাম ও থাকে অনেকসময়।
– রফিকের বিস্ময় থামাতে অরনী স্বাভাবিক আচরন করলেও তার নিজের ভেতরে আসলে প্রচন্ড বিস্ময় জমা হতে শুরু করল অরনীর ফেরার অপেক্ষায় বাবা বাড়ির বাইরে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ওকে দেখে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। ও ঠিক আছে কি না,রাস্তায় কোনো অসুবিধা হয়েছে কি না, কি কি করেছে বাইরে গিয়ে, এসব শুনে বললেন, ‘ভালোই তো, পার্কটিতে তোমার ভালো লাগলে আমি মাঝেমধ্যে তোমাকে নিয়ে যাব ওখানে। ‘ অরনী মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে নিজের রুমে চলে গেল। ফ্রেশ হবার পর ব্যালকনিতে এসে বাবার সাথে বসল চা খেতে। বাবা ওর পাশে সরে এসে বসে বললেন, ‘জানিস, আজ অনেক দিন পর আমি একটু ভালো আছি।’ অরনী চুপ করে আছে দেখে বাবা বলে উঠলেন, ‘জিজ্ঞেস কর,কেন ভালো আছি!’
— বাবা,বলতে শুরু করো তো! আমি জিজ্ঞেস না করলেও তুমি বিষয়টা আমাকে বলবে। কারণ তুমি তোমার ভালো থাকা,খারাপ থাকার সব কিছু আমাকেই বলো।
— কিন্তু তুই তোর ভালো মন্দ আমাকে বলিস না।
— এই যে আবার শুরু হলো অভিমান। এই এক মাস থেকে একই অভিমানে হ্যাচক্যাচাং হয়ে গেলাম!
— হ্যাচক্যাচাং আবার কি রে?
— এগুলো আমার নিজস্ব ভাষা। নিজের সাথে কথা বলার জন্য।
— কি সব অদ্ভুত কথা!
— প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যেই অদ্ভুত কিছু না কিছু থাকে বাবা। ভালো করে খেয়াল করলেই ব্যাপারটা টের পাবে।
— আমার মধ্যে অদ্ভুত কি আছে বলতো!
— এই যে, মাঝেমধ্যে তুমি অনেক রাতে, মা ঘুমানোর পর, পুরনো একটা ডায়েরী হাতে নিয়ে বাইরে বের হও। সেই ডায়েরী থেকে মাত্র একটা পৃষ্ঠা ছিড়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়ে আবার ডায়েরীটা নিয়ে ঘরে চলে যাও। গত কয়েক মাস যাবত তুমি এটা করছ। অনেকদিন ধরে কাজটি একটু একটু করে না করে তুমি কিন্তু একদিনেই ডায়েরীটা পুড়িয়ে দিতে পারতে। আপাতত এটাই তোমার অদ্ভুত আচরণ।
— ওহ! তুই তাহলে এটা জানিস। ঐ ডায়েরীতে কি আছে জানতে চাস?
— না বাবা, কিছু একান্ত অপ্রকাশিত ব্যাপার নিজের মধ্যে নিজের মত করে রাখার অধিকার প্রত্যেককে দিতে হয়। এখন বলো তোমার আজকের ভালো থাকার কারণ।
— তুই তো কিছুতেই তখন আই স্পেশালিষ্ট সেনগুপ্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দিসনি আমাকে। কিন্তু ডক্টর হয়ে এমন একটা আনইথিক্যাল সার্জারী করার জন্য শাস্তি তার প্রাপ্য আর সেটাই সে পেতে যাচ্ছে!
— মানে? কে দেবে তাকে সাজা?
— তুই যে রোগীকে কর্নিয়া ডোনেট করেছিস,তার পরিবারই মামলা করেছে ডক্টর সেনগুপ্তের বিরুদ্ধে।
— কি বলো! তারা কেন মামলা করবে! যেভাবেই হোক চোখ পেয়েছে তারা, এটা তো তাদের সৌভাগ্য!
— সেটা আমারও খটকা লেগেছে। হতে পারে বড় অঙ্কের টাকা এদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।
— রাইট! এটা হতে পারে! কিন্তু তুমি এসব কোথায় শুনেছ?
— আজকের পত্রিকায় এসেছে খবরটা।
অরনী চা শেষ করে উঠে দাঁড়ালো, ‘ওকে বাবা আমি গেলাম, একটু রেস্ট করব। অরনী ঘুরে দাঁড়ালে বাবা বললেন, ‘ অরনী শোন মা, তুই তোর স্বেচ্ছাচারিতা করে আমাদেরকে অর্ধমৃত করে রেখেছিস। এবার আমাদের পালা। তবে সে চেষ্টা তোকে নতুন জীবন দেয়ার জন্য। আগামীকাল সকাল দশটায় রেডি থাকিস। ডি,আই,এইচ হসপিটালে স্কটল্যান্ড থেকে একজন আই স্পেশালিস্ট আসছেন কাল। সেখানে তোর সিরিয়াল দিয়ে রেখেছি। বাই এনি হাউ, আই ওয়ান্ট ইউ লাইক বিফোর এন্ড আই উইল ডু এভরিথিং ফর দ্যাট।’ ‘আচ্ছা’ বলে অরনী রুমে গিয়ে সটান শুয়ে পড়ল। কপালের উপর একটা হাত রেখে চোখ বন্ধ করে ও চিন্তার জট গুলো খুলতে চেষ্টা করছিল। শিপন ছেলেটা কেন ওর বাড়ির সামনে আসে? খারাপ কোনো উদ্দেশ্য নয় তো? কথা শুনে অবশ্য খারাপ মনে হয়নি তাকে। অরনী ঠিক করল,কালই সে পার্কটিতে আবার যাবে। ব্যাপারটি জানার চেষ্টা করা দরকার।
আর এদিকে ডাক্তার সেনগুপ্তের জন্য ওর ভীষণ খারাপ লাগছিল। উনি কাজটি কোনোভাবেই করতে চাননি। অনেকদিন ধরে অনেক ভাবে বোঝানোর পর উনি রাজী হয়েছিলেন, গোপনীয়তার শর্তে। তাহলে তার এই পরিণামের জন্য তো অরণীই দায়ী। উনাকে বিপদমুক্ত করা প্রয়োজন। কিভাবে কি করবে ভেবে কুল কিনারা পেল না ও। এসব ভাবতে ভাবতে অরনীর একটু তন্দ্রার মত এসেছিল। হঠাৎ সজোরে সেল ফোনটা বেজে উঠল। অরনী ফোন কানে লাগিয়ে ঘুম জড়ানো গলায় হ্যালো বলতেই ওপাশে শোনা গেল, ‘ অরণী,আমি মাহিন, আমাকে একটি বার ক্ষমা করো প্লিজ। আমরা আবার নতুন করে শুরু করি প্লিজ!’
গলার আকস্মিক পরিবর্তনে স্বরটা উঁচূতে উঠে উত্তপ্ত কিছু শব্দ বা বাক্য অরনীর মুখে এসে জমা হল। কিন্তু ঢোঁক গিলতে গিলতে সেগুলোকে আবার ভেতরে পাঠালো সে । এরপর ফোনের সুইচটা অফ করে আবার ঘুমানোর বৃথা চেষ্টায় সে রত হল জাহিদ স্যারের সাথে অরনীর সাক্ষাতটা হয়নি। উনি গ্রামের বাড়িতে আছেন। এক সপ্তাহ আগে উনার বাবা মারা গেছেন। তবে ক্লাবের অনেকের সাথেই হয়েছে সাক্ষাত। বিস্ময়ে সবাই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল অরনীকে দেখে। আকাশ নামের একটি ছেলে বলে উঠেছিল , ‘ প্রশ্নই উঠে না। আপনি মিথ্যে বলছেন। শুধু মোটিভেটেড হয়ে কেউ কর্নিয়া ডোনেট করেনা। অন্য কোনো কারণে করেছেন এটা আপনি।’ অরনী শুনে মৃদু হেসেছিল শুধু। আর কিছুই বলেনি কফিসপটায় তেমন লোকের আনাগোনা নেই আজ। মাহিনের সাথে আগে অনেক বার এসেছে অরনী এখানে। আজ পার্ক থেকে বেরিয়ে অরনীর খুব ইচ্ছে হল এখানটায় একটু বসতে।
পার্কে যাওয়াটা অরনীর দৈনন্দিন রুটিনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে গত তিন দিনেও শিপন ছেলেটির কোনো হদিস ছিল না পার্কে। ছেলেটিকে নিয়ে যে রহস্যের সৃষ্টি হয়েছিল, তা যে নিছক কাকতালীয় সেটা বোঝা গেল। তবে আজ পার্কে একটি ঘটনা ঘটেছে। একটু দূরে সোরগোল হচ্ছিল। অরনী একজনকে ডেকে জিজ্ঞেস করাতে জানতে পারল, কিছু ছেলে দূর থেকে অরনীর ছবি তুলছিল। সেটা দেখে কেউ একজন প্রতিবাদ করায় এই সোরগোল তৈরি হয়েছে। এরপর খুব অস্বস্তি লাগছিল অরনীর। বেরিয়ে এসেছে তখনই।
অরনীর চোখের গ্লাস ওকে পরিচিত জায়গাগুলোতে অপ্রস্তুত হওয়া থেকে রক্ষা করে। কফিসপের মালিক ওকে চেনেন। কিন্তু কোনো প্রশ্ন করেননি ওকে।এতে অরনী স্বস্তি পেল। অরনী যে টেবিলটিতে বসেছে, তার পেছনের টেবিলটায় এক জোড়া যুবক যুবতী নীচূ স্বরে কথা বলছে। কফির অপেক্ষায় বসে থেকে হঠাৎ তাদের কথোপকথন অরনীর কানে এল আর ও সহসা নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারালো। হাত পা কাঁপছিল,গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল, কিছু যেন দলা পাকিয়ে ভেতর থেকে উঠে আসছিল। মেয়েটি আবেগ আপ্লুত কণ্ঠে বলছে, ‘মাহিন, আই লাভ ইউ, এন্ড আই কান্ট লিভ উইদাউট ইউ।’
প্রতিউত্তরে অমানুষটিও বলছে, ‘লাভ ইউ টু মাচ।’ ঘৃণায় গা গুলিয়ে উঠল অরনীর। এই পাষন্ড গতকালও অরনীর কাছে ক্ষমা চেয়েছে,ফিরে আসতে চেয়েছে ওর জীবনে। আর আজ এখানে বসে অরনী মনে মনে কথা বলতে শুরু করল। ধিক্কার জানাতে লাগল নিজেকে। এমন প্রতারককে একসময় ভালোবেসেছিল। এমন নির্বোধ কিভাবে হয়েছিল সে! কিছুক্ষণ পর মাহিন আর তার নতুন শিকার উঠে চলে গেল। অরনী ফিস ফিস করে শুধু একটা শব্দ ছুঁড়ে দিল ওদের দিকে, ‘বাস্টার্ড!’ খুব অসুস্থ লাগায় কফিসপের বাইরে বেরিয়ে এল অরনী। বাড়িতে যাওয়া দরকার এখুনি। কিন্তু রফিকের কোনো খবর নেই। কোথাও গেছে আশেপাশে হয়তো। অরনী অপেক্ষা করতে লাগল দাঁড়িয়ে। হঠাৎ শুনল, ‘আমি পৌঁছে দেই আপনাকে ?’
— শিপন, আপনি?
— চিনে ফেললেন এত সহজে?
— আপনি ফলো করেন আমাকে? কিন্তু কেন?
— ভেতরে কি হয়েছিল? অমন ফ্যাকাসে হয়ে গেলেন কেন হঠাৎ?
— কেন ফলো করছেন আমাকে? কফিসপে,বাড়ির সামনে,পার্কে সব জায়গায় আছেন। আচ্ছা, একটা কথা বলুন তো, আজ কি আপনি পার্কে উপস্থিত ছিলেন?
— হুম। প্রতিদিন থাকি। আপনি যখন থাকেন।
— তার মানে আমার ছবি যারা তুলছিল,তাদের সাথে সোরগোলটা আপনিই করেছিলেন?
— হ্যাঁ, আমিই করেছিলাম।
— আপনি কি চান আমার কাছে শিপন?
— রাস্তায় যেতে যেতে বলি।
— ঠিক আছে চলুন!
ট্যাক্সি নিয়ে নিল ওরা। বসতে বসতে অবলীলায় শিপন বলে ফেলল, ‘ আপনি অনেক বেশি সুন্দর। এত সুন্দর মানুষ আমি কখনো দেখিনি।’ অরনী বিরক্ত হল। ছেলেদের এসব সাধারণ সংলাপ। তাই বলে এতটাও বানিয়ে বললে কানে লাগে,’এখন বলুন কি চান আপনি?’
— বলছি! আচ্ছা আপনাকে কেউ কখনো বলেছে আপনার ভোরবেলার স্নিগ্ধ মুখ দেখার জন্য সারারাত ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা যায়? আপনার হাসি দেখার জন্য একটা যুদ্ধের মারনাস্ত্রের মুখ থেকে আপনার কাছে ফিরে আসার তীব্র বাসনা হয়? আপনার অরনী বিরক্ত হয়ে থামিয়ে দিল, ‘ কি চান আপনি?’
— আপনাকে চাই। আমৃত্যু চাই।
— কৌতুক করছেন?
— না, মোটেই নয়।
— আচ্ছা তাহলে শুনুন! আমার সম্মতি নেই।
— কেন জানতে পারি?
— পারেন। কারণ তিনটি। প্রথমত আমার অন্ধত্ব নিয়ে আমি কাউকেই আমার জীবনের সাথে জড়াবো না।
— এটা কোনো ব্যাপারই নয়। আপনার দৃষ্টি আবার ফিরে আসা সম্ভব। সেটা আমার দায়িত্ব। আর দৃষ্টি না ফিরলেও আপনি আমার কাছে ততটাই ইম্পর্ট্যান্ট , যেমনটি দৃষ্টি থাকলে হতেন! দ্বিতীয় কারণ বলুন।
— মাহিন নামের একটি ছেলেকে গত এক বছর ধরে আমি ভালোবাসতাম,বিয়ের সিদ্ধান্তও নিয়েছিলাম আমরা। হঠাৎ একদিন তার রুমে গিয়ে তাকে অন্য মেয়ের সাথেও ভালোবাসা বাসির ভূমিকায় দেখলাম। সুইসাইডের কথা ভেবেছিলাম। পরে সিদ্ধান্ত বদলে ফেলি। অন্ধ হওয়ার একটা অপশন এসে গেল। সে দিকে গেলাম শেষে। তো এসব জানার পর নিশ্চয় আর আমাকে বিয়ে করতে চাইবেন না। হো হো করে হেসে উঠল শিপন, ‘ কাউকে ভালোবাসতেন, এটাকে এই বিয়ের প্রতিবন্ধকতা ভাবলেন কি করে এমন প্রগতিশীল একজন মেয়ে হয়েও? এবার তৃতীয় কারণ বলুন!’
— সম্ভব হলে আমি যাকে বিয়ে করতে চাইতাম, সে আপনি নন।
— কে সে,বলুন না আমাকে!
— এখন থেকে কয়েক মাস আগে একটি ছেলে আমার উপকার করতে গিয়ে মানুষের হাত মার খেয়েছিল।
আমি অনেক দিন পর্যন্ত তার জন্য খুব কষ্ট পেতাম। টানা একুশ দিন চেষ্টার পর আমি তার খোঁজ পাই। জানতে পারলাম, আমার একটি ছোট ভুলের কারণে সেদিন তার উপর পাবলিকের অত্যাচারটা ছিল ভয়াবহ মাত্রায়, তার চোখের অপটিক নার্ভ পর্যন্ত ড্যামেজ হয়ে গিয়েছিল সে আঘাতে, শোনার পর আমি প্রায়ই তার জন্য কাঁদতাম, কিন্তু এসব জানার পর ভয়ে কখনো তার কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইতে পারিনি। ধীরে ধীরে এক সময় অনুভব করলাম, তার জন্য এক অজানা টান আমার ভেতরে তৈরি হয়ে গেছে।
— এখনো কি সেই টান আছে তার জন্য?
— হ্যাঁ আছে।
— তাহলে তো হয়েই গেল। তাকে গিয়ে বলুন,আপনি তাকে ভালোবাসেন।
— কোনোদিন না। এই অন্ধত্ব নিয়ে সেটা সম্ভব নয়।
— আপনি আমাকেও কোনোভাবেই বিয়ে করতে রাজী হবেন না? এটাই চুড়ান্ত?
অরনীর নির্দেশনা মোতাবেক ট্যাক্সি ওর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। ও নামতে নামতে বলল, ‘হ্যাঁ। এটাই চূড়ান্ত! আমার বাড়ি এসে পড়েছে। চলি আমি। আজকের পর থেকে তাহলে আর আমাকে ফলো করবেন না আশা করি।
অরনী নেমে পড়েছে ট্যাক্সি থেকে। জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে শিপন বলল, ‘শুনুন গাড়িতে উঠার সময় বলেছিলাম না,আপনার মত সুন্দর মানুষ আমি কখনো দেখিনি, তার একটা প্রমাণ দেব আপনাকে?’
— বলুন।
— আমাকে এত কিছু বলতে পারলেন, অথচ যে ছেলেটি আপনার খুব ছোট একটি উপকার করেছিল বলে বিনিময়ে তাকে আপনি নিজের জীবনটাই উপহার দিয়ে দিলেন , সেটা একবার ও বললেন না! এগুলোকেই বলে সৌন্দর্য! এই সৌন্দর্যের কথাই আমি বলেছি। অরনী অস্ফুট স্বরে বলে উঠল, ‘কি দিয়েছি তাকে?’
— নিজের দৃষ্টি।
— সে কী! আপনি জানলেন কিভাবে? শিপন মৃদু হেসে ট্যাক্সি থেকে নেমে পড়ল। অরনীর কাছে দাঁড়িয়ে চুপ করে রইলো।’ অরনী উদগ্রীব ভঙ্গীতে উঁচূ স্বরে বলে উঠল, ‘ কে আপনি? ‘
— আমিই সেই হতভাগ্য যাকে এই মেয়েটি তার স্বর্বস্ব দিয়ে উজাড় হয়ে খুব স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে।
— আপনিই রোমেল?
— নামটা জানেন দেখছি!
— এত কিছু জেনে নিয়েছিলাম, আর নামটাই বাদ রাখব জানতে? কিন্ত এই শিপন নামে পরিচয় দেওয়া কেন নিজেকে?’
— নিজেকে একটু আড়াল করার চেষ্টায় । নইলে পৃথিবীর সব চাইতে সুন্দর মেয়েটির মনে কি আছে কখনোই জানা হত না!
অরনী তার মাথাটা নীচূ করে ফেলল, চোখের জল লুকাতে । রোমেল সেটা বুঝতে পেরে বলল , ‘কেউ কি তার বাড়ির ভেতরে আমাকে একটু যেতে ও বলবে না? এটা ও কি সম্ভব নয় ?’ এটা শুনে অরনী দুহাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগল। রোমেল ওর হাত ধরে একটু টেনে ওকে বুকের কাছটায় নিল। গড়িয়ে পড়ছে জল তার চোখ থেকেও। রাস্তার সবাই তাকিয়ে দেখছে। কিন্তু তাতে ভ্রুক্ষেপ করল না রোমেল……
(সমাপ্ত)
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত