বাসর রাতে বিছানার এক কোণে বসে আছি, এই মুহুর্তে আমার হাজবেন্ড ঘরে ঢুকে দরজা লক করে দেয়। আমার বয়স সবে মাত্র ১৭ বছর, প্রচণ্ডভাবে ভয় পাচ্ছি। হাজবেন্ড কেমন হবে, কি বলবে, কি করবে এইসব ভেবে। আমার হাজবেন্ড এর নাম সুমন। সুমন আমার পাশে বসে আমার ঘোমটা টা খুলতেই দরজায় নক হয়। সুমন কোন কথা না বলেই ঘোমটা টা আবার টেনে দিয়ে দরজা খুলে দেয়। তখন দেখি আমার শ্বশুর মশাই ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। আমি বিছানা ছেড়ে নেমে গিয়ে উনাকে জিজ্ঞেস করি,
__ “ কিছু লাগবে আব্বা। ”
__ “ সুমনের কিছু লাগবে কিনা সেটা দেখতে এলাম। ”
__ সুমন রাগে কটমট করতে করতে বলে , “ না আব্বা আমার কিছু লাগবেনা। ” আমি মনে মনে রাগ করে বলি, “ আহারে পুত্র প্রেমি, ছেলে ছাড়া মনে হয় কিছুই বুঝেনা হুহহ।” আব্বা আর কিছু না বলে চলে গেলো। হালকা শীতের রাত ছিলো, সুমন পাশে এসে বললো,
__ “ কিছু মনে করোনা। ”
__ আমি মনে মনে বলি “ এহহহ ন্যাকা। ” মুখে বলি, কিছুই মনে করিনি। ”
সুমন এসে আমার মুখে হাত দিতেই আবারোও দরজায় নক করে, সুমন তড়িঘড়ি করে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেয়, শ্বশুর মশাই দাঁড়িয়ে আছে।
__ “ শ্বশুর সুমনকে বললেন, বাবু ঠান্ডা পড়েছে, ঘরে কম্বল দিতে ভুলে গিয়েছি, তাই দিতে আসলাম। আচ্ছা আসি বৌমা। ”
বাসর রাতে শ্বশুর যদি দুইবার দরজায় নক করে, কেমন টা লাগে বলুন তো। যাই হোক, সুমন এসে সব রাগ মাটি করে দেয়। খুব ভোরে শ্বশুর মশাই আবারোও নক করে দরজায়। আচ্ছা নতুন বউয়ের ঘরে সাত সকালে নক করলে কেমন লাগে। দরজা খুলে দিলাম, দরজার বাইরে দাঁড়িয়েই শ্বশুর মশাই বলে উঠলেন,
__ “ বৌমা এখন তো ফজরের নামাজ পড়ার সময়, নামাজ পড়ে নাও। সুমন কেও নামাজের জন্য ডেকে দিও। আমি আর সুমন মসজিদ এ গিয়েই নামাজ পড়ি প্রতিদিন। ” মনে মনে আমি প্রচণ্ড ক্ষেপা, বাসর রাতে ও কি নিজেদের মতো একটুও সময় পাবোনা। তাও বাধ্য বউমার মতো সুমন কে গিয়ে ডেকে তুলি। বেচারা সুমন কোনরকম শাওয়ার শেষ করে বাবার হাত ধরে নামাযে গেলো। আমি ও ভালো বউয়ের মতো পবিত্র হয়ে নামাজ পড়ে নিই। এরপর কিছুক্ষণ কোরান শরিফ তিলাওয়াত করি। নতুন জীবনে পদার্পণ করেছি, আজ আমার জীবনে নতুন ভোর। যেহেতু সুমনের বাবা ছাড়া সুমনের পৃথিবীতে আর কেউ নেই। আমিই রান্নাঘরে প্রবেশ করি, আগে শুনেছি শ্বশুর মশাই নাস্তা বানাতেন ।রান্নাঘরে গিয়ে কোথায় কি রাখা আছে খুঁজতে একটু সময় লাগলো। নাস্তা তে ভাবছিলাম পরোটা বানাবো আর আলুর দম । রান্নাঘরে খুটখাট শব্দ শুনে শ্বশুর মশাই চলে আসলেন রান্নাঘরে। এসেই বললেন,
__ “ বৌমা তুমি রান্না জানো! ” বৃদ্ধের চোখে যেনো বিষ্ময়।
__ “ জ্বী বাবা জানি। ” আটা খুমির করতে মন দিলাম। তখন শ্বশুর মশাই আবারো বললেন,
__ “ যাক বাবা ভালোই হলো, আজ থেকে আমার ছুটি। তা বউমা সুমনের জন্য ঠিক চাঁদের মতো গোল করে রুটি বানাবে। জানোই তো ছেলেটা আবার চাঁদ রুটি ছাড়া রুটি খায় না। আর শুনো, পরোটা তো একদম ই খায় না সুমন। ওর এসিডিটি হয় প্রচণ্ড। ” আমার মাথা বিগড়ে গেলো রাগে, আমার শখের পরোটা তে শ্বশুর মশাই ছাই ফেলে দিলো। এহহহ আবার শখ করে নাম দিয়েছে চাঁদ রুটি। ঢং দেখে বাঁচি না, কিন্তু মুখে বললাম,
__ “ জ্বী বাবা, আপনার কথা মতো ই কাজ করবো। ” শ্বশুর মশাই খুব খুশি হয়ে গেলেন, এরপর খুব সুন্দর করে বললেন,
__ “ তা মা তুমি হয়তো জানোনা, সুমন বাবা তো ডিম পোঁচ ছাড়া রুটিই খায়না। ”
__ “ জ্বী বাবা তাই হবে। ”
সকালে নাস্তার টেবিলে শ্বশুর আর শ্বশুরের বেটা দুজনেই খুশি। আমার শখ পূরণ হলোনা বলে রাগ মনে থাকলেও সবার সামনে হাসিখুশি থাকার অভিনয় করে যাচ্ছিলাম। ব্রেকফাস্ট শেষ করে ভাবলাম চা চুলায় বসিয়ে দিয়ে প্লেট গুলো চট করে ধুয়ে নিই। যেই ভাবা সেই কাজ, গ্যাস অন করে চা বসিয়ে দিয়ে প্লেট সাফ করতে গেলাম। শ্বশুর মশাই আবারো আসলেন,
__ “ বৌমা, বলছিলাম কি প্লেট ধুচ্ছো খুব ভালো কথা। আস্তে শব্দ করো, নইলে আবার সুমনের অসুবিধা হয়। তুমি তো আর জানো না, সুমন শব্দ একেবারে সহ্য করতে পারেনা। ”
__ “ জ্বী বাবা, তাই হবে। “ শ্বশুর মশাই চলে গেল। সহ্যের একটা সীমা আছে, উনার ই ছেলে আর আমার বোধহয় স্বামী না। এহহহ শব্দ সহ্য করতে পারেনা, গা পিত্তি জ্বলে যায়। ” প্লেট গুলো খুব আস্তে করে ধুয়ে রেখে দিলাম। চুলোয় চায়ের পানি গরম হচ্ছে, অনেক খুঁজে দেখি চা পাতি নেই। বাধ্য হয়ে শ্বশুর মশাই এর ঘরে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম চা পাতির কথা। উনি বললেন,
__ “ বাসায় তো চা পাতি নেই, তুমি তো দেখছি কিছুই জানোনা। আমার সুমন ছোট বেলায় চা পান করার সময় জিহ্বা পুড়িয়ে ফেলেছিলো। এরপর থেকে আর চা করিনা এই বাসায়। ” কথা শুনে রাগে আমার শরীর মনে হচ্ছে জ্বলে যাচ্ছে। আমি আল্লাহ কে ডাকা শুরু করি,
__ “ হায় আল্লাহ! এই কোন বাড়ি তে আমাকে পাঠাইলা। মাত্র ১২ ঘন্টা তেই তো আমি দিশেহারা হয়ে গেলাম ।” গ্যাসের চুলো অফ করে দিয়ে ঘরে এসে বসলাম । সুমন এসে বসে আমার পাশে,
__ “ বউ, তোমার নতুন বাড়ি কেমন লাগছে! ”
__ “ আহহ! ন্যাকার পুত্র ন্যাকা আবার জিজ্ঞেস করছে কেমন লাগছে। ” মুখে বললাম, “ তোমাকে পেয়ে আমি খুব সুখী। ” সুমন তো খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল। যাই হোক সুমনের খুশিতে আমিও খুশি। দুপুর ১১:৩০ বেজে গেছে, ভাবলাম দুপুরের রান্না টা সেরে নিই। রান্নাঘরে গিয়ে চাল ধুয়ে ভাত চাপিয়ে দিই আগে, এরপর বাসায় সজবি ছিলো কিছু সেগুলো দিয়ে একটা সব্জির তরকারি করবো ভাবলাম, সাথে মুরগির মাংস। সব্জী কেটে রেখেছি, মাংস ও পরিষ্কার করে নিয়েছি। শ্বশুর মশাই আবারো আসলেন রান্নাঘরে,
__ “ বৌমা, তুমি তো আর জানো না, সুমন কিন্তু লবন কম খায় আর ঝাল টা জেনো বেশি না হয়। ওর আবার মুখ জ্বলে। আর মাংস টা ভালো করে সিদ্ধ করে নিও, ও আবার শক্ত খাবার খেতে পারেনা। ” বুইড়া শ্বশুর মশাই এর উপর রাগ উঠে গেলো, সুমন হ্যান পছন্দ করেনা, ত্যান খায় না, হ্যান হয় না, ত্যান হয়না। আমি আবার ঝাল খেতে খুব পছন্দ করতাম, কিন্তু আর হলো না । কিন্তু নতুন বউ, তার উপর উনি আবার সুমনের বাবা। আমি খুব আস্তে করে বললাম,
__ “ আপনার যা আদেশ বাবা। ” শ্বশুর চলে গেলেন। শ্বশুর মশাই খুব খুশি এবার, লাঞ্চ উনার খুব পছন্দ হয়েছে। সুমন ও খুব প্রশংসা করলো রান্নার। যাই হোক, স্বামী শ্বশুরের কাছে প্রশংসা শুনে আমারও বেশ মজাই লাগলো।
একটু রেস্ট নিয়ে সুমনের কাছে গিয়ে আবদার করলাম,
__ “ এই শোনো না, আমরা যদি একটু নদীর ধারে গিয়ে বেড়িয়ে আসি। তোমার ও ভালো লাগবে আমারও ভালো
লাগতো। ”
__ “ তুমি বেড়াতে যাবে! আচ্ছা রেডি হও, আমি বাবাকে রেডি হতে বলি। ” আমার গা পিত্তি জ্বলে উঠে আবারও, নতুন বর বউয়ের সাথে নাকি শ্বশুর যাবে বেড়াতে। কিছুই বললাম না আর, রেডি হয়ে তিনজন মিলে ঘুরতে গেলাম। বাসায় আসলাম রাত্রে, ডিনার সার্ভ করে সবাইকে খাইয়ে দিয়ে নিজেও খেয়ে নিলাম। মন খারাপ করে ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর সুমন আসলো, আমার কপালে চুমু দিয়ে বললো,
__ “ শুনো মিলি, আজ সারা টা দিন তোমার অনেক কষ্ট হয়েছে জানি। তাও যে তুমি হাসি মুখে সব কিছু সহ্য করেছো তার জন্য আমি অনেক খুশি। ” আমি বেশ অবাক হয়ে গেলাম, আস্তে করে বললাম, “ সরি, কি বলছো! বুঝলাম না। ”
__ “ আমি সারাদিন তোমাকে পর্যবেক্ষণ করেছি মিলি। তোমার মন মাঝে মাঝে বিষন্ন হচ্ছিলো, বাবা যখন অর্ডার করছিলেন। কিছু কথা বলি আজ, আমার মা আমার জন্মের পর মারা গেছিলেন। তারপর থেকেই আমি আমার বাবার কাছে বড় হয়েছি। আমার বাবা চাইলে নতুন সংসার করতে পারতেন, যদি নিজের সুখের কথা ভাবতেন। কিন্তু আমার মায়ের চলে যাবার সময় শেষ কথা ছিলো, সুমনকে সব সময় খুব যত্নে রেখো। তারপর থেকে বাবা আমার এতো কেয়ার নিতেন যে বাবার সাইকোলজিকাল প্রব্লেম হয়ে যায়। বাবার দুনিয়ায় আমি ছাড়া আর কেউ নেই। আমি তোমার কাছে শুধু এইটুকু চাইবো বাবার মনে কোন কষ্ট দিওনা কখনো। ” এমন কিছু শুনবো কখনো আশা করিনি। এটা শুনার পর শ্বশুর মশাই এর প্রতি রাগের বদলে শ্রদ্ধাবোধ বেড়ে গেল। নতুন বউ হিসেবে নতুন পরিবেশ এ মানিয়ে নিতে কিছুদিন সময় লেগেছিলো। কিন্তু আমরা ছিলাম তিনজন মানুষের হ্যাপি ফ্যামিলি। এখন অবশ্য চারজনের ফ্যামিলি ও হতে চলেছে।
গল্পের বিষয়:
গল্প