ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে থমকে গেলাম। শিহাবের চোখদুটো জ্বলছে! ডিম লাইটের অন্ধকার আলোতে, মশারির ভেতরেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ওর চোখদুটো, লাল টকটকে মনি দুটো ভয়ংকর ভাবে জ্বলজ্বল করছে!
প্রতিদিনের মতো আজও বাচ্চাকে নিয়ে শুয়ে পড়েছিলাম রাত দশটায়। শিহাবের একটা প্রজেক্ট প্রোপোজাল জমা দেয়ার আছে, টেবিলে বসে ল্যাপটপে টিপাটিপি করছিল। একটুপরই ওটা নিয়ে মশারির মাঝে ঢুকে যাবে জানি। ক’দিন ধরেই কাজ করছে গভীর রাত পর্যন্ত। সারাদিনের ধকলে অতসব দেখার সময় হয়নি, বিছানায় শোয়া মাত্রই ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। কেন যেন মাঝরাতে হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেলো। উঠে ওয়াশরুমে গিয়েছি, বেরিয়ে দেখি এই দৃশ্য। ল্যাপটপ কোলে শিহাব বিছানায় বসে। হ্যাঁ শিহাবই তো, শুধু ওর কুচকুচে কালো চোখের মনির জায়গাটা লাল, জ্বলছে জলন্ত আগুনের মতই। বৈশাখ মাসের গুমোট গরমেও শরীরে শীতের কাঁপন টের পেলাম। আমি চোখ ডললাম, ঘুমের ঘোরে ভুল দেখছি না তো! হঠাৎ শিহাব মুখ তুললো, জলন্ত চোখে অপলক তাকালো আমার দিকে, গমগমে কন্ঠস্বরে বলে উঠলো, “কি হলো, ওখানে দাঁড়িয়ে গেলে যে!”
আমি চমকে উঠলাম। পায়ের নিচের মাটি কেঁপে উঠলো। মনে হলো, একছুটে ঘর থেকে পালিয়ে যাই, কিন্তু আমার ছোট্ট এক বছরের বাচ্চাটা যে বিছানাতেই ঘুমিয়ে আছে! কি করব এখন? চেঁচিয়ে উঠবো? কিন্তু কার কাছে সাহায্য চাইবো? এই দুই রুমের ফ্ল্যাট বাড়িটাতে আমরা তিনজন ছাড়া আর কেউ যে নেই! “কোনও সমস্যা? আমি আসবো?” বিছানা থেকে গম্ভীর আওয়াজ আসলো।”নাআআ”, আমি প্রায় চিৎকার করে উঠলাম। “পায়ে ঝিঁঝিঁ ধরেছে, আসছি আমি।” ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম, মশারি তুলে বিছানায় ঢুকলাম। শিহাব তাকিয়ে আছে আমার দিকে, অন্ধকারে ওর সাদা দাঁতগুলো ঝিক করে উঠলো। আমি আঁতকে উঠে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকলাম, প্রতিমুহূর্তে মনে হচ্ছিল এই বুঝি এখনই পিঠে ওর ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পাবো। এ জীবনে যত দোআ দরুদ শিখেছি সব আওড়ালাম। ভোরের প্রতীক্ষায় প্রচন্ড ভয়ের মাঝেও কখন যেন অতল ঘুমে তলিয়ে গেলাম।
প্রবল বৃষ্টির আওয়াজে ঘুম ভাঙলো, বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠলাম। উল্টোদিক ফিরে শিহাব ঘুমোচ্ছে তখনও। মেয়ে আমাকে ছেড়ে কখন যেন বাবার বুকে চলে গেছে। আমি আঁতকে উঠলাম। বিছানা থেকে সাবধানে নেমে আলতো হাতে আলমারি খুলে ব্যাগটা বের করলাম। এবার মেয়েকে নেয়ার পালা। পা টিপে টিপে কাছে গিয়ে ফিসফিস করে ডাকলাম, “টিয়ানড়ে উঠলো শিহাব, “ছুটির দিন এতো সকাল সকাল কোথায় বেরোচ্ছো?” “ইয়ে মানে…, মায়ের শরীরটা একটু খারাপ, ফোন দিয়েছিলো।” আগে থেকে ঠিক করে রাখা বুলি আওড়ে গেলাম। “এই এতো বৃষ্টির মাঝে কি করে যাবে! পরে যাও।” শিহাব কি কিছু সন্দেহ করছে? আটকাতে চাইছে আমাকে? তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, “অসুবিধা নেই, আমি ঠিক চলে যেতে পারবো।”
“তাহলে টিয়া থাকুক আমার কাছে। তুমি যাও, মাকে দেখে তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।” মানে কি? আমার ইচ্ছে হলো চিৎকার করে উঠি। শিহাব কি ইচ্ছে করেই টিয়াকে আটকে রাখছে? আমি যে পালাতে চাইছি বুঝে যায়নি তো। শিহাবের গলার স্বর অবশ্য একেবারে স্বাভাবিক, হয়তো আসলেই কোনও সন্দেহ করেনি। কিন্তু টিয়াকে রেখে যাওয়া কি ঠিক হবে? মন বললো, এখন না বেরোলে দুজনেই আটকে যাবো। টিয়াকে বাঁচানোর জন্য হলেও আমার এই সুযোগেই বেরোনো উচিত।
কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে এলাম, নেমে আসলাম নিচে, রাস্তায়। আমি আসলে নিজেও জানিনা কোথায় যাবো, কি করব কিছুই বুঝছি না। মনে কেবল কু ডেকে যাচ্ছে। শুধু মনে হচ্ছে, খুব অশুভ কিছু একটা ঘটতে চলেছে। খুব দ্রুত কিছু করতে না পারলে সর্বনাশ হয়ে যাবে! কিন্তু কোথায় যাবো? কার কাছে যাবো? কেউ কি বিশ্বাস করবে আমার কথা? কিন্তু আমি নিশ্চিত জানি, আমি যা দেখেছি, তাতে কোনও ভুল নেই সামনে তাকিয়ে দেখি, একটা ভাঙা ছাতা মাথায় দিয়ে পারুল দ্রুত পায়ে হেঁটে আসছে। পারুল আমার ঠিকে ঝি, থাকে সামনের বস্তিতে। ওকে দেখে আমার মনে পড়লো কিছুদিন আগে ওর বোনকে জ্বিন ধরেছিলো। কঠিন এক জ্বিন, কোন কবিরাজ ছাড়াতে পারেনি। শেষপর্যন্ত এক ফকির বাবার তাবিজ নিয়ে আর পানিপড়া খেয়েই নাকি সুস্থ হয়েছিলো। ওর কাছে শুনেছিলাম সামনের মাজারের পাশেই সেই ফকির বাবা থাকে। বিশাল গুনী, মস্ত শক্তিশালী। পারুলের মুখে সেই গল্প শুনে তখন কত হেসেছি, অথচ আজ এই মূহুর্তে ওকে দেখেই যেন আমি ভরসা পেলাম। বৃষ্টি মাথায় আমি ছুটে গেলাম ওর দিকে।
শিহাবের সাথে আমার পরিচয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষেই। বায়োকেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের সবচাইতে মেধাবী ছাত্র। দেখতে মোটামুটি সুদর্শন, তবে কারও নজরে পড়বার মতো নয়। কারনটা ছিলো ওর পোশাক। দুটো সস্তা শার্ট আর প্যান্ট পরেই ও গ্র্যাজুয়েশনের পুরোটা সময় পার করেছে। নিজের থাকা খাওয়া পড়াশোনা সব খরচ ও টিউশনি করে চালাতো, আবার দেশেও টাকা পাঠাতো। মাঝে মাঝে লাইব্রেরিতে পড়তে গেলে শিহাবকে দেখতে পেতাম, এক মনে পড়েই চলেছে, একাডেমিক অথবা অন্য কোনও বই। দু একটা এসাইনমেন্ট এ ওর হেল্প নিয়েছিলাম। তখনই প্রথম বুঝেছিলাম, ও চমৎকার একটা ছেলে, বুদ্ধিমান এবং ভদ্র। পরিবারের কথা জানতে চাইলেও অকপটে জানিয়েছিল সবকিছুই। ওর বাবা মদ্যপ চরিত্রহীন হওয়ায় ওর তিন বছর বয়সেই মা ছেড়ে এসেছিলেন তাকে। সাত বছর বয়সে যখন ওর মা আবার বিয়ের পিড়িতে বসেন, মায়ের দ্বিতীয় সংসারে ঠাঁই হয়নি ওর। নানীর পরম ভালোবাসা আর মামাদের চরম অবহেলার মাঝেই ওর বেড়ে ওঠা। পড়াশোনায় ভালো ছিলো বরাবরই, ক্লাসে সবসময় প্রথম হতো। আর ওর বাড়ির অবস্থাও সবার জানা।
তাই স্যারদের সহযোগিতায়ই পড়াশোনা চালিয়ে গেছে। ইন্টারমিডিয়েট এ অসাধারণ রেজাল্ট করায় কলেজের এক স্যার নিজ দায়িত্বে নিজ খরচে ওর বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেবার ব্যাবস্হা করেছিলেন ধীরে ধীরে কখন কিভাবে যে আমাদের সম্পর্কটা অন্যদিকে মোড় নিলো, আমি নিজেও বলতে পারিনা। মুখে কেউ কোনদিন বলিনি, ভালোবাসি। তবুও একসময় বুঝলাম, আমরা কেউ কাউকে ছাড়া থাকতে পারবো না। আড়ালে আমাদের নিয়ে হাসাহাসি চলতো। শিহাবের টোপে পা ফেলেছি বলে বন্ধুরা আমাকে সতর্কও করেছে অনেক। কিন্তু আমার সরে আসবার সাধ্য ছিলো না। পাশ করবার পর যখন আমার বিয়ের আলাপ উঠলো, ওকে নিয়ে গেলাম আমাদের বাড়ি। সব শুনে বাবা-মা তক্ষুনি ওকে বাতিলের খাতায় ফেলে দিলো। এরপর বাবা-মায়ের অমতে তাদের জানিয়েই একদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম। দু’জনে মিলে সংসার পাতলাম।
তবে চার বছর আগের আর বর্তমানের মাঝে অনেক ফারাক। দুজনের চাকরিতে বর্তমানে বেশ ভালো একটা অবস্থান আমাদের, পরিবারের সাথে সম্পর্কও এখন অনেকটা স্বাভাবিক। তবে হ্যা, শিহাবের পরিবারের সাথে আমাদের কোনও সম্পর্ক নেই। ছাত্রাবস্থায় নানী মারা যাবার পর থেকেই শিহাবের সাথে ওর সকল আত্মীয়ের সম্পর্ক চুকেবুকে গেছে আমার মুখে সব কথা শুনে ফকির বাবা গম্ভীর হয়ে গেলেন, “মা জননী, তোমার জন্য দুঃসংবাদ.. ভাবছিলাম তোমার স্বামীর উপর কোনও দুষ্ট জ্বিন ভর করছে। কিন্তু এখন মনে হইতাছে….
“কি মনে হচ্ছে? বলুন। থামলেন কেন?”
“তোমার স্বামীর উপর কোনও জ্বিন ভর করে নাই, বরং সে নিজেই একটা জ্বিন…”
“কিইইই….. এসব কি বলছেন আপনি? আমি ওকে গত দশ বছর ধরে চিনি…”
“কিন্তু অর পরিবারের কাউরে তুমি চিনো না। ঐ পরিবারের কারো সাথে তুমার দেখাও হয় নাই। হইছে?”
আমি থমকে গেলাম।
“কারো সাথে কথা হইছে?… কও না ক্যান, হইছে কথা?” আমি এপাশ ওপাশ মাথা নাড়লাম, “কিন্তু এটা কি করে সম্ভব? শিহাব জ্বিন “এইজন্যই তো কই, স্যার এতো ভালা ক্যান? মানুষ কি আর এতো ভালা অয়, হ্যায় জ্বিন বইল্যাই মনে হয় এমুন”, পারুল হঠাৎ গম্ভীর মুখে মাথা ঝাঁকাতে লাগলো, “ফকির বাবায় ঠিক কথাই কইছে আফা।” আমি এক ধমক লাগিয়ে দিলাম পারুলকে। ফকির বাবা হো হো করে হেসে উঠলো, “আমার কথা বিশ্বাস হইতাছে না তো? আচ্ছা কও দেখি, তুমার স্বামীর কন্ঠার হাড়টা কি বেশি উঁচা?” আমি অবাক হয়ে বললাম, “হ্যা, কিন্তু তাতে কি?”
“তিনার বুকে হাতে পায়ে পশম কি বেশি?” আমি চোখ কুঁচকে তাকালাম। “তিনার চোখের মনিডা কি ঘন কৃষ্ণ বর্ণ?” আমি কিছু বলার আগেই পারুল আবার বলে উঠলো, “হ, আর স্যারের হাতেও তো ছয়ডা আঙ্গুল।” ফকির বাবা এবার সন্তুষ্ট চিত্তে মাথা ঝাকালেন, “আর কুনু সন্দেহ নাই, তুমার স্বামী একজন জ্বিন।” আমি হা করে তাকিয়ে রইলাম। বলে কি এই লোক? শিহাবকে আমি গত দশ বছর ধরে চিনি। আমাদের ছয় বছরের সম্পর্ক আর গত চার বছরের বিবাহিত সংসার। ফকির বাবার কথা অনুযায়ী ও যদি জ্বিনও হয়, তো এতো বছর পর সেই জ্বিনের রূপ প্রকাশ করার কি দরকার পড়লো ওর? আমার প্রশ্নের উত্তরে ফকির পাল্টা প্রশ্ন করলো, “সে কি বর্তমানে কোন কিছু নিয়া বেশি ব্যস্ত বা চিন্তিত?”
আমি বিড়বিড় করলাম, “হ্যা। একটা প্রজেক্টের কাজ নিয়ে “শুনো মা, এইসব দলছুট মনুষ্যরূপী জ্বিনদের ফিরায়া নেওয়ার জন্য অন্য জ্বিনেরা সবসময় চেষ্টা চালায়। মনুষ্যরূপী জ্বিনরাও সেইটা জানে। ওরা পলায় পলায় থাকে, ধরা দেয় না। কিন্তু কাজের ব্যস্ততায় তার ঐদিকে মনোযোগ কম ছিলো, এই সুযোগে ওর ভিতরে এখন অন্য জ্বিন প্রবেশ করছে। এইজন্যই তুমি ওর লাল চক্ষু দেখছো। এখন ওর ভিতরের জ্বিনটা চেষ্টা চালাবো তুমার স্বামীরে আর বাচ্চারে তাদের দ্যাশে নিয়া যাইতে। আর এতে বাঁধা পড়লে তুমার বা তুমার বাচ্চার মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। আমি পরিষ্কার দ্যাখতাছি, তুমার মাথার উপর বিপদের কালো মেঘ ঘনীভূত হইতাছে।”
ফকির বাবার কথা শুনে আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। নিজেকে নিয়ে ভাবছি না, কিন্তু শিহাব আর টিয়ার কথা ভেবে আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছে। কাঁপা গলায় জানতো চাইলাম, “কি করব এখন আমি?” ফকির বাবা দীর্ঘসময় চোখ বুজে রইলো। এরপর চোখ মেলে আমার হাতে একটা দুমড়ানো মোচড়ানো রাংতা কাগজ ধরিয়ে দিলো, “আপাতত এইটা রাখো। দুইদিন পর আইসা আমার থিকা তাবিজ নিয়া যাবা। কিন্তু এরমধ্যে যদি সে কুনু সন্দেহ করে, তাইলেই কিন্তু বিপদ। যেকোনো বিপদ বুঝলে এই কাগজের মধ্যে যেই গুড়া আছে সেইটা তার দিকে ছিটায়া দিবা। এখন তুমি বাড়ি যাও।”
বলে সে হঠাৎ স্থির হয়ে গেলো। চোখদুটো খোলা, তবে সে চোখের দৃষ্টি কোনদিকে বোঝা দায়। আমি আরও কিছু জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছিলাম, পারুল আমাকে ইশারায় থামিয়ে দিলো। হাত টেনে দূরে সরিয়ে নিয়ে বললো, “আইজ বাবা আর কথা বলবো না। দুইদিন পরে আইসা তাবিজ নিয়া যাইয়েন আফা। সাবধানে থাইক্কেন। এইসব কথা কাউরে কইয়েন না, জ্বিন যদি ট্যার পায়, তাইলে কিন্তু সর্বনাশ! আর আমি কইলাম এখন কয়দিন আর কামে যামুনা, তয় দরকার লাগলে আমারে অবশ্যই ফুন দিয়েন।” এই বলে পারুল চলে গেলো। সেই রাংতা কাগজে মোড়ানো পাউডার সাবধানে ব্যাগে ঢুকিয়ে আমি দৌড় লাগালাম বাড়ির দিকে।
বৃষ্টিতে চুপচুপে হয়ে বাড়ি ফিরলাম। বেল বাজাতে শিহাব দরজা খুলে দিলো, “আয়হায়, এ কি অবস্থা তোমার? ছাতা নিয়ে বেরোও নি! তোমার তো এসব ভুল হয়না! মা কেমন আছেন?” আমি কোনও কথার জবাব না দিয়ে ছুটে ঘরে ঢুকলাম, “টিয়া কোথায় টিয়া?” বলতে বলতে বেডরুমের দরজায় এসে দেখি টিয়া হাই চেয়ারে বসে, ওর মুখ শরীর চেয়ার সব খাবারে মাখামাখি। পিছন পিছন শিহাব এসে ঢুকলো, “কি করে যে এই বাচ্চা কাচ্চাকে খাওয়াও তোমরা? পৃথিবীর সবচাইতে কঠিন কাজের একটা নিশ্চিত!” আমি টিয়ার দিকে হাত বাড়াতেই শিহাব আটকালো, “আরে আরে কি করছো? নিজের দিকে দেখেছো? সারা গা ভেজা। তুমি যাও, আগে ফ্রেশ হয়ে আসো। এমনিতেই তোমার ঠান্ডার ধাত, ওকে আমি সামলাচ্ছি।”
এতোক্ষণে যেন আমি হুশে ফিরলাম। কেমন নরম সুর শিহাবের গলায়, ওর চোখটাও এখন আর লাল নেই। সেই গভীর কালো চোখ, যেই চোখের দিকে তাকিয়ে আমি বারবার ওর প্রেমে পড়েছি। আমার চোখ উপচে হঠাৎ জল গড়ালো, এই শিহাব জ্বিন, মানুুষ নয়? ওর থেকেই আমার ক্ষতির আশঙ্কা? সত্যি বলছে তো ফকির বাবা? সত্যিই যদি ও জ্বিন হয়, কি হবে এরপর? কি হবে আমার মেয়ের? আমার হাত পা সব ঠান্ডা হয়ে আসে। শিহাব অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, “কি হয়েছে তোমার? শরীর সুস্থ? মা ঠিক আছে তো?” আমার গলা দিয়ে কোনও আওয়াজ বেরোয় না, চোখ দিয়ে শুধু গলগল করে পানির ধারা নেমে আসে। শিহাব অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।
সারাদিন তেমন কিছু হলোনা। আমি যথাসম্ভব স্বাভাবিক আচরণ করার চেষ্টা করলাম। প্রতিদিনের মতো আজও রাত দশটা বাজতেই টিয়া ঘুমের জন্য ঘ্যানঘ্যান শুরু করে দিলো। মশারি টানিয়ে দিয়ে ওকে নিয়ে বিছানায় চলে গেলাম। শিহাব তখনও রিডিং টেবিল এ। গভীর মনোযোগে কাজ করছে। আজ রাতেও কি ওর উপর জ্বিন ভর করবে? কখন? মধ্যরাতে? আমি ওর দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখলাম। সারাদিনের উদ্বেগ উৎকন্ঠা ক্লান্তিতে এমন বিপদেও যে কখন ঘুমিয়ে গেলাম, টের পেলাম না। আজও মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলো, চোখ মেলে দেখি শিহাব বিছানায়, ল্যাপটপের দিকে নজর। গতরাতের মতো আজও ওর চোখের মনি দুটো লাল টকটকে, আগুনের মত ধকধক করে জ্বলছে। আমি শ্বাস বন্ধ করে পড়ে রইলাম। শিহাব কিন্তু ঠিক টের পেয়ে গেলো, ল্যাপটপের দিকে চোখ রেখেই বললো, “ঘুম ভাঙলো?”
আমি চুপ করে রইলাম। শিহাবের কন্ঠ আবার গমগম করে উঠলো, “টিয়াকে ওপাশে শুইয়ে তুমি মাঝখানে চলে আসো।” আমার দম এবার সত্যিই বন্ধ হয়ে আসার যোগাড়। “শুনছো? আসো এদিকে।” বলে আমার দিকে তাকালো, ওর লাল টকটকে দুই চোখে কামনার দৃষ্টি। অন্ধকারে ঝিলিক দিয়ে উঠলো ওর সাদা দাঁত, আমার দিকে দুহাত বাড়িয়ে দিলো একটা চিৎকার দিয়ে আমি উঠে বসলাম। বালিশের নিচে রাখা রাংতা কাগজ বের করে তার পাউডারটা ছুড়ে দিলাম ওর দিকে।
ডান চোখটা চেপে ধরে একটা ভয়ংকর চিৎকার দিয়ে উঠলো শিহাব। চোখ চেপে ধরেই ছুট লাগালো ওয়াশরুমের দিকে। টিয়া ঘুম ভেঙে তারস্বরে কান্না জু্রে দিলো। আমি কাঁপতে কাঁপতে কাগজ হাতে ওয়াশরুমের সামনে গিয়ে দাড়ালাম। ও বেরিয়ে আসলেই আবার পাউডার ছুড়ে মারব। নষ্ট করে দিবো ওর ঐ লাল চোখ। কিছুক্ষণ পরই শিহাব বেরিয়ে আসলো, ডান চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। আর কি আশ্চর্য, পাউডার টা পড়তেই সেই চোখের মনি একদম কালো হয়ে গেছে। এক চোখ লাল, আর এক চোখ কালো। দু’চোখে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। কি অদ্ভুত ভয়ানক দেখাচ্ছে ওকে!
আমার হাত কাপছে। কাঁপা হাতে আমি আবারও কাগজ খুললাম। পাউডারটা ছুড়ে দিতে যাবো, তার আগেই শিহাব সরে গেলো। ঘরের আলো জ্বালিয়ে এক হাতে কি যেন বের করে আনলো বা চোখ থেকে। একটা ছোট প্লাস্টিকের বক্সে ঢোকাতে ঢোকাতে বললো, “কি হয়েছে তোমার বলতো? গতরাত থেকে এমন অদ্ভুত আচরণ করছো কেন? টিয়া কাঁদছে শুনতে পাচ্ছো না, আগে থামাও ওকে।” আমি তখন হতভম্বের মতো তাকিয়ে আছি ওর হাতে ধরা লেন্সের ছোট বাক্সটার দিকে। আমার চোখের সামনেই শিহাব দাঁড়িয়ে, দুটো গভীর কুচকুচে কালো চোখ নিয়ে। ডান চোখ কিছুটা লাল, পানি ঝড়ছে এখনও। আমার ছুড়ে দেয়া পাউডারের ইফেক্ট।
“তোমার হাতে ওটা কি?” কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম।
“এটা? লেন্স।”
“লেন্স! তুমি কবে থেকে লেন্স পরতে শুরু করলে!”
শিহাব টিয়াকে কোলে তুলে নিলো, “দু সপ্তাহ আগে সানগ্লাস কিনতে গেলাম না, ঐ সময় চশমার দোকানে দুটো ছেলে এই রেড কন্ট্যাক্ট লেন্স কিনছিলো। একজন বললো, রাতের বেলা এটা পরে কম্পিউটারে কাজ করলে নাকি চোখের আরাম হয়। ওদের আলাপ শুনে কি মনে হলো, আমিও নিয়ে নিলাম একটা। ভুলেই গিয়েছিলাম। গতকাল রাত জেগে কাজ করার সময় মনে পড়লো। তবে একদম ভুয়া জিনিস, সুদিং ইফেক্ট কি হবে, আমার তো মনে হয় এটা পরে আমার চোখে আরও স্ট্রেইন পড়ছে বেশি।”
আমি অবাক চোখে তাকালাম, শিহাবের উচু কন্ঠার হাড়, লোমশ বুক আর হাতের আঙুলের দিকে তাকিয়ে হি হি করে হেসে ফেললাম। বিজ্ঞানের ছাত্রী হয়ে আমি এসব কি বিশ্বাস করেছি, ছি ছি ছি!! হাসতে হাসতে লেন্সের বাক্সটা হাতে তুলে সোজা বিন এ ফেলে দিলাম। পিছনে না তাকিয়েও স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, শিহাব আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। মনে মনে ভাবছে, এই মেয়ে পাগল হলো নাকি!
গল্পের বিষয়:
গল্প