অগোছালো অবনির গল্প

অগোছালো অবনির গল্প
আজ ১৩ই ডিসেম্বর, আমার জন্মদিন। পাহাড়ের গা ঘেষে ঘেষে হেটে আমি আমার বার্থডে সেলিব্রেট করছি।
আমি একজন আত্মকেন্দ্রিক মানুষ। জীবনটাকে একলা উপভোগ করেই হয়ত জীবনের আস্বাদ নিই। প্রতি ডিসেম্বরেই আমি পাহাড়ে ঘুরতে আসি। ১৩ই ডিসেম্বর এই অশুভ দিনটা কাছের মানুষদের থেকে আড়ালে থাকার জন্যই হয়ত আমার এই আয়োজন। এবার দিয়ে ৯টা অশুভ দিন আমি এই পাহাড়ের আশেপাশে ঘুরে সেলিব্রেট করেছি। ৯টা বছর ধরে আমি নিজের কাছ থেকেই পালিয়ে আছি।
৯ বছর পর আবার একটা অশুভ দিন আর সেই দিনটাতে আমার প্রাণের দোস্ত নীলার সাথে দেখা। দিনটাকে জীবনের সেরা উপহার মনে হচ্ছে। নীলা অনেক রিকুয়েস্ট করলো ওদের সাথে কিছু সময় আড্ডা দেয়ার জন্য কিন্তু আমি পারলাম না। “আমার সাথে আজ একজনের দেখা করার কথা আছে, তোদের সাথে কাল দেখা করবো” এই মিথ্যে কথাটা বলে চলে আসতে হলো তাকে। আমি আজকেই চিটাগং থেকে রাজশাহীতে ফিরে যাব। কাল আমার প্রাণের দোস্ত আমাকে খুঁজেও পাবে না; এই চাপা কষ্টের মাঝেও এত বছর পর নীলা আর আবিরকে একসাথে দেখতে পেয়ে বেশ ভাললাগলো। আসলে এই ভাললাগার বিশ্লেষণ করার মতো ক্ষমতা আমার নেই।
মনের সাথে যুদ্ধ তো এই নয় বছর ধরেই করে চলেছি। প্রত্যেকবারই আমি এই যুদ্ধে জিতেছি। আমার হেরে যাওয়া অবাধ্য মনটা এখনো মাঝরাতে নির্ঘুম থেকে আবিরের কথা ভাবে, এটা ভাবতেই নিজেকে নির্লজ্জ মনে হয়। কারণ আবির আমার বেস্ট ফ্রেন্ড নীলার স্বামী। আবিরকে নিয়ে ভাবার কোনো রাইট নেই অবনির। আবিরের সাথে পরিচয় হয় ভার্সিটি লাইফের সেই ফার্স্ট ইয়ারে। আমরা ক্লাসমেট ছিলাম। আমি আর নীলা ছিলাম বখাটে আড্ডাবাজ গ্রুপের সদস্য। নীলা কৌশিক, ছোটন, আর আমি, এই চারজন মিলেই আমাদের আড্ডাবাজীর বখাটে গ্রুপ ছিল। আমরা চারজন ইন্টার থেকেই বন্ধু ছিলাম। পেছনের বেঞ্চে বসেই জীবনের আস্বাদ নেয়াটাই ছিল আমাদের গ্রুপের বৈশিষ্ট্য। আসলে ভার্সিটিতে যেতাম ঐ আড্ডার মায়াতেই।
নীলা ছিল একটা শান্ত, ভদ্র, টিপটাপ, সরল, সংসারী টাইপের গৃহপালিত জন্তু। পৃথিবীর যা কিছু ভাল উপমা আছে সব নীলার বৈশিষ্ট্যে পাওয়া যাবে। সে ছিল আমার একান্ত অনুগত প্রাণের দোস্ত। আমি যেটা বলিবো সেইটা সে অক্ষরে অক্ষরে পালন করিতে বাধ্য থাকিবে এমন টাইপের দোস্ত হলো নীলা। আমি নীলাকে দোস্ত এর চেয়ে বোনই বেশী মনে করেছি। আমার বৈশিষ্ট্য ছিল নীলার উল্টো। আমি ছিলাম অগোছালো, উদাসীন, বেখেয়ালী, বেপরোয়া টাইপের মেয়ে। চুল চিরুণী না করে এক ঝাড় ঝাঁকড়া চুল ছড়িয়ে ভার্সিটিতে যেতে আমার লজ্জা করতো না। মেয়েলী ভাব ভঙ্গিমা আমার মধ্যে খুব একটা ছিল না। আমাকে ভাললাগবে এমন ছেলে পাওয়া বেশ দুষ্কর। আর আমার মধ্যেও প্রেমের আবেগের বালাই-ই ছিল না। জীবন মানেই প্রেম নয়। আমার কাছে জীবন মানেই দোস্ত ছিল।
ভার্সিটি লাইফের শুরুতেই দেখা হলো আবিরের সাথে। আবিরকে প্রথম দেখেই নীলা ক্রাশ খেলো। ছেলেটা বেশ ভদ্র টাইপের। লেখা পড়ায় বেশ মনযোগী। নীলার দিন কাটতো উঁকি ঝুঁকি দিয়ে আবিরকে দেখেই। নীলার ভাব ভঙ্গিতে আমি রীতিমত বিরক্ত হতাম। প্রেমের মতো একটা ফালতু জিনিস নিয়ে সারাদিন চাতকীর মতো চেয়ে থাকাটা বিরাট একটা হাস্যকর ব্যাপার ছিল আমার কাছে। জীবন হবে স্বাধীন মুক্ত, ঠিক দেয়াল ছাড়া ঘাসের বাগানের মতো। কারও সাথে রিলেশনে জড়ানো মানেই ফালতু কিছু বন্ড। এটা করো না, ওটা করো, এটা কেন করলে, ওটা কেন করোনি, প্রেম মানেই দিন রাত এই সব প্যানপ্যান। উফ্ আই ডিজলাইক দ্যাটজ! নীলা খুব করেই চাচ্ছিল আরো দু বেঞ্চ আগে বসতে। বুঝলাম ওটাতে আবিরকে দেখার একটু সুবিধের জন্য। এত দিন ধরে আবিরের পেছন সাইড দেখে দেখে মেয়েটা ক্লান্ত হয়ে গেছে তাই এবার সামনের এক সাইট দেখা দরকার। কিন্তু এই সামান্য চোখাচোখি প্রেমের জন্য এই পেছনের বেঞ্চের মহত্ত্ব আমি নষ্ট করতে পারি না। তাই পেছনেই বসতে হবে এটাই আমার নির্দেশ।
একদিন আমাকে অবাক করে দিয়ে নীলা আমাকে একলা রেখে দু বেঞ্চ সামনে গিয়ে বসলো। হাউ স্ট্র্যাইঞ্জ! নীলা আমার ইন্টার থেকে বন্ধু আর এই দু দিনের আবিরের জন্য আমাকে ইগনোর! এটা টলারেট করা আমার পক্ষে ইম্পসিবল! আমি নীলাকে অবাক করে দিয়ে আবিরের পাশে বসা ছেলেটাকে উঠিয়ে দিয়ে আবিরের পাশে গিয়ে বসলাম। আর মনে মনে হাসলাম, “এবার দোস্ত তুই শুধু আবিরকে নয় আমাকেও দেখ।” নীলা হতভম্ব হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
তারপর থেকে আমরা দুজন আবিরের পাশেই বসতাম। যদিও আমি ওদের মাঝখানে বসতাম কারণ নীলার আবিরের পাশে বসতে লজ্জা করতো। আমার বরাবরই লজ্জা একটু কম ছিল। কারণ এই লুতুপুতু প্রেম প্রেম ভাবটা আমার মধ্যে ছিল না। তাই হয়তো পুতুপুতু লজ্জাও নেই। আমার কাছে প্রেমের চেয়ে বন্ধুত্বের দামটাই বেশী ছিল। আবিরের সাথে আমাদের দুজনারই ফ্রেন্ডশিপ হয়ে গেল। আবির ছেলেটা বেশ নম্র আর ভদ্র গোছের। ওর পছন্দও ছিল নম্র গোছের মেয়ে। সেই দিক দিয়ে নীলা ছিল ওর জন্য সুপার পারফেক্ট। এখানে আমাকে ভাললাগার কোনো কারণই নেই। আমি সবসময় সবকিছু জোর করেই নিতাম। জোরাজোরিটা আমার বেশ লাগতো। আবির প্রথম প্রথম বিব্রত হলেও দু তিন মাসের মধ্যে তার অভ্যেস হয়ে গেছিল। বখাটে গ্রুপের আড্ডাবাজীতে আবির আর নীলাকে নিয়ে নানান রকমের হাসাহাসি হতো। মোটামোটি ভাবে সবাই ভেতর ভেতর বুঝতো ওদের দু’জনার চোখাচোখি প্রেম চলছে। ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও ওদের লজ্জা আর চোখাচোখি শেষ হয়ে বলাবলি আর শুরু হলো না।
আমি আর নীলা আলাদা হোস্টেলে থাকতাম। হঠাৎ নীলার মায়ের অসুস্থতার খবর এলে সে বাড়ি চলে যায়। সেই থেকে বখাটে গ্রুপের আড্ডাও নিথর হয়ে গেল। আমি আর আবির এক সাথেই ক্লাস করি, কফিশপে সময় কাটাই। মাঝে মাঝে রিকশা করে ঘুরতেও যাই। ইদানিং আবিরের সাথে মাঝ রাতে ফোনেও কথা বলি। তবে সেই কথাগুলো প্রেমালাপ ছিল না। আমার অগোছালো জীবনের খবরদারি করার মানুষ হিসেবে আবিষ্কৃত হলো আবির। টাইমলি খাওয়া, রাত না জাগা, অসময়ে গোসল না করা এমনকি চুল চিরুণি করার খবরদারিটাও সে শুরু করে ছিল। কেনো জানি না আমিও আবিরের সব কথা মেনে নিতে শুরু করলাম। মাঝরাতে আমার মনের সুপ্ত কথাগুলো তাকে একটা মেসেজে ব্যক্ত করতে বাধ্য থাকিলাম। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝে নিজেকে অচেনা লাগে। মনে মনে ভাবি, কি করে অবনি এত পরিপাটি হয়ে গেল?
এটা করো, ওটা করো না এই ধরনের প্যানপ্যান গুলো কেমন করে যেন মধুর হয়ে গেল। যেন আমি ঐ প্যানপ্যান গুলো শোনার জন্যই বসে থাকি। নীলা ফিরে আসার পর থেকে আবার সেই তিনজনের ঘুরাঘুরি। সেদিন ছিল ১৩ই ডিসেম্বর আমার জন্মদিন অথচ আমি বেমালুম ভুলে গেছি। অবশ্য এ ঘটনা নতুন নয়। কখনোই আমি আমার জন্মদিনসহ কোনো বিশেষ দিনই মনে রাখতে পারি না। সেদিন সকালে রেডী হয়েছি ক্লাসে যাবার জন্য হঠাৎ আবিরের ফোন এলো। হ্যালো বলার আগেই ওপাশ থেকে-
–“অবনি আজ চুল খোপা করে আসবে।” ফোন রিসিভ করেই এমন একটা উদ্ভট কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম-
–“কি উদ্ভট কথা বলছো আবির? আমার চুল কাঁধে গড়াগড়ি খায়, এটা খোপা করা ইম্পসিবল।”
–“আমি কোনো এক্সকিউজ শুনতে চাই না অবনি।”
–“খোপা আর অবনি! সবাই হাসবে আবির।”
আবির কিছু না বলেই লাইনটা কেটে দিলো। আমি খুব কষ্টে অনেকগুলো ক্লিপ আটকিয়ে খোপা করলাম। আর মনে মনে আল্লাহ আল্লাহ করছি এটা যেন খুলে না যায়। হোস্টেল থেকে নিচে নামতেই দেখলাম আবির দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ পাঞ্জাবী পরে ক্লাসে যাবে এটা ভেবেই হাসি পেলো। কিন্তু পাঞ্জাবীতে তাকে দারুণ দেখাচ্ছে। তারপর তার হাতে গিটার দেখে আমি তো অবাক! আবির যে গান গাইতে পারে সেটা সে আমাকে কখনও বলেনি। তার মত নম্র স্বভাবের ছেলে গান গায়, বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হলো। সে বলল, আজ আমাকে নিয়ে কোথায় নাকি যাবে সে। সেই উদ্দেশ্যেই রিকশায় উঠলাম। আমি আবিরকে বললাম নীলাকে ফোন করে ডাকি আমরা তিনজন একসাথেই ঘুরবো। কিন্তু আবির বলল-
–“আজকের দিনটাতে অন্তত নীলাকে ডেকো না প্লিজ!” তারপর হঠাৎ সে আমাকে চোখ বন্ধ করতে বলল। আমি তো অলরেডী তার বশীকরণের স্বীকার হয়েই আছি তাই নির্দিধায় চোখ বন্ধ করলাম। সে একটা বেলী ফুলের মালা আমার খোপায় পেঁচিয়ে দিয়ে বলল-
–“অবনি তোমার চুলের ঘ্রাণ মাতাল হবার মত।” বেলী ফুলের মৌ মৌ গন্ধ নাকে আসতেই যেন একটা মাতাল করা অনুভূতি অনুভব করলাম। আবির বলল,
–“চোখ খুলবা না কিন্তু!”
সে আমার হাত টেনে নিয়ে চুড়ি পরিয়ে দিলো। আমি চোখ খুলে দেখলাম আমার দু’হাত ভরা লাল টুকটুকে রেশমী চুড়ি। অবনি আর চুড়ি এক সাথে! অবাক হলাম, এই প্রথম আমি চুড়ি পরেছি! তবে আসাধারণ লাগছিল।
আমি বিস্ময়ের দৃষ্টিতে আবিরের দিকে তাকালাম কিন্তু আবিরের দৃষ্টিতে বিস্ময় ছিল না। মনে হচ্ছিল আবির কিছু একটার মাঝে ডুবে আছে। আমরা একটা মাঠের প্রান্তরে নদীর ধারে গিয়ে পাশাপাশি বসলাম। আবির গিটার বাজিয়ে গান গাইলোহ “তুমি আসবে বলেই আকাশ মেঘলা বৃষ্টি এখনো হয়নি তুমি আসবে বলেই কৃষ্ণচুড়ার ফুল গুলো ঝরে যায়নী তুমি আসবে বলেই সেই দিনটায় সন্ধ্যে অব্দি আমরা একসাথে ঘুরেছি। সন্ধ্যেয় সে হোস্টেলে নামিয়ে দেয়ার সময় বলল- “শুভ জন্ম দিন অবনি।”
তার উইশ করার পর আমার মনে পড়লো আজ আমার বার্থডে ছিল। সারাটা রাত একটা গভীর ভাললাগায় কেটে গেল। ইদানিং নীলা আমাকে বেশ এড়িয়ে চলে। আমি বুঝে উঠতে পারি না যে, তার কি হয়েছে! দু’দিন ধরে সে ক্লাসেধ আসছে না আর তার ফোনও সুইচ অফ পাচ্ছিলাম তাই তার হোস্টেলে গেলাম। তার রুমমেট বলল, দু’দিন ধরে নীলার জ্বর। সে খাবার দাবার তো দূরে থাক ওষুধ পর্যন্তও খাচ্ছে না। একটাই কথা বলছে, “আমি বাঁচতে চাই না।” তার রুমে ঢুকে নিথর নীলাকে দেখে আমার চোখ ছলছল হয়ে গেল। দু’দিনেই মেয়েটার শরীরের হাল কি করেছে! আমি তার কপালে হাত রাখতেই সে চোখ মেললো। আমি কিছু বলতে পারছিলাম না। একটা রোগাটে স্বরে নীলা বলল-
–“দোস্ত তুই আবিরকে ভালোবাসিস তাই না? লুকোবিনা আমি কিন্তু, আমি সব জানি।” তার কথা শুনে আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। কি উত্তর দেবো সেই ভয়ে পালাতে ইচ্ছে করছিল। মেয়েটা আবিরের ব্যাপারে এতটাই সিরিয়াস যে, আবিরের প্রসঙ্গ দিয়েই কথা শুরু করলো। আমি নিজেকে স্বাভাবিক করে হাহা করে হেসে উঠে বললাম-
–“অবনি আর প্রেম একসাথে? তোর কি এটা পসিবল মনে হয় দোস্ত?”
–“এ ভাবে কেনো বলছিস দোস্ত? তুই কাউকে ভালোবাসিস দেখে আমার খুব ভালোলাগছে। আমি চাই তোর জীবনটা সাজানো গোছানো হোক।”
–“তুই যে আবিরকে ভালবাসিস সেটা সবাই জানে, খামাখা মিথ্যে কেন বলছিস? আবিরকে আমি ছোটন আর কৌশিকের মত আমার একটা ভাল বন্ধু ছাড়া আর কিছুই ভাবি না।” নীলা লুকানোর চেষ্টা করে বলল-
–“কে বলেছে তোকে আমি আবিরকে ভালোবাসি?”
–“তোর চোখ বলছে। আজ কিন্তু আমি এসে ছিলাম তোকে বলতে যে, আবির বলেছে, সে নীলাকে ভালোবাসে।”
আমার কথা শুনে মুহূর্তের মধ্যেই নীলার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল। মনে হচ্ছে অর্ধেক জ্বর নেমে গেছে। সরল মেয়েদের এই একটাই সুবিধে, যে কোনো বুঝ নিয়েই এরা কষ্ট বিলিন করতে পারে। কিন্তু আমি তো তার মতো সরল নই তাই নিজেকে বোঝানোর ভাষা খুঁজেই পেলাম না। মনে মনে বললাম, “প্রাণের দোস্ত ভালো থাকিস আমার প্রিয় জিনিসটাকে নিয়ে।”
সেদিন নীলাকে খাবার আর ওষুধত খাইয়ে হোস্টেলে ফিরলাম। সারারাত ঘুম এলো না। নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হলো। আমার জানের দোস্ত নীলার ভালোবাসার মানুষটাকে আমি যে, সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছি সেটা নীলা যদি প্রশ্ন না করতো তবে সত্যিই আমি রিয়্যালাইজড করত পারতাম না। সারারাত জেগে জেগে আবিরের প্রতি আমার ভালোবাসাটা পরিমাপ করলাম। এমন উপছে পড়া ভালোবাসা বুকে চেপে রেখে সারাটা জীবন কি করে কাটাবো সেটা ভেবেই দম আটকে আসছিল। পরের দিন আবিরের সাথে দেখা হলো ক্যাম্পাসে। তার হাতে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিলাম। যে চিরকুটটা আমি অনেক দিন আগে নীলার বইয়ের ভেতর থেকে ফাজলামী করে চুরি করে ছিলাম। সেখানে লেখা ছিল- “আবির খুব ভালোবাসি তোমাকে” নীলা”  চিরকুটটা পড়ে আবির প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো। আমি হা হা করে হেসে বললাম –
–“হ্যালো মিস্টার, নীলা তোমাকে খুব ভালয়বাসে।”
–“আর তুমি?”
–“অবনি আর ভালোবাসা এই দুটো একসাথে মানায় না সাহেব।”
–“তাহলে এতদিনের এতকথা সব মিথ্যে?”
–“একটাও কি প্রেমের কথা বলেছি বলো? বরং নীলা তোমার প্রেমে পড়েছিল বলেই তোমার সাথে ফ্রেন্ডশিপ করেছিলাম। আর আড্ডাতে তো সব ফ্রেন্ডরা জানেই যে তোমার আর নীলার মাঝে ইয়ে চলছে।”
–“সত্যিই কি ইয়ে চলছিল অবনি?”
–“মেয়েটা তোমাকে ভালোবেসে মরতে বসেছে আবির, এরপরেও কি করে বলি যে, কিছু চলছে না?”
আবির চেঁচিয়ে উঠে বলল-
–“একশটা মেয়ের মনে আমার জন্য প্রেম উতলে পড়তে পারে আই ডোন্ট কেয়ার অবনি। কিন্তু আমার মনে কার ফাগুনে রঙ লেগেছে সেটা অবশ্যই আমার দায়িত্ব”
–“কি বলতে চাইছো আবির? নীলাকে তুমি ভালোবাসো না?”
–“বলতে চাইছি আমি তোমাকে ভালোবাসি অবনি!”
–“কিন্তু আমি তো তোমাকে কখনোই কৌশিক আর ছোটনের থেকে আলাদা ভাবে দেখিনি! বরং আমি তোমাকে আমার বন্ধুর প্রেমিক ভেবেছি।”
–“বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হচ্ছে যে, তোমার মাঝে আমার জন্য ভালোবাসার ছিটে ফোঁটাও ছিল না বা নেই কিন্তু তোমার জন্য আমার এক বুক ভালোবাসা আছে অবনি!”
–“নীলার জন্য রেখে দাও ওগুলো। আর তুমি যেমন টিপটাপ শান্ত স্বভাবের মেয়ে পছন্দ করো তার একটা বৈশিষ্ট্যও কি আমার মধ্যে আছে আবির? বরং সব বৈশিষ্ট্য নীলার মধ্যে আছে। এই ক্যাম্পাসের কাউকে আমার প্রেমে পড়তে দেখেছো তুমি?”
–“তোমার সাথে চলতে চলতে কখন যে আমার ভালোলাগাগুলোও বদলে গেছে সেটা আমি বুঝতেই পারিনি অবনি। আমি চাইনা টিপটাপ শান্ত স্বভাবের মেয়ে। আমি ঐ অগোছালো দূরন্ত অবনিকেই ভালোবাসি। যে চুল চিরুণী করে না, যে চুল বাঁধতে পারে না, যে টাইমলী খাবার খায় না, যে নিজের বার্থডে পর্যন্তও মনে রাখতে পারে না; আমি সেই অবনিকেই ভালোবাসি!” আবিরের কথাগুলো শুনে আমার জাস্ট মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। কত বড় হতভাগী আমি যে, এত ভালোবাসা দু’হাত ভরে নেবার ক্ষমতা আমার নেই। এত অসহায় কেন আমি মাবুদ? আমি নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম-
–“দেখো আবির আমি কখনোই তোমাকে নিয়ে এসব ভাবিনি। আসলে এই সব প্রেমমাখা আবেগ আমার নেই। বরং নীলা অনেক প্রেমময়ী। আমি শিওর সে তোমাকে খুব হ্যাপী রাখবে।”
–“আমার জীবন নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবার দায়িত্বটা আমারই তাই তুমি এটা নিয়ে আর কথা বলো না প্লীজ!”
–“আমাকে যদি সত্যিই ভালোবেসে থাকো তবে আমার কসম নীলাকে রিফিউজ করো না প্লিজ! তাহলে আমি কিন্তু মরে যাব আবির!” আহত স্বরে সে বলল-
–“আমাকে তুমি একটুও ভালোবাসোনি অবনি?” আবিরের এই প্রশ্নে থমকে যাই আমি। কি বলবো? পৃথিবীর সব ভাষাটা যেন অচেনা লাগছে। তবুও স্বাভাবিক ভাবেই হাহা করে হেসে জবাব দিলাম-
–” আবির এই সব কথা আমার সাথে জাস্ট যায় না বুঝলে।” আমি আর কথা না বাড়িয়ে আবিরের সামনে থেকে সরে এলাম। নম্র ছেলেরা বুদ্ধিমান হয় তাই যেকোনো ভাবেই সে বুঝে ফেলতেই পারে যে, আমার কথাগুলো সব বানানো। তবে নীলাকে বাঁচানো কঠিন হবে। আবিরের ভালোবাসাটা দুমড়ে মুচরে আহত করে এলাম। কি নিষ্ঠুর আমি! কি নির্মম আমি! সেই রাতটা কি করে পার করেছিলাম তার সাক্ষী আমি ছাড়া কেউ ছিল না।
পরের দিন নীলাকে আবিরের সামনে নিয়ে গিয়ে ওদের দুজনকে মিলিয়ে দিলাম। আবিরের হাতে নীলার হাত রাখলাম। আবির নির্দ্বিধায় নীলাকে গ্রহণ করে নিলো। একটিবারও আবির আমার দিকে তাকালো না। হয়ত আমার প্রত্যাখ্যানের জবাব দিলো। যাই হোক আমি তো এটাই চেয়েছিলাম। তারপর আড়ালে গিয়ে দেখলাম ওরা দুজন হাত ধরে হেটে চলে যাচ্ছে। মনে মনে নীলাকে বললাম, “দোস্ত আমার সব চেয়ে পছন্দের জিনিসটা আজ তোকে উপহার দিলাম রে, তুই ওটাকে আগলে রাখিস কিন্তু!” কেন জানি না তখন আর কাঁন্নাটাকে আটকে রাখতেই পারলাম না। নিচে বসে পড়লাম তারপর হাউ মাউ করে কাঁদছি হঠাৎ “অবনি” ডাক শুনে পেছনে ফিরে দেখি ছোটন দাঁড়িয়ে। আমি তাকে দেখে তাড়াতাড়ি করে চোখের পানি মুছে কিছু বলতে যাব কিন্তু কাঁন্না ছাড়া কোনো কথাই বের হচ্ছে না। আমি ছোটনের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁন্না লুকাচ্ছি অথচ আমার ঠোঁট অবিরাম কেঁপে চলেছে। অনেক চেষ্টা করে বললাম-
–“জানিস দোস্ত বাসা থেকে ফোন আসছে আম্মু খুব আসুস্থ তাই মনটা একটু খারাপ।” এইটুকু বলতেই আমি কেঁদে ফেললাম। ছোটন আমার মাথায় হাত রেখে বলল-
–“অবনির সাথে মিথ্যা, জাস্ট যায় নারে দোস্ত।” তার কথা শুনে আমি আবার হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলাম। এটা ছাড়া যে আর কোনো আওয়াজই বেরুচ্ছে না।
–“নিজের ভালবাসাকে দান করে দিয়ে এই শূন্য জীবনটাকে নিয়ে কি করে কাটাবি দোস্ত? কেন এমন করলি তুই? কেন নিজের সাথে এত বড় বিশ্বাস ঘাতকতা করলি?”
–“আমি নীলাকে খুব ভালোবাসিরে, আবিরকে ছাড়া সে বাঁচতে পারবে না, মরে যাবে।”
–“আর অবনি কি নিয়ে বাঁচবে?”
–“আমি সত্যিই জানি না রে। তুই বল না রে দোস্ত, আমি কি নিয়ে বাঁচবো? আবির ছাড়া যে আমার পৃথিবীতে কিচ্ছু নেই, কিচ্ছু নেই।”
–“তাহলে কেন এমন করলি দোস্ত?”
–“বল না দোস্ত আমি সারা জীবন নিজের সাথে বঞ্চণা করে কাটাতে পারবো তো? কখনো যদি আবিরকে আমার নিজের করে পেতে ইচ্ছে করে তবে সেই ইচ্ছের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আমি জয়ী হতে পারবো তো?”
–“জানি না”
–“পারবো আমি, আমাকে যে পারতেই হবে।
প্লিজ কখনো ওদেরকে বলিস না যে, আমি আবিরকে ভালোবাসি!”
সেই থেকে আবিরকে দেখতে না পাওয়ার বিরহে আমি রোজ একটু একটু করে দগ্ধ হয়েছি। এতটা বছরেও কষ্টের রঙ একটুও হালকা হয়নি। এই বিয়োগ ব্যাথায় রোজ আমি একবার করে মরে গেছি। আবিরের দেয়া সেই রেশমী চুড়িগুলো খুব করে আগলে রেখেছি। মানুষটাকে তো আগলে রাখতে পারিনি তাই তার দেয়া উপহারটাকে নয় বছর ধরে যত্ন করে রেখেছি। মন খারাপের ভয়ানক রাতে চুড়িগুলোকে পাশে নিয়ে শুয়ে থাকি। চুড়িগুলোকে বলি, “তোর আবির ভালো আছে।”
সেদিনই আমি ভার্সিটি আর ঐ শহরটা ছেড়ে চলে এসেছিলাম। আমার দুটো ভালোবাসার মানুষকে একসাথে দেখে
খুশি হবার মতো বড় আর উদার মন আমার ছিল না, হয়ত আজও নেই তাই ওদের একসাথে দেখে আজকেও আমি পালিয়ে যাচ্ছি। আজও বুঝে উঠতেই পারলাম না যে, আমি প্রতিনিয়ত কার থেকে পালাচ্ছি! গল্পটা হয়ত এখানেই শেষ হয়ে যেতো। কিন্তু হোটেল থেকে বের হয়েই নীলার সাথে দেখা হয়ে গেল। তাকে দেখে আমি আঁতকে উঠলাম। কিছু বলার ভাষা নেই আমার। কি বলবো বুঝতে পারছি না। সে আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল-
–“পালিয়ে যাচ্ছিস অবনি?”
–“পালাবো কেনো?”
–“এতটা বছর ধরে তো পালিয়েই আছিস। তোর মতো স্বার্থপর বন্ধু বোধহয় আর কারও নেই রে। আমার দূর্ভাগ্য যে, কোনো একদিন তোর মতো সেলফিশ আমার বন্ধু ছিল। তাই তোকে আর দোস্ত বলতে পারছি না।”
–“ঠিকই বলেছিস।”
–“আমি সরল বলে তুই আমাকে এ ভাবে ঠকাতে পারলি অবনি?”
–“কি ভাবে ঠকালাম তোকে?”
–“সেদিন আমার রুমে এসে বলে ছিলি যে, আবির নীলাকে ভালোবাসে, আমি সেটাই বিশ্বাস করে ছিলাম। দু দিন পর আবিরের হাতে হাত রেখে আমাকে মিলিয়ে দিয়ে তুই সেই হারিয়ে গেলি। তুই চলে যাবার পর আবির কি বলে ছিল জানিস?
–“কি বলেছিল?”
–” সে বলে ছিল, ‘আমার জীবনে যে আকাশটা দেখছো ঐ আকাশটার নাম অগোছালো অবনি! ঐ যে সূর্যটা দেখছো ঐ সূর্যের নাম অগোছালো অবনি, আমার শ্বাস প্রশ্বাসের নাম অগোছালো অবনি। আমার জীবণ জুড়ে সামান্য একটু যায়গাও যদি থাকতো যেখানে অবনি নেই তবে সেখানে আমি তোমাকে রাখতাম নীলা।’
যে মানুষটার মনে আমার জন্য কিঞ্চিত যায়গাটুকুও নেই, যে মানুষটার জীবনের কোনো এক প্রান্তে গিয়েও আমার জন্য এতটুকুও যায়গা দিতে পারবে না, সেই মানুষটাকে আমি কি করে বিয়ে করতাম অবনি? আবির আর আমার বন্ধুত্বটা ছিল, ওটা আমি নষ্ট করিনি। আমি নিজে দেখেছি, মানুষটা এই নয়টা বছর ধরে নিরবে তোর জন্য অপেক্ষা করেছে। সে কখনোই তোকে খুঁজেনি, সে আজ অব্দি বিশ্বাস করে যে, তার সেই অগোছালো অবনি একদিন অবশ্যই তার কাছে ফিরে আসবে। কত বড় সৌভাগ্য নিয়ে তুই পৃথিবীতে এসেছিস! নয় বছর ধরে ফেরারী হয়েও আবিরের মনপ্রাণ জুড়ে তুই লুটিয়ে আছিস। অথচ দেখ আমি কাছাকাছি থেকেও আবিরের মাঝে কোথাও নেই।
জানিস অবনি, আমি আর বেশী দিন বাঁচবো না, আমার কোলন ক্যান্সার হয়েছে। তাই আবিরকে বললাম, ‘জীবনের শেষ কটা দিন আমাকে নিয়ে ঘুরতে যাবে আবির? কিছু ভালো স্মৃতি চোখে ভাসিয়ে হাসি মুখে মরতে চাই!’ তাই তাকে নিয়ে পাহাড়ে ঘুরতে এসেছি। আমার ভাগ্য কতটা ভালো হঠাৎ তোকেও পেয়ে গেলাম।” আমি নীলার কথাগুলো শুনে স্তম্ভিত হলাম। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিনা। আমার প্রানের দোস্তের ক্যান্সার! আমি আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না। তাই তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললাম। নীলা আমাকে শান্ত করে বলল-
–“অনেক তো বেঈমানী করেছিস, আজ একটা কথা রাখবি অবনি?”
–“বল দোস্ত আজ তোর সব কথা রাখবো প্রমিস।”
–“নিজের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করেছিস, আমার সাথেও বিশ্বাস ঘাতকতা করেছিস ঠিক আছে কিন্তু ঐ যে দূরে দাঁড়িয়ে তোর জন্য যে মানুষটি নয় বছর ধরে অপেক্ষা করছে, তার সাথে আর বঞ্চনা করিস না প্লিজ”
আমি তাকিয়ে দেখলাম দূরে আবির দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু নীলার প্রশ্নের জবাব নেই আমার কাছে।
–“আবিরের সাথে আর বঞ্চনা করিস না প্লিজ। আমার জীবনের শেষ ক’টা দিন আমি আমার দুটো প্রিয় মানুষকে একসাথে দেখতে চাই।” নীলার কথায় আমি স্তম্ভিত হয়ে পিছিয়ে গেলাম। এত বছর পর এটা কি করে সম্ভব! কি বলবো আমি? এখন কি বলা উচিত আমার? হে আল্লাহ এ কোন পরীক্ষায় ফেললে আমাকে? যে মানুষটার বিচ্ছেদের বিরহের অনলে পুড়ে পুড়ে আমি নিঃস্ব প্রায়, অথচ আজ তাকেই গ্রহণ করতে আমার ইতস্তত লাগছে। কি করবো কিছু ভেবেই কুলকিনারা পাচ্ছি না। নীলা আমার সম্মতির অপেক্ষায় আমার মুখপানে চেয়ে আছে, তাকে ‘না’ বলবো কি করে?
–প্রমিস করেছিস কিন্তু! আমার জীবনের শেষ কটা দিন আমাকে উপহার দে নারে দোস্ত! প্লিজ না বলিস না!”
আমি স্তব্ধ দাঁড়িয়ে আছি? দূরে একাকী দাঁড়িয়ে আছে আবির। নয় বছর ধরে জমানো অভিমান তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত জড়িয়ে আছে। জানি না তার এই অভিমান আমি বিলীন করতে পারবো কি না। নীলা আহত দৃষ্টিতে একটা ম্লান হাসি মুখে এঁকে আমার দিকে চেয়ে আছে! আমি এক পা দু পা করে এগোচ্ছি আবিরের দিকে….
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত