– দেখুন আমি আপনাকে শুধুমাত্র আমার মেয়ের জন্য বিয়ে করেছি। আমার স্ত্রীর অধিকার দিতে পারব নাহ। যদিও কথা টা আগে থেকেই বলা। তবুও আরেকবার মনে করিয়ে দিলাম।
– ধন্যবাদ। আমি আপনার মেয়ের মা হয়েই এ বাড়িতে এসেছি। আপনার স্ত্রী হয়ে নয়। ভরসা করতে পারেন। বিশ্বাস ভাঙব না।
কথাটা শুনেই চমকে উঠলো আরাফ। পরিচিত কন্ঠস্বর আর পরিচিত কথা। আজ আরাফ আর আশার বিয়ে হলো। বিয়ে না বলে চুক্তি বলা যেতে পারে। বিয়ে মানে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক তৈরি হওয়া। দুজন দুজনার সুখ-দুঃখ, ভাল-খারাপ সবসময় পাশে থাকার শপথ নেয়া। কিন্তু এখানে অন্যরকম হয়েছে। আরাফ আশাকে বিয়ে করেছে তার ১ মাস বয়সী মেয়ে সাধনা কে দেখাশোনা করার জন্য। সাধনার জন্মের সময় ওর মা মারা গিয়েছে। তাই ওর জন্য মা প্রয়োজন। আয়া দিয়ে বাচ্চা মানুষ করলে সঠিক শিক্ষা পাবে না বলে গরীব দেখে শিক্ষিত মেয়ে বিয়ে করিয়ে দিয়েছে আরাফ এর মা বাবা। আর সাধনার নতুন মা হলো আশা যে কিনা দুই বছর আগে আরাফ এর প্রেমিকা ছিল।
শুধু মাত্র পরিবারের জন্য সেদিন আরাফ সমস্ত সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে আরেকজন কে বিয়ে করে নেয়। কারন আশার পরিবারের আর্থিক অবস্থা মোটেও ভাল ছিল না। আর আশা দেখতে ততটা সুন্দরীও নয়। আশার অভিযোগ করার যথেষ্ট কারণ থাকা সত্ত্বেও সে সেদিন চুপ ছিল। ঘরোয়া ভাবে কোন রকম আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই আরাফ আর আশার বিয়ে হয়। আরাফ আশাকে বিয়ের আগে দেখে নি। ওর মা-ই কথা বলেছে। আশার বাবা মা রাজি ছিল না। আশা অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছে। কিন্তু একজন শিক্ষিতা মেয়ে হয়ে আশা এমন সিদ্ধান্ত কেন নিল সেটা কেউই বুঝতে পারলো না। আরাফ ঘরে ঢুকে বিছেনায় বসা আশার দিকে না তাকিয়ে হাতের ঘড়ি খুলতে খুলতে উপরের কথা টা বললো। চমকে গিয়ে তাকিয়ে দেখে আশা মুচকি হেসে তাকিয়ে আছে সাধনা কে কোলে নিয়ে।
– সাধনা কে ঘুম পারিয়ে দিয়েছি। আপনি শুয়ে পড়ুন। আমি সাধনা কে নিয়ে পাশের ঘরে যাচ্ছি।
– তুমি? কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব হতে পারে?
– কেন হতে পারে না?
– তুমি বিয়ে করো নি?
– মনে একজন কে জায়গা দিয়ে সেখানে জোর করে অন্য কাউকে কি করে বসাই বলুন?
সবাই তো স্বার্থপর হতে পারে না! আরাফ মাথা নিচু করে ফেলল। আসলেই সে স্বার্থপর। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। কিন্তু এক দিক থেকে খুশি হয়েছে যে আশার মত এত ভাল একটা মেয়ে ওর জীবনে এসেছে৷ যে কিনা ওকে সর্বস্ব দিয়ে ভালবাসত। কিন্তু ওর সাথে অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছে। ক্ষমা চাইবে ভাবছে। ততক্ষণে আশা দরজার কাছে চলে গিয়েছে।
– আশা শোনো।
– হ্যাঁ বলুন।
– আমাকে ক্ষমা করে দাও তুমি।
– কিসের জন্য?
– তোমার সাথে এত বড় অন্যায় করেছি আর তুমি আমার মেয়ের জন্য এত বড় স্যাক্রিফাইস করলে। (ছলছল চোখে)
– উহু। স্যাক্রিফাইস নয়। ঋণ শোধ করেছি শুধু।
– কিসের ঋণ?
– এই যে আমার মত অযোগ্য মেয়েকে করুণা করে একসময় ভুল করে ভালোবেসে ছিলেন, সেই ঋণ।
– এভাবে বলছো কেন? ভুল তো মানুষ ই করে। তাই না?
– হুম, সেটা আমি করেছি। আমার নিজের সীমা ভুলে যাওয়া অনেক বড় ভুল ছিল। আর তাই আমি শাস্তি পেয়েছি।
এটা বলেই পাশের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়লো। আরাফ সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। বারবার অতীতের কথা গুলো মনে পড়ছে। গায়ের শ্যামলা রঙ দেখেই প্রেমে পড়েছিল। আর সেই কারনেই ছাড়তে হলো। আরাফই আগ বাড়িয়ে ভালোবাসার কথা বলেছিল। আশা প্রথমে রাজী হয়নি পরিবারের অস্বচ্ছলতার কথা ভেবে। কিন্তু আরাফ আশ্বস্ত করেছিল, সে সব সামলে নিবে। কিন্তু ঘটলো তার বিপরীত। অন্যায় হলো আশার সাথে। আর নিজেকে সামলাতে হলো তার। যদিও আশার মনে আক্ষেপ নেই কোন। সে নিজের মন কে কঠিন করে নিয়েছে। আগে যতটা হাসিখুশি স্বভাবের ছিল এখন ততটাই কঠিন স্বভাবের। তবে মুচকি হাসিটা ধরে রেখেছে এখনো। দিনশেষে এই কৃত্রিম হাসিটাই তার প্রাণ।
যথেষ্ট স্বল্পভাষী এবং বুদ্ধিমতী মেয়ে। তাই শশুড়বাড়ি তে অল্প দিনে সবার মন জয় করে নিল। তবে আরাফের সাথে কোন কথা বলে না। এমনকি প্রয়োজন হলে তা অন্য কাউকে দিয়ে বলায়। আরাফ বেশ কয়েকবার চেস্টা করেছে কথা বলার জন্য। কিন্তু আশা একটা কথাও বলে নি। সাধনাকে নিজের মেয়ের মত যত্ন করে। সেও তার মায়ের ভক্ত। কেউ দেখলে বুঝবেই না যে আশা সাধনার সৎ মা। একদিন বিকেলে আশা ছাদে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।আকাশে ঘন কালো মেঘ করেছে। এমন গুমোট ভাব দেখে আশার পুরোনো কথা গুলো মনে পড়ে গেল। না চাইতেও চোখ জলে ভিজে গেল।
– আচ্ছা আশা, আমাকে কখনো ছেড়ে যাবে না তো?
– বিশ্বাস ভাঙব না, ভরসা করতে পারো।
– সত্যি?
– হুম। তিন সত্যি।
বিশ্বাস জয় করার মানুষ টা নিজেই বিশ্বাস ভেঙে দিল। আজ আবার নিজের প্রয়োজনে ভালবাসতে চাইছে। কি অদ্ভুদ, না? চাইলেই কি আমার দুইটা বছর ফেরত আসবে? আমার নির্ঘুম রাত গুলো কি ফিরিয়ে দিতে পারবে? পারবে নাহ। আমি আমার মন কে কঠিন করে তুলেছি। এখানে মাতৃত্ব ছাড়া অন্য কোন অনুভূতি নেই, কোন ভালবাসা নেই। বেঈমানকে আর যাই হোক দ্বিতীয় বার ভালবাসতে নেই। এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেল। তাকিয়ে দেখে আরাফ হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে হাতে বেলিফুলের মালা নিয়ে। ওর খোঁপায় মালাটা গুঁজে দিতে যাবে তখনই সরে গেল।
– আমি আপনার সন্তানের মা হয়ে এ বাড়িতে এসেছি আরাফ সাহেব। আপনার স্ত্রী হয়ে নয়।
– সব কিছু কি ঠিক করা যায় না?
– নাহ। মন মরে গেছে, ভালবাসার অনুভূতি শেষ হয়ে গেছে।
এখন আমি শুধুই একজন মা। দেখুন না নিয়তি, যেই আমি অযোগ্য বলে আপনার স্ত্রী হতে পারিনি, সেই আমি আপনার সন্তানের মা। আর একটা কথা আর কখনো স্ত্রীর অধিকার চাইলে সেদিন আমি এই বাড়ি থেকে চলে যাব। আপনার সন্তান আবারো মা হারা হবে। আরাফ আর কিছু বললো না। ভেজা চোখে আশার চলে যাওয়া দেখছিল। আশা চোখ মুছে মনে মনে ভাবলো, থাক না কিছু অপূর্ণতা।
গল্পের বিষয়:
গল্প