এক ঝড়ের রাতে উনার এলো জ্বর। সে’কি জ্বর বাবা। আমি তার পাশেই ছিলাম। আমি তার খুব কাছে ছিলাম তবুও তার পাগলামি যেন কমেই না। রাত বাড়ে তার পাগলামি যেন বাড়ে। সে পাগলামি করতে করতে আমাকেও যেন পাগলী বানিয়ে ছাড়ছে। আমি তার কত কাছে আছি তবুও যেন সে আমাকে আরও কাছে চায়। তার এইসব দেখে আমি মাঝেমাঝেই অবাক হই! ‘মানুষ টা এমন কেন?’ ঝগড়া দূরে থাক! তাকে আমি যতোই কটূ কথা বলিনা কেন সে কিছুই মনে করবেনা আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলবে ‘ভালোবাসি’ তার মুখে এই শব্দটা শুনতে শুনতে আমি একপ্রকার বিরক্ত। যখন-তখন কারণেঅকারণে তার মুখে ‘ভালোবাসি’
সেদিন বাবা-মা মানে শশুর-শাশুড়ি কেও বাড়ি ছিলেন না। এক আত্নীয়ের বাড়িতে গেছিলেন। সেই রাতে আমার সাহেবের এলো জ্বর। বাইরে বাজ পড়ে আর উনি আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। আর বারবার বলে ‘ও মায়া আমি যদি আর না বাঁচি?’ আমি বিরক্তি নিয়ে বলি ‘উফফ আপনার কিচ্ছু হবেনা চুপ করুন’ সে থামেইনা। আবার কিছুক্ষণ পর বলবে ‘মায়া আমি মনেহয় মরেই যাবো’ আবার বিরক্ত নিয়ে বলি ‘উফফফ চুপ নাহলে মুখ শেলাই করে দেবো কিন্তু’
বাইরে বৃষ্টির ঝাপটা বাড়ছে ছাদের পানি পাইপ দিয়ে পড়ছে তারই শব্দ রুমে আসছে। মাঝেমাঝে আশেপাশে বাজ পড়ার শব্দ। যদিও আমি ভয় পায় তবুও আমার সাহেব আমার থেকে বেশি ভিতু। সে আমাকে জড়িয়ে ধরবে তো ধরবেই। এসেছে জ্বর কই চুপচাপ ঘুমিয়ে থাকবে তা-না বলবে
— মায়া আমি শেষ (শেষ মানে?)
– মায়া আমি মরে যাবো মনেহয় (মানে কি?)
– মায়া আমাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরো (ধরেছি তো বাবা)
– মায়া হাতটা দাও, আমার মাথায় হাত দিয়ে রাখো (আচ্ছা)
– মায়া বুকের মাঝে কেমন যেন করতেছে, আচ্ছা বউ তুমি কি অন্যের হয়ে যাবা? (ধুরো)
– বউ আমি তোমারে অনেক ভালোবাসি। মাথার মধ্যে কেমন জানি ঘুরতেছে বুঝলে। (বকবক কম করুন ঘুমান)
– জান আমি ঘুমালে তুমি কি হারিয়ে যাবা? (ওরে আল্লাহ না আমি কই যাবো)
– তুমি হারিয়ে গেলে আমি কান্না করবো কিন্তু (হারাচ্ছিনা তো)
সে আমাকে নানান প্রশ্ন করবে। আর তাকে জড়িয়ে ধরে আছি তবুও বলবে ‘মায়া শক্ত করে। আরও বেশি শক্ত করে ধরো খুব শীত লাগছে’ আগে বিরক্ত হতাম ভাবতাম আমার বর কি সাইকো? পরে বুঝলাম আমি তার জীবনের সবথেকে মূল্যবান। আমি হারিয়ে গেলে সে বাঁচতেই পারবেনা। সাইকো তবে আমার জন্য শুধু। আমার মুখ থেকে ভালোবাসি শোনার জন্য তার কত পাগলামি বাবাহ! আর যদি আমি রাগ করি বা অভিমান। সেদিন সে খাবেনা কথা বলবেনা। মেয়েদের মতো আমার পেছন পেছন ঘুরবে আর কান্না করবে। একটা ছেলে বা ব্যাসিক্যালি ছেলেরা যে এতো ভালোবাসতে পারে উনাকে না দেখলে বুঝতেই পারতাম না। ভালোবাসা দেখেছি আমি উনার চোখে।
শাড়ি পরা ছিলো আমার ভিষণ এলার্জির কাজ। তবে তার ঘর করার পর আমাকে এলার্জির ট্যাবলেট খেয়ে নিতে হয়েছে। সে অফিস থেকে ফিরে আসার পথে সামনে যা দেখবে তাই কিনে আনবে। শতবার বলি সে শুনবেনা ওই এক কথা ‘আমি কী মানুষের বউকে দেই হ্যাঁ? আমি আমার বউকে দেই’ এই প্রশ্নের উত্তর নেই। এজন্য চুপচাপ তার দিকে তাকিয়ে থাকি।
আজ ঝড়ের রাতে উনার পাগল পাগল সব প্রশ্ন শুনে ফিরে গেলাম সেই ১৮ সালে। উনার সাথে তখন আমার পরিচয়। দীর্ঘ দুইটা বছর সে আমার সাথে কথা বলে। এক কোটিবার সে আমাকে প্রপোজ করে আর আমি তাকে রিজেক্ট করি। সে আবার নতুনভাবে প্রপোজ করে আমিও রিজেক্ট করি। তবুও আমি তাকে ভালোবাসতাম। কেন জানি তাকে ‘না’ বলার মাঝে একটা তৃপ্তি পেতাম। সে আমার উপর খুব রেগে থাকতো আমি বুঝতাম। বাবা আমার জন্য পাত্র দেখা শুরু করে। আমি উনার কথা বাবাকে বলেছিলাম। বাবা আমাকে বলেছিলো ‘গ্রামে তোমাকে বিয়ে দেবোনা আমি’ বাবার সাথে খুব কথা কাটাকাটি হয়। আর সেই রাতেই আমি বাসা থেকে বের হয়ে বাসে উঠি। উনাকে বলিনি কারণ বললে সারারাত ঘুমাবেনা আর আমার চিন্তাতে অসুস্থ হবে। সকালে বাস যখন তার থানার কাছাকাছি তখন একটা কল দিলাম “এখানে আসুন একবার”
উনি যেন আকাশ থেকে পড়লেন। আমি বোরখা পরে এসেছিলাম আমাকে দেখার কোনো উপায় নেই কারও। উনাকে আমি ছবিতে লক্ষবার দেখেছি। উনি জানেওনা উনার কয়েকশো ছবি আমার গ্যালারী জুড়ে। উনি এলেন তারপর আমাকে কল দিলেন। আমাকে দেখে যেন আবার উনি আকাশ থেকে পড়লেন। উনার চোখমুখ খুশিতে যেন বাধ ভেঙ্গে যাবে। আমি উনার পরিবার সম্পর্কে আগেই জানতাম। উনার বড়ভাই বিয়ে করেছেন কয়েক মাস হলো। উনি ছোটো ছেলে। একটা রিক্সা নিয়ে বাড়ির দিকে উনি এগোলেন। উনি বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছিলেন। আর কেমন লজ্জা পাচ্ছিলেন। ওই মুচকি হাসি যে আমাকে পাগলী করে সেই খোজ কী সে রাখে?
বাড়িতে গেলাম আমার নাম মায়া শুনেই সবায় বুঝে গেলো। কারণ আমার নাম সবায় শুনেছে কেও দেখেনি। ওর আম্মা আমাকে দেখে ভিষণ খুশি হলেন। আর সেই রাতেই আমাদের বিয়ে! আমার বাবা খুব রেগে ছিলেন আমার উপর। কারণ উনার জেদ উনার কাছে বড়। আর আমার কাছে আমার ভালোবাসা। বিয়ে হয়েছে কতদিন হলো আজও তাকে ‘ভালোবাসি’ বলা হয়নি। অথচ তার কিছু হলে আমি অস্থির হয়ে পড়ি। সে এমনি একটু পাগল পাগল আছে সেটা আমার শশুর বাড়ির লোক জানে। আর বিয়ের আগেই উনার ঘরজুড়ে শুধু আমার নাম। আজও আমার মুখে ভালোবাসি শোনার জন্য তার কত আপ্রাণ চেষ্টা।
সেদিন দেখি হাত কেটে নিয়ে বসে আছে। ভয়ে আমাকে বলছেই না। তার মুখ দেখেই বুঝেছি কিছু একটা হয়ছে। বলবেই না আমাকে! পরে হুমকি দিলাম বাবার বাড়ি চলে যাবো আর কোনোদিন ফিরবনা। এইটুকু বলতেই দেখি তার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম। পরে ‘স্যরি তো বাবা কানে ধরছি আর কোনোদিন বলবো না প্লিজ কান্না করবেন না আমি সহ্য করতে পারিনা’ তার কান্না থামেইনা। পরে তাকে জড়িয়ে ধরতে হলো তার কপালে চুমু দিতে হলো। সে যেন ছোটো বাচ্চা। পরে জানলাম তার হাত কেটেছে সেই ব্যথার থেকেও বেশি ব্যথা ওইযে আমি বাবার বাড়ি যাবো এটা।
আমাকে এক মিনিট যদি দেখে কোনো ছেলের সাথে চ্যাটিং করতে অমনি গাল ফুলে ঢোল। পেটেপেটে তার যে কত অভিমান আছে সেই ভালো জানে। মাঝেমাঝে ভাবি আমি কোন নাটকের স্যুটিং করছিনা তো?? একটা মানুষ কিভাবে পারে এতো ভালোবাসতে? তার চোখে আমি ভালোবাসা দেখি? তার হাসিতে তার দরাজ কণ্ঠে আমি ভালোবাসা দেখি। তাকে নিয়ে লিখতে বসলে লিখা যেন শেষ হতেই চায় না।
শুধু কি জ্বর উনার কবে কি হয়েছে যেদিন ভয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরেনি? আর তাকে জড়িয়ে ধরলে শক্ত করে ধরতে হবে। ভিষণ শক্ত বাবা গো। আমার না খুব হাসি পায় তার পাগলামি গুলো দেখে। আমাকে হাসিখুশি রাখার জন্য তার কত পাগলামি চলে সারাদিন। তবুও মানুষ টা খুব ভাল। উনার যাকিছু সব যেন আমারি জন্য।
বাসরঘরের কথা মনে হলো। কবে যে আমি বলেছিলাম আইসক্রিম খাবো মনে নেই আমার। তবে উনার দিব্যি মনে আছে! আমাকে অনেক গুলো আইসক্রিম দিয়ে বলল ‘তোমার জন্য’ আর আমার হাত ধরতে যেয়ে তার সে’কি হাত কাঁপাকাঁপি আজও মনে পড়ে। আবার তার তুতলে ফেলা। ছেলেটা একটু বেশিই নার্ভাস। ভিতুও সবকিছুতে আমার পরামর্শ ছাড়া এক বিন্দু কাজ করবেনা। আমাদের কভুও ঝগড়া লাগেনা এইটা আমি কিছুতেই বুঝিনা। আমি ঝগড়া করবো ভাবলেও উনি হাসি শুরু করে। আর কিছু বলতে গেলেই কান্না করবে। যেন উনিই মেয়ে। অথচ বিয়ের আগে আমরা কত ঝগড়া করেছি? রাগ করে দুজনি না খেয়ে থেকেছি। আর এখন? আসলেই কাছে না থাকলে ভালোবাসা বাড়েওনা আর বোঝাও যায়না..
তাকিয়ে দেখি উনি আমার বাহুতে ঘুমিয়ে আছে আমি তার মাথায় হাত বুলাচ্ছি আর ভাবছিলাম অতীতের কথাবার্তা। ভালোবাসা টা কেমন? খুব বেশি ভালোবাসা কেমন? বা প্রিয়জনকে খুব ভালোবাসা কেমন? খুব কাছে রাখা ব্যাপারটা কেমন? আমার না এখন অনেক ধনসম্পদ এসব নিতে ইচ্ছা করেনা। আমার এখন শুধু ইচ্ছা করে তাকে কাছে পেতে। তাকে এক সেকেন্ড না দেখলে কেমন জানি ছটফট লাগে। তার কিছু হলে নিজেরি খারাপ লাগে। তার জ্বর হয়েছে দেখে আমারি খারাপ লাগছে। ছেলেটা একটু না না অনেক অনেক বেশি ভালোবাসে আমাকে আর প্রচুর বিশ্বাস করে। আমার মরণ যেন ওর বুকেই হয়। ওকে ভুলে যাওয়া বা ওকে হারিয়ে ফেললে আমিও পাগল হয়ে যাবো।
ও এমন একটা মানুষ যাকে কেবল ভালোবাসা যায়। যাকে ভুলে থাকা প্রায় অসম্ভব। আমি কখনওই তাকে ভুলতে চাইনা। সে আমার পুরো অস্থিত্বে মিশে আছে মিশে থাকুক। আমি আজও তাকে ভালোবাসি বলিনি। কেন জানি বললেও কম হবে তাই। আমি তাকে বলার থেকে বেশি ভালো…. না না আমি এই কথা বলতেই চাইনা। সে ঘুমিয়ে আছে আমি তাকে দেখছি! নিষ্পাপ শিশুর মতো ঘুমিয়ে আছে। তার কপালে একটু চুমু দেবার লোভ সামলাতে পারলাম না। তাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করছে কারণ বাইরে বিকট শব্দে বাজ পড়ছে সে ঘুম থেকে উঠেই বায়না ধরবে ‘ও মায়া আমাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরোনা প্লিজ আরও শক্ত করে’ এজন্যই তো আমি তাকে জড়িয়ে ধরে আছি শক্ত করে খুব শক্ত করে…. পাগল একটা.. পাগলটা শুধু আমার……..
গল্পের বিষয়:
গল্প