তৃতীয়বারও যখন কন্যা সন্তানের বাবা হলাম তখনও মুখে হাসি ভরা ছিলো। ডাঃ এসে যখন বললো মেয়ে হয়েছে, তখন পরিারের সবার মুখ কালো হয়ে গেলো। আমার আবার মেয়ে হয়েছে শুনে হাসি মুখে বলেছিলাম আলহামদুলিল্লাহ। আমার স্ত্রী সোহাগী তখন কেবিনের ভিতর। ডাঃ মেয়েটা এনে আমার কোলে দিলো। আমি মেয়েটাকে নিয়ে সোহাগীর কাছে গেলাম। তার মুখে একটা চিন্তার ছাপ দেখলাম।
_ তুমি কেমন আছো? (আমি)
_ আমি আবার মেয়ে জন্ম দিছি! (সোহাগী)
_ আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই চিন্তা কেনো করো? আল্লাহ যাকে ভালবাসে তাকেই মেয়ে সন্তান দেয়।
_ কিন্তু….
আমি তখন স্ত্রীর হাতটা ধরে বলেছিলাম। এক সময় দেখো এই মেয়ে গুলো আমাদের নাম উজ্জ্বল করবে।
সবাইকে নিয়ে বাসায় চলে আসি। স্ত্রী ও মেয়েকে রুমে রেখে। বাকি দুটা মেয়েকে হাতে ধরে রুম থেকে বের হয়ে গেলাম। অন্য রুমে মা বাবা, ভাই বোন সবাই বসে আছে। আমাকে দেখেই বাবা বলে…আমাদের বংশের জন্য কি বড় ছেলের ঘরে নাতী দেখবো না? সব মেয়েই হচ্ছে !
আমি হাসি দিয়ে বাবাকে বললাম তখন…. আমার এই মেয়ে গুলো আমার জানের টুকরো। আমার এই মেয়েই দেখো পুরো গাঁয়ের জন্য কিছু করে দেখাবে। বাবা বলে…তোর ছোট ভাইয়ের দেখ ২টা ছেলে। আর তোর? বলি দরকার হলে দশটা মেয়ে হউক তারপর ছেলে বড় ছেলের ঘরে নাতি দেখতে চাই। আমি বলি তখন… এইসব নিয়ে চিন্তা করার দরকার নাই। আমারটা আমি বুঝি। তখন বুঝতে পারি সবাই নাতিই চায়। আল্লাহ যা দিছে তাতে আমি খুশী। বড় মেয়েটা জন্ম নেওয়ার পর সবাই কত খুশী ভাবছে ২য় বার ছেলে হবে।
২য় বারও মেয়ে হলে সবাই বলে রানার কি কপালে ছেলে নাই তার বউয়ের ঘরে সব মেয়ে হয়। আসলে আমি সব সময়ই আল্লাহর উপরই ভরসা করে থাকি। আমার স্ত্রী সোহাগীও তেমন। যদিও মানুষের কথা মাঝে পরে মনটা কেমন হয়ে গেলো। আমি রানা গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করি। যা আয় হয় এতেই আল্লাহর রহমতে অনেক সুখে আছি। আমার ঘরে আর সব কিছু থাকুক আর না থাকুক তবে স্ত্রীর ভালবাসা ভরপুর ছিলো। তাইতো সব কিছুতে ধর্য্য, সহ্য করতে পারি।
সোহগী অসুস্থ থাকায় পরের দিন থেকে বড় ২টা মেয়েকে নিয়েই স্কুলে যেতাম। তাদের যত্ন করতাম সবাই আমাকে খারাপ বলতো মাষ্টার কি করে মহিলাদের মতো ঘরের কাজ করে। বউয়ের সাথে রান্না করে। আর এই বিষয় গুলো বেশিই ঘাটাঘাটি করতো আমার ছোট ভাইয়ের বউই বেশি। আমার ছোট ভাইটার বাজারে একটা ছোট কাপড়ের দোকান আছে। আমিই তাকে দোকান নিয়ে দিয়েছিলাম।
বিয়ে করার আগে যতটা টাকা জমিয়ে ছিলাম সবটাই দিয়ে দোকান দিয়ে দেই। যখন সোহাগীকে বিয়ে করে ঘরে আনি তখন একটা কানাকড়িও জমানো ছিলো না । তাকে বলে ছিলাম হয়তো আমি বেশি গহনা বা ভালো কাপড় দিয়ে আনতে পারিনি তবে ভালবাসায় কমতি রাখবো না। সে হেসে সেই দিন বলে ছিলো স্বামীর ভালবাসা ছাড়া কোন নারীই সুখি হয় না। আমাকে বলে সেই দিন…. একসাথে সুখে দুঃখে থাকলেই হবে। জীবনে কখনো অশান্তির ছোঁয়া লাগেনি। মেয়ে তিনটা নিয়ে আর স্ত্রী নিয়ে সুখেই কাটতো দিন গুলো। মেয়ে তিনটাকে বাসায় রেখেই একজন মহিলা শিক্ষক দিয়েই ইসলামের সকল জ্ঞান অর্জন করাই। আল্লাহর অনেক রহমত ছিলো মেয়ে গুলো অনেক মেধাবী হয়। ৭-৮বছরেই কোরআন পড়তে শিখে যায় আর নামাজ রোজার সকল কিছুই জ্ঞান অর্জন হয়ে যায়।আমার স্ত্রীর সাথে থেকেই নামাজ রোজা সকল কিছু চর্চা করতো।
আমার স্কুলেই পড়তো তিনটা মেয়ে। আস্তে আস্তে মেয়ে গুলো হাই স্কুল পর্যন্ত চলে যায়। সবাই তখনই বলতো আমাদের ছেলে হওয়ার জন্ম আরো সন্তান নেই না কেন। সবাইকে একটা কথাই বলতাম আমার মেয়ে গুলো আমার নাম করবে একদিন। যা হাজারটা ছেলে করতে পারবে না গ্রামের ভিতর। বড় মেয়ে দুটা একই ক্লাসে পড়ে। ছোটটা তাদের ২ক্লাস নিচে। সব ক্লাসে তারা প্রথম অথবা ২য় হয় বার্ষিক পরীক্ষায়। মাধ্যমিক পাশ করলে বড় দুটা মেয়ে খাগড়াছড়ি থেকে কুমিল্লায় নিয়ে ভর্তি করিয়ে দেই। আমার বড় শালা তখন কুমিল্লায় একটা স্কুলে শিক্ষকতা করে। একটা হোস্টেলে রেখেই ইন্টার পাশ করাই।
তাদের মামা প্রায়ই তাদের দেখাশোনা করতো। ইন্টারে পুরো কুমিল্লা বোর্ডে দু বোন তারা মেধায় প্রথম দ্বিতীয় হয়। কিছুদিন পরই মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা দেয় আর ডাক্তারী পড়ার সুযোগ হয়ে যায়। ততদিনে আমি অবসরে চলে আসি। অবসর ভাতা তখন সরকার ১৫লাখ টাকা দেয়। আর সেই টাকা দুটা মেয়ের ডাক্তারী পড়ার জন্য হিসাব করে দেখি চলে যাবে তারা পড়া শেষ করতে। আমি তখন টাকা গুলো ব্যাংক থেকে না তুলে তাদের জন্য অল্প অল্প করে খরচ করতাম। আমি গ্রামে শুরু করি কৃষি কাজ। পাশাপাশি মাছের চাষ, পশুপালন করি। সব কিছু মিলিয়ে সংসার চলাতে হিমশিম খেতে হতো। ছোট মেয়েটাও ইন্টার পাশ করে কুমিল্লায় আইন নিয়ে ভর্তি হয়। ছোট বেলা থেকেই বেশি কথা বলতো তারই ফল একদিন বড় উকিল হবে।
আমি কিনা যা জমি ছিলো তার থেকে কিছুটা বিক্রি করতে হয়। সংসার চালাতে। কয়েক বছর কষ্ট করার পরই দুটা মেয়ে ডাক্তার হয়ে বের হয়ে যায়। তারপর আরো এক বছর কষ্ট করি। তারা দুজন যখন পুরোপুরো রোগী দেখতে শুরু করে। আমার আর পিছনে তাকাতে হয়নি। টাকা যেনো নিজেই হেটে বাসায় আসে। আমাদের গ্রামে এই দু বোনই প্রথম এম বি বিএস ডাক্তার। একবছর যাওয়ার পরই একটা পাকা ঘরে করলাম। আমার বাবা -মা ততদিনে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে নিয়েছে। আমাদের গ্রামে কোন হাসপাতাল নাই। তাই আমার বাড়িতে একপাশে কিছুটা জমি ভরাট একটা ঘর তুলে হাসপাতাল বানাই। আর সেটার নাম দেয় মেয়েরা “রানা স্বাস্থ্য কেন্দ্র “
একজন তিনদিন করে বাসায় থাকে দু বোন পুরো সপ্তাহ মানুষকে বিনামূল্যে চিকিৎসা দিয়ে যায় গ্রামবাসীকে । তারপর খাগড়াছড়ি শহরেও হাসপাতালে রোগী দেখে। একজন গ্রামের মাষ্টার হয়ে আর কি চাই। মেয়েরা সব করে দেখালো। ছোট মেয়েটাও উকালতি করা শুরু করে দিছে। কুমিল্লা জজকোর্টে। সবাই আমাদের জন্য দোয়া করার শেষ নেই। আমার ছোট ভাইয়ের দুটা ছেলে পড়াশোনা বেশি আর করতে পারেনি। কাপড়ের ব্যবসা করে দুজন। আয়ও তেমন খারাপ না। আমার ইচ্ছেতেই আমার ডাক্তার দুটা মেয়েকে আপন ছোট ভাইয়ের ছেলেদের কাছে বিয়ে দিয়ে দেই। বড় মেয়ের স্বামীটা যদিও একবছরের ছোট। আমার কথার অবাধ্য হয়নি মেয়েরা। সবাই মিলি মিশে একই সাথে থাকি। পুরো গ্রামে আমার মেয়েদের এক নামেই চিনে ডাক্তার ইরা, কেয়া।
উকিলের কথা আর নাই বললাম।
আল্লাহ চাইছে যা তা হলো আমার মেয়েরা অনেক বড় হলো। যা আমার পুরো বংশের কেউ পারেনি। মেয়ে বলে তারা পিছিয়ে নেই। মেয়েরাও পারে করে দেখাতে। বংশের নাম উজ্জ্বল করতে বাপ মায়ের নাম উজ্জ্বল করতে। আমি আর সোহাগী কখনো ভালবাসার কমতি হয় নি। সব কিছুই যা হলো একজন নারীর ভালবাসা যে আমার স্ত্রী। আর যারা করলো আমার নাম উজ্জ্বল তার হলো তিনট মেয়ে। হাজার ছেলের চেয়ে বেশি। মেয়েরাও পারে সব কিছুতে ছেলেদের বিচার করতে নেই। নারীরাও পারে সব কিছু করতে। ভরসা থাকলে সব পারে মেয়েরা। আমার মেয়েরাও তাই
গল্পের বিষয়:
গল্প