মোটা ছেলে

মোটা ছেলে
আমি মোটা। একটু বেশিই মোটা। দুজনের সিট আমার একাই লাগে। রিকশায় আমি বসলে অন্য কারো বসার জায়গা থাকে না। আমার বড় ভাইও মোটা। পাত্রী পছন্দ হয়, বিয়েও ঠিক হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিয়েটা হয় না! লেখাপড়ায় আমরা দুজনই খুব ভালো। কখনো দ্বিতীয় হইনি। ব্যবসা করবে বলে ভাই চাকরী ছেড়েছে। অফিসে সবাই মজা করে! কত সহ্য করা যায়? আমার সাথে পড়তো লামিয়া। আম্মার ওকে খুব পছন্দ হতো। একদিন আমাকে নিয়ে ওর কাছে গেলো। আম্মা সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিলো। লামিয়া কেমন একটা হাসি দিয়ে জবাব দিয়েছিলো, “ আপনি কী আপনার মেয়েকে কোনো হাতির সাথে বিয়ে দিতেন? ”
লামিয়া আমার ভাইকে চিনতো। তখন আম্মার মুখের দিকে আমি তাকাতে পারছিলাম না! সেদিনটা মনে হয় আম্মার জীবনের সবচেয়ে দুঃখের ছিলো! এরপর একদম চুপ হয়ে গিয়েছিলো আম্মা। দুদিন চুপ ছিলেন। কান্না করতেন। আম্মা খুবই হালকা পাতলা মানুষ! কিন্তু তাঁর দুটো ছেলেকে আল্লাহ্ কেনো এতো মোটা বানিয়েছে? এই একটাই প্রশ্ন বারবার নামাজ পড়ে আল্লাহ্ এর কাছে জানতে চাইতেন। আমি চোখ দেখে বুঝতে পারতাম। লামিয়া দেখতে একশোতে, একশো। লম্বা চুল, ফর্সামতো চেহারা। লেখাপড়াতেও ভালো।
আম্মা কলেজের শিক্ষিকা। রাস্তা দিয়ে যাবার সময় লামিয়াকে দেখতো। আর আমাকে বলতেন, এই মেয়েটাকে বৌ সাজলে খুব সুন্দর লাগবে। অবশেষে ভাইয়ের বিয়ে হলো। মেয়েটাও খুব ভালো। সবসময় ভাইয়ের এবং আম্মার দুজনেরই খেয়াল রাখে। আম্মার কোনো মেয়ে নেই বিধায় খুব যত্ন করেই রাখে। কিন্তু দিনশেষে খাবার টেবিলে লামিয়ার খোঁজখবর জানতে চাইতো আমার কাছে! হঠাৎ একদিন আর লামিয়ার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ নেই আম্মার! মেয়েটার মধ্যে এতোদিন কী দেখেছিলো আম্মাই ভালো জানে। চার বছর পর আমিও বিয়ে করি। একটা ছেলে হয় প্রথমে। তারপর মেয়ে। বড় ভাইয়ের দুই ছেলে, এক মেয়ে। আর আমার ছেলেকে দেখে যেতে পেরেছিলো আম্মা! আমার মেয়েটা যখন তানহার পেটে। আম্মা তখন আল্লাহ্ এর কাছে!
সময় কতো দ্রুত চলে যায়। চোখের সামনে ছেলে মেয়ে দুটো বড় হয়ে গেলো। বড় ছেলেটাকে বিয়ে করালামই তো দুবছর হতে চললো। বুড়ো হয়ে গিয়েছি। মুখের দাঁড়ি সব পেঁকে গিয়েছে। আজকে ফুলের জন্মদিন। বাপ বেটি ঘুরতে বেড়িয়েছি। খোলা আকাশের নিচে একটা বটগাছ। দুজনে এর নিচে বসে ফুচকা খাচ্ছি। এর মধ্যে এক ভদ্রমহিলা হাজির। আমার সাথে কোনো কথা না বলেই আমার মেয়েটাকে বললো, “ তুমিই কী ফুল? সত্যিই তুমি ফুলের মতো সুন্দর, নিখুঁত! ” নিজের প্রশংসা শুনে কোন মেয়েই না খুশি হয়? ফুল মুচমি হাসি দিয়ে বললো, “ আপনাকে তো চিনলাম না আন্টি! ” ভদ্রমহিলা চেয়ার টেনে বসলেন। তারপর বললেন, “ তুমি আমাকে চিনবে না মা, তোমার বাবা আমার অনেক পুরনো বন্ধু! ”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “ আমার পুরনো বন্ধু? স্কুলের? কলেজের না ভার্সিটির? নাম কী? ” ভদ্রমহিলা বললেন, “ ভুলেই গিয়েছিস গুড্ডু, আমি লামিয়া! ” আমি থমকে গেলাম! মেয়েটার উজ্জ্বলতা এই বয়সেও জোনাকিপোকাদের মতো! তবে তাঁর সাথে আমার বন্ধুত্ব কোনোদিনও গভীর ছিলো না। তবুও অনেক বছর পর পুরনো কোনো সহপাঠীকে পেয়ে উচ্ছাসিত আমি। তারপর অনেক কথা হলো। তাঁর বিয়ে হয়েছে। তিনটে মেয়ে একটা ছেলে। ছেলেটা সবার বড়। মেয়ে তিনটা বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ফুলকে এমনভাবে দেখছিলো। ফুলের সাথে এমনভাবে কথাবার্তা বলছিলো! আমি রহস্য খুঁজে পাচ্ছিলাম না। মেয়েটার নাম্বারও নিয়ে নিয়েছে।
রাত সারে আটটায় ফুল এসে হাতে মোবাইল ধরিয়ে বললো, “ নাও তোমার জোয়ানকালের বান্ধবী ফোন দিয়েছে। ”
কথা হলো। অনেক কথাই হলো। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো সে কালকে আমার সাথে দেখা করতে চায়। সঙ্গে অবশ্যই ফুলকে নিয়ে যেতে হবে! বিকেলের দিকে ফুল ভার্সিটি থেকে আসে। খুবই ক্লান্ত থাকে। কিন্তু আমার সাথে ঘুরতে যেতে বললে সে মনে হয় আকাশ থেকে একলাফ দিতে দুবার ভাববে না। তাড়াহুড়ো করে তৈরি হয়ে বের হলাম দুজন। লামিয়া এলো। সঙ্গে মনে হয় তাঁর ছেলে। চারজন একটেবিলে বসে আছি। কথাবার্তা হচ্ছে। এর মাঝে লামিয়া আমাকে ইশারায় একটু দূরে ডাকলো। সরে এলাম দুজন। টেবিলে এখন ফুল আর তাঁর ছেলে বসে আছে। লামিয়া বললো, “ আমার ছেলেটাকে তোর পছন্দ হয়েছে? আমার কিন্তু তোর মেয়েকে খুবই পছন্দ। আমার ঘরের বৌ না, আমার আরেকটা মেয়ে বানাতে চাই! ”
আমি আঁচ করতে পারছিলাম। তবে এভাবেই বলে দিবে ভাবিনি। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস বিয়ে বললাম, “ আজকে যদি আম্মা বেঁচে থাকতেন। তাহলে হয়তো তোকে বলতো, “ একটা হাতির সাথে কী আপনার মেয়েকে বিয়ে দিতেন? ”
লামিয়ার মুখটা নিমিষেই কালো হয়ে গেলো! কতটা ব্যথা পেয়েছে বুকে, তা চোখে ভেসে উঠছে! কারণ ওর ছেলে এতো মোটা! সে বয়সে আমিও ততো মোটা ছিলাম না! আমি আবারো বললাম, “ তবে আমি তা বলবো না। আমি পুরো বিষয়টাই ফুলের উপরে ছেড়ে দিতে চাই। সে বড় হয়েছে। ভালো খারাপ বুঝে। সে যদি তোর বাড়িতে যেতে চায়। আমার কোনো আপত্তি নেই। বিয়েটা দিয়ে দিলেই তো হয় না। সারা জীবন তো সেই সংসার করবে। বাপ বেঁচে থাকলে দু একদিন দেখতে যাবে, এই যা। ”
লামিয়া আর কিছু বললো না। সে ফুলের সাথেই মনে হয় পরে কথাবার্তা বলেছে। আর ফুলের কী মতামত আমি জানি না। তবে লামিয়াকে তাঁর খুবই পছন্দ। এটা আমি বুঝতে পারি। এজন্যই হয়তো বিয়েতেও রাজি হয়েছিলো! আজকে ঊনত্রিশে সেপ্টেম্বর, ফুল আর সিফাতের বিয়ে! এই বিয়েতে সবচেয়ে খুশি মনে হয় লামিয়া! আমার মেয়েটাকে যে সে দুচোখে আগলে রাখবে তা আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু আমি চোখ বুঁজে আম্মার কথা ভাবছি। উনি কী এই বিয়েতে খুশি? নাকি না?
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত