কচুপাতা রং এর শাড়ি

কচুপাতা রং এর শাড়ি
আজ চাকরির প্রথম সেলারি পেলাম। টাকার অংকটা খুব বেশি না হলেও প্রথম পাওয়া তাই ছোট মনে হচ্ছেনা। অফিস থেকে বের হয়ে রাসেলকে ফোন করলাম। ভার্সিটি লাইফের সব ফ্রেন্ডের মধ্যে রাসেলের সাথেই আমার সম্পর্কটা একটু গাঢ়ো।
রাসেল আসতেই ওকে নিয়ে মার্কেটে গেলাম। কচুপাতা রঙের একটা শাড়ি কিনবো। তৃণার জন্য। আমার স্বচ্ছ প্রেম। তৃণা। প্রায় সাড়ে তিনবছর থেকে একসাথে ধাপ ফেলে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় পৃথিবীতে এই একটাই ভালো মেয়ে অবিশিষ্ট ছিলো,যেটা আমার কপালে এসে আটকে গেছে। অাবার মাঝে মাঝে সেই তৃণাকে মনে হয় ডাস্টবিন থেকে ঝড়ো হাওয়ায় উড়ে আসা কাগজের ঠোঙ্গা,প্রচন্ড দুর্গন্ধ ছড়ায় তখন,তবু সব ম্যানেজ করে নেই। কারণ আমি জানি আমি তৃণাকে যতটা ভালোবাসি,তৃণা আমাকে তারচেয়ে বেশি ভালোবাসে। অনেকগুলো দোকান দেখার পর একটা শাড়ি অবশেষে পছন্দ হলো। কচুপাতা সারফেসের উপর হালকা জলছাপ প্রিন্ট। তৃণাকে দারুণ মানাবে। ১৪৫০ টাকা দিয়ে শাড়িটা কিনে মার্কেট থেকে বের হতেই রাসেল প্রশ্ন করল-
-কিরে,প্রথম সেলারি পেয়ে আন্টির জন্য শাড়ি কিনলি বুঝলাম,কিন্তু এমন অদ্ভুত কালারের কেন?
মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেলো আমার। এতক্ষণ ওকে সাথে নিয়ে তৃণার জন্য শাড়ি কিনলাম, অথচ এখন মা’কে টেনে আনতেছে এর মধ্যে। ঝাড়ি দিয়ে বললাম-
-আরে মা’র জন্য না,এটা তৃণার জন্য। কচুপাতা রংটা ওকে খুব ম্যাচ করবে।
-ওহ,তো আন্টির জন্য কিছু নিবিনা?
-নাহ্। মা’র অনেক আছে।
রাসেল আর কিছু না বলে বিদায় নিয়ে চলে গেলো,আমি যাচ্ছি তৃণার সাথে দেখা করতে। পৌরপার্কে তৃণা অপেক্ষা করছে।
পার্কের কর্ণারে একটা অঘোষিত নির্দিষ্ট বেঞ্চ আছে আমাদের বসার জন্য। এই পার্কে আসলে আমরা এই বেঞ্চেই বসি। পার্কের কর্ণারে আসতেই তৃণাকে বসে থাকতে দেখলাম। প্রথম দেখা না,প্রথম প্রেমও না,তবু কেনো জানি হার্টটা একটু বেশিই চঞ্চল হয়ে উঠছে। এতদিনের সম্পর্কে বাবার পকেট মেরে তৃণাকে অনেক কিছুই দিয়েছি তবে অাজ একটু স্পেশাল মনে হচ্ছে। প্রথম সেলারি,প্রথম ইনকাম বলে কথা! কাছে অাসতেই হাসিমুখে তৃণাকে প্রশ্ন করলাম-
-অামার মহারাণী কেমন অাছে?
-উমম ভালো। তুমি?
-অাজ একটু বেশিই ভালো।
-কেনো কেনো? অাজ কি স্পেশাল কিছু? অার তর সইছিলোনা। শাড়ির প্যাকেটটা বের করে তৃণার হাতে দিলাম। বললাম-
-অাজ প্রথম সেলারি পেয়েছি। তাই তোমার জন্য একটা শাড়ি কিনেছি,দেখো তো পছন্দ হয়েছে কিনা?
তৃণা শাড়িটা খুলে দেখে অগ্নি দৃষ্টি নিয়ে অামার দিকে তাকালো। ওর দৃষ্টিতে ভষ্ম হতে হতে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিকে তাকালাম ওর দিকে- তৃণা একটু জোরেই বলল-
-এটা কি কিনছো?
-কেনো দেখছোনা? শাড়ি?
-শাড়ি তো দেখতে পাচ্ছি,
কিন্তু এই বাজে রং এর শাড়ি অামি পড়ি? তোমাকে কে কিনতে বলছে এমন রং এর শাড়ি? জীবনে দেখছো অামি এত লো কোয়ালিটির শাড়ি কিংবা জামা পড়েছি? অামি কি বলব ভেবে না পেয়ে অামতা অামতা করে বললাম-
-অাসলে তৃণা,অামি ভাবছি এই কালারটা তোমার অনেক ভালো লাগবে,ম্যাচ করবে তোমার সাথে,তাই.. ঝাড়ি দিয়ে অামাকে থামিয়ে দিয়ে তৃণা বলল-
-চুপ করো। তোমার রুচিবোধ বলে কিছু যে নেই সেটা অামার জানা অাছে। তোমার শাড়ি তুমিই রাখো অামার প্রয়োজন নেই,বাই।
শাড়িটা অামার গায়ের উপর ছুঁড়ে ফেলে তৃণা হন হন করে চলে গেলো। ঘটনার তান্ডবে অামি বাকরুদ্ধ! তৃণার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে ভাবছি অামার দোষটা কোথায়! সামান্য কালারে কি অাসে যায়? প্রথম সেলারি পেয়ে এত অাবেগ,মায়া নিয়ে শাড়িটা কিনলাম,এই অনুভুতিটার কোন মূল্যই নেই তৃণার কাছে! শাড়িটা অফিস ব্যাগে ভরে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। বাসায় গিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে ওয়াশরুমে ঢুকবো এসময় মা জানতে চাইলো কিরে সেলারি পেয়েছিস? মেজাজটা খিটখিটে থাকায় সংক্ষেপে হ্যাঁ সূচক জবাব দিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলাম।
কাঁদতে চেয়েও কান্না অাসছেনা,এই অনুভুতির মত বাজে অনুভুতি অার নেই। ভেতরটা অসহ্য অতৃপ্ততায় বিষাক্ত হয়ে উঠছে। মানুষ কত বিচিত্র! কলিজা ভুনা করে দিলেও হয়ত বলবে লবণ কম হইছে,অারেকটু লবণ দিতে পারলেনা? সাড়েতিন বছর থেকে যাকে বুকে রেখে স্বপ্নের মহল বানিয়েছি তার ব্যবহারে অাজ সেই মহলেই ঘুণ ধরল। সমস্ত অাবেগ,অনুভূতি মূল্যহীন! নাহ্ অার কিছু ভাবতে পারছিনা। প্রচন্ড খুধা পেয়েছে। ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুমের দরজা খুলতেই মা’র কিছু কথা কানে এলো। কার সাথে কথা বলছে দেখার জন্য উঁকি দিতেই দেখি পাশের ফ্ল্যাটের শাপলা অান্টিকে মা কিছু একটা দেখাচ্ছেন। অারেকটু লক্ষ্য করতেই অবাক হয়ে গেলাম! অামার শাড়িটা। বাসায় এসে ব্যাগ থেকে শাড়িটা বের করে টেবিলের উপর রাখছিলাম। মা অস্থির ভাবে হাত নাড়াচ্ছে অার শাপলা অান্টিকে শাড়িটা দেখিয়ে দেখিয়ে বলছে-
-শাড়িটা সুন্দর না ভাবি? অামার ছেলেটা অাজ প্রথম সেলারি পেয়েছে,অামার জন্য কিনছে। বোকাটা অামাকে দিতে ভুলে গেছে মনে হয়,ওর টেবিলের উপরে দেখি শাড়িটা রেখে দিয়েছে। অামি নির্বাক। মধ্যবিত্ত সংসারের যাতাকলে পিষ্ট অামার মাকে অামি এর অাগে কখনো এত খুশি দেখিনি মনে হয়! ড্রয়িংরুমে বাবা অার ছোটবোন বসে ছিলো। মা দৌড়ে এদিকে অাসতেই অামি অামি অামার রুমে ঢুকলাম। ভেতর থেকে শুনছি মা বাবাকে বলছে,
-এই দেখছো? অামার ছেলে কি অানছে? অাজকে ও প্রথম সেলারি পাবে বলছিলামনা? ওর প্রথম সেলারি দিয়ে অামার জন্য শাড়ি অানছে। দরজার ফাঁক দিয়ে সবকিছু দেখছি-শুনছি। বাবার ভেজা চোখ দেখা দুর্লভ। অথচ অামি বাবার চোখের কোণ চিকচিক করতে দেখলাম। মা’কে শাড়ির অাঁচলটা টেনে চোখে নিয়ে যেতে দেখলাম। বাবা হেসে মাকে বলছে-
-তোমার জন্য তোমার ছেলে শাড়ি এনেছে বুঝলাম,কিন্তু অামার ছেলে কি অামার জন্য কিছু অানেনি?
মা ততক্ষণাৎ জবাব দিলো,অামি নিশ্চিত তোমার জন্য,নিশাতের(নিশাত অামার ছোটবোন) জন্য অানছে কিছু,কিন্তু দিতে ভুলে গেছে হয়ত!
পরিবারের তিনটি মানুষকে অামি এতটা খুশি খুব কম সময় দেখেছি! মাত্র ১৪৫০ টাকার একটা শাড়ির মাঝে এত খুশি লুকিয়ে ছিলো? কিন্তু এই শাড়ি তো অামি তৃণাকেও দিয়েছিলাম,কতগুলো বক্ষভেদ কথা শুনিয়ে শাড়িটা ছুঁড়ে ফেলে অামার সাড়ে তিনবছরের গার্লফ্রেন্ড চলে গিয়েছিলো,কোয়ালিটি খারাপ,কালার খারাপ বলে! হঠাৎ ছোটবোনের কথা শুনলাম। মা’কে বলছে-
-মা? তুমি তো এমন হালকা কালারের শাড়ি পড়োনা? মা ছোটবোনকে ধমক দিয়ে বলল,
-চুপ কর। পড়িনা তো কি হইছে? এটা পড়ব। অামার ছেলে পছন্দ করে অামার জন্য কিনছে,তাই অামারও পছন্দ হইছে।
ধপাস করে খাটের উপর বসে পড়লাম। ভেতরে ডুঁকরে ডুঁকরে কেউ কাঁদছে। তৃণার পছন্দ হয়নি কচু পাতা রং,তাই মুখের উপর শাড়িটা ছুঁড়ে মেরেছে। অার অামার মা’র ও পছন্দ হয়নি কচু পাতা রং,অথচ মা অামার পছন্দ দিয়ে নিজের অপছন্দকে সরিয়ে জোড় করে পছন্দ করে নিয়েছে,যাতে অামি কষ্ট না পাই! নিঃশ্বাস ভারী হয়ে অাসছে অামার। হঠাৎ ছোটবোন ডাকলো। ভাইয়া অায় মা খেতে দিবে। খাবার টেবিলে বসে লজ্জ্বায় যেনো অামার মাথা হেট হয়ে অাসছে। অজানা একটা হীনতাবোধ কাজ করছে ভেতরে। বাবা,ছোটবোন,মা সবাই ভাবছে অামি তাদের জন্য কিছু না কিছু কিনছি। অথচ অামি এমন স্বার্থপর,তাদের জন্য কিছু নিবার কথা মাথাতেই অাসেনি। কালনাগণীর জন্য কচুপাতা রং এর এত দামী শাড়ি কিনে অপমানিত না হয়ে যদি মা’র জন্য বাবা’র জন্য,বোনের জন্য কমদামী কিছু কিনতাম তাহলে এখন এতটা পাপবোধ হতোনা ভেতরে। মা খাবার দিতে দিতে বললেন,
-বাবা,এত দামী শাড়ি কেনার কি দরকার ছিলো বল তো? কমদামী একটা কিনতি!
জানিস রংটা অনেক সুন্দর হইছে, ময়লা হলে বুঝা যাবে না। আর পারলাম না। পুরুষদের চোখ ভেজার নিয়ম নেই এই নিয়ম ভেঙে ডুঁকরে কেঁদে উঠে মাকে জড়িয়ে ধরলাম। মনের ভেতরে আমার তুফান হচ্ছে! হায়রে কার জন্য কি করলাম। ২৫ বছরের জীবনে মা’কে কিছুই দিতে পারিনি। অথচ এই মা কতকিছু দিয়েছে,প্রতিদান চায়নি! ১৪৫০ টাকার “কচু পাতা রং এর শাড়ি” আমাকে অাবেগ এবং বাস্তবতার পার্থক্য বুঝিয়ে দিলো! সমমূল্য স্থান,কাল,পাত্র ভেদে মানুষ চিনিয়ে দিলো! যাকে সারাজীবন দিয়েও মূল্য পেতাম না,তাকে দিয়েই যাচ্ছিলাম,অথচ যে কখনো পাওয়ার আশা না করে আজীবন দিয়েই যাচ্ছে তাকে চিনলাম ২৫ বছর পর! ধন্যবাদ ‘কচু পাতা রং এর শাড়ি’
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত