জীবনের গল্প

জীবনের গল্প
কোয়ারেন্টাইনে বুঁয়া নেই, আপাতত আমিই বুঁয়া। তরকারী কাটছিলাম। হঠাৎ আম্মু আহত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
-“তোর চোখ মুখ এমন ফ্যাকাশে লাগে কেন? বিষয়টা অনেকদিন ধরেই আমি খেয়াল করছি।”
আমি একটু লাজুক ভাব নিয়ে বললাম,
-“আমি আগের চেয়ে ফর্সা হয়েছি তাই।”
-“উহু, তোর জন্ডিস হয়েছে। চোখসহ সারা শরীর হলুদ দেখা যাচ্ছে।”
মেজাজটাই গরম হয়ে গেল। ফর্সা হয়েছি ভেবে আমি মনে মনে আনন্দেই ছিলাম। কতবার নিজেকে আয়নায় দেখেছি আর পুলকিত হয়েছি। দিলো আম্মু আমার আনন্দে জল ঢেলে। আসলেই আমাকে কেউ ভালোবাসে না।
আম্মুকে বোঝানোর উদ্দেশ্যে বললাম-
-“আমার গায়ের রঙে হলুদ আভা তো জন্মগতই। কবে লালচে আভা দেখেছো। আমি তো আসলে হলদে ফর্সা। এজন্যই আমাকে হলুদ পোষাকে সবচেয়ে বেশি মানায়। আর আমার পছন্দের রংটাও তো হলুদই।” আম্মু সন্দেহের চোখে তাকিয়ে আমার কাছে এসে চোখ আর হাত পায়ের তালু পর্যবেক্ষণ করলো। তারপর অস্থির কন্ঠে বলল,
-“রক্ত তো একদমই নেই শরীরে। সারা শরীর হলুদ আল্লাহ! জন্ডিস হয়েছে নিশ্চিত। তোর রক্ত পরীক্ষা করতে হবে। আজকেই ক্লিনিকে রক্ত দিয়ে আসবি। এমন ভাবে আম্মু কথা বলল, যেন সে কোনো স্পেশালিস্ট। আমি চেঁচিয়ে উঠে বললাম,
-“আমি কিছুতেই আমার শরীরে সুচ ফুটাতে দেবো না। মরে গেলেও দেবো না।”
-“এখন বুঝতে পারছি, এজন্যই তোর মেজাজ খুব খিটখিটে হয়ে গেছে। সবার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকাস। ধমকে একাকার করিস সবাইকে।” আমি আগুন চোখে তাকিয়ে বললাম,
-“আমি এখন তোমার চেয়ে বেশি ফর্সা হয়েছি বলে তুমি জ্বলছো নাকি? সেদিন ভিডিও কলে দি-ও বলছিল, আমাকে ফ্যাকাশে রক্তশূন্য লাগছে। দি-ও মনে হয় জ্বলছিল তাই ফর্সা না বলে ফ্যাকাশে বলেছে। এত হিংসুটে তোমরা? ছিঃ”
রাগে আমার চোখমুখ লাল হয়ে গেল। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম, দি-র সাথে আমি আর কোনো যোগাযোগই রাখবো না। এরা কেউ আমার মা বোন নয়। কেন জানি আম্মু করুণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর ক্ষীণ স্বরে বলল,
-“তুই সত্যিই অসুস্থ, ভীষণ অসুস্থ।” আম্মুর কথায় পাত্তা না দিয়ে তরকারী কাটায় মনোযোগ দিলাম। আম্মু ধমকের স্বরে আব্বুকে বলল,
-“সেই কবে থেকেই আমি তোমাকে বলছি যে, ওর চোখমুখ ফ্যাকাশে লাগে। আবার আবল তাবল কি সব বলেও। তুমি গুরুত্বই দিলে না। এখন বড় কোনো রোগ হলে তো টেনশনে তোমার প্রেসার আগে বাড়বে। আমার কথার তো কেউই গুরুত্ব দেয় না।” একি এরা আমার মাথা খারাপ হয়েছে এসব ভাবছে নাকি? ফর্সা হওয়ার সাথে মাথা খারাপ হবার সম্পর্ক কি? আব্বু তড়িঘড়ি করে শার্ট পরলেন। আম্মু বলল,
-“কোথায় যাচ্ছো?”
-“আসছি।” কিছু না বলেই আব্বু বেরিয়ে গেলেন। আধা ঘন্টা পর ফিরে একগাদা ওষুধ বের করে বললেন,
-“এসব তিনবেলা খাবি।”
বড় বড় সিরাপের ফাইল দেখে আমি হা করে তাকিয়ে রইলাম। কোন ডাক্তার এতসব ওষুধ লিখেছে তা মাবুদ জানে। আমি যে, লিকুইড মেডিসিন খেতে পারি না এসব আব্বু জানে না নাকি? আমি খুব করুণ অবস্থায় আছি। নিজেকে আমার খুব দুস্থ মানুষ মনে হয়। কারণ আব্বুর ডিউটি এখন আমাকে অত্যাচার করা। তিনবেলা ওষুধ ঠিকঠাক খাচ্ছি কি না সেই খবর নেয়। এরচেয়ে বড় অত্যাচার হলো খাবার ঠিকমতো খাচ্ছি কি না। দশ মিনিট পর পর রুমে এসে বলেন,
-“পেয়ারা খেয়েছিস?”
-“পরে খাবো।”
-“আপেল কেটে দিই?”
-“পরে কেটে খাবো।”
-“বেদানার জুস খা এখন।”
-“বেদানার জুস ঘেন্না লাগে খেতে।”
-“কেন?”
-“মনে হয় রক্ত খাচ্ছি।”
-“তরমুজ খাবি? তুই তো তরমুজ খুব পছন্দ করিস।”
-“আব্বু এখন আমি কিচ্ছু খাব না। যাও তো রুম থেকে।” আব্বু আসামির মতো তাকিয়ে বললেন,
-“মাল্টার জুস আনি?”
আমি বড় বড় চোখে আব্বুর দিকে তাকাই। তিনি নিরিহ বাচ্চার মতো ভয় পেয়ে বেরিয়ে যান। যাবার আগে আহত স্বরে বলেন,
-“না খেলে সুস্থ হবি কী করে? তুই অসুস্থ তাই আমি ভালো নেই, একটুও ভালো নেই।”
অভিমান আর জমাট কষ্ট নিয়ে আব্বু বেরিয়ে যান। তিনি হয়তো জানেনই না যে, তার হৃদয়হীনা কন্যা কারও অভিমানের দাম দিতে জানে না। মনে মনে বললাম, আমি মোটেও অসুস্থ নই। ভালোবাসার দৃষ্টিতে আমাকে দেখছো তাই অসুস্থ লাগছে। অন্যদের মতো দৃষ্টি বদলে ফেলো, দেখবে কত নিশ্চিন্তে বেঁচে থাকতে পারবে। আব্বু দশ পনেরো মিনিট পর পর রুমে এসে এই একই কাহিনী করেন। মাঝে মাঝে খাবার হাতে নিয়েই রুমে ঢুকেন। আমার কোয়ারেন্টাইন বড্ড বিষাদময়। মেডিকেল জ্ঞান না থাকা মানুষগুলো বোধহয় এমনই হয়। এদের কাছে বইয়ের গুটিকয়েক নিয়মের চেয়ে হৃদয়টাই আসল। কিন্তু আমি যে কোনো ফেয়ারনেস ক্রীম ছাড়াই ফর্সা হলাম সেটা কেউ কেন বিশ্বাস করছে না?
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত