হেমন্ত প্রজ্ঞা আর অনাগত সংসার

হেমন্ত প্রজ্ঞা আর অনাগত সংসার
হেমন্তের কালো শার্টের ঠিক মাঝের বোতামটা আজ ইচ্ছে করে ছিঁড়ে দিয়েছি। উদ্দেশ্য ছিলো ও ডাকবে,আর বোতাম সেলাই করে দিতে বলবে। আজ তিনদিন হলো হেমন্তের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে। আমি প্রজ্ঞা। বাবা মায়ের সাত মেয়ের মধ্যে আমি বড়।খুব একটা ধুমধাম করে আমার বিয়ে হয়নি।মেজো বোন হুট করে নিজের পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করে ফেলেছে।এটা লোক জানাজানির আগেই আমাকে চটজলদি বিয়ে দিতে হয়েছে।নতুবা পাড়াপড়শি খারাপ ভাববে, এসব ভেবেই আব্বা হেমন্তের সাথে পারিবারিকভাবে আমার বিয়েটা দেন। কিন্তু বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত হেমন্ত আমার সাথে একটি কথাও বলেনি।বিষয়টার কারণ কি সেটা জানতে হলে তার সাথে কথা বলতে হবে।কিন্তু কথা বলার সুযোগ না পাওয়াতেই এই কাজটা করেছি।
আশ্চর্য হলাম বেশ।কালো শার্টের এই হাল দেখে সে মেরুন কালারের শার্ট পড়েছে।এত রাগ হচ্ছিলো নিজের উপর,সবগুলা শার্টের বোতাম ছিঁড়ে দেওয়া উচিৎ ছিলো।তাহলেই বেশ হতো। সুঁই সুতা নিয়ে কালো শার্টের বোতামটা সেলাই করতে বসেছি।কিছুক্ষণ পর হেমন্তের সাথে ওর এক বান্ধবী এসে রুমে ঢুকেছে।আর তার সাথে কেমন রসিয়ে কথা বলছিলো হেমন্ত! সহ্য হচ্ছিলো না আমার।তারপরেও হজম করে নিয়েছি। বান্ধবী ঘর থেকে বের হতেই রুমের দরজা লাগিয়ে হেমন্তের মুখোমুখি দাঁড়ালাম। মাথার ঘোমটা ফেলে একদম ওর সামনে গিয়ে বললাম,
–নাটক করেন আমার সাথে ? অন্য মেয়ের মাথে রসিয়ে কথা বলেন আর ঘরের বউয়ের সাথে কথা তো দূরের কথা, তাকাইতেও মন চায় না ? বলি ভালো না লাগলে বিয়ে করলেন কেন ?
–বোবা মানুষের সাথে কেন যে আব্বা আমারে বিয়া দিতে গেছে ? আমার অসহ্য লাগছে।ধ্যাৎ রাগারাগি করে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছি।এই তিনদিনে এই বাড়িটা আমার কাছে যম মনে হচ্ছে।এখানে কথা বলার মত কেউ নেই! আমি স্রেফ বোবার মতোই একটা রুমে পড়ে থাকি।হেমন্তও কথা বলে না।এসব ভেবেই কাঁদছিলাম।
হঠাৎ মারিয়া এসে পাশে দাঁড়িয়েছে।
–ভাবী, নিচে যাবে চলো।মা ডাকছে তোমাকে। মারিয়ার সাথে নিচে মায়ের ঘরে গিয়ে দাঁড়াতেই মা বললো,
–প্রজ্ঞা মা, এখানে বসো।এই নাও এটা আমার শ্বাশুড়ি আমাকে দিয়েছিলেন, আর আজ আমি তোমাকে দিচ্ছি। কথাটা বলেই মা আমাকে সুন্দর একটি চুলের কাঠি দিয়েছেন।সেকেলে মানুষ চুলের কাঠি পরতো,সেটা আমার জানা ছিলো না।আমি জানতাম তারা ফিতা দিয়েই চুল বেঁধে রাখতো।
কাঠিটা চুলে গুঁজে সিঁড়িপথ অতিক্রম করছি আর ভাবছি,যার বউ হয়ে এসেছি সেই এড়িয়ে চলছে আর এদিকে মা আমাকে ছেলের বউ বলে চুলের কাঠি উপহার দিচ্ছে! রুমে গিয়ে দেখলাম হেমন্ত সাহেব শুয়ে আছেন। হাতে এশট্রে আর সিগারেট।আমায় দেখে সিগারেটের আগুন নিভিয়ে রেখে দিয়েছে।অবশ্য এসব নিয়ে আমি কিছু বলিনি।আমি ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসে চুলের কাঠিটা হাতে নিয়ে বলছি, হ্যাঁ রে কাঠি। তোর স্থান আমার মাথায় শোভা পায় না।নেহাত মা দিয়েছেন বলে নিতে হয়েছে।তুই বরং ড্রেসিংটেবিলের ড্রয়ারে থাক।তোকে সেই পাবে যে এই বাড়ির সত্যিকারের বউ হয়ে আসবে।এই জনমে তোকে পাওয়ার সাধ আমার মনে হয় ব্যর্থ।
কথাগুলো শেষ করে বিছানায় গিয়ে অন্যদিকে মুখ করে শুয়ে পড়লাম।কিছুক্ষণ পর হয়তো হেমন্তও শুয়ে পড়বে বিপরীত দিকে মুখ করে।চলতে থাকুক এভাবে।চেষ্টা তো কম করিনি।একটা মানুষ কথা না বললে তাকে দিয়ে জোর করে কথা বলানো যায় না।কথাগুলো ভাবছি আর অনিচ্ছা স্বত্বেই বালিশ ভেজাচ্ছি। ভোরে আজানের ধ্বনি শুনে ঘুম ভেঙে গেলো।চোখ খুলতেই দেখি হেমন্ত বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।ঘুমানোর আগে যেমন দেখেছি সেরকমভাবেই দাঁড়িয়ে আছে।তার মানে সারারাত সে ঘুমায় নি ? আমি উঠেই তার পাশে দাঁড়িয়ে বললাম,
–শরীর খারাপ লাগছে আপনার ? ঘুমান নি যে ?
প্রশ্নটা করতেই হেমন্ত কিছু না বলে চুপ করে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়েছে।আমার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিলো।আমি কি হেমন্তের জীবনে যন্ত্রণা হয়ে আসলাম ? আমার কি এখানে, হেমন্তের সাথে থাকা উচিৎ নয় ? চলে যাবো তাহলে ? মাত্র সপ্তাহখানেক হলো বিয়ে হয়েছে।এখন যদি বাড়িতে ফিরে যাই তাহলে বাবা মা কষ্ট পাবে।কিন্তু এরকম একটা জড়পদার্থের সাথে আমি আদৌ থাকতে পারবো?
নানান চিন্তা মাথায় ঘোরপ্যাঁচ করছে। সকাল বিকাল রোজ ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসে চুলের কাঠিটা দেখি।কিন্তু সাহস করে দ্বিতীয়বার পরিনি।ইচ্ছে ছিলো হেমন্ত যেদিন বউ বলে স্বীকৃতি দিবে ঠিক সেদিন মায়ের দেওয়া এই কাঠিটা চুলে গুঁজে দিবো। বিয়ের সপ্তাহখানেক পর ব্যবসায় সূত্রে হেমন্ত আমাকে নিয়ে নিজের ফ্ল্যাটে উঠে।সেখানে আমি হেমন্ত আর মীনাক্ষী’দি থাকে।মীনাক্ষী’দি আমাকে কাজা টুকটাক হ্যাল্প করার জন্যই প্রতিদিন আসে।উনি আমাদের প্রতিবেশী। এখানে এসে নিজেকে আরও বেশি অসহায় লাগছে।মাসখানেক হয়ে গেলো আমাদের বিয়ে হয়েছে কিন্তু হেমন্ত আমার সাথে একটি কথাও এখন পর্যন্ত বলেনি।আমিও এই বিষয় নিয়ে আর অভিযোগ করিনি বা করবো না।দেখি তার মনে কি চায় ?
–প্রজ্ঞা , প্রজ্ঞা হুট করে চোখ খুলতেই দেখি হেমন্ত সামনে দাঁড়িয়ে আছে।তার মানে হেমন্ত ডাকছিলো আমায় ! স্ট্রেঞ্জ ! এতদিন পর আমার নাম ধরে ডাকলো সে ?
–কি হয়েছে তোমার ? ঘরের দরজা খোলা রেখেই ঘুমোচ্ছ ? যদি কিছু হয়ে যেতো ? মীনাক্ষী’দি আসেনি আজ ? ওভাবে তাকিয়ে আছো কেন ? কিছু জিজ্ঞেস করছি তো তোমাকে।
–স্যরি,চোখটা লেগে আসছিলো।আর মীনাক্ষী’দি এসেছিলো তো।মনে হয় আমি ঘুমে দেখেই চলে গেছে।
–এতোটা দায়িত্বহীন কিভাবে হয় মানুষ! দরজাটা এটলিস্ট মিলিয়ে যেতে পারতো।
–ঠিক আছে।মাথা গরম করবেন না।আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন, আমি চা দিচ্ছি।
–শোনো, শার্ট চেইঞ্জ করতে করতেই আমায় হেমন্ত বলছে।
–জ্বি,বলুন।
–আমার এই শার্টের বোতামটা ছিঁড়ে গেছে।সেলাই করে দিবে ? উনি শার্ট চেইঞ্জ করে অন্য শার্ট গায়ে দিয়ে বললেন।
–আগে চা দিবো? নাকি বোতাম সেলাই করে দিবো ?
–বোতামটা সেলাই করে দিলে মন্দ হয় না।
আমি সুঁই সুতা হাতে নিয়ে উনার শার্টের বোতাম সেলাই করছিলাম।তখনই আমার হাত ফসকে সুঁই নিচে পড়ে যায় সাথে আমি নিজেও।তারপর কিছু মনে নেই। অজ্ঞান হয়ে যাই। জ্ঞান ফিরতেই দেখি হেমন্ত ডাক্তার সমেত আমার পাশে বসেছে। কতগুলো টেস্ট নাকি করাতে হবে! বুঝতে পারছি না, হঠাৎ কি হলো! ফ্ল্যাটে ফিরতেই হেমন্তের নতুন একটা রূপ নজরে আসলো।যার জন্য আমি এতদিন অপেক্ষা করেছি।
সে নিজের হাতে ড্রেসিংটেবিলের ড্রয়ারে রাখা চুলের কাঠিটা আমার চুলে গুঁজে দিলো।আমার খুব জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করলো হেমন্তকে।কিন্তু আমি পারছি না।আমার শ্বাস প্রশ্বাস ভারি হয়ে আসলো।চোখের সামনে ধোঁয়াশা লাগছে।হয়তো ঘুম আসছে ভেবেই চোখ বন্ধ করে ফেললাম। দু’দিন পর টেস্টের রিপোর্ট আসলো।করোনা পজেটিভ।হাসপাতালে এডমিট হয়ে গেলাম।হেমন্তকে এখানে আসতে নিষেধ করেছি।কিন্তু ও প্রায় আসে এখানে। ওকে টেস্ট করাতে বলেছি।ওর টেস্টের রিপোর্ট নিগেটিভ এসেছে।এটাই প্রার্থনাতে ছিলো। এখন অনেক রাত হবে হয়তো! চারপাশে পরিচিত কেউ নেই। চলে যাওয়ার আগে ওর স্পর্শ আর হয়তো পাবো না। মনে হচ্ছে সময় ফুরিয়েছে।
এই এক নিষ্ঠুর নিয়তি! সেদিন রাতে ও আমার পাশে শুয়ে বলেছিলো,বন্ধুর সাথে বাজি ধরেছিলো,যে বিয়ের পর এক মাস বউয়ের সাথে একটিও কথা না বলে থাকবে।তার জন্যই সে আমার সাথে কোনো কথা বলেনি। কিন্তু এই মানুষটার সাথে কাটিয়ে আসা দিনগুলোতে কত বাজে মন্তব্য করেছিলাম তাকে নিয়ে,সে সবকিছুর জন্য ক্ষমা চাইতে পারলাম না। এত অল্প সময় নিয়ে কেন পৃথিবীতে আসলাম ? আমার তো একটি সুন্দর সংসার হতে পারতো। হেমন্ত, প্রজ্ঞা, আর আমাদের ছোট্ট একটা মেয়ে ‘বেলা’ কিংবা ছেলে ‘সময়’ ।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত