লকডাউনের শুরুতেই বৌ কে ঘরের কাজে সাহায্য করতে গিয়ে পরপর দুইবার ধরা খাওয়ার পর ঘরের কাজে হাত দিতে চাইলেই বৌয়ের গরম হওয়া আর আমার শরম পাওয়ার দৃশ্য চোখে ভাসতেই লজ্জায় নিজের চুল নিজের ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। এই যা চুলে হাত দিতেই মনে পড়ে গেল আমার চুল তো লম্বা হতে হতে মেয়েদের মতো হেয়ার ব্যান্ড দিয়ে বাঁধা যায়। আমার মেয়ে অথৈ এর খুব আগ্রহ আমার লম্বা চুল নিয়ে। খাটে হেলান দিলে বা দুপুরে বিছানায় শুয়ে থাকলেই অথৈ দৌড়ে আসবে চিরুনী আর হেয়ার ব্যান্ড নিয়ে। বয়স চার হলে কি হবে আচার আচরণে পাক্কা বুড়ি। দুদিন আগের ঘটনা, দুপুরে ভাত ঘুম দিতে মাত্র শুয়েছি অথৈর আমার চুল নিয়ে খেলা শুরু। আমার ও খুব ভালো লাগছিল। কখন ঘুমিয়েছি নিজেই জানি না। ওর মায়ের ডাকে ঘুম থেকে উঠে দেখি মা মেয়ে দুজন হাসতে হাসতে শেষ। আমি বুঝলাম না হঠাৎ মা মেয়ে পাগল হয়ে গেল নাকি?
– কি হলো? এতো হাসলে তো পেটে খিল ধরে যাবে।
বৌ হাসতে হাসতে আমাকে টেনে তুলে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসিয়ে দিল। আয়না দেখে তো আমি ভয়ে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেছি। দুইটা হেয়ার ব্যান্ড দিয়ে ওর মতো দুইটা ঝুটি বেঁধে দিছে । ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়ে লাল করে রাখছে। কপোলে আর কপালে বেহিসাবি পাওডার ব্যবহার করা হয়েছে। ছোট ছোট দাড়ির জন্য পুরো মুখে দিতে না পারার ক্ষোভ কালো দাড়ি সাদা হওয়া দেখেই বুঝা যাচ্ছে।
আমি হাসব না কাঁদব বুঝতেছি না। মা মেয়েকে বকা দিয়ে লাভ নেই। কেন জানি ওদের প্রাণ খোলা হাসিটা দেখতে খুব ভালো লাগছে। ইচ্ছে করছে ওদের সামনে এভাবে সং সেজে বসে থাকি আর মা মেয়ের প্রাণবন্ত হাসি দেখি।
কিন্তু বসে থাকলে তো হবে না। নিজেকে হিজড়া টাইপের লাগছে। সুযোগ পেলেই ছবি তুলে রাস্ট্র করে ফেলবে। তারাতারি বেসিনে গিয়ে মুখ ধুয়ে, চুল আছড়ে এসে বিছানায় হেলান দিয়ে মাত্র মোবাইল ফোনটা হাতে নিতেই এক শালির ম্যাসেজ
– দুলাভাই, আপনাকে দেখতে হেব্বি লাগছে। শালির প্রসংশা দেখে মনটা খানিক ভালো হয়ে গেল। সকালে মাই ডে তে দেয়া খোঁচা খোঁচা দাড়ির দুলাভাইকে মনে হয় আরো পৌরষদিপ্ত লাগছে তাই প্রসংশা করছে। একটু ভাব নিতে হবে তাই বললাম
– আরে সকাল থেকে তো ভক্তদের বিশেষ করে মেয়েদের লাভ ও কেয়ার রিয়্যাক্টে লাল হয়ে গেছি। এতো এতো কমেন্ট তো পড়েই দেখিনি। টুকটাক লিখালিখি করি হাতে গোনা কয়েকজন পাঠক পাঠিকা লাইক কমেন্ট করে তাই একটু বাড়িয়ে বলা। কিন্তু শালিকার এমন উত্তর আমি আশা করিনি।
– দুলাভাই, যে ছবি লাগাইছেন হা হা রিয়্যাক্ট ছাড়া আর কিছুই দেয়ার কথা না। শালির ঘরের শালি নিশ্চয়ই মিথ্যে বলে বোকা বানাচ্ছে। তারাতারি ফেসবুকে ঢুকে আমি তো তব্দা খেয়ে বোকা না বাঁকা হয়ে গেছি। মা মেয়ে এর মধ্যে আমার হাফ লেডিস মার্কা চেহারার ছবি তুলে মাই ডে তে সেট করে দিছে। আর দশ মিনিটে তিনশো হা হা রিয়্যাক্ট।
ঐ বাঁকা অবস্থায় চোখ বাঁকা করে মা মেয়ের দিকে মোবাইল ফোন দেখাতেই বৌ আবার খিলখিল করে হেসে উঠল, এই সংক্রমণ রোগে ধরল আবার মেয়েকে। মা বুঝে হাসতেছে মেয়ে না বুঝে হাসতেছে আর এদিকে আমি দুঃখে আর লজ্জায় হাসতেছি। আনন্দ অশ্রু থাকে বলেই কি আমার দুঃখের হাসি বের হচ্ছে? না আর পারা যাবে না। আর কদিন ঘরে থাকলে আমি পাগল হয়ে যাব নিশ্চিত। ফেসবুকে মাই ডে ছবি পাল্টানোর সাথে সাথে নিজের কাপড় ও পাল্টালাম। বাইরে যাওয়ার জন্য প্যান্ট আর টি শার্ট পরলাম। বৌ বলছে
– কোথায় যাচ্ছো?
কোন উত্তর দিলাম না। বৌ একটু ভয় পেয়েছে মনে হয়। আমি রেগে বের হয়ে যাচ্ছি ভাবছে নিশ্চয়ই। মুখ ভার দেখলাম। ভয়ে মনে হয় দুইবার জিজ্ঞেস করেনি। অথৈ বারবার বলছে
– বাবা, কোথায় যাও?
কাজে যাচ্ছি, বলে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে গেলাম। আজই চুলের একটা ব্যবস্থা করতে হবে। সেলুন তো সব বন্ধ।একটা ট্রিমার কিনে আজকেই চুল ছোট করে ফেলব। মার্কেট ও বন্ধ। অনেক খুঁজে একটা ছোট সুপার শপে পাওয়া গেল কাঙ্খিত ট্রিমার। একটা আছে তাও দ্বিগুণ দাম। দাম বেশি হলেও মান বাঁচানো ফরজ।
– একবার চার্জ দিলে কতক্ষণ চালানো যায়?
– কমপক্ষে এক ঘন্টা।
– চার্জ আছে?
– আছে। এই যে চলছে। দামটা একটু কম রাখা যায় না?
– না ভাই, আপনি পরিচিত মানুষ তাই কম বললাম। অন্য কেউ হলে আরো বেশি বলতাম।
ভদ্রলোক ব্যবসায়ীদের চিরাচরিত বাণী বলা শুরু করে দিছে। এর মধ্যে সত্যি অন্য কেউ হাত ঢুকিয়ে দিয়েছে। একজন না দুইজন এসে জিজ্ঞেস করছে ভাই এটার দাম কতো? এই দুইজনের অবস্থা ও কি আমার মতো? এটা ভাবতেই হাসি পাচ্ছে। দোকানদার আমার চোখের দিকে তাকালেন। সম্মতি পেতেই পেকেট করে ধরিয়ে দিলেন।
বাসায় আসতেই মা মেয়ে দৌড়ে এলো। হাতে পেকেট দেখে অবাক। বৌ প্রশ্ন করার সাহস পাচ্ছে না মনে হয়। অথৈ জিজ্ঞেস করলো
– বাবা পকেটে কি? চকলেট?
– না বাবা, চুল, দাড়ি কাটার মেশিন।
– তুমি কি নাপিত নাকি? মানুষের চুল কাটবা?
– বাবা, নিজের চুল নিজে কাটব। বৌ সাহস করে কাছে এসে বলল
– আমি কেটে দিই? তুমি কাপড় পাল্টে এসো। গতবার ওর কাজ করতে গিয়ে অকাজ করাতে ও যে গরম হয়েছিল এর জবাব দেওয়ার সুযোগ হলো।
– শোন, পুরুষ মানুষের কাজ মেয়েদের দিয়ে হয় না।
– আজকাল মেয়েরা সব পারে।
– কোথাও মেয়ে নাপিত দেখেছো?
এবার বৌয়ের মুখ বন্ধ করা গেল।
– শোন, মেয়ে নাপিত হলে ছেলে নাপিতরা ভাত পেত না। তোমাদের মতো ছেলেরা মেয়ে নাপিতের পেছনে লাইন দিত।
– পারো না তাই করো না। পারলে ছেলেদের গাল টানার জন্য হলেও এই কাজ করতো।
জানি এর পরের উত্তর কি হতে পারে তাই কথা না বাড়িয়ে কাপড় পাল্টাতে চলে গেলাম। লুঙ্গি পরে খালি গায়ে সামনের ব্যলকনিতে চলে গেলাম ট্রিমার নিয়ে। মা মেয়েকে বলে দিলাম ডিস্টার্ব না করতে । ওখানে দেয়ালের সাথে একটা বড় আয়না আছে।
ট্রিমার টা অটো ফাংশন। এক থেকে দশ পর্যন্ত সাইজ আছে। কত নাম্বার দিয়ে কাটব বুঝতেছি না। সেলুনে গিয়ে বসলেই কেটে দেয় বলা লাগে না। অনেক ভাবতে ভাবতে একটা নাম্বার মনে পড়লো তিন। হ্যাঁ আমি তিন নাম্বার স্টাইলে চুল কাটি। ট্রিমারে তিন নাম্বার দিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে কানের উপর দিয়ে রাউন্ড চালিয়ে দিলাম। হাত সরাতেই দেখলাম ধান ক্ষেতের মাঝের আল এর মতো হয়েছে ঠিক। ন্যাড়া মাথায় এক সপ্তাহ পরে চুল উঠলে যে সাইজ হয় ঐ সাইজের একটা রাউন্ড হয়ে গেল। নিজের উপর রাগ হতে লাগলো। ভাবলাম তিন হলে বেশি ছোট হয় পাঁচে দিই। ভাইব্রেশনে কাঁপছে নাকি রাগে কাঁপছে জানি না তবে মাথার উপরের অংশ এমন কাট দিছি, দেখে মনে হচ্ছে মাথায় পাহাড়িরা জুম চাষ করে রাখছে।
এরকম একটা পাহাড় দেখছিলাম শ্রীলঙ্কার না আফ্রিকার। পাহাড় টাকে গোল করে সিঁড়ির মতো ধাপে ধাপে কেটে ধান চাষ করেছে। নিজের মাথা এই অবস্থা দেখে সত্যি কান্না করতে ইচ্ছে করছে। ধুর! জিরো দিয়ে একেবারে ন্যাড়া করে ফেলি। বাম কানের উপরের অংশটা কাটতেই ট্রিমার টা বন্ধ হয়ে গেলো। রাগে ট্রিমার টা আছাড় মারতে ইচ্ছে করছে। এতো দামী জিনিস ফেলতে ও পারছি না। বৌ কে ডাক দিয়ে ট্রিমার এর পেকেটটা আনতে বললাম। বৌ তো আমাকে দেখেই হাতের পেকেট সহ ধপ করে বসে পড়ল। ও কয়েক মিনিট হাসতে ভুলে গেছে মনে হচ্ছে। ওর হাত থেকে পেকেটের গায়ে লেখা নিয়মাবলী দেখে আবার মাথায় হাত। কমপক্ষে আট থেকে দশ ঘন্টা চার্জ দিলেই এই মেশিন আবার চলবে। আমি মুখ কালো করে বসে পড়তে দেখে বৌ হাসি থামিয়ে কাছে এলো।
– খুব তো বলছিলে, নিজে নিজে পারবে। মেয়েরা এসব পারে না। এখন এই মাথা নিয়ে থাকো।
ট্রিমার এর চার্জ এর সাথে সাথে আমার চার্জ ও বুঝি শেষ। আমি বৌয়ের কোন কথার উত্তর দিতে পারছি না। মনে হচ্ছে আমি কোমায় চলে গেছি। সবকিছু দেখছি কিন্তু বলতে পারছি না। মেয়ে ভিডিও করছে আর মেয়ের মা আমাকে ন্যাড়া করে দিচ্ছে।
এরপরের কাহিনী আরো খারাপ। গোসল করে বের হতেই মোবাইল ফোনে কল আর কল। সব ভিডিও কল। শালা, শালার বৌ, শালি সবাই লাগাতার ভিডিও কল দিতেই আছে। বৌয়ের একটা ফ্যামিলিয়ান গ্রুপ আছে ওখানে ওর চৌদ্দ গুষ্টির ভাই বোন সব এড করা। এতক্ষণে আমার ভিডিও ওদের গ্রুপের মাধ্যমে মাথার চুলের সাথে সাথে মান সম্মান ও কামিয়ে দিয়েছে। কি আর করা ফোন বন্ধ করে ফুল স্পিডে পাখা ছেড়ে কাঁথা গায়ে শুয়ে পড়লাম।
গল্পের বিষয়:
গল্প