মেয়েটি

মেয়েটি

নীতুকে আম্মার অপছন্দের কারণ হচ্ছে, আম্মার ইচ্ছা ছিলো আমি যেন তার খালাতো বোনের মেয়েকে বিয়ে করি। আব্বার অপছন্দের কারণ হচ্ছে, নীতুদের দূর্বল আর্থিক অবস্হা। আর আত্নীয় স্বজনের সমস্যার কারণ হচ্ছে, নীতুর গায়ের কালো রং।

দুই বছরের সম্পর্ককে পূর্ণতা দেওয়ার জন্য, নীতুকে বিয়ে করেছিলাম একরকম পরিবারের অমতেই। আব্বা আম্মা আত্নীয় স্বজন কেউই রাজি ছিলোনা। কিন্তু আমার জন্য বাধ্য হয়েই তাদের বিয়েটা দিতে হয়েছিলো। আম্মা নীতুর সাথে কখনো ভালোভাবে কথা বলেনি। সারাদিন গাধার মতো খাটিয়ে নিয়েও, মানুষের কাছে গল্প করেন বউ প্রচুর অলস, হাত দিয়ে এক টুকরা কাগজ ছিড়েও অর্ধেক করতে চায় না। বাড়ির সব কাজ আমার একার করতে হয়। বাপেরতো কোন ছাল নাই, মেয়ে রাজরানীর মতো থাকতে চায়। এর চেয়ে আমার বোনের মেয়ে কত ভালো ছিলো, একবারে সোনার টুকরা মেয়ে।

আব্বা নীতুর সাথে কথা বলেন না। নীতুর হাতের এক গ্লাস পানিও মুখে দেন না। আব্বার সামনে যাওয়া নীতুর নিষেধ। রাস্তায় লোক মুখেও নানান কথা শোনা যায়। হাফিজ এটা কি বিয়া করলো? কী চেহাঢ়ার শ্রী। প্রেম কইরা যখন বিয়া করছোস চেহাঢ়াটাতো দেখবি। আব্বা আম্মার মানষিক অত্যাচারের পাশাপাশি, আত্নীয় স্বজনের নানান কটু কথা নীতুকে সহ্য করতে হয়। ওর দিকে আমার তাকাতে লজ্জা করে। আমি কিছু বলতে পারিনা, নিজেকে কাপুরুষ মনেহয়।

নীতুর সাথে আমার সম্পর্কটা হয় কিছুটা অন্যরকম ভাবে। উচ্চ মাধমিক পাশ করার পর আমি আর পড়াশোনা করিনি। তাই আব্বা আমাকে বাজারের আমাদের কাপড়ের দোকানে বসিয়ে দেন। পূর্ব পশ্চিমে লম্বালম্বি বাজার। বাজারের পশ্চিম পার্শে কলেজ। বাজারের পূর্ব পার্শের ছেলে মেয়েদের, বাজারের মধ্য দিয়েই কলেজে যেতে হয়। সেখান থেকে একটা মেয়েকে ভালো লেগে যায়। মেয়েটাকে নিয়ে আমি হাবিজাবি চিন্তা করি। গভীর প্রেমে হাবুডুবু খাই। সকালে দোকান খুলে অপেক্ষায় থাকি, দুপুরে টিফিন টাইমে কলেজের সামনে গিয়ে ঘুরে আসি, বিকেলের দিকে অধির আগ্রহে বসে থাকি কলেজ ছুটি হবে মেয়েটাকে একনজর দেখতে পাবো বলে। যেদিন মেয়েটি কলেজে আসেনা সেদিন আমার মন খারাপ হয়।

একদিন চিঠি লিখে কলেজের এক ছেলেকে দিয়ে মেয়েটাকে দিতে বলি। ছেলেটা এসে খবর দেয় কলেজ ছুটি হলে সে আমাকে দেখা করতে বলেছে। আমার ভয় হয়, গিয়ে অবাক হই এই মেয়ে সেই মেয়ে না। আমি কিছু বলিনা। মেয়েটা বলে, আমি জানি আপনি চিঠিটা আমাকে দেননি। যাকে দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন সে হয়তো ভুল করেছে। কারণ, আপনি চিঠিতে যেসব বলেছেন, আমার সাথে তার কোন মিল নেই। আপনি চিঠিতে কারো নাম উল্লেখ করেন নি। আপনি নাম বলেন, আমি তাকে চিঠিটা দিয়ে দিবো। হঠাৎ আমার কি যেন হয়ে যায়। মনেহয়, মেয়েটাকে সত্য বললে সে কষ্ট পাবে। তার মায়াভরা চোখের কাজল গুলো ভিজে যাবে। মনের অজান্তেই বলে ফেলি, চিঠিটা আমি তোমাকেই দিয়েছি।

নীতুর সাথে প্রেম হওয়ার পর, নীতুর চেহাঢ়া নিয়ে অনেকেই আমাকে ইনসাল্ট করে কথা বলেছে। কিন্তু নীতুর কাজল মাখা মায়াবী চোখ, চকচকে দাঁতের হাসি, তার সুন্দর করে কথা বলা আমাকে সব ভুলিয়ে দিয়েছে এমনকি ওই মেয়েটিকেও। সবার মাঝে শুনেছি একেকটা গুণ থাকে। নীতুর গুণ হচ্ছে সে গুছিয়ে অসম্ভব সুন্দর করে কথা বলতে পারে। ও যখন কথা বলে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে শুধু কথাগুলো শুনি, আমার হিংসে হয় আমি কেন এতো সুন্দর করে কথা বলতে পারিনা।

আব্বা আম্মা আমাকেও ভালো চোখে দেখেন না। দিনে আমি দোকানে থাকি, নীতুর সাথে সারাদিনে আমার আর দেখা হয়না। আম্মা নীতুর তুচ্ছ কোন ভুল পেলে আমি দোকান থেকে আসার সাথে সাথে আমার কাছে বিচার দেয়। মাঝে মাঝে আমি বলি, আম্মা নীতু যদি তোমার মেয়ে হতো তুমি কি এগুলা ভুল ধরতে? আম্মা তখনই চিৎকার দিয়ে বলে, এই মেয়ে আমার ছেলেকে তাবিজ করেছে। ছেলে আমারে দেখতে পারেনা। কি ছেলে পেটে ধরলাম আমারে দেখতে পারেনা। আল্লাহ তুমি আমারে এটা কোন পাপের শাস্তি দিলা! সেজন্য আমি কিছু বলিনা। আব্বাও আমার সাথে তেমন কথা বলেনা। কাজের বিষয়ে দু একটা কথা ছাড়া বেশি কথা বলেনা। রাতে নীতুর কাছে যাই, আমি ওকেও কিছু বলতে পারিনা নিজের প্রতি ঘৃণা হয়। তবুও বলি, তোমার খুব কষ্ট হয় তাইনা?

-কষ্ট হবে কেন?
-সবাই তোমার সাথে এমন করে কষ্ট হয়না?
-হয়, তবে আপনি যদি আমাকে সারাজীবন এভাবে ভালোবাসেন তাহলে কোন কষ্টই কষ্ট মনে হবেনা।
-আমি জানি তোমার অনেক কষ্ট হয়।
-একদিন দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে।
-সে একদিনটা কোনদিন আসবে?
-আসবে খুব শীঘ্রই।
-হুম আসলেই ভালো।
-হুম। আপনার চুল দাড়িতো বড় হয়ে গেছে , কাটেন না কতদিন। আপনি কি গাধা নাকি সব আমাকে বলে দিতে হবে ?

আমি কিছু বলিনা ও আরো বলতে থাকে, সারাদিন দোকানে বসে থাকেন চেহাঢ়ার কি হাল বানিয়েছেন লক্ষ করেছেন? আমি কিছু বলিনা ওর মায়া ভরা চোখের দিকে তাকিয়ে কথা গুলো শুনতে থাকি। ভাবি এই মায়া ভরা চোখ গুলোকে কি আর কেউ দেখে? দেখলে সেও হয়তো ওর প্রেমে পরে যাবে বারবার। ওরাতো দেখে শুধু ওর গায়ের রং। সুন্দর এই চোখ দুটোর প্রতি দৃষ্টি আর কতজনের। মনের অজান্তেই বলে ফেলি, এই সু-নয়না একটু হাসোতো? নীতু আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, আমি এতক্ষণ যা বলেছি তুমি শুনোনি?

-না।
-তো কি করলে?
-তোমার সুশ্রী নয়নে হারিয়ে গিয়েছিলাম।

ও হঠাৎ কড়া কথা কথা বলতে গিয়ে হেসে ফেলে। আমি তাকিয়ে ওর হাসি দেখি, যে হাসিতে কোন কৃত্তিমতা নেই, আছে শুধু ভালোবাসা। প্রশ্ন জাগে একটা মেয়ে এতোটা কষ্ট নিয়েও কিভাবে এরকম হাসি হাসতে পারে? মনে মন প্রার্থনা করি নীতুর কথাই যেন ঠিক হয়। একদিন যেন সব সবকিছু ঠিক হয়ে যায়।

হাসপাতালের একটা বেডে সাদা কাপড়ে ঢেকে নীতু শুয়ে আছে। আম্মার কোলে একটা বাচ্চা কান্না করছে। সে জানেনা কেন সে কান্না করছে? একদিন বয়সের বাচ্চা কি বুঝতে পারে সে মা বলে কাউকে ডাকতে পারবেনা? নাকি অদৃশ্য কোন শক্তি তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে, সেজন্য সে কান্না করছে। আব্বার চোখ কেন যেন আজ টলমল করছে। আমার চোখে আজ পাণি নেই। শুনতে পাচ্ছি আম্মা আব্বাকে ডেকে নিয়ে বলতেছে, শেফালির মেয়ের এখনো বিয়ে হয়নি আমি বললে সে না করতে পারবেনা। আমি ভাবতে থাকি সত্যি এখন সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত