সুখের সীমা

সুখের সীমা

– আম্মা, চেয়ারম্যান চাচার ছেলের বিয়েতে আমরা খেতে যাব না?
– না বাবা। ওটা তো বড়লোকদের বিয়ে সেখানে আমরা যেতে পারি না। তুমি যদি লেখাপড়া করে অনেক বড় হও তাহলে ঠিকই আমরা এসব বিয়েতে যাব।

– কিন্তু মা, রাফি তো তার মা বাবার সাথে যাবে, তাহলে আমরা কেন যাব না মা।
– বাবা তুমি না অনেক ভদ্র ছেলে বুঝার চেষ্টা করো ওখানে সব বড়লোকরা আসবে আর যারা বড়লোক না তারা যদি ওখানে যায় তখন কি করবে জানো?

– কি করবে গেলে?
– তখন পুলিশের হাতে দিয়ে দিবে। তোমার বাবা মাইনেটা পেলে, তোমায় আমি মুরগি জবাই করে খাওয়াবো। সবাই মিলে খাব। অনেক মজা হবে। এখন তুমি ঘুমিয়ে যাও বাবা। আরিফ এর বয়স ৯ বছর। এত কিছু বুঝার কথা না। আসলে সে এতকিছু বুঝলোও না। কিন্তু সে এটা জানে তার মা যেগুলো বলছে সেগুলোর সব টুকু সত্যি নয়। একটা অজানা কষ্ট নিয়ে সে ঘুমিয়ে পড়লো।

পরদিন সকালে তার মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙ্গে। সে স্কুলে যাবার জন্য রেডি হয়। স্কুল শেষে বাড়ি আসার মুহূর্তে তার সাথে হুমায়রা, রাফি আদনান সবাই আসে। তারা চেয়ারম্যান চাচাদের বাড়ির বিয়ে নিয়ে কথা বলতে থাকে একে অপরের সাথে। হুমায়রা বলল, – জানিস রাফি চেয়ারম্যানদের বাড়িতে যে বিয়ে হচ্ছে ওখানে অনেক দূর থেকে বাবুর্চি আসবে কত কি রান্না করা হবে আমার তো এসব ভাবতেই জিভে জল চলে আসছে। রাফিও আনন্দের সুরে বলল, হেরে আমারও অপেক্ষা সইছে না। কত মজা হবে বিয়েতে। আদনান বলল, জানিস আমি একটা গেঞ্জি আর একটা প্যান্ট কিনেছি বিয়েতে আসার জন্য। সবাই নানা রকম কথা বলছিল বিয়ে নিয়ে কিন্তু আরিফকে শান্ত দেখে তারা জিজ্ঞেস করল,- কিরে তোর কি হয়েছে, তুই কথা বলছিস না যে? আরিফ স্বাভাবিক ভাবে বলল – কিছু হয়নি তো, আসলে মাথাব্যথা করছে কখন থেকে, তাই বেশি কথা বলছি না। হুমায়রা জিজ্ঞেস করলো – আচ্ছা আরিফ তুইও তো আসছিস তাই না?

আরিফ কি বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে পরে বলল আসলে আমরাও তো আসতাম কিন্তু আমার বাবা আমাদের নিয়ে নানা বাড়ি যাবে হয়তো। এ কারণে হয়তো আসা হবে না। আদনান বলল- কেন তোর নানার বাড়িতে পরে গেলেই তো পারিস। কত বড় বিয়ে কত মজা হবে। মিস করিস না ভাই। আরিফ বললো – আসলে আব্বা যা বলে তাই তো করতে হবে তাই না। আমার এখানে কিছু বলার সুযোগ নেই। আচ্ছা একটা কাজ কর তরা না হয় আস্তে আস্তে বাড়ির দিকে এগো আর আমি না হয় একটু তাড়াতাড়ি চলে যাই আমার না একটু বেশিই মাথা ব্যাথা করতেছে।

মিথ্যা কথা আরিফ বলেনা। কথাগুলো অগোছালো ভাবেই বলল। চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ির সামনের পুকুরের পাশে একটা সরু রাস্তা পুব দিকের পাড়ায় চলে গেছে। সেই রাস্তা দিয়েই আরিফকে তার বাড়ি যেতে হয়। যখন সে চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ির সামনে পৌঁছালো তখন সে বিয়ে বাড়ির দিকে তাকাল, কত রকমের রং করা হচ্ছে বাড়ির চারপাশে, কতগুলো সমবয়সী ছেলেমেয়ে সেখানে খেলাধুলা করছে। তার কেমন যেন বুকের ভিতর ধুক করে উঠলো। সেখানে আর না তাকিয়ে সোজা বাড়ির পথে দ্রুতপদে হাঁটতে লাগলো। বাড়ি গিয়ে ব্যাগটা রেখে মাকে খেতে দিতে বলল। সাধারণত আরিফ স্কুল থেকে ফেরার পর দুপুরের খাবার খেয়ে মায়ের নির্দেশে ঘুমোতে যায়। আজকে মা বলার আগেই ঘুমোতে গেল। কিন্তু কিছুতেই তার ঘুম হচ্ছে না, শুধু বারবার একটা জিনিসই মাথায় আসতেছে, কালকেই তো বিয়ে, কত মজা হবে সেখানে। আদনান, হুমায়রা, রাফি সবাই কত মজা করবে।

আমি কেন যেতে পারব না? তার কাছে এর কোনো সঠিক উত্তর নেই এবং তার মায়ের কাছেও এর কোনো উত্তর নেই। কারো কাছেই হয়তো কোনো উত্তর নেই। তাই সে আর কাউকেই প্রশ্নটি করে না। নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করে। কিন্তু ছোট মানুষ নিজেকে সংযত করতে পারে না। যে জিনিসটা ছোটদের মাথায় একবার ঢুকে পড়ে সেটা সহজে বের হয়না। তাদের সমবয়সী অন্যরা যদি একই কাজটি করে তখন আবার সে যদি এই কাজটিই করতে না পারে সেটা কিন্তু ছোট মানুষদের আর বুঝের মধ্যে থাকেনা। কিন্তু তবু আরিফ বুঝে গেছে, আর তাই নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে সে।

অনেকক্ষণ এপাশ-ওপাশ করার পরেও আরিফের ঘুম পাচ্ছিল না। বিছানা থেকে উঠে বারান্দায় গিয়ে নীল আকাশের দিকে তাকায় আর ভাবে,- আচ্ছা এত সুন্দর আকাশ, এত সুন্দর গাছপালা, এত সুন্দর পৃথিবীর মানুষ যিনি সৃষ্টি করেছেন তিনি কি এটাও পারতো না করতে, সবাইকে সমান টাকা পয়সার মালিক বানিয়ে পাঠাতে। পৃথিবীতে কোন গরীব, অসহায় কে না বানিয়ে সবাইকে সবল করে, অর্থ দিয়ে পাঠাতে। কেন করলেন না। এর উত্তর আরিফের মাথায় আসে না। কোন আক্ষেপ থাকেনা বালকটির ভেতর। প্রবাহমান নিয়ম অনুযায়ী আরিফদের কত ইচ্ছা যে কালের গর্ভে হারায়, তার হিসাব কেউ কখনো রাখেনি।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত