মিজান ভাইয়ের খুব একটা দরকার না হলে আমাকে তেমন ফোন দেয়না। তার কাছে আমি ছ্যাঁচড়া নামে পরিচিত। এখনও উনি আমার কাছে প্রায় ৬ হাজারের মতন টাকা পায়। এশার নামাজ পরে এসে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি মিজান ভাইয়ের অনেক গুলো মিসকল উঠে রয়েছে। ব্যাপারটা আমার কাছে স্বাভাবিকই মনে হলো। কারণ মিজান ভাই টাকা ছাড়া অন্য কিছুর জন্য আমাকে কল দিবেন না। কিন্তু অবাক হলাম মিজান ভাইয়ের মেসেজ দেখে। সেখানে লেখাঃ ‘রুবেল ভাই আমার, প্লিজ কলটা রিসিভ কর। আমি টাকার জন্য ফোন দেইনি। আমার বুকটা ফেঁটে যাচ্ছেরে ভাই। প্লিজ কলটা ধর।’ মেসেজটা পড়া শেষ হতেই মিজান ভাইর ফিরতি কল। আমি রিসিভ করতেই মিজান ভাই কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল…
–রুবেল আমার সব শেষরে, আমি কি করব এখন?
-মানে কি হলো ভাইয়া, কিছুইতো বুঝলাম না।
–আমার সবশেষরে….
বলেই মিজান ভাই কান্না শুরু করলো। আমি কি করব বুঝতো পারলাম। কি হয়েছে সেটাও জানিনা। মিজান ভাইকে কোনরকম শান্ত করলাম। তবুও কাঁদছে। আমি আগ্রহভার কণ্ঠে বললাম….
–কি হয়েছে ভাই, বাসায় কারো কিছু হয়েছে?
-তিথীর (মিজান ভাইর প্রেমিকা) বিয়ে আগামীকাল।
–মানে? কি বলো এসব?
-আমাকে একটু আগে ফোন করে সব বললো তিথী। প্রথমে বিশ্বাস করিনি পরে ময়নার (তিথীর বান্ধবী) কাছ থেকে সব জানলাম।
–কি বলো ভাইয়া, এতকিছু হলো আর তুমি আজকে জানো?
-আমি মরে যাবরে রুবেল….
বলেই হাউমাউ করে কান্না শুরু করলো মিজান ভাই। আমি কি করব বুঝতে পারছিনা। মিজান ভাই আর আমি একই গ্রামে থাকি। আমাদের বাসাও পাশাপাশি। মিজান ভাইর বাবা নেই। মা আর ছোট একটা বোন আছে। টিউশনি করিয়ে যা পায় তা দিয়েই সংসার আর পড়াশোনার খরচ চলে। আর তিথিদের বাসা আমাদের পাশের গ্রামে। পড়াশোনার জন্য জন্য মিজান ভাই আর আমি দুজনেই ঢাকা থাকি। মিজান ভাই এবার অনার্স ৩র্থ বর্ষে। আমি অনার্স ১ম বর্ষে। তবে দুজনের ভার্সিটি আলাদা। তিথীর সাথে মিজান ভাইর ৩ বছরের সম্পর্ক। আমাকে প্রায়ই মিজান ভাই তিথী আপুর কথা বলতো। মেয়েটাকে উনি ভীষণ ভালোবাসে। ফেসবুকে ভাইয়া কবিতা লিখতো। প্রত্যোকটা কবিতায় তিথীর কথা উল্লেখ থাকতো। কমেন্টে উনাদের মিষ্টি ঝগড়া, খুনসুটি হতো। কিন্তু আজকে এরকম একটা নিউজ শুনবো আশা করিনি। মিজান ভাই ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমি বললাম….
–ভাইয়া কেঁদনা।
-কি ভুল ছিলো আমার রুবেল।
–ভাইয়া আমিও বুঝতে পারছিনা।
ভাইয়া কিছু বলতে পারছেনা। কেঁদেই চলছে। উনার কান্না শুনে কখন যে নিজের চোখে পানি এসেছে খেয়ালই করিনি। প্রিয়জন হারানো যে কতটা কষ্টকর সেটা মিজান ভাইয়ের কান্না শুনেই আঁচ করতে পারছি। ততক্ষণাৎ মিজান ভাই বলল….
-রুবেল চল এখন-ই গ্রামে যাব।
–কি বলো ভাই? এত রাতে?
-তুই আমার মেসের সামনে চলে আয়, রাতের ট্রেনেই বাসায় যাব।
–ভাইয়া শান্ত হন, যা হবার হয়েছে।
-ভাইরে আমি মরে যাব, পারবনা তিথীকে ছাড়া থাকতে। প্লিজ কিছু একটা কর….
আবারো কান্নায় ভেঙ্গে পরল মিজান ভাই। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল…’আমি গ্রামে যাব। রাতের ট্রেনেই। প্লিজ রুবেল…’ এক মুহূর্ত দেরি করলাম না। টিশার্ট গায়ে দিয়ে এক প্রকার দৌঁড়ে চলে গেলাম মিজান ভাইর মেসে। কেঁদে চোখটা ফুঁলিয়ে ফেলেছে। মুখ একদম লাল হয়ে গেছে। আমাকে দেখেই মিজান ভাই জরিয়ে ধরে কাঁদা শুরু করলেন। আমি কোনরকম মিজান ভাইকে শান্ত করলাম। আলনা থেকে সবুজ রংএর একটা শার্ট পরিয়ে দিলাম। মিজান ভাই হাত দিয়ে ইশারা করলো বালিশের নিচে মানিব্যাগ। আমার পকেটে রাখলাম মানিব্যাগ, মিজান ভাই পাগলের মতন মেস থেকে বের হলো। একটা সিএনজি নিয়ে তাড়াতাড়ি কমলাপুর রেলওয়ে ষ্টেশন যেতে বলল। আমি মিজান ভাইয়ের পাশেই বসা। হাতে থাকা রোমাল দিয়ে মিজান ভাই বারবার চোখের পানি মুচতেছেন। আমি অসহায় দৃষ্টিতে মিজান ভাইর দিকে তাকিয়ে আছে। মাঝেমাঝে ভাই নিচের ঠোঁট চেপে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমি ভাইর হাতটা শক্ত করে ধরলাম। রেল স্টেশন পৌঁছেই ট্রেনের টিকিট কাটলাম।
আমি বাসায় ফোন করে আব্বাকে সমস্ত ঘটনা খুলে বললাম। আব্বা সব শুনে বলল…’মিজান যাতে কোন ঝামেলা না করে, নইলে ওরা মারবে। কারণ তিথিরা মানুষ ভালোনা। আর খান বংশ।’ মিজান ভাই একেরপর এক তিথীর নাম্বারে কল দিচ্ছে কিন্তু ব্যস্ত। নাম্বার ব্লাকলিস্টে। ফেসবুক, ইমু সব জায়গায় ব্লক। এতে মিজান ভাই আরো পাগল হয়ে গেলো। শেষে আমার ফোন দিয়ে কল দিলো। রিসিভ করতেই মিজান ভাই বলল….
–প্লিজ তিথী, আমার কষ্ট হচ্ছে। তুমি এটা করতে পারনা।
-দেখো মিজান আগামীকাল আমার বিয়ে, আমাকে কোন ফোন দিওনা প্লিজ।
–আমাদের রিলেশন?
-যা ছিলো ভুলে যাও। আমি পারবনা তোমায় বিয়ে করতে।
–কি বলছো তিথী এসব।
-টুটটুট….
কল কেঁটে দিছে। আবার কল দিলাম কিন্তু অলরেডি নাম্বার ব্লক লিস্টে। মিজান ভাইর কলিজা ছিড়ে যাচ্ছে। চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পরছে। এদিকে মিজান ভাই কিচ্ছু খায়নি। চোখমুখ শুকিয়ে গেছে। আমি রুটি কলা কিনলাম মিজান ভাই মুখে দিলনা।
সকাল ৭ টায় ট্রেনে করে আমরা বাজারে পৌঁছালাম। সেখান থেকে প্রায় দু’ঘণ্টা লাগে আমাদের গ্রামে যেতে। সকালে তেমন একটা আমাদের গ্রামের কোন গাড়ি পাওয়া যায়না। একরাতে মিজান ভাইয়ের চোখের নিচে কালি পরে গেছে। একটা ছেলে এতটা পান্না করতে পারে মিজান ভাইকে না দেখলে বুঝতামই না। ভালোবাসার জন্য মানুষ কতটা পাগল। আধাঘণ্টা ওয়েট করার পর একটা অটোরিকশা পেলাম। ভাড়া বেশি দিয়ে রওনা দিলাম গ্রামের উদ্দেশ্যে। খেয়াল করলাম মিজান ভাইর মুখটা একদম মলিন। ঠিক সদ্য ভুমিষ্ঠ হওয়া মৃত সন্তান জন্ম দেওয়া মায়ের মুখের মতন। চোখের মাঝে অশ্রুকণা জমা হচ্ছে। রোমাল দিয়ে সেগুলো মুচছে মিজান ভাই।
অতঃপর গ্রামে এসে পৌঁছালাম। আব্বুকে আগেই বলেছিলাম। তাই আব্বা সরাসরি আমাদের কাছে আসলেন। মিজান ভাইকে নিয়ে আমাদের বাসায় গেলাম। আন্টিকে কিছু বলিনি কারণ সে কষ্ট পাবে। কিন্তু মিজান ভাইকে আঁটকানো গেলোনা। এক প্রকার দৌঁড়ে পাশের গ্রামে গেলো। আমিও পিছে পিছে গেলাম। তিথীদের বাসায় গিয়েই চিৎকার শুরু করলো মিজান ভাই। চিৎকার শুনে বাড়ির লোকজন সবাই অবাক হলো। তিথী ঘর থেকে বের হলো। মিজান ভাই তিথীর দিকে যেতেই বিয়ে বাড়ির লোকজন মিজান ভাইকে ধরলো। মিজান ভাই তিথীকে বলছে….
–তিথী প্লিজ এমনটা করনা। ভালোবাসি খুব…
কিন্তু তিথী কিছুই বলছেনা। মিজান ভাই ছোটাছুটি করছে। তিথীর মুখ দেখেই বুঝলাম মিজান ভাইর জন্য তার একটুও অনুশোচনা নেই। বরং একরাশ ঘৃণা। আমি মিজান ভাইকে ছাড়ানোর জন্য গেলাম। কিন্তু উনি ছাড়তে চাইছেনা। একসময় তিথীর ভাই, চাচারা মিজান ভাইকে হালকা মেরে বাসা থেকে বের করে দেয়। আমি এক প্রকার টেনে মিজান ভাইকে সেখান থেকে নিয়ে আসি। বাসায় এসে সেকি কান্না। ততক্ষণে আন্টিও খবর পায়। নিজের বাপ মরা ছেলের পাগলামিতে উনিও কান্নায় ভেঙ্গে পরে। এভাবেই চলে যায় কয়েকদিন। খান বাড়ির লোকজন বলে দেয় তিথীকে কোন প্রকার ডিস্টার্ব করলে গ্রাম ছাড়তে হবে। কয়েকদিন পর-ই মিজান ভাই আর আমি ঢাকায় চলে যাই। তারপর থেকেই দুজন একই মেসে থাকি। কিন্তু মিজান ভাইর মুখে কখনওই হাসি দেখতে পারিনি। ঠিক ৪ মাস পরে আমি পারি জমাই প্রবাসে।
সারাদিনের ডিউটি শেষে মিজান ভাইর সাথে টুকটাক কথা হতো। কিন্তু ভাইকে আর কবিতা লিখতে দেখিনি। প্রায়ই বলতাম, ‘ভাল্লাগেনা কবিতা টবিতা’ বলেই ভাইয়া এড়িয়ে যেত। কয়েকদিন পর মিজান ভাইর চিরপরিচিত আইডিটারও খোঁজ পাইনা, ডিএক্টিব। আমিও ব্যস্ত হয়ে পরি রোজকার ডিউটিতে। কেমন জানি আবদ্ধ হয়ে যাই অন্য একটা জগতের সাথে। তখন অনেক আপনজনই পরে রয়য়ল অযত্নে। মিজান ভাইও সেই অযত্নেই আজ ঠিক ৫ বছর পর দেশে যাচ্ছি। হুট করেই মনে হলো সেই মিজান ভাইর কথা। কত পাগল ছিলো তিথীর জন্য। কতদিন দেখিনা তাকে। কতদিন পড়িনা তার কবিতা। সেই ছয় হাজার পাওনা টাকাও দেওয়া হয়নি এখনো। মা বলেছে মিজান ভাই একটা ছোট চাকরি করে। বিয়ে করেছে, একটা মেয়েও হয়েছে। মেয়ের নাম নাকি তিন্নি। একবার ইয়ার্কি করে বলেছিলাম ‘মিজান ভাই আপনার মেয়ে হলে নাম রাখবেন তিন্নি।’
পাগল ভাইটা সেই নামই রেখেছে। আমাকে ভালোই মনে রেখেছে তাহলে। অথচ খোজ নেয়নি। অভিমানের খাতা খুলে বসব। ভাবির হাতে রান্না করা সরষে ইলিশ মাছ দিয়ে ভাত খাওয়ার আবদার করব। আচ্ছা উনি কি সেই ছয় হাজার টাকার কথা মনে রেখেছে? কি জানি খুব ইচ্ছে মিজান ভাইয়ের সাথে দেখা হলে বলব, ‘ভাই তিথী কেমন আছে?’