স্মার্ট হবার পর

স্মার্ট হবার পর

পাত্রীর ঠোঁটের নিচে আকর্ষণীয় একটা তিঁল ৷ তিঁলটার দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে অপলকে তাকিয়ে আছি ৷ পাত্রী শাড়ি পরেনি, টিশার্ট পরে আমার সামনে বসা ৷ ঢাকা গুলশানের আধুনিক পরিবারের মেয়ে সে ৷ ৪ বছর লন্ডনে ছিল ৷ যেকারণে বাঙ্গালী সংস্কৃতি তার মধ্যে দেখা যাচ্ছেনা ৷ পাত্রীর গলার অনেকটা নিচেও তিঁল রয়েছে, সেদিকে চোখ যেতেই আমার গা কাঁপা শুরু হলো ৷ মনে মনে বললাম না জানি আর কোথায় কোথায় তিঁল রয়েছে তার ৷ পাত্রীর বুক বরাবর দৃষ্টির সংযোগ স্থির রইলো ৷ পাত্রী এটা বুঝতে পেরে বাঁধাহীন কন্ঠে বলে উঠলো,

-আপনি কি বোবা? কথা জানেন না? সেই তখন থেকে দেখেই যাচ্ছেন ৷ এমনভাবে দেখছেন যেন আমি অর্ধনগ্ন মডেল! পাত্রীর রুপে ঘায়েল হয়ে মোহবিষ্ট ছিলাম ৷ ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলাম ৷ সম্ভিত ফিরলো পাত্রীর জোরালো কন্ঠস্বরে ৷ তাকে জবাব দিলাম,

-না না, আমি বোবা না ৷ কথা জানি ৷ আসলে আপনাকে দেখে কল্পনার সাগরে ডুব দিয়েছিলাম ৷ হুশ ছিলনা ৷ সত্যি বলতে আপনার মায়াবী চেহারা দেখে এমনটা হয়েছে ৷ যে কারণে কথা বলার কোনো জো ছিলনা!

-তো, এখন বলুন; কথা বলতে তো মানা করিনি ৷ আমাদের আশেপাশে কেউ নেই ৷ সবাই চলে গেছে ৷ নির্ভয়ে বলতে থাকুন!
-আপনার নামটা কি?
-নাম তো জানেন ই, আবার জিজ্ঞেসা করছেন কেন?
-আপনার মুখ থেকে শুনতে চাচ্ছি ৷
-আমার নাম নাদিয়া ৷

-কিন্তু আমি তো জানতাম সাদিয়া ৷
-ওটাও আমার নাম ৷
-আচ্ছা, তো লন্ডন শহরটা কেমন ছিল?
-অনেক ভাল ৷ আমার তো ইচ্ছা বিয়ের পর লন্ডন চলে যাওয়ার এবং সেখানে স্থায়ী হওয়ার ৷
-হাজবেন্ডকে রেখে?
-আজব! হাজবেন্ডকে রেখে যাবো কেন?
-কিন্তু আমি তো লন্ডন যেতে চাইনা ৷ দেশেই থাকবো ৷
-আশ্চর্য! আপনি লন্ডনে যাবেন নাকি দেশে থাকবেন সেটা আমাকে বলছেন কেন?
-ওমা, আমরা বিয়ে করবোনা? আপনি তো বিয়ের পর লন্ডনে চলে যাবেন ৷ কিন্তু আমার তো লন্ডন একদমই পছন্দ না ৷

-আপনি ইতিমধ্যে স্বপ্ন দেখে ফেলছেন যে আমি আপনাকে বিয়ে করবো?
-কেন? আপনি আমাকে বিয়ে করবেন না?
-না, আপনাকে আমার একদমই পছন্দ হয়নি ৷ নাদিয়ার কথা শুনে বুকটা ধারাক করে উঠলো ৷ হাতুড়ির পিটুনি খাচ্ছিলাম মনে হলো ৷ হতভম্ব হয়ে তাকে বললাম,

-পছন্দ না হবার কারণ? নাদিয়া তাচ্ছিল্যকর কন্ঠে বলল,
-প্রথমত আপনি স্মার্ট না ৷ কথা বলাও শিখেন নি ৷ তারচেয়ে বড় কথা আপনি লন্ডন শহরকে অপছন্দ করেন ৷
-যদি বলি লন্ডন শহর আমার পছন্দ, তবে কি আমাকে পছন্দ হবে আপনার?
-জি না, লন্ডন শহর আপনি পছন্দ করলেই তো স্মার্ট হয়ে যাবেন না ৷
-তারমানে বিয়েটা হচ্ছেনা?
-না ৷

একরাশ বিষন্নতা ও অপমানের চাকু বুকে নিয়ে নাদিয়ার বাসা থেকে চলে এলাম বাবা, মা ও মামাকে সঙ্গে নিয়ে ৷ বাসায় ফিরে ভাবতে লাগলাম নাদিয়াকে কি করে জব্দ করা যায় ৷ এই মেয়েকে জব্দ করতেই হবে ৷ আর সেটা তার মন জয় করে ৷ তার মন জয় করার উপায় স্মার্ট হওয়া ৷ যেমনটা শাহরুখের রাবনে বানাদে জুড়ি মুভিতে বোকা শাহরুখ হয়েছিল ৷ স্মার্ট হবার লক্ষ্যে পুরুষদের পার্লারে গিয়ে হালকা দাঁড়ি ও গোঁফ কেটে ক্লিন ফেসে রুপান্তরিত হলাম ৷ চুলের কাটিং পাল্টে ফেললাম ৷ চোখের লেন্স পাল্টে ফেললাম ৷ তারপর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতে লাগলাম ৷ অবাক হয়ে গেলাম আমার চেহারা দেখে ৷ এই আমি আগের মত নেই, একদম পাল্টে গেছি ৷

নাদিয়া হয়তো চিনবেই না আমার নতুন রূপ দেখে ৷ এবার পালা হাঁটার স্টাইল, কথা বলার স্টাইল পরিবর্তন করা ৷ সেটাও করে ফেললাম ৷ এবার ডিএসএলআর ক্যামেরা দিয়ে প্রফেশনাল ফটোগ্রাফারের সহায়তায় শ’খানেক পিকচার উঠলাম ৩দিনের মধ্যে ৷ এবার ফেসবুকের পুরোনো আইডি থেকে সমস্ত পুরোনো পিকচার ডিলিট দিয়ে নতুন ১০টা পিকচার আপলোড করলাম ১দিনের মধ্যে ৷ আইডির সবাই তো অবাক ৷ নিজের মধ্যে হিংসা ভাব চলে এলো, ভাবলাম নাদিয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়াবোনা ৷ যে আমাকে ঘৃণা করে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে অপমানিত করে তাড়িয়ে দিয়েছে তার পিছু ঘুরে কি লাভ? নাদিয়ার কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলাম!

১৫দিন পার হয়ে গেল ৷ ১৫দিনের মধ্যে সুপ্তি নামের একটা মেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেলো ৷ তার ফোন নম্বরও নিয়ে ফেলছি ৷ চলছিল বন্ধুত্ব ৷ ২ মাস পার হয়ে গেল ৷ হঠাৎ একদিন সুপ্তি আমাকে প্রোপজ করে ফেললো ৷ আমি তো তার প্রতি আগে থেকে মুগ্ধ তাই ফিরিয়ে দেবার প্রশ্নই আসেনা ৷ সুপ্তি হয়ে গেল আমার গার্লফ্রেন্ড ৷ আরো ২ মাস কেটে গেল ৷ হঠাৎ একদিন সুপ্তি বললো তার বিয়ে ঠিক হয়েছে ৷ এনগেজমেন্টও হয়েছে ৷ এই বিয়ে থামানো সম্ভব না ৷ একটাই উপায় পালানো ৷ সুপ্তির কথামত পালাতে রাজি হয়ে গেলাম ৷ আগামী রবিবারে পালাবো আমরা ৷ সেই মোতাবেক বাসা থেকে বের হলাম ৷ সুপ্তি তার আব্বুর রুম থেকে ২ লাখ টাকা ও তার মায়ের ৪ ভরি স্বর্ণ চুরি করে নিয়ে বাসা থেকে বের হলো ৷ আমার যে স্মার্ট ভাবটা ছিল সেটা ১ মাস হলো পরিবর্তন করে ফেলছি৷৷

শুধু কথা বলার মার্জিত ভাবটা বিদ্যমান আছে ৷ লাস্ট ১মাসের মধ্যে সুপ্তির সঙ্গে ভিডিওকলে কথা হয়নি ৷ সে ভিডিও কলে কথা বলা পছন্দও করতোনা ৷ বর্তমানে আমি কাজী অফিসের সামনে দাঁড়ানো ৷ পনের মিনিট ধরে সুপ্তির জন্য দাঁড়িয়ে আছি ৷ কিন্তু তার আসার খবর নেই ৷ এভাবে ১ঘন্টা পার হবার পর সুপ্তি এলো ৷ তার গায়ে বোরখা ৷ অবাক হলাম বোরখা দেখে ৷ সুপ্তি আমাকে দেখে চোখ গোলগোল করে তাকিয়ে বোরখার নেকাপ খুলতে লাগলো ৷ নেকাপ খুলেই বিস্ময়ের কন্ঠে বলল,

-আপনি এখানে? বিয়ে করতে আসছেন নাকি? পালিয়ে বিয়ে করবেন? মিটমিট করে হাসলাম ৷ হাস্যজ্জ্বল চেহারাতে বললাম,

-হুম, পালিয়ে বিয়ে করতে যাচ্ছি ৷ পাত্রীটা কে জানেন?
-কে?
-আমার সামনে যে মেয়েটি দাঁড়ানো, যার আসল নাম সাদিয়া ৷ নিজের দেওয়া নাম নাদিয়া ৷ ফেসবুকের নাম সুপ্তি! সুপ্তি হকচকিয়ে উঠলো ৷ চোখ নাচিয়ে তোড়জোর কন্ঠে বলল,

-কিহ? কি বলছেন? আপনি কে বলুন তো? তৃপ্তির হাসি হেসে বললাম,

-আমি সেই আনস্মার্ট বজলু শেখ ৷ যে আপনাকে পাত্র হিসেবে দেখতে গিয়েছিল? আর আপনি তাকে আনস্মার্ট বলে ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন! সুপ্তির চোখ ছলছল করছিল ৷ ঢোক গিলে কাঁপা গলায় বলল,

-ও! তো, আপনি আমার উপর প্রতিশোধ তুলতে এতসব নাটক করেছেন? ক্ষেতভাব থেকে নিজেকে পাল্টিয়ে স্মার্ট হয়ে আমাকে ধোঁকা দেবার চেষ্টা করেছেন? চাপাকন্ঠে বললাম,
-সেরকমই বলা চলে ৷ তবে একসময় ভেবেছিলাম আপনার অপমানের কথা ভুলে যাবো, আপনাকে এড়িয়ে চলবো ৷ কিন্তু পরে মনে হলো, তাকে জব্দ না করা পর্যন্ত মন শান্ত হবেনা ৷
-তারজন্য আজ আমাকে বাড়ি ছাড়া করলেন?
-না, সেজন্য না ৷ আসলে আপনাকে একটা জিনিস দেখাতেই এখানে এনেছি!
-কি দেখাতে?
– এটাই দেখাতে যে এই ক্ষেতকেও কত রুপবতী মেয়ে ভালবেসে বিয়ে করতে ঘর ছাড়তে পারে ৷ একটু অপেক্ষা করুন সে চলে আসবে!
-না, সে আসবেনা ৷ সে আপনার সামনেই দাঁড়ানো ৷
-মানে?
-মানে খুব সোজা ৷

আপনি সুপ্তির পাশাপাশি সুইটি নামের যে মেয়ের সঙ্গে ফেসবুকে প্রেম করতেন সেই মেয়ে অন্য কেউ নই, আমিই ৷ ওটা আমার আরেকটা আইডি ৷ ফোনে কথা বলতাম আমরা,় যেসময় নাকি আপনি অবসর সময় কাটান ৷ সুইটির সঙ্গে আপনার কখনই ভিডিওতে কথা হয়নি, যে কারণে আমি আপনাকে নিজের ফটো না দিয়ে অন্য কারো ফটো দিয়েছিলাম ৷ আপনিও সেটা বিশ্বাস করেছিলেন এবং আমাকে ভালও বেসে ফেলেছিলেন ৷ জানেন আপনার সঙ্গে আমিও কেন উল্টা নাটক করেছিলাম?

-কেন?
-কারণ, আপনি যেদিন নিজেকে বদলে ফেলে আপনার আইডিতে স্মার্ট লুকের পিকচার আপলোড দিয়ে কয়দিন পর আমার আইডিতে ম্যাসেজ দেওয়া শুরু করেছিলেন, সেদিনই আপনার পিকচার দেখে বুঝেছিলাম আপনি সেই আনস্মার্ট বজলু ৷ এও বুঝেছিলাম যে আপনি আমাকে প্রেমের ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করবেন ৷ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আমিও উল্টো চাল চালি! বলেন কেমন দিলাম? সুপ্তি ওরফে নাদিয়া ওরফে সাদিয়ার কথা শুনে আমি অজ্ঞান ৷ জ্ঞান ফিরে দেখি সাদিয়া আমার মাথায় পানি ঢালছে এবং আমি আমাদের বাসায়!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত