খালেক সাহেবের স্ত্রী মারা গিয়েছে তিনমাস।মেয়েদের সংসার আছে তারাই বা আর কতদিন থাকতে পারে!তাই উপায়ন্তর না পেয়ে একমাত্র ছেলে খালিদ আহমেদ কে বিয়ে করালো।মেয়ে মানুষ ছাড়া একটা সংসার অচল তা বুঝতে পারলো খালেক সাহেব।খালিদ সদ্য মাত্র ভার্সিটিতে উঠেছে, অন্যদিকে যে মেয়েকে বাড়ির বউ করে আনা হয়েছে সে ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে।কারো পড়াই বন্ধ হলো না।খালেক সাহেব ছেলে আর ছেলের বউ দুজনের পড়ার ই দায়িত্ব নিয়ে নিল।
খালিদের স্ত্রীর নাম চামেলি। খালিদের অনার্স কমপ্লিট হয়েছে,কিছুদিন হয় খালিদ একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে জয়েন করেছে।অন্যদিকে চামেলি অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ছে।তার মধ্যেই জানতে পারলো চামেলি অন্তঃসত্ত্বা।চামেলি মা হতে চলেছে এই খবরটা যেন বাড়িতে খুশির জোয়ার এনে দিল।খালিদ চামেলির খুব খেয়াল রাখে,আর খালেক সাহেব ছোট বাচ্চাদের জিনিসপত্র এনে ঘর ভর্তি করছে।
চামেলিকে নার্সিংহোমে নেওয়া হলো।খালিদ আর ওর বাবা উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছে কখন খুশির খবরটা শুনতে পাবে।অপারেশন রুম থেকে ডক্টর বের হলেন তবে অন্ধকার মুখ করে।খালিদ অস্থির হয়ে জানতে চাইলো কি হয়েছে ডক্টর? ডাক্তার কিছু না বলে ভেতরে যাওয়ার পারমিশন দিলো।ভেতরে গিয়ে যা দেখলো তা দেখবে কল্পনাও করেনি।চামেলির নিথর দেহ সাদা চাদরে ঢাকা।বুকে পাথর চাপা দিয়ে নিয়তি মেনে নিতেই হয়,খালিদ ও তা করলো।
খালিদ সুন্দর একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তানের বাবা হয়েছে।প্রাপ্তির সুখ আর হারানোর ব্যথা মিলে এমন একটা পরিবেশ হয়েছে,যেন অনুভূতি প্রকাশের ভাষাও নষ্ট হয়ে গিয়েছে।খালেক সাহেব নাতনীর মুখ দেখে নাম রাখলেন চাঁদ আহমেদ। এইটুকু ছোট বাচ্চা দুইজন পুরুষ মানুষের পক্ষে সামলানো মুশকিল,তার উপর খালিদের অফিস রয়েছে।বোনরাই বা আর কতোদিন থাকবে।
তাই চামেলি মারা যাওয়ার দুইমাস পরে খালিদকে আবারও বিয়ে করানো হলো।এই মেয়ের নাম চম্পা। যদিও চম্পার মা-বাবা প্রথমে রাজি ছিলো না।কিন্তু চম্পার ইচ্ছেতেই বিয়েটা হয়েছে। চাঁদকে দেখার পর চম্পার কেমন মায়া হলো।একটা অসহায় বাচ্চা, যার মা নেই,এই বাচ্চাটার মায়ের অভাব পূরণ করলেও যে পূণ্য হবে।চম্পা মা-বাবাকে বুঝিয়ে এই বিয়েতে রাজি করিয়েছে। চাঁদ এতোটাই মিষ্টি হয়েছে দেখতে যে, যে কেউ দেখলে ওর মা হতে চাইবে।খালেক সাহেব বলে চাঁদ নাকি দেখতে একদম চামেলির মতো হয়েছে। চম্পার বিয়ের পাঁচ বছর চলে,ইচ্ছে করেই বাচ্চা নেয়নি।চাঁদকে মানুষ করাই যেন চম্পার প্রধান কাজ।আর চাঁদও হয়েছে তেমন মা ছাড়া কিছু বোঝে না।
মামনী, মামনী–হুম মামনী বলো।মামনী আমাকে একটা বাবু এনে দিবা?মামনী তোমার একটা নতুন বাবু চাই,ঠিক আছে তোমার পাপাকে বলব এনে দিতে।মামনী মামনী পুতুল বাবু না।তাহলে কোন বাবু?সাহেদের মত একটা বোন এনে দিবা?সাহেদের বোন ত তোমারও বোন তাই না।না মামনী আমাকে একটা বোন এনে দাও না,পাপাকে ফোন করে বলো নিয়ে আসতে।
মামনী তুমি চকলেট খাবে,চকলেট দেই।না খাবো না,আচ্ছা আচ্ছা কান্না করতে হবে না,বলবো একটা লাল টেডি বিয়ার নিয়ে আসতে।না,না, আমার একটা বোন চাই,এই বলে কোল থেকে নেমে বারান্দায় চলে গেল। বোন যে কিনতে পাওয়া যায় না,এইটুকু বাচ্চাকে সে কথা বোঝানো যাবে না।চম্পা বারান্দা থেকে চাঁদকে এনে বললো বোন কিনে দিবে।তারপর খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলো।
রাতে ডাইনিং এ খেতে বসে চম্পা চাঁদের বাহানার কথা বললো।সব শুনে খালেক সাহেব বললো আমিও এ কথাটা ভাবছি বেশ কিছুদিন ধরে,পরিবারে একজন নতুন সদস্য আসলে আমারও খুশি লাগবে।এই বলে উনি ডাইনিং থেকে চলে গেলেন। খালিদ বললো,তুমি কি বলো?আমি কি বলবো,তবে মেয়ে যেমন লক্ষী তেমন একরোখা, বোন চাই মানে বোন চাই।ঠিক আছে আমরা ডক্টরের সাথে কথা বলবো।তবে….চম্পা আমি জানি তুমি কেন বাচ্চা নিতে চাও না,যদি চাঁদকে কখনো অবহেলা করো নিজের বাচ্চা পেয়ে তাই।কিন্তু তোমার উপর আমার পূর্ণ বিশ্বাস আছে কখনোই তুমি তা করবে না।চম্পাও আর কথা বাড়ালো না।
সকালে ঘুম থেকে উঠে চাঁদ যখন জানতে চাইলো,পাপা বোন এনেছে কিনা,তখন চম্পা চাঁদকে কোলে নিয়ে বললো মামনী বোনটা আমরা তোমার আগামী জন্মদিনে উপহার হিসেবে দিবো কেমন।না না আজই চাই।মামনী লক্ষী মেয়েরা মামনীর কথা শুনে,তুমি তো লক্ষী মেয়ে আমার কথা শুনবেনা?চাঁদ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে,সম্মতি সূচক মাথা নাড়লো।
তিনমাস পরে বুঝতে পারলো চম্পা মা হতে চলেছে। আল্লাহর অশেষ রহমতে চাঁদের একটি বোন ই হলো।আল্লাহর কাছে চম্পা শুকরিয়া আদায় করলো।চাঁদের সাথে নাম মিলিয়ে রাখলো চারু আহমেদ। চাঁদ নিজেই এখনও বাচ্চা, কিন্তু তারপরেও সারাক্ষণ বোনের পাশে বসে থাকে,সেকি খুশি দেখার মতো।কোলে নিতে পারেনা তবুও কোলে নিতে চায়। চাঁদের জন্য চম্পা ওর জাতীয় পরিচয়পত্র থেকে শুরু করে,সার্টিফিকেটের নামও পরিবর্তন করে নিয়েছিল।
চাঁদ আর চারুর বার্থ সার্টিফিকেট স্কুল কলেজ সবখানে মায়ের নাম দেয়া আছে চামেলি চম্পা।কারণ চাঁদ যদি কখনো গর্ভধারিণী মায়ের কথা ভেবে কষ্ট পায় তাই।তবে চম্পা ওরে অবশ্যই সত্যিটা জানাবে তবে সময় হলেই। চাঁদের এখন বিশ বছর,ভার্সিটিতে পড়াশোনা করে,আর চারু সামনে এসএসসি দিবে। চাঁদ হঠাৎ মায়ের আলমারি থেকে শাড়ি নামাতে গিয়ে,শাড়ির ভাজে রাখা একটা ডায়েরি তে চোখ গেল।ডায়েরিটা হাতে নিয়ে ওর কাভারটা খুব পছন্দ হলো।যদিও কারো ডায়েরি পড়া অভদ্রতা তারপরেও চাঁদের ডায়েরিটা খুলতে ইচ্ছে হলো।কৌতূহল নিয়েই খুললো।
ডায়েরি খুলে একটা অতিব সুন্দরী একজন মেয়ের ছবি পেল,আর একটা পাতায় কিছু কথা লিখা। চম্পার যেদিন বিয়ে হয়েছিল সেদিনের ডেট দিয়ে কিছু লিখাঃ “আজ থেকে আমি চাঁদের মা হওয়ার দায়িত্ব নিলাম।জানিনা কতোটা পালন করতে পারবো।তবে সে চেষ্টার কোন ত্রুটি রাখবো না।” তার নিচে, চারু যেদিন জন্ম হলো সেদিনের ডেট দিয়ে লেখাঃ”আজ থেকে আমার দুই মেয়ে,চাঁদ আর চারু। তবে এই দুইয়ের মাঝে পার্থক্য হলো একজনকে আমি গর্ভে ধারণ করেছি আর একজনকে ধারণ করিনি।কিন্তু আমার কাছে দুজনই সমান,যদি বলি চাঁদ আরও বেশি।
অপর পৃষ্টায় যে দিন চাঁদের আঠারো বছর পূর্ণ হলো সেদিনের ডেট দিয়ে লিখাঃ “প্রিয় চামেলি আপা, দোয়া করি আল্লাহ যেন আপনাকে বেহেশতের সর্ব্বোচ্চ মর্যাদা দান করে।ভালো থাকেন আপনে উপরে।আপনার স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে এ বাড়িতে আপনার অনেক আসবাবপত্র রয়েছে। বাগানের দক্ষিণের কৃষ্ণচূড়া গাছটা আপনার খুব প্রিয় ছিল,ঐগাছটা এখনও রয়েছে। ডালপালা ছড়িয়ে ছাতার ন্যায় আকৃতি ধারণ করেছে।যখন কৃষ্ণচূড়া ফুটে তখন সমস্ত বাগান যেন লালে লাল হয়ে থাকে।চাঁদেরও আপনার মতো কৃষ্ণচূড়া খুব পছন্দ। আর আছে আমার কাছে এই ছবিটা।অবশ্য খালিদের কাছে আপনাদের বিয়ের অ্যালবাম রয়েছে, যা ও যত্ন করে সিন্দুকে রেখে দিয়েছে। চাঁদ এখন বড় হয়েছে,ওরে চাই আমি সত্যিটা জানাতে।কিন্তু সাহস হয়ে ওঠে না।কেমন যেন ভয় হয়,আমি চাই না ও জানোক আমি ওর সৎ মা।
আমি তো ওর সৎ মা না ভালো মা হতে চাই।খালিদের মুখে আপনার অনেক কথা শুনি,কথা শুমলে মনে হয় আপনার মত ভালো মানুষ আর দুইটা হয় না।নিঃসন্দেহে আপনে আমার থেকেও খুব ভালো মা হতেন তা চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া যায়।তবে আমি চেষ্টা করেছি ওর মা হয়ে ওঠতে তবে কতোটা পেরেছি তা জানি না।জানেন চাঁদ আর চারু দু’জন দুজনকে চোখে হারায়। ওপারে যেন আপনে ভালো থাকেন প্রতিবার নামাজ শেষে সেই দোয়া করি।” ‘চম্পা’ ডায়েরি পড়ে চাঁদ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো।মায়ের ছবির উপর টুপটুপ করে কয়েক ফোঁটা চোখের পানি পড়লো।না নিজের মায়ের জন্য না,ভালো মায়ের জন্য।
ডায়েরি আর ছবি হাতে নিয়েই রুম হতে একদৌঁড়ে বের হয়ে,রান্নাঘরে গিয়ে চম্পাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো।কি হলো চাঁদ, হঠাৎ মামনী কে এতো ভালবাসছো যে,কোন খুশির খবর আছে কি?চাঁদ কাঁদো কাঁদো গলায় বললো মামনী তুমি তো আমার সবথেকে ভালো মামনী।আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি।সারা পৃথিবী খুঁজলে কি তোমার মতো ভালো মা পাওয়া যাবে?চম্পা হতভম্ব হয়ে গেল,চাঁদের দিকে ঘুরে দেখলো ওর হাতে ডায়েরি আর ছবিটা। এবার চম্পাও কেঁদে ফেললো।চম্পা চাঁদকে জড়িয়ে ধরে সেকি কান্না,যেন থামার নাম নেই। চারু এসে এদের কান্না দেখে বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছে,কারণ ও বুঝতে পারছেনা কি হয়েছে।