বোন বয়সে বড়ো হলে তার স্বামীর বাড়িতে অধিকার কিংবা মা মরা ছেলের পরিচয়ে খানিকটা করুণা জুটিয়ে থাকাটাও দৃষ্টিকটু না কিন্তু ছোট বোনের স্বামীর বাড়িতে বড়ো দাদা হয়ে মাসের পর মাস থাকাটা দৃষ্টিকটুই বটে সেই সাথে বেশ অস্বস্তির এবং খানিকটা লজ্জারও। সেই লজ্জা, অস্বস্তি আরো বাড়িয়ে দিত ছোট বোনের শাশুড়ি, তার স্বামীর ওমক তোমক আত্নীয়রা। ছোট বোনের স্বামীর বাড়িতে যেয়ে পড়ে থাকতে হবে ওমনটা কোনকালে দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি।
বড়ো হয়েছিলাম লক্ষ্মন সাহার পরিত্যক্ত জমিদার বাড়িতে, বাবা ছিলেন জমিদারের বড়ো ছেলের খুব কাছের স্নেহভাজন। দেশ বিভাগের পর তিনি হিন্দুস্তান চলে গেলে বাবা ঐ স্নেহের অধিকার বলে আমাদের নিয়ে সদ্য পরিত্যক্ত হওয়া জমিদার বাড়িতে ওঠেন। মস্ত পুকুর, যত্নে সাজানো পূজোঘর, উঠোন সমান বিশাল ছাদটাকে একটা বয়স অবধি কেবল আমাদেরই মনে হতো, সে ভুল অবশ্য আমার কৈশোরের গোঁফ ওঠার আগেই ভেঙে যায়।
জমিদার বাড়ির উঠোনে কখনো মাটির চাড়া আবার কখনো বা বাঁশের কঞ্চির ধারালো আগা দিয়ে মা আমাদের দুই ভাই-বোনকে পালাক্রমে বর্ণজ্ঞান দান করেছিলেন। উঠোনের তুলসী গাছের একটু দুরেই বর্ণমালা নিয়ে মস্ত খোট এঁকে রেখেছিলেন মা। ভোরবেলা ঘুম থেকে জাগিয়েই সেই বর্ণ খোটের সামনে দাঁড় করিয়ে দিতেন।
জমিদার বাড়ির গন্ধ গায়ে মাখিয়ে চললেও আদদে আমাদের অবস্থানখানা ঠিক কোথায় তা জানান দিতে মায়ের দুখানা জীর্ণ শাড়ি, আমাদের আধপেটে থাকার জন্য কিনে আনা ভাত রাঁধার ছোট্ট হাঁড়িখানা যথেষ্ট ছিল। বাবা আমাদের জমিদার বাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে বলেছিলেন তিনি হিন্দুস্তান যাচ্ছেন লক্ষ্মন সাহার ছেলে আনন্দ সাহার সাথে সাক্ষাৎ করতে, জমিদার বাড়িতে থাকার জন্য পাকা বন্দোবস্ত করতে যাচ্ছেন বলেই মা সোৎসাহে বাবাকে বাড়ির মূল ফটক অবধি এগিয়ে দিয়েছিলেন মনে মনে বিরাট কিছু একটা পেয়ে যাবার আশা বেধে।
মায়ের আশাতে ঘূণে ধরেছে, ক্যালেন্ডারের পাতা বদলে গেছে, মায়ের নতুন শাড়িখানা পুরোনো হয়েছে, চোখের কোণে কালি জমেছে তবুও বাবা কোন বন্দোবস্ত করে উঠতে পারেননি বলেই হিন্দুস্তান থেকে ফেরেননি হয়তো। জমিদারদের পুকুরে হেলেঞ্চা শাক সেদ্ধ করে নুন দিয়ে তা হাসতে হাসতে দু ভাই-বোন খেয়ে নিতাম, পূজো এলে দুই ভাই-বোন গুটিশুটি মেরে ঘরের এক কোণে বসে রইতাম। মা একসময় বাধ্য হয়েই স্যাকরা ব্যাটার কাছে তার কানে দুল দুখানা বন্ধ রেখে টাকা নিয়ে এলেন, জমিদারদের মস্ত পুকুরখানা তিনজনে মিলে সাফসোফ করে তাতে মাছের পোনা ছাড়লাম। সময় গড়াতেই আমাদের আধপেটা ভাতের আড়ির বদলে ভরপেটার জন্য বড়ো হাঁড়ি কেন হলো, মা সস্তায় শাড়ি কিনলেন, আমাদেরও নতুন কাপড় কিনে দিলেন। সময় বদলে যাবার ঐ ক্ষণে মা দুর্গা না এলেও আমাদের দু ভাই-বোনের মনে তখন মা দুর্গার আগমনী বাজনা বাজতো, সারাক্ষণই পূজো পূজো গন্ধ পেতে লাগলাম। দরিদ্রের ঘরে নুন ভাতের বদলে মাছ ভাত এলে, জীর্ণ কাপড়ের বদলে নতুন কাপড় জুটলে, মায়ের চোখের কালি মিলিয়ে গেলে তাহাই যে দুর্গো পূজো সেই বোধটুকুন আমার পনেরো বছর বয়সেই পেয়ে গিয়েছিলাম।
দেবীর যেমনি একটা সময় পর বিসর্জন হয় আমাদের সুখ টুকুনেরও একটা সময় পর বিসর্জন হলো। কার্তিকের গুমোট বাধা রাত্তিরে মা আমাকে ডেকে বললেন, বোনকে দেখে রাখিস, মা চলে যাব আজ। সতেরো বছরের ঐ বয়সটাতে বুঝে গিয়েছিলাম মা কী বোঝাতে চেয়েছিলেন। শ্যামা ঘুম ভেঙে চোখ ডলতে ডলতে বলেছিল, দাদা তুই কাঁদছিস কেন? কী হয়েছে রে? আমি যখন বলেছিলাম, মা মরে গেছে রে বোন, মা মরে গেছে। শ্যাম ফিক করে হেসে বলেছিল, এখন কী মিথ্যে মিথ্যে খেলা খেলার সময়? সকালে খেলবোনে আবার। শ্যামার সঙ্গে আমি প্রায়ই মিথ্যে মিথ্যে খেলা খেলতাম, শ্যামা সে রাতে ভেবেছিল আমি বোধহয় তার সঙ্গে মিথ্যে মিথ্যে খেলা খেলে চলেছি। শ্যামার যখন ভুল ভাঙে ততক্ষণে মাকে নিয়ে শ্মাশনের দিকে পা বাড়িয়েছিলাম মামাদের সাথে নিয়ে।
মামারা দু ভাই-বোনকে ভুলবাড়িয়া নিয়ে চলে গেলেন। মামিদের চোখ টানাটানি, পান থেকে চুন খসার খেসারত দিতে হতো নানা অপমান নিরবে সহ্য করে। বছর দুয়েক পেরোতে শ্যামা যখন পনেরোই পা দিল তখন মামারা তুলাগঞ্জে শ্যামার বিয়ে দিয়ে দিল। শ্যামা মামা বাড়ির ছাড়ার আগে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, তুই আমার মা, তুই আমার বাবারে দাদা। তোকে ছাড়া আমি কোথাও যাব না। কদিন পরপরই আমি যেয়ে তোকে দেখে আসব, এমন মিথ্যে স্বান্তনায় শ্যামা মামা বাড়ি ছাড়ে। শ্যামা চলে যাবার পর আমি ভুলবাড়িয়ার এক মুদি দোকানে কাজ নিলাম তবে শান্তি পাচ্ছিলাম না কিছুতেই। শ্যামা যে আমার কাছে কী ছিল তা ধীরেধীরে টের পেতে শুরু করলাম। নিজেকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবচেয়ে ক্ষুদ্র কীট মনে হতে লাগল। মনের অসুখ শরীরে ছড়িয়ে গেল, শয্যাশায়ী হলাম ধেয়ে আসা ভীষণ জ্বরে, সে জ্বর কবিরাজ, ডাক্তারও ছাড়াতে পারলো না।
একদিন ভরদুপুরে শ্যামা মামা বাড়ি এসে কেঁদেকেটে অস্থির হয়ে গেল, শ্যামার স্বামী ধীরেনটাও সেদিন আমার গায়ে হাত দিয়ে কেঁদে ফেলেছিল প্রায়, কোনমতে নিজেকে সংবরণ করে আমার হাতখানা ধরে বলেছিল, দাদা, চলুন আমাদের বাড়ি। শ্যামার আবদারী আবেদনে ধীরেনের আবদার উপেক্ষা করার মতো মনের জোরও তখন আমার ছিল না। তবে সেই জ্বরই যে আমার জন্য কাল হলো তা বুঝতে আমার সময় লেগেছিল পাকা সাতটা মাস।
সুস্থ হয়ে উঠলেও, ধীরেন আর ধীরেনের মায়ের শক্ত আবেদনে আমাকে শ্যামার শ্বশুর বাড়িতেই থেকে যেতে হয়। শ্যামা-ই যে ধীরেনকে দিয়ে বলিয়েছিল তা বুঝে গিয়েছিলাম শ্যামার চাপা হাসি ভরা মুখখানা দেখে। জ্বরে বিছানায় পড়ে থাকার পুরো সময়টা জুড়েই আমার সেবা-শুশ্রুষা করেছিল শ্যামা আর শ্যামার ছোট ননদিনী অপলা। অপলার নামের স্বার্থকতার জানান দিতে তার জোড়া ভ্রু, সুমিষ্ট বাচনভঙ্গি, অজগরসম চুলের বাহার আর তার হলদে ফর্সা গায়ের রঙই যথেষ্ট ছিল।
অপলা সারাক্ষণই জ্বালিয়ে মারতো। শ্যামা বলতো, অপলাকে এটাসেটা এনে দিস খুশি হবে। শ্যামার কথা রাখতেই রোজ দোকান থেকে ফিরবার সময় তার জন্য দানাদার, লজেন্স কিনেই ফিরত হতো। অপলা হাত পেতে বলতো, কি এনেছ দাও দাও। বাড়ির ছোট মেয়ে হওয়ায় সবাই অপলাকে বেশ স্নেহ করতো, অপলা সেই স্নেহের খাতিরে বড়ো ছোট সকলকেই তুমি সম্বোধনে ডাকতো। আমার বেলাতেও অপলার একই নিয়ম ছিল। কোনদিন ভুল করে কিছু না নিয়ে ফিরলে অপলা মুখ পানসে করে বলতো, কিশোর দা! আজ কিছু আনলে না যে? আমি কানে ধরে বলতাম, এমন ভুল আর হবে না দেখো। তবে ওমন ভুল আমার প্রায়ই হতো। অপলা অভিমান করে বলতো, তুমি এত ভুলোমনা কেন?
আমার কাছ থেকে হাত পেতে লজেন্স নেয়া অপলা সময় গড়াতে কেমন যেন বদলে গেল, অবান্তর কথার ডালাগুলো গুটিয়ে নিল। শ্যামা ঘুমিয়ে পড়লে আমাকে খেতে বসিয়ে নানা পদ পাতে বেড়ে দিয়ে মধুর অত্যাচার চালাতে শুরু করল। একদিন রাতে খেতে বসিয়ে আবদারী গলায় বলল, কিশোর দা, আমাকে লজেন্সের বদলে এক পাতা টিপ আর এক কৌটো আলতা এনে দেবে? মাছের কাঁটা বাছায় মনোযগের সবটা ঢেলে দিয়ে বলেছিলাম, আচ্ছা এনে দেব। অপলা পরমুহূর্তেই বলেছিল, আমাকে লাল টিপে মানায় বেশ নাকি কালোতে?
আমি মাছের কাঁটা ছেড়ে অপলার দু ভ্রুর মাঝে তাকিয়ে বলেছিলাম, তোমাকে লাল টিপে বেশ মানায়, সাথে যদি একখানা লাল শাড়ি থাকে তবে আরও বেশ লাগবে। অপলা আমার পাতে মুড়িঘণ্ট বেড়ে দিতে দিতে আমার মাইনের ওপর একটা ছোট্ট ধ্বস নামিয়ে বলেছিল, একখানা লাল শাড়ি এনে দেবে? দাদাকে বললে দাদা পুচকো বলে নাক সিটকাবে। অপলার আবদার অগ্রাহ্য করার মতো সাহস তখন আমার ছিল না বলেই গ্লাসে জল ঢালতে ঢালতে বলেছিলাম, মাইনে পেলেই কিনে দেব।
মাইনে পাবার দিনই গৌরীপুরের হাট থেকে লাল একখানা তাঁতের শাড়ি আর এক পাতা লাল টিপ কিনে শ্যামার হাতে দিয়ে বলেছিলাম, অপলা বেশ বায়না করেছিল তাই কিনে আনা, ওকে দিয়ে দিস। শ্যামা খানিকক্ষণ শাড়ি উল্টে পালটে আমার দিকে চেয়ে বলেছিল, দেখিস দাদা কোন ঝামেলা যেন না বাঁধে, কেউ যেন কিছু না মনে করে। আমি অপ্রস্তুত হয়ে ঈষৎ হেসে বলেছিলাম, ঐটুকুন একটা মেয়েকে নিয়ে কে কী ভাববে! শ্যামা সেদিন আমার চোখে চোখ রেখে বলেছিল, মেয়ে মানুষের বুকে বাড়তি কাপড় উঠলেই সে নারী হয়ে ওঠে, আর অপলা ঐটুকুন মেয়ে নয়। আমি সেদিন কিছু বলতে পারিনি কিছুটা লজ্জায় আর খানিকটা দ্বিধায়।
নিজেকে সেদিন প্রশ্ন করেছিলাম, আসলেই কি অপলা নারী হয়ে উঠেছে? আসলেই কি সে আর ঐটুকুন নেই? সেদিন উত্তর পাইনি, উত্তর পেয়েছিলাম চৈত্রের কোন এক দুপুরে। দোকান হতে দুপুরে খেতে বাড়ি ফিরে কাজের লোকটার কাছে শুনি বাড়িসুদ্ধ লোক মরা দেখতে গিয়েছে। সেদিন অপলা একলাই বাড়ি ছিল। ভাত বেড়ে দেবার জন্য অপলাকে খুঁজতে খুঁজতে ওর ঘরে গিয়ে দেখি ও টানটান হয়ে শুয়ে আছে, চৈত্রের ভ্যাপসা গরমে অপলার কামিজের খানিকটা নাভির উপরে উঠে গেছে। একমুহূর্তের জন্য সেদিন কেমন যেন এক অদ্ভুত অনূভুতি কাজ করেছিল, যে অনুভূতি সেদিনের আগে মাথা তুলে দাঁড়ায়নি একটিবারের জন্যও। তৎক্ষনাৎ বাইরে বেরিয়ে এসে দরজায় টোকা দিয়ে নেশাতুর গলায় অপলাকে ডেকে তুলেছিলাম।
শ্যামার চোখে দেখা নারী অপলাকে সেদিনের পর থেকে আমার কাছেও নারী অপলা ঠেকতে লাগলো। তবে সেটা ছিল একবারে প্রচ্ছন্নে, হাবভাব, কথার ছলে অপলাকে সারাক্ষণই বুঝিয়ে দিতে চাইতাম সে যে আমার কাছে কিশোরী অপলা হয়েই রয়েছে।
একদিন রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম আমার ভেতরের পৌরুষটা কেবল নারী অপলাকে কাছে চায় নাকি কিশোরী অপলাকে। ভেতরের পৌরুষ ভণিতা না করেই সেদিন বলেছিল, পুষ্প সুন্দর বলেই হাতে নিতে হয়, তারপরেই না দম ভরে তার ঘ্রাণটুকু শুষে নিতে হয়। ভেতরে পৌরুষের দেয়া উত্তরখানা আমার কাছে সস্তা কোন দর্শন মনে হয়েছিল কেবল। আমি নিজেকে পরখ করে নেবার জায়গা খুঁজছিলাম তখন। সুযোগ আমার সামনে এসেই ধরা দিয়েছিল দিন দুয়েক পেরোতেই। দোকানের মহাজনের সাথে গিয়েছিলাম দক্ষিণের এক জলসায়, জলসা শেষে যে যার মতো মেয়ে মানুষ নিতে ফুর্তিতে মেতে ছিল, এমনকি আমার চল্লিশোর্ধ্ব মহাজনও বাদ যায়নি। সে রাতে জলসার কয়েকজন মেয়ে আমার হাত ধরে টানলেও আমার নিজের প্রতি ঘৃণা হচ্ছিল, ওদের দিকে তাকাতেও বাধছিল। পরদিন সকালে বাড়ি ফেরার সময় বুঝতে পারলাম নারী অপলা সেদিন কেবল আমার ভেতরে থাকা কিশোরী অপলার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল, যার খোঁজ আমি সেদিনকার ভর দুপুরে পেয়েছিলাম।
নিজের মনকে বুঝ দিয়েছিলাম, অপলাকে জড়িয়ে কোন ঝামেলা পাকলেই আমার বোনের সংসার ভাঙবে, আমার মুখে লোকে থুতু ছেটাবে। কাজেই নিজেকে আবার গুটিয়ে নিয়েছিলাম, সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ও বাড়ি আর থাকবো না। হ্যাঁ বাড়ি ছেড়েছিলাম ঠিকই তবে সেটা অপমানিত হয়ে, নিজেকে খাটো করে আর বুকের কোথাও অপলার জন্য এক সমুদ্দুর সমান ভালোবাসা নিয়ে।
আমি যখন বাড়ি ছাড়ার সুযোগ খুঁজছিলাম তখন এক বিকেলে অপলা আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, কিশোর দা, আপনার মহাজনের মেয়ে আমার সাথেই একই ক্লাস পড়ে আপনি জানেন? আমার উত্তরের আশা না করে অপলা পাগলা ভীমরুলের মতো আমার মুখের সামনে মুখ এগিয়ে এনে বলেছিল, শুনলাম আপনি আপনার মহাজনকে বলেছেন আপনার জন্য ভাড়া বাড়ি খুঁজে দিতে? এমনটা ভুলেও করবেন না। এমনটা করলে সোজা আপনার ভাড়া বাড়ি যেয়ে উঠব, সেটা কি ভালো দেখাবে? চোর ধরা পড়লে যেমনি পালাবার পথ খোঁজে আমিও তেমনি পালাবার পথ খুঁজতে খুঁজতে বলেছিলাম, আমাকে যেতেই হবে অপলা। আমার যাওয়া ছাড়া কোন পথ নেই।
অপলা খপ করে আমার হাত ধরে বলেছিল, মৈত্র বাড়ির মেয়ে হয়ে জন্মেও কোনদিন নিজের ভাতটা বেড়ে খায়নি তবুও তোমার জন্য চোখে পানি দিয়ে জেগে রইতাম কেবল তোমাকে ভাত বেড়ে খাওয়াবো বলে, মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে এক মাসের লজেন্স একদিনেই কিনে আনতে পারতাম তবুও কেন হাত পেতে তোমার কাছে চাইতাম? কেন চাইতাম এক পাতা লাল টিপ আর একখানা শাড়ি? উত্তর দিতে পারবে? লজেন্স দেবার ছলে তুমি যাতে একটুখানি ছুঁয়ে দেও, রাতে ফেরার পর তোমার ক্লান্ত মুখখানা দেখে যেন দুটো চোখ আনন্দে এক করতে পারি, শুধু এটুকুর জন্যই। এই এটুকুনের ভার মেলা, আর সেই ভার টের পেয়ে আজ তুমি পালাচ্ছ কেবল বোনের কথা ভেবে? আমার কথা, তোমার নিজের কথা একটিবারও ভাবলেন না? ভেতরে থাকা নরম মানুষটা সেদিন যুক্তি তর্ককে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অপলার হাতখানা ঝাঁকিয়ে বলেছিল, তবে কী করবো এখন? অপলা ঈষৎ হেসে বলেছিল, মা আমার কথা ফেলবেন না, দাদাও নয়। দাদা বাড়ি ফিরলেই মাকে দিয়ে সবটা বলাবো তবুও পালিয়ে যেও না।
বিপদে পড়া খরগোশ চোখ বুজেই ভাবে এই বুঝি বিপদ কেটে গেল, এই বুঝি সে বেঁচে গেল। অপলা আমার চোখ বেঁধে দিয়ে ভাবিয়েছিল আমাকে হয়তো পালিয়ে বাঁচতে হবে না। শিশুর ন্যায় অযৌক্তিক ওমন সমীকরণে পা বাড়াতেই আমার পা তপ্ত আগুনের আঁচে ফসকে গিয়েছিল সেদিন রাতেই । ধীরেন সেদিন বাড়ি ফিরে শ্যামার সাথে তুলকালাম বাধিয়েছিল। ধীরেন রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে চেচিয়ে বলেছিল, তোর ভাইয়ের এত বড়ো সাহস কোত্থেকে হয়? মৈত্র বাড়ির ছেলেরা ছোটলোকের মেয়ে ঘরে আনলেও মৈত্র বাড়ির মেয়েদের ছোটলোকের ঘরে দেই না আমরা এ কথা তোর অকৃতজ্ঞ ভাইকে মনে করিয়ে দিলি না কেন? এক্ষুনি আমার বাড়ি ছেড়ে ভাই নিয়ে বিদেয় , যা বেরো বলছি। শ্যামা বারবার ধীরেনকে বলছিল, তোমার পায়ে ধরি, শান্ত হও, দাদা শুনবে। ধীরেন আরো জোরে গলা ছেড়ে বলেছিল, খাইয়ে পরিয়ে কালসাপ পুষছি, এ কথা মা আমাকে বারবার বললেও আমি কানে নেইনি, তোর ভাইকে ভরসা করেছিলাম।
আমি সেদিন আলগোছে শ্যামাদের ওখান থেকে বেরিয়ে আসি, মহাজনকেও কিছু জানায়নি। আমার মা, বাপ মরা বোনটিকে আমার জন্য একবিন্দু কষ্ট দেবার সাহস করিনি সেদিন আর।এরপর মাস তিনেক এখানে সেখানে ঘুরে ফিরে গিয়েছিলাম জমিদারের সেই পরিত্যক্ত বাড়িতে। ভেবেছিলাম ওখানে কোনরকম মাথা গুঁজে থেকে যেতে পারব। ওখানে গিয়ে দেখি কারা যেন বাড়িটার দখল নিয়েছে।
কাউকে চেয়ে তাকে পাবার পর হুট করে কোন ঝড়ে হারিয়ে ফেলে তাকে বুকের ভেতর সযত্নে পোষাটা যে কতটা যন্ত্রণার, কতটা অসহায়ত্বের তা আজকাল বেশ টের পাই। নিজের বোনটার জন্যও আজকাল খুব মায়া হয়, করুণা হয়, চোখের কোণটা ভিজে ওঠে। আমি দুটো মানুষকে হারালেও সে একসাথে হারালো তার দাদাকে, বাবাকে আর মাকে। ওর বুকের ভেতরটা আমৃত্যু ভারী হয়ে থাকবে এটা ভাবতেই এক পাহাড়সম অপরাধবোধ আমাকে জেঁকে বসে।