অরুণা

অরুণা

– `এরকম বিভৎস চেহারার মেয়েকে কোনো ভালো ঘরের ছেলে তো দূরে থাক কোনো মুচিও বিয়ে করতে চাইবে না’
বলেই হনহন করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো ছেলেপক্ষ।

অরুণাকে আজ সপ্তম বারের মতো ছেলেপক্ষ দেখতে এলো। বরাবরের মতই দেখতে এসে তাকে পছন্দ না করেই বাড়ি ত্যাগ করলো ছেলেপক্ষ।যদিও অরুণার বাবার জানা ছিলো যে তার মেয়েকে কারও পছন্দ হবে না,তবুও সে একবুক আশা নিয়ে ছেলেপক্ষ কে আসতে বলতো।অরুণা এবার অনার্স শেষ করেছে।বাবার অগাধ টাকা থাকায় তাকে আর চাকরি খুঁজতে হয়নি।তাই অনার্স এর পরের শেষের সময়টা বাড়িতেই কাটিয়ে দিচ্ছিলো আর এদিকে বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছিলো বিধায় অরুণার জন্য ছেলে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু ভাগ্য অরুণার সহায় ছিলো না বিধায় তাকে আজ এক অভিশাপ বয়ে নিয়ে বেড়াতে হচ্ছে।অবশ্য দোষটা ভাগ্যের নয়,অরুণারই!

৫ মাস আগের কথা এলাকার নামকরা সুন্দরী ছিলো অরুণা। তার নামের যেমন মাধুর্য ছিলো তেমনি তার রুপের মাধুর্য ছিলো প্রখর,সাথে তার দাম্ভিকতাও।অরুণার নিজের রুপের প্রশংসায় নিজেই বিভোর থাকতো।সব মানুষের মধ্যে যেমন কিছু ভালো স্বভাব উল্লেখযোগ্য তেমনি কিছু খারাপ স্বভাব ও পরিলক্ষিত থাকে।কিন্তু অরুণার ক্ষেত্রে ছিলো উল্টোটা।তার খারাপ স্বভাব গুলোই যেন পরিলক্ষিত হতো সবসময়।এলাকার মানুষজন যেমন তার রুপের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলো অন্যদিকে তার খারপ কাজের বর্ণনায় মুখে ফেনা তুলে ফেলতে দেখা যেতো। অরুণার বাজে স্বভাব গুলোর মধ্যে তার অন্যতম বাজে স্বভাব ছিলো সে কোনো দরিদ্র, অসহায় বা বিপর্যস্ত মানুষকে সহ্য করতে পারতোনা।এরকম অসহায় প্রকৃতির মানুষদের দেখলে তার কেমন গা ঘিনঘিনিয়ে উঠতো।

অরুণার বাবার অগাধ টাকা থাকায় তাদের বাড়িতে ৪/৫ জন কাজের লোক ছিলো। কাজের লোকদের মধ্যে একজনের মা অসুস্থ থাকায় সে চাকরি ছেড়ে দিয়ে যাওয়ার সময় তার পরিবর্তে অন্যএকজন কে দিয়ে যায়।মেয়টার নাম ছিলো কবরী। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে অরুণা তাদের বাগানে হাঁটতে যেতো। কবরী সেদিন বাগানেই কাজ করছিলো ।কবরীকে দেখেই সে বাবার কাছে যেয়ে বলতে লাগলো -`এমন কুৎসিত চেহারার মেয়েকে কাজের লোক হিসেবে রেখেছো কেনো বাবা!ওই জন্তুটাকে বাড়ি থেকে বের করে দাও।ওটাকে দেখলে কারও কাজ তো দূরে থাক,খাওয়া ঘুম ও হারাম হয়ে যাবে।’

কবরী পিছনে দাঁড়িয়ে সব শুনছিলো এতক্ষণ। কবরীকে কুৎসিত বলার কারণ হলো সে ছিলো এসিড দগ্ধ। এসিড দগ্ধ হওয়ার কারণে তার চেহারাটা হয়তো বিকৃত রুপ ধারণ করেছে কিন্তু তাকে জন্তু বলার কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছে না সে।অপমানে,লজ্জায় মাথাকাটা যাচ্ছে তার।এরকমটা সে আশা করেনি।সেও চেয়েছিলো অন্য সবার মতো সুস্থ সুন্দর জীবন।ভাগ্যের নিষ্ঠুর খেলায় হেরে গিয়ে তাকে বিভৎস জীবন কাটাতে হচ্ছে।এক মাস যাবত কবরী অরুণাদের বাসায় কাজ করছে।

এই একমাসের ভিতর অরুণাকে একবারো দেখেনি সে।অন্যান্য চাকরদের কাছে অরুণার রুপের প্রশংসা শুনেছে কিন্তু তার নিষ্ঠুর ব্যবহার সম্পর্কে শুনেনি।যার ফলে কবরীর ধারণা হয়ে গিয়েছিলো অরুণার রুপের সাথে তার ব্যবহার এর ও বাহার রয়েছে।আজ একমাস পর অরুণার রুপ দেখে যতটাই না মুগ্ধ হয়েছে তার থেকে ব্যবহার দেখে অরুণার উপর ততটাই ঘৃণা জন্মেছে।এসব কথা শুনতে পেয়ে কবরী তার থাকার ঘরে যেয়ে ব্যাগপত্র নিয়ে বেরিয়ে গেলো এমনকি তার একমাসের বেতনটাও নেয়নি।যাওয়ার সময় অরুণাকে বলে গেলো -`আমি এই অফমানের শোধ নিবার পারি নাই তয় কি অইছে,উপরে একজন আছে হেই এর শোধ নিবো।আমার খোদা এই অফমান সইহ্য করবো না।আফনের কপালে দুঃখ আছে মনে রাইখেন। ‘ বলেই সে চলে গেলো। অরুণা কেবল তার যাওয়ার দিকেই চেয়ে রইলো তার কথা গুলোতে অরুণার মনে ভাবান্তর হলো না।

দুমাস পেরিয়ে গেলো। অরুণা একদিন বাজার থেকে বাড়ি ফিরছলো।বৃষ্টি থাকায় সে রাস্তার পাশে একটা হোটেলের ছাউনি তে দাঁড়িয়ে ছিলো। ছাতা নিতে ভুলে যাওয়ায় তার এই ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।অরুণা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো তার একটু সামনেই চুলায় পানি গরম হচ্ছিলো। এর মধ্যে একটি গাড়ি বেগ হারিয়ে সোজা হোটেলের দিক চলে আসে।সেই গাড়ির ধাক্কা লেগে চুলার উপর পাতিলটা যেয়ে অরুণার গায়ের উপর পড়ে এবং পাতিলের পানি অরুণার সারা গায়ে ছিটকে পড়ে।অরুণা হারলো জ্ঞান হারলো এবং জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে হাসপাতালের বেডে আবিষ্কার করলো। অরুণা কিছুই মনে করতে পারলো না। তার বেডের পাশে তার বাবা-মা কাঁদছে।কি হয়েছে জানতে চাওয়ায় অরুণার বাবা-মা নার্সকে বলে একটি আয়না অরুণার হাতে ধরিয়ে দিলো।

আয়নায় যা দেখলো তা দেখার জন্য অরুণা মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। সে আয়নায় তার ঝলসানো চেহারা দেখতে পেলো।তখন পাতিলের পানি পড়ে তার চেহারা ঝলসে গিয়ে বিকৃত রুপ ধারণ করেছে।দেখার পর অরুণা মূর্তির মতো স্থির হয়ে গিয়েছিলো। তার হৃদস্পন্দন ও যেন থেমে গিয়েছে।মূহুর্তেই অরুণার দাম্ভিকতা যেন মাটিতে মিশে গেলো,সাথে কবরীর কথা গুলো যেন মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকলো। হাসপাতাল থেকে রিলিজ হয়ে বাসায় আসার পর অরুণা বের হতো না।বের হলেও দেখা যেত কেও তার সামনে আসছে না।আঁড়াল থেকেই দেখছে।এলাকার মানুষ গুলোর কাছে সে কেমন অবহেলিত হতে শুরু করলো। সে বুঝতে পারলো তার রুপের জন্যই সকলের কাছে প্রশংসার পাত্র ছিলো, অথচ তার ব্যবহার ভালো থাকলে আজ অবহেলার শিকার হতো না।এদিকে অরুণার বাবাও ছেলে দেখতে থাকলো।কোনো ছেলেই তাকে পছন্দ করছে না।

অরুণার বাবার ডাকে বাস্তবে ফিরে এলো সে।পাঁচ মাস আগের কথাই ভাবছিলো এতক্ষণ সে।সেদিন এর পর থেকে অরুণার জন্য কোনো ছেলে দেখা হয়নি।অরুণা নিজেই মানা করেছিলো তার বাবাকে।অরুণা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলো তার মতই অবহেলিত,অবাঞ্চিত মেয়েদের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখবে।এরপরই অরুণা এলাকা ছেড়ে চলে গিয়েছিলো, সেই যে গিয়েছিলো তাকে আর ফিরতে দেখা যায় নি।অরুণার বাবা-মা ও জানত না তার মেয়ে কোথায় গিয়েছিলো।ঠিক কয়েক বছর পর অরুণা তার বাবা-মা কে ফোন দিয়ে জানায় সে একটি আশ্রমে প্রধান সহকারীর দায়িত্বে আছে।আশ্রম টিতে ছিলো হাজার এর উপরে অবহেলিত এবং দগ্ধ নারী।অরুণা এরপর তার বাবা-মা এর সাথে রাতের আঁধারে এসে দেখা করে যেত এবং দিনের আলো ফোঁটার আগেই সে বেরিয়ে যেত তার নতুন ঠিকানায়।বাকি জীবনটা সে আশ্রমের নারীদের সেবায় কাটিয়ে দেয়।।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত