ফোর সিজন্স রেষ্টুরেন্টের কোনের টেবিলটায় আমরা বসেছি । আমরা বলতে আমি, আমার স্ত্রী লুনা , ছোটবোন তিতলী আর মিসেস হাসান । আমরা আগে থেকে মিসেস হাসানের সাথে পরিচিত না । পরিচয় পর্ব সারতে দেরী হলোনা । মিসেস হাসান নিজ থেকে পরিচিত হলেন । আমাদের এখানে আসার পেছনে একটা উদ্দেশ্য আছে । খবরের কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দেখে মিসেস হাসানের দেয়া ফোন নাম্বারে যোগাযোগ করে আজ আমরা দেখা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি । ভদ্রতার খাতিরে হোক বা নিয়মের খাতিরে হোক মিসেস হাসানের উদ্দেশ্যে বললাম – কি খাবেন বলেন । অর্ডার করে আমরা কথা শুরু করি ।
– আজকের বিলটা আমি দেয়ার অনুমতি চাইছি ।
– আজ আমি খাওয়াবো । ভাগ্যে থাকলে পরেরদিন আপনি ।
– হা হা হা । তবে তাই হোক ।
খাবারের অর্ডার দিয়ে কিছুক্ষণ নিরবতার পর আমিই শুরু করি – হুম । আমরা আপনার বিজ্ঞাপনে কিছুটা ধারণা করতে পেরেছি । বাকিটা আপনি বলুন ।
– সম্পর্কে ও আমার আপন ননদ । বিয়ের দশ বছর পর ওর স্বামী মারা যায় । অনেক চেষ্টা তদবীরেও ওদের কোন সন্তান হয়নি । এ নিয়ে ওর স্বামীর কোন আক্ষেপও ছিলোনা । খুব ভালোবাসতো নীনাকে । নীনা কোন কষ্ট পায় এমন কথাও ওর স্বামী কোনদিন বলেছে বলে শুনিনি । দুম করে হার্ট এ্যাটাক হয়ে হাসপাতালে নেয়ার পথেই জাহিদ মারা যায় । নীনার বয়স তখন বড়জোড় বত্রিশ ! শ্বশুরকুলের কেউ অল্প বয়সি সুন্দরী বউ ঘরে রাখতে রাজী হলোনা ।
– তারপর ?
– আমি তখন ছোট ছোট দুই বাচ্চা , সংসার আর চাকরী নিয়ে হিমসিম খাচ্ছিলাম । ভেবে দেখলাম নীনার মতো আপন কেউ থাকলে আমি নিশ্চিন্তে বাচ্চা, সংসারের দায়িত্ব ওর হাতে তুলে দিয়ে চাকরী সামলাতে পারি । আমারও উপকার হলো আবার নীনারও নিরাপদ একটা আশ্রয় হলো ।
– তারপর ?
দম নিয়ে মিসেস হাসান শুরু করলেন – সংসার সন্তান নীনার হাতে ছেড়ে দিয়ে আমার চাকরী জীবন শেষ করলাম । ছেলেমেয়েরাও বড় হলো । মেয়ের বিয়ে দিলাম । এবারতো ছেলে বিয়ে দিতে হবে তাইনা ?
– বুঝলামনা ! ছেলের বিয়ের সাথে নীনা আন্টির সম্পর্ক কি ?
– তা যা বলেছো ! সম্পর্ক না থাকলে কি আর এই সিদ্ধান্ত নেই ?
– জ্বী ওটাই জানতে চাইছি ।
– নীনার বয়স এখন পঞ্চান্ন পেরিয়ে গেছে । আগের মতো এক হাতে সংসার সামাল দিতে পারেনা । বাড়তি টাকা দিয়ে এই আকালের বাজারে একজন ছুটা বুয়া রাখতে হয় । তাছাড়া নীনাও আজকাল নানা অসুখ বিসুখে ভোগে । ডাক্তার ঔষধ খরচাওতো কম না ? তাই এই সিদ্ধান্তে আসা ।
– আপনাদের সিদ্ধান্তের কথা নীনা আন্টি জানেন ?
– আদৌ ওকে জানানোর প্রয়োজন আছে কি ? ওর ভার টানার মতো অবস্থা আমাদের নেই । বিয়ে দিয়ে একটা গতি করতে পারলে ভালো । নয়তো গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিবো ।
কাল বিকেলে আমরা মিসেস হাসানের বাসায় যাবো কথা দিয়ে এসেছি । মা মারা গেছেন চার বছর আগে । মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে আমরা দুই ভাইবোন পৃথিবীর দুই প্রান্ত থেকে ছুটে এসেছিলাম । মায়ের মৃত্যুর পর এই প্রথম দেশে এলাম । বাবাকে আমাদের কাছে নেয়ার বিফল চেষ্টা করেছি এই চার বছর । মায়ের স্মৃতি আকড়ে বাবা পরে আছেন এই চার বছর । মায়ের স্মৃতি ফেলে বাবা কোথাও যাবেননা এই সিদ্ধান্তে তিনি অটল।
বাচ্চাদের পড়া, নিজেদের চাকরীর অজুহাতে আমরা একবারও বাবাকে দেখতে আসার সুযোগ পাইনি বা চেষ্টা করিনি । দুইমাস আগে তিতলী জানালো ও দেশে আসছে । আমিও কেমন একটা তাগিদ অনুভব করলাম বাবাকে দেখার । তিতলী আসার পরের সপ্তাহে বউ নিয়ে আমিও এলাম । মাকে নিয়ে বাবা যে ঘরটায় থাকতেন ওটায় ঢুকেই আমি চমকে উঠি ।
কে বলেছে মা নেই ? বাবার বালিশের পাশে মায়ের বালিশ দুটো আজো আগের মতোই আছে । আলনায় পরিপাটি করে সাজানো মায়ের শাড়ি । জুতো জোড়াও আগের জায়গায় । ড্রেসিং টেবিলে সাজানো মায়ের শখের চুড়ি , আয়নার এককোনে মায়ের কপালে দেয়া শেষ টিপটাও । টিপের আঠা শুকিয়ে গেলে বাবাই হয়তো আঠা লাগিয়ে জায়গামতো আটকে রাখেন । চিরুনী, লিপষ্টিক , পাউডারের কৌটোও আগের মতোই । মায়ের সাদা ধবধবে কার্ডিগানটাও হ্যাঙ্গারে আগের জায়গায় ঝুলানো । একটুও ময়লা লেগে নেই ।
কিন্তু বাড়ির কোথাও মায়ের রিনরিনে গলার শব্দ নেই ! আমার নেহাল এসেছে তিতলী এসেছে বলে উচ্ছাস করার কেউ নেই ! বাবা একা ! খুব একা ! পয়ষট্টি বছরের আমার বাবা মায়ের সব স্মৃতি যক্ষের ধনের মতো আগলে রেখেছেন। অথচ বাবাকে আগলে রাখার কেউ নেই ! মায়ের মৃত্যুর পর বিধবা বড় ফুপু কিছুদিন বাবার কাছে ছিলেন । সংসার সন্তানের প্রয়োজনে তিনি চলে গেছেন । হাত পুড়িয়ে নিজ হাতে বাবাই রান্না করে খান । বুয়া রাখলে পাছে লোকে কিছু বলে তাই ওই পথ মাড়াননি ।
হাবীব নামের সতের আঠারো বছরের ছেলেটা এমন একটা কান্ড না ঘটালে নিশ্চিত থাকা যেতো । সেই এক বছরের বেশি বাবার রান্না বান্নাসহ সব দেখাশোনা করতো । বাবার বিস্বাসের চরম অবমূল্যায়ন করে ঘুমে থাকা বাবার বালিশের তলা থেকে আলমিরার চাবি বের করে বাবার সঞ্চিত টাকা নিয়ে একদিন পালিয়ে গেলো । সেই থেকে বাবা বিস্বাস অবিস্বাসের দোলাচলে আর কাউকে নিজের কাছে রাখেননি । বাবা চলছেন একা একাই এই তিনটি বছর । রোগে শোকেও বাবার পাশে কেউ নেই !
এবার দেশে আসার আগে আমরা ঠিক করে এসেছি বাবাকে আর একা থাকতে দিবোনা । সঙ্গীহীন বাবাকে একা রেখে যাওনা ঠিক না । বাবাকে কিছুই জানানো হয়নি । আজ আমাদের মিসেস হাসানের বাসায় যাওয়ার কথা । সকাল থেকেই উসখুস করছি বাবাকে কেমন করে জানানো যায় । জানলে বাবা যেতে রাজী হবেন কিনা তাও সন্দেহ । বলি বলি করেও আর বলা হলোনা। মায়ের বাগানে বাবাকে পানি দিতে দেখা যাচ্ছে । তিতলী বাবার পাশে দাড়িয়ে আলতো করে পিঠে হাত বুলিয়ে বলে – চলো বাবা সবাই মিলে ঘুরে আসি তোমার ভালো লাগবে ।
– তা ঠিক বলেছিস । তোরা তৈরী হ , আমি বাকি গাছগুলোয় পানি দিয়ে আসছি । তা কই যাবি ঠিক করলি ?
– আমার পরিচিত এক আন্টির বাসায় । আমরা মিসেস হাসানের সুসজ্জিত বিশাল ড্রইংরুমে বসা । কারো মুখে রা নেই । কিছুক্ষণ পর মিসেস হাসান এলেন।
– মিঃ নেহাল , ইনি আপনার বাবা ?
– জ্বী ।
– আপনাদের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাতেই হয় । এই বয়সি একজন মানুষ একা থাকা রিক্স । কখন কি হয়ে যায় বলাতো যায়না ? আপনজন কেউ পাশে থাকা দরকার । বাবা এবার নড়েচড়ে বসেন – সরি আপনি কি বলছেন বুঝলামনা ।
– মিঃ নেহাল আপনার বাবা কিছু জানেননা ?
– জ্বীনা আন্টি বাবাকে কিছু বলা হয়নি ।
– তবে ?
– আন্টি একটা সময়ে বাবারা যেমন সন্তানের ভালো চান, আরেকটা বয়সে সন্তানও বাবার ভালো চাইতে পারে । ব্যাপারটা এমনই দাড়িয়েছে ।
– তিনি যদি অমত করেন ?
– তা কেন করবেন ? বাবার কোন সিদ্ধান্তে আমরা অমত করিনি তো ?
বাবা ফ্যালফ্যাল করে আমাদের দিকে তাঁকান । আটপৌড়ে একপ্যাচে সুতি শাড়ি পড়া ঘোমটা দেয়া যে মানুষটা এইমাত্র এলেন তার দিক থেকে চোখ ফেরানো দায় । ঘোমটার ফাঁকে উকি দেয়া কাচাপাকা চুলে তাকে প্রথম দেখায় আমার মা বলে ডাকতে ইচ্ছে হলো । চোখ মুখে মমতা আর কোমলতায় জ্বলজ্বলে । তিতলী তার পাশে বসে তার হাত দুটো কোলে নিয়ে বলে – অমত করোনা বাবা ! এই মানুষটারও একজন বিস্বস্ত সঙ্গীর প্রয়োজন যেমনি তোমারও । বাবার মুখে কথা নেই । টুপটুপ করে সাদা দাড়ি বেয়ে জল গড়িয়ে পরছে । আমি বাবার হাত ধরে মিনতি করে বলি – অমত করোনা বাবা । তোমাকে একা রেখে যেতে আমাদের খুব ভয় হয় বাবা।
– তাই বলে তোদের মায়ের জায়গায়…..
– আর কথা বাড়িওনা বাবা । মায়ের বালিশের পাশে আরো দুটো বালিশ জোড়া লাগলো নাহয় !
মিসেস হাসানের মনোভাব আমরা আগেই বুঝে গেছি । ছাই ফেলতে ভাঙা কুলোর তার আর প্রয়োজন নেই । নতুন মাকে নিয়ে আমরা রাতেই চলে এসেছি । কাজি ডেকে বিয়ে পড়াতে যতোটুকু সময় লাগে তারচে বেশি দেরী করিনি ।
বাবা বারান্দর ইজি চেয়ারে চুপচুপ বসে আছেন । মায়ের জন্য হয়তো একা বসে কাঁদছেন । ছেলেমেয়েরা তাকে এমন কাজে বাধ্য করবেন তা হয়তো স্বপ্নেও ভাবেননি । ঘোরের মধ্যে বসে আছেন বাবা । তিতলী আর আমার বউকে সাথে নিয়ে বাবার সামনে দাড়াই – ভুল বলো আর ঠিক বলো সব আমরা করেছি বাবা । নীনা আন্টির এতে কোন হাত নেই । তোমাদের দুজনেরই সঙ্গীর প্রয়োজন ছিলো । আমরা তা করে দিয়েছি । যাও ঘরে গিয়ে নীনা আন্টির সাথে কথা বলো তোমার ভালো লাগবে ।
– তাই বলে এই বয়সে তোরা এমন কাজটা করবি ?
– কথা বাড়িওনা বাবা যাও ঘরে যাও । নতুন পরিবেশে মানুষটা একা রয়েছে ।
বাবাকে নিয়ে আমরা নীনা আন্টির কাছে গেলাম – আমরা কি আজ থেকে আপনাকে মা ডাকতে পারি ? নীনা আন্টি খাট থেকে নেমে এলেন – পেটে না ধরলে মা হওয়া যায়না বাবা ? দশ বছর সাধনা করেও একটি সন্তানের মা হতে পারিনি ! আর দেখো এক নিমিষেই আল্লাহ্পাক তোমাদের মতো সন্তান আমাকে উপহার দিলেন ? কোন পূন্যের ফল এটা জানিনা বাবা !
– মাগো আমার বাবাটাকে তুমি দেখে রেখো এরচে বেশি কিছু চাইনা ।
আমরা তিন মাসের ছুটিতে এসেছিলাম । ছুটি প্রায় শেষের দিকে । বাবা মাকে দিয়ে হানিমুন করাতে চেয়েছিলাম । তারা হানিমুনে যেতে রাজী হয়েছিলেন, তবে শর্ত সাপেক্ষে । শর্ত পালন করে সবাই মিলে কক্সবাজারে বাবার হানিমুন পর্ব শেষ করে এসেছি । সাতদিন পর আমরা ফিরে যাবো আমাদের গন্তব্যে । আমার মা খুব ব্যাস্ত । তার নাতি নাতনিরা কে কি পছন্দ করে সব তৈরী করে নিপুন হাতে প্যাকেট করছেন । এর মধ্যেই আমাদের পছন্দ জানা হয়ে গেছে । বাবাকে দিয়ে বাজার করিয়ে রান্না করে পাশে বসে খাওয়াচ্ছেন । যেনো কতো জনম জনমের বন্ধন আমাদের ।
– এই তিতলী বউমার পাতে মাছের পেটিটা তুলে দেতো মা । তুইতো আবার পিঠের টুকরো পছন্দ করিস । এই নেহাল মাশকলাইর ডালটা কেমন হয়েছে বললি নাতো ।
– আরে মা ! বাবার দিকেও নজর দাও !
– দেখছিসনা তোদের বাবা কেমন হা করে তোদের খাওয়া দেখছে ? সেই কখন একটুকরো মুরগী নিয়ে এখনও বসে আছে ।
– তুমিও বসে যাও মা । সবাই একসাথে খেয়ে উঠি ।
– নারেহ্ আমি পরে খেয়ে নিবো । তোদের আগে খাইয়ে নেই । আমি আবার দুই কাজ একসাথে পারিনা । তালগোল পাকিয়ে যায়। পরে দেখা যাবে তোরা একটা খেয়েছিস অন্যটা খাসনি !
আহা কতো বছর পর মায়ের আদর উপভোগ করছি ! এমন করেই মা পাশে বসে আমাদের খাইয়ে পরে নিজে খেতেন । মাও নাকি এই দুইকাজ একসাথে পারতেননা । পরের সপ্তাহে চোখের জলে নাকের জলে মা আমাদের বিদেয় দিলেন । যাবার বেলায় বারবার মনে করিয়ে দিলেন – বছর বছর না এলে তোদের বাবাকে জ্বালিয়ে মারবো মনে রাখিস ।