পরিবর্তন

পরিবর্তন

মেলাদিন হইলো বাপের বাড়ি যাইনা, তুমি যদি একটু আমারে আর সজলরে রাইখা আসতা। বাবারে অনেক দেখতে ইচ্ছে করছে।’ রাশেদা কথাটা বলেই হাশেমের দিকে তাকায়। হাশেম তখন পাটিতে বসে প্লেট থেকে বড় বড় করে ভাতের লোকমা গিলছে। রাশেদা আবার বলল….

–আইজকা কি নিয়া যাইবা? হাশেম ভাত ভর্তি প্লেটে পানি ঢেলে হাত ধুতে ধুতে বলল….

-প্রতিদিন বাপের বাড়ি বাপের বাড়ি বলে চিল্লাবি না। ভাল্লাগেনা তোর এই প্যাঁচাল, আর তোর বাপে তো আর মরে নাই।

–এমনে কও কেন?
-বলছিনা প্যাঁচাল পারবিনা, ঘরে বসে থাক।
–এমন করো কেন? মেলাদিন হইলো বাপেরে দেহিনা।
-এক্কেবারে মরা মুখ দেহিস। আজাইরা প্যাঁচাল সবসময়…

কথাটা বলেই আলনা থেকে ঝারা দিয়ে গামছাটা কাঁধে নেয় হাশেম। রাশেদা হাশেমের দিকে তাকিয়ে আছে। কতদিন হলো মানুষ টা তারসাথে ভালো করে কথা বলেনা। একটু খেয়াল করেনা। রাশেদার কষ্ট হয়, প্রকাশ করেনা। আড়াল করেই রাখে। হাশেম দরজার বাইরে পা রাখতেই রাশেদা বলল….

–সজলরে একটা সাইকেল কিনে দিলেই পারো, পোলাডা কত করে চায়।
-তোর বাপরে ক সাইকেল কিনে দিতে।
–ছেলে মানুষ, কতদিন ধরেই তো চায়। পাশের বাড়ির রবিন ভাইর ছেলের সাইকেলে দিকে চাইয়া থাহে খালি সেই খেয়াল করোনা?

-সকাল সকাল কিসব বলিস মাথা গরম করিস না। ঘরের মহিলা ঘরে থাক। আর পোলার জন্য এত দরদ হলে নিজে কামাই করে সাইকেল কিনে দে বলেই হনহন করে চলে যায় হাশেম। রাশেদা সেই দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। অভিমানে চোখের কোনে এক ফোটা অশ্রু জমা হয় রাশেদার। সজল এসে জিজ্ঞেস করে….

–মা আইজকা আব্বা সাইকেল কিনে আনবনা?
-হরে বাবা আনবো।
–তুমিতো প্রতিদিনই কও, কই আনেনাতো?
-কাজের মেলা চাপ থাকে বাবা, আইজকা আনব। যাও খেলতে যাও সজল চলে যায়। বাচ্চা ছেলে মা যা বোঝায় তাই বোঝে। রাশেদার চোখ ভিজে আসে। পুরাতন কাপরের আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছে। আর ভাবতে থাকে, আগামীকাল ছেলেকে কি উত্তর দিবে?

মহাজনের সাথে বেশ খাতির হাশেমের। হাশেম পেশায় বাজারের শ্রমিক। বড় বড় ট্রাক আসলে সেগুলোর কন্ট্রাকে মাল নামায়। দিনশেষে বেশ মোটা অংকের টাকা পায় সে। অনেকদিন হলো মহাজনের কাছ থেকে টাকা নেয় না হাশেম। কারণ একসাথে অনেক টাকা হলে নিবে। কাজ শেষে অনেক গুলো টাকা পায় হাশেম। সবমিলিয়ে ১৩ হাজারের মতন। খুশিতে এই অল্প টাকা গুলোই বারবার গুনছে হাশেম। তার পাশেই বরকত মিয়া বসে আছে। বরকত মিয়ার মন খারাপ। অনেকদিন হলো বউ টা গুরুতর অসুস্থ। গতমাসে ডাঃ জানিয়েছে তার বউয়ের ব্রেন টিউমার। যেকোনো সময় বিপদ হতে পারে। অপারেশন করতে অনেকগুলো টাকা লাগবে। কিন্তু হাতে অত টাকাও নেই। বরকত মিয়ার মন খারাপ দেখে হাশেম বলে….

–কি মিয়া ভাই মন মরা কেন?
-কিছুনারে, তা কত টাকা পেলি?
–১৩ হাজার পাইছি ভাই, অনেক ভালো লাগতাছে।
-বউটার টিউমার কিযে করি কথাটা বলেই দীর্ঘ একটা শ্বাস ছাড়ে বরকত মিয়া। অন্য দিকে তাকিয়ে বলে….
–জানিস হাশেম তোর ভাবির হাতের রান্না খুব সুস্বাদু ছিলো। কতদিন আমারে রাইন্ধা খাওয়ায় না। পিচ্চি মাইয়াটাও ঠিক মতন রাধতে পারে না।
-টেনশন কইরো না ভাই সব ঠিক হইব।
–জানিস তোর ভাবি আমারে অনেক ভালোবাসে, কিন্তু একমাস ধরে বাসেনা। রাগ করেছে মনে হয় আর কিছু বলতে পারেনা বরকত মিয়া। গলাটা ধরে আসে। চোখটা ভিজে যায়। গামছা দিয়ে চোখের পানি মুছে নেয় সে। আবার বলে….

–তর ভাবিরে কইস আমারে জানি একটু রান্না কইরা খাওয়ায়। অনেক ভালোবাসি বউটারে। যেদিন প্রথম ঘরে আনছিলাম তারপর থেইক্কা একটা টু শব্দও করে নাই। আমার সব কথাই মানছে। অনেক ভালো ছিলোরে….

-ভাই সব ঠিক হইয়া যাইব তুমি চিন্তা কইরো না।
–বাদ দে, বাড়িতে যাবি কহন?
-এইতো একটু পরেই যামু….
–অনেক গুলোতো টাকা পেলি বউয়ের লাইগ্গা কিছু নিবিনা?
-বউর লাইগগা কি নিমু আর। বরকত মিয়া হাসে। মুচকি হেসে বলে….
–বউ হলো ঘরের লক্ষী, লক্ষ্মীরে কখনো কষ্ট দিসনা হাশেম। আমি যাইরে বাসায় মাইয়াডা একা।

বলেই বসা থেকে উঠে পরে বরকত মিয়া। হাশেমের খুব একটা ভাবান্তর হয়না। ভাবতে থাকে প্রথমদিকের দিনগুলোর কথা। রাশেদা মাইয়াটাও কত সাদাসিধা। কখনো হাশেমের কথার নড়চড় করে নাই। কখনো জোর আব্দার করে কিছু চায় নাই। যা দিয়েছে তাই মেনেছে। অথচ কয়েকদিন হলো মেয়েটা বাপের বাড়ি যেতে চাইছে সেটাও যেতে দিচ্ছে না হাশেম। হাশেমের নিজের প্রতি অনুশোচনা হয়। কতদিন হলো মেয়েটার দিকে তাকায় না সে। একমাত্র ছেলেটাকেও বুকে জড়িয়ে নেওয়া হয়না। ভালো ভাবে কথাও হয়না। হাশেম ভাবে আচ্ছা এইযে এত পরিশ্রম কাদের জন্য? এই সংসার জগত কার জন্য? হাশেমের বুকটা ধুক করে ওঠে। অপরাধ বোধ জাগে তার মনে। অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছে সে মহাজনের কাছে যায় হাশেম। মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে…

–ভাই একটা কথা ছিলো?
-বল কি কথা।
–না মানে আমি দুইদিন কাজে আসতে পারুমনা।
-কেন?
–বউ টা অনেকদিন যাবত বাপের বাড়ি যাইতে চায়, ভাবছি বউরে নিয়া শ্বশুর বাড়ি যামু। মহাজন হাসতে হাসতে বলে…..
-আচ্ছা দুইদিন পর আসিস, তুই না থাকলে খালি খালি লাগে।

কৃতজ্ঞতার ভঙ্গিতে সালাম দিয়ে চলে আসে হাশেম। খুব করে মনে পরছে রাশেদার কথা। যখন বউ সেজে এসেছিলো তার ঘরে। পরনে লাল টুকটুকে শাড়ি ছিলো। হাতে গাঢ় করে মেন্দি দেওয়া ছিলো। হাশেমের লজ্জা লাগে। পরক্ষনেই আপন মনে হেসে ওঠে সে।

রাত ৮ টা বাঁজে। সজলের জন্য সাইকেল কিনে নিয়ে বাসায় ফেরে হাশেম। দরজার কাছে গিয়ে সাইকেলের বেল বাজায় সে। বেলের কিড়িংকিড়িং শব্দ শুনে দরজা খোলে রাশেদা। হাশেম কে দেখে অবাক হয়ে যায়। পাশ থেকে ছোট ছেলে সজল দৌঁড়ে সাইকেলের কাছে চলে যায়। সাইকেল ধরেই খুশিতে চিৎকার করতে থাকে। হাশেম ঘরে ঢুকে ঘামে ভেজা শার্ট আলনায় রাখে, রাশেদা বলে….

–আইজকা সকাল সকাল আইলা যে?

হাশেম কিছু বলেনা। রাশেদার দিকে তাকায়। রাশেদার দুই হাত ধরে বিছানায় বসায়। রাশেদার অসস্তি হচ্ছে। বুকের ভেতরটা হুট করেই মোচর দিয়ে উঠছে। মনে হচ্ছে কেউ একজন তাকে ভালোবাসা দিয়ে মেরে ফেলতে চাইছে। হাশেম রাশেদার হাত দুটো ধরে বলে….

–বউ তোরে খুব কষ্ট দেই আমি তাইনা?
-কি হইছে তোমার এমন করতাছো কেন?
–কিছু হয়নাই, আমারে মাফ করিস।
-ছিঃ ছিঃ কি কও এইসব? হাশেম আর কিছু বলেনা। রাশেদার জন্য আনা শাড়ি ওর হাতে দিয়ে বলে….
–এইটা তোর লাইগগা আনছি, মেলা দাম। মহাজনেরর কাছ থে ছুটি নিছি। কালকে শ্বশুর বাড়ি যামু।

রাশেদা কি বলবে বুঝতে পারছেনা। ওর মুখে কোন কথা নেই। বুকের ধুকধুক শব্দটা ক্রমাগত বেরেই চলছে। হাশেম আস্তে করে উঠে যায় ফ্রেস হওয়ার জন্য। রাশেদার কাছে সবকিছু কেমন জানি স্বপ্নের মতন লাগছে। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের জল মুছে নেয় সে। সুখ জিনিস টা এতটা কাছ থেকে অনুভব করবে তার ধারনার বাইরে ছিলো। হুট করে পাওয়া সুখের একটু অনুভূতিতে ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে রাশেদার। পাশেই সজল সাইকেলের বেল বাঁজাচ্ছে। সজলের চোখ চিকচিক করছে। মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠেছে। ভালোবাসায় যেন পূর্ণতা পেয়েছে রাশেদার সংসার। এভাবেই পূর্ণতা পাক হাজারো রাশেদার সংসার।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত