সাধারণত বাবা হওয়াটা খুবই আনন্দের। কিন্তু মিষ্টির পেটে আমার অনাগত সন্তান বেড়ে উঠছে জেনেও আমি সংশয়ে ছিলাম খুশি হবো কি না। একদিন সব সংশয় কাটিয়ে ওকে ডেকে বললাম,
-মিষ্টি, বাচ্চাটা নষ্ট করে দাও। লকডাউন শেষ হলেই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো তোমাকে এবরশন করাতে।’ একটু আগেও ওর মুখে হাসি ছিল। আমার কথাটা শুনে ধীরে ধীরে মুছে গেল হাসিটা। জানি খুব কষ্ট হচ্ছে ওর কথাটি শুনে। অসহায়ভাবে তাকালো সে আমার দিকে। আমি কৃত্রিম হেসে তাকে কাছে টানলাম। এক হাত দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে অন্য হাত দিয়ে তার মাথাটা আমার কাঁধে রেখে বললাম,
-দেখো, তোমার এখনও অল্প বয়স। তোমারও তো একটা ভবিষ্যত আছে। তাই না?’ আমি ভবিষ্যত বলতে কী ইঙ্গিত করছি ও ভালোভাবে বুঝেছে। কাঁধ থেকে মাথাটা তুলে বললো,
-তুমিহীন ভবিষ্যত আমি চাইতে পারি এটা ভাবলে কী করে? যে ভবিষ্যতে তুমি থাকবে না, সেই ভবিষ্যতে আমি কী করে থাকি বলো?’
ওর কথাটি শুনে কেন জানি আরও অনেকবছর বাঁচতে ইচ্ছে হলো। যেদিন প্রথম আমার ব্রেইন টিউমার ধরা পড়েছিল, সেদিন আমি যতটা কষ্ট পাইনি, ও কষ্ট পেয়েছে তারচেয়ে অনেকখানি। তারপর থেকে প্রায় ওকে দেখা যেত নামাজ শেষে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জায়নামাজে বসে কী যেন প্রার্থনা করতে। হয়তো যিনি রোগ সৃষ্টি করেছেন, তাঁর কাছে স্বামীর রোগমুক্তির প্রার্থনা করে সময়ের পর সময়। ডাক্তার বলে দিয়েছে আমি বড়জোর অল্প কয়েকদিন বাঁচবো, একমাস বা দু’মাস, অথবা আরও কম। এই অবুঝ মেয়েটির প্রার্থনা কি পারবে আমার আয়ু বাড়িয়ে দিতে? প্রার্থনায় ও কী চায়? আমার রোগমুক্তি? নাকি আমার যাত্রার সঙ্গী হতে?
লকডাউনের কারণে এখন প্রায় সময় কাটে বাড়িতে। তাই মিষ্টিকে এখন খুব কাছ থেকে দেখা হয়। চাকরির কারণে আগে বাড়িতে আসা হতো মাসে একদিন বা দু’দিন। তখন ওকে বড্ড মিস করতাম। এখন সারাক্ষণ ওকে দেখি আর ভাবী, এই মেয়েটার কী হবে আমি না থাকলে? ওর জীবনটা তো নষ্ট হয়ে যাবে। তাই ওকে বাচ্চা নষ্ট করার কথা বলেছিলাম। বাচ্চা থাকলে হয়তো ওকে অন্য কেউ বিয়ে করতে চাইবে না। তবে আমি জানি আমাকে ছাড়া ও দ্বিতীয় কোনো পুরুষকে কখনও মেনে নিতে পারবে না। প্রয়োজনে আজীবন একা কাটিয়ে দেবে।
খুব বড় ফ্যামিলির মেয়ে ও। দেখতেও মাশাল্লাহ! চরিত্রেও কোনো কালিমা নেই। চাইলেই কোনো ধনীর দুলালকে বিয়ে করে লাক্সারিয়াস জীবন কাটাতে পারতো। কিন্তু কী দেখে যে আমার মতো মধ্যবিত্ত এক বেকার ছেলের প্রেমে পড়ে বিয়ে করেছিল, সেটা ও-ই ভালো জানে। বিয়ের আগে আমার চাকরি ছিল না। একটা বেকার ছেলের সাথে খুব কম সংখ্যক পরিবার মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি হয়। কম বলতে এমন পরিবার নাই বললেও চলে। মিষ্টির পরিবারও রাজি না আমার সাথে ওর বিয়ে দিতে। কিন্তু একদিন ও ভালোবাসাকে বড় করতে গিয়ে সব ছেড়ে চলে আসে আমার কাছে। পিছনে পড়ে থাকে তার বিলাসবহুল বাড়ি, রাজকীয় সুখ। আমরা দুজন কাজী অফিসেই বিয়ে করি। ওর স্ট্যাটাস সম্পর্কে জানার পর আমার পরিবার আমাদের বিয়েটা ভালোভাবেই মেনে নেয়।
মেয়ে ধনীর দুলালি, একদিন ওর ভাগের সম্পদটা তাদের ছেলের কপালে জুটবে, আর কী চায়? রাজি না হওয়ার উপায় নেই। তাই প্রথম প্রথম ও যখন আমার পরিবারে ঠাঁই নেয় তখন সবার কাছে ওর কদর বেড়ে যায়। কিন্তু ওর নিজের পরিবার যখন একদিন ওর সাথে একেবারে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে, তখন আমার পরিবারে ওর কদরটা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। এভাবে চলতে চলতে কদরটা একদিন শূন্যের কোটায় চলে আসে। মাকে দেখা যায় ওর প্রায় সব কাজে খুঁত ধরতে। ওর কারণে আমিও অসহ্য হয়ে ওঠেছি পরিবারে। এটাই স্বাভাবিক। আমার চাকরি নেই। আর কতদিন আমাদের দুজনকে এভাবে বসে বসে খাওয়াবে? বাধ্য হয়ে আমি একটা ছোটখাটো চাকরি নিলাম। লকডাউনের কারণে এখন যেহেতু সময়টা বাসায় কাটে, তাই এখন দেখা হয় আমার পরিবারে মিষ্টির অবস্থানটা কোন জায়গায়। রমজান এসে গেছে। প্রথম রমজানের দিন ও সেহরির সব রান্না শেষ করে কেবল একটু রুমে এসেছে, তখনই মায়ের গলা শোনা যায়,
-বলি নবাবজাদি, অমনিই গিয়ে জামাইর গা ঘেষতে হয়, না? ভাত খাওয়ার পর যে এক কিলি পান খাবো, তাও কি নিজে বানিয়ে খেতে হবে?’ বলতে বলতে মা পানের কৌটা নিয়ে বসলো রান্নাঘরে। মিষ্টি রুমে এসে ঘাম মুছারও সময় পেল না। আবার ছুটে গেল মাকে পান বানিয়ে দিতে। আমি কিছু বললাম না। চুপচাপ দেখলাম। এই পরিবারে বউয়ের পক্ষ নেয়া যায় না। নিলেই বউয়ের চাটুকার, বউয়ের তোষামোদকারি হয়ে যায়। একটুপর মায়ের গলা শোনা গেল আবার,
-উঁহ, এখন আসছে নবাবজাদি পান বানিয়ে দিতে। তোমার আর পান বানাতে হবে না। আমি নিজেই বানিয়ে নিয়েছি।’
মাথা নিচু করে রুমে চলে এলো মিষ্টি। আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো, যেন কিছুই হয়নি। আমি মাঝেমাঝে অবাক হয়, এই মেয়েটা কী করে পারে সবকিছু মানিয়ে নিতে, সবকিছু সহ্য করতে। ওকে দেখে আমি বিছানা থেকে ওঠে বসলাম। ওকে আমার কোলে নিয়ে জড়িয়ে ধরলাম। এই অবস্থায় যদি মা আমাদের দেখতো তাহলে নিশ্চিত ক্ষেপে যেতো। আমার পুর্বপুরুষ থেকেই দেখে আসছি, বউকে অতিরিক্ত ভালোবাসাটা এই বংশে কেমন যেন নিচু চোখে দেখে সবাই। বউ মানে ওরা বোঝে শুধু বাড়ির কাজ করবে, আর শ্বশুর শাশুড়ির সেবা করবে। মিষ্টি উঠে গিয়ে দরজাটা একটু ঠেলে দিলো। হয়তো ও বুঝতে পেরেছে আমার মনের ভাবনাটা। আবার যখন ও আমার কোলে এসে বসে, ওর চুলের ঘ্রাণ লাগে আমার নাকে। আমি তার চুল ধরে অন্যমনস্ক হয়ে বললাম,
-ওপারে গেলে এই চুলের গন্ধটাকে খুব মিস করবো।’ আমার কথা শুনে ওর মুখটা হঠাৎ মলিন হয়ে যায় বুঝতে পেরে কথা ঘুরিয়ে নিলাম আমি। ওর ঘাড়ে আমার থুতনি রেখে বললাম,
-কোথায় যাবো বলো তোমায় রেখে?’ এবার হাসলো ও। আমার ভালোবাসা দিয়ে ওর সারাদিনের ক্লান্তি, অসহায়ত্ব দূর করার চেষ্টা করলাম। রবীন্দ্রনাথের হৈমন্তী দেখতে কেমন ছিল আমার জানা নেই, তবে মাঝেমাঝে ওকে দেখে মনে হয় হৈমন্তী বুঝি এমন ছিল। হৈমন্তীরা আসলেই দেখতে এমন হয়।
লাইট অফ করে দুজন শুয়ে পড়লাম ঘুমানোর জন্য। সেহরির আগেই আমার ঘুম ভেঙে যায়। এভাবে ঘুম ভাঙে না আমার সাধারণত। মিষ্টির ফুঁপানোর শব্দ শুনেই ঘুম ভেঙেছে। দেখি, ও তাহাজ্জুদ নামাজে বসে মোনাজাত ধরে কান্না করছে। আমি ঘুমানোর পরই হয়তো ও তাহাজ্জুদ পড়তে ওঠেছে। আমি কখনও ওকে কাঁদতে দেখিনি। আমার সামনে কখনও ও কাঁদে না। কখনও নিজের দুর্বলতাটুকু আমার সামনে প্রকাশ করে না। এই মুহূর্তে সে আমার আয়ু প্রার্থনা করে হয়তো কান্নাকাটি করছে। আমি যে জেগে গেছি এটা ওকে বুঝতে দিইনি। আমিও চাই ওর দুর্বলতা যে আমি জানি, এটা যেন ও না জানে। আমার সামনে অন্তত ও শক্ত থাকুক, ভালো থাকুক। পাশ ফিরে আবারও ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। সারারাত ও আর ঘুমায়নি। সেহরিতে সবার খাবার পরিবেশন করার সময় আমি এক নজরে ওর চেহারার দিকে তাকালাম। কে বলবে এই মেয়েটা নামাজে বসে সারারাত কান্না করেছে? দেখে একটুও দুঃখী মনে হলো না তাকে। সবার খাবার বেড়ে দেয়ার পর সে নিজে বসলো খেতে। তার প্লেটের মাংসটা মায়ের প্লেটে তুলে দিয়ে বললো,
-মা আমার মাংসটা খেতে ইচ্ছে করছে না।’ মা সত্যি সত্যি ভেবেছে ওর হয়তো খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কিন্তু আমি বুঝেছি ও আসলে মায়ের সাথে একটু ভাব জমাতে চাচ্ছে। আমার দিকে একবার চোখাচোখি হলো ওর। সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নিলো ও।
ফজরের নামাজের পর বেশ কিছুক্ষণ কুরআন তেলাওয়াত করে একটু ঘুমানোর জন্য শুইলো ও। ওর খুব ঘুম পাচ্ছে বুঝতে পারছি। ঘনঘন হাই তুলছে। চোখের নিচে কেমন যেন কালি জমেছে। এভাবে কতো রাত যে সে কেঁদে কাটিয়েছে আমার অজান্তে, ঘুমের ঘোরে আমি বুঝতেই পারিনি। অথচ আমার কারণেই ওর রাত জাগা। ওকে এখন শুতে দেখে লাইট অফ করে আমিও শুইলাম। আমার আরও কাছে টানলাম ওকে। একহাতে ওকে জড়িয়ে ধরলাম, একটা পা তুলে দিলাম ওর পায়ের উপর। ও কেমন যেন গুটিশুটি হয়ে আছে, যেন একটা আস্তানা খুঁজছে। দুহাত জোড় করে ও বুকের সাথে লাগিয়ে নিয়েছে, আর মুখটা আমার বুকে গুঁজাতে চাইছে। যেন একটা নীড় খুঁজছে। যেন আমার বুকটা তার নিরাপদ আশ্রয়। খুব মায়া হলো ওর জন্য। আমি ওর মাথায় হাত বুলাতে লাগলাম। ওর নিশ্বাস আমার কানে আসছে। হয়তো ও ঘুমিয়ে পড়েছে। আমারও চোখে ঘুমঘুম ভাব চলে এসেছে। একসময় বাহির থেকে মায়ের কণ্ঠ শোনা গেল,
-সকাল হয়ে গেছে, কোথায় একটু উঠান ঝাড়ু দেবে তা না। নবাবজাদি ঘুমাচ্ছে। এই বয়সে এসে আমাকেই ঝাড়ু ধরতে হচ্ছে।’
মায়ের কথা শেষ হওয়ার আগেই দেখলাম ও উঠে দৌড় দিছে বাইরে। আমি আরও ভাবলাম ও হয়তো এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। বাড়িতে মিষ্টির ভালোমন্দ খেয়াল করার মতো কেউ যে নেই তা কিন্তু না। আমার ছোট বোন, ও বুঝতো মিষ্টির অনুভূতিগুলো। প্রায় ও মিষ্টিকে সঙ্গ দিতো। মাঝেমাঝে সুযোগ ফেলে বসে গল্প করতো। এখনও দুজন বসে আছে বাইরে। গজল গাচ্ছে দুজন মিলে। আমি বরাবরই মিষ্টির গানের গলার ভক্ত ছিলাম। বিয়ের আগে যখন আমাদের রিলেশন ছিল ও প্রায় আমাকে গান শুনাতো। প্রথম যেদিন ও আমাকে গান শুনায়, ওটা ছিল একটা রবীন্দ্রনাথ সঙ্গীত।
‘ভালোবেসে সখি নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো তোমার মনেরও মন্দিরে সেদিন ওর কণ্ঠে গানটা শুনে মনে হয়েছিল পৃথিবীর সব সুর বুঝি বিধাতা ওর গলায় ঢেলে দিয়েছে। তবে ওর কণ্ঠে কখনও গজল শোনা হয়নি। আজ ভেতর থেকে এক ধ্যানে শুনছি। ও টেনে টেনে গাইছে, ‘ত্রিভুবনের প্রিয় মুহম্মদ, এলো রে দুনিয়ায়, আয় রে সাগর আকাশ বাতাস দেখবি যদি আয় গেয়ে চলেছে ও গজলটা। আমি ভেতর থেকে চোখ বন্ধ করে শুনছি। যেন ডুবে গেছি গজলে। ততক্ষণে আসরের ওয়াক্ত হয়ে গেছে। মসজিদ থেকে ভেসে এলো আজানের সুর। বাসার সবাই ওযু করে যার যার মতো ঘরেই নামাজ পড়ে নিলাম। ও নামাজ শেষে দীর্ঘ প্রার্থনায় বসলো। প্রতি নামাজ শেষে ও হাত তুলে এতো কী চায়? রান্নাঘর থেকে মা ডাক দিলো ওকে,
-মিষ্টি… মিষ্টি…
-নামাজ পড়ছে ও।’ জবাব দিলাম আমি।
-নামাজ কি শুধু ও একা পড়ে? এতক্ষণ লাগে নামাজ পড়তে? বুঝি বুঝি সব কামকাজ না করার পাঁয়তারা। কতো কাজ পড়ে আছে, কে করবে এগুলো? একটু পর ইফতারের সময় হয়ে যাবে।’
মিষ্টি মোনাজাত শেষ করে উঠে দাঁড়ালো। তারপর বেরিয়ে গেল রান্নাঘরের উদ্দেশ্য। এখন থেকে রাত পর্যন্ত তাকে আর কাছে পাবো না। এখন সে ইফতারের আয়োজন করবে, ইফতারের সময় হলে সবাইকে ইফতার দেবে। তারপর এটো তালা-বাসন ধুবে। এরপর মাগরিবের নামাজ, তারপর আবারও সবাইকে খাওয়াবে। সব শেষে এশার নামাজ আর তারাবিহর নামাজ পড়ে আমার কাছে আসবে। ইদানিং তাকে দেখে খুব মায়া হয়। আচ্ছা আমি মারা গেলে ওর কী হবে? কার আশ্রয়ে থাকবে ও? কার বুকে জড়োসড়ো হয়ে পাখির মতো নীড় খুঁজবে? আমার পরিবার কি তাকে আর রাখবে? নিজের পরিবার থেকেও তো সে বিতাড়িত। নিজের মৃত্যুর কথা ভেবে কখনও আফসোস হয়নি। তবে আজ খুব কষ্ট হলো ভাবনাগুলো মাথায় আসতেই। গোসল করে এসে সবে আমার সামনে এলো মিষ্টি। আজ সে একটা নীল শাড়ি পরেছে। শাড়ি পরলে ওর সৌন্দর্য যেন দ্বিগুণ বেড়ে যায়। আমি ওকে কাছে টেনে বসালাম। গভীরভাবে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম ওকে। ও অস্ফুটে জিজ্ঞেস করে,
-কী দেখছো ওভাবে?’
-তোমাকে দেখছি। এতো মিষ্টি মেয়েটাকে মা কী করে সহ্য করতে পারে না, বুঝি না।
-কে বলেছে মা আমাকে সহ্য করতে পারে না? আসলে কোনো মা-ই প্রথম প্রথম এটা সহ্য করতে পারে না, যখন তাঁদের ছেলের উপর অন্য মেয়ে এসে বেশি করে অধিকার ফলায়। তাঁরা চায়, ছেলের উপর তাঁদের অধিকারটাই যেন সবার চেয়ে উপরে থাকে।
-কিন্তু মা তো আমার দিকেও নজর দেয় না। আমার জন্য কোনো চিন্তা নেই মায়ের। আমি ক’দিন আর বাঁচবো বলো?’
-চুপ!’ আমার ঠোঁটে আঙুল দেয় মিষ্টি। ‘কে বলেছে মায়ের চিন্তা নেই? সারাদিন তো রুমেই শুয়ে থাকো। তুমি জানো মায়ের কথা? মা সুযোগ পেলেই আড়ালে গিয়ে কাঁদে। আমি প্রায় মাকে কাঁদতে দেখি তোমার জন্য। শুধু বুঝতে দেয় না…
-আর তুমি?’ ক্ষীণকণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম। ও জবাব দিলো না। নিরসভাবে চেয়ে থাকলো। ঠোঁটটা হালকা কেঁপে ওঠলো ওর। বুঝলাম ওর কান্না পাচ্ছে। আমি আবার বললাম,
-সত্যকে মেনে নিতে হবে। ইদানিং মাথায় খুব চাপ লাগে। একবার ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত ছিল। নিজের জন্য আমার আফসোস নেই। কিন্তু আমি না থাকলে তোমার কী হবে?’ কোনো জবাব দিলো না ও। মুখ নিচু করে রইলো। কান্না কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে। মুখ খুলতে পারছে না। মুখ খুললেই কেঁদে ফেলবে। আমি ওকে জড়িয়ে ধরলাম। কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললাম,
-যতদিন যাচ্ছে তোমার গানের গলাটা আরও বেশি যেন মিষ্টি হয়ে যাচ্ছে। হয়তো শেষ সময়ে এসে এমনই লাগছে। আর কখনও তোমার কণ্ঠে গান শুনতে পাবো কি না জানি না। আজ একটা আমায় গান শুনাবে?’ চুপ করে রইলো ও। নাক টেনে কান্না কন্ট্রোল করলো। তারপর দরজাটা ঠেলে দিয়ে একটা রবীন্দ্রনাথ সঙ্গীত শুরু করলো, মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না?
কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে, তোমারে দেখিতে দেয় না ও গান গেয়ে চলেছে। আর আমি আনমনা হয়ে শুনতে লাগলাম। ওকে জড়িয়ে ধরে মাথা দুলাতে লাগলাম। আগে যখন ওকে গান গাইতে বলতাম, ও আশেপাশে কেউ আছে কি না দেখে নিতো। তারপর দরজাটা ঠেলে দিয়ে গলাটা নিচু করে গাইতে শুরু করতো। কারণ মায়ের কানে গেলে স্বামী সোহাগী বলে বকা দিতো। আজ তেমনটা করেনি। গান শেষে ও আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। ওর সকল সংযমের বাধ যেন ভেঙে গেছে। আমাকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে ওঠলো। কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো,
-আমাকে ছেড়ে যেও না প্লিজ। আমি কী করে থাকবো তোমাকে ছাড়া? তোমার জন্য আমি রাত জেগে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, আল্লাহ কি আমার প্রার্থনা শুনবে না? এই যে দেখো, এই যে…’ আমার একটা হাত মিষ্টি ওর পেটের উপর বুলাতে লাগলো। ‘এই যে তোমার সন্তান আমার পেটে বড় হচ্ছে, ওর মুখটা না দেখে তুমি কীভাবে যাবে? জন্মের পর ও কাকে বাবা ডাকবে?’ হু হু করে বেড়ে চললো ওর কান্না। আমারও চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। খুব ইচ্ছে হচ্ছে আজ, এই মেয়েটার জন্য হলেও যদি আরও অনেকদিন বাঁচতে পারতাম!