জোনাকিপোকা এবং একটি এপিটাফ

জোনাকিপোকা এবং একটি এপিটাফ

মানিকগঞ্জ ছাড়িয়ে বরযাত্রীর বহর যখন আরিচাঘাট পৌঁছালো রাত তখন একটা একুশ। কাঁধের উপর মাথা রেখে ইলা ঘুমিয়ে পড়েছে। ওর মুখের উপর থেকে চুল সরাতে সরাতে ওকে ডেকে নিলাম। দুটোর লঞ্চে উঠতে হবে আমাদের। মাইক্রো থেকে সবাই ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে। ইলা শাড়ি ঠিকঠাক করে নিলো। আমার কাঁধের কাছটাতে লিপস্টিকে দাগ দেখে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বললো,

‘কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম টের পাইনি’।
‘সমস্যা নেই। গত কয়েকদিনের ধকল আর চিন্তায় আমিও খানিকটা ক্লান্ত।’
‘কতক্ষণ লাগতে পারে লঞ্চে?’
‘ ধরো সবমিলিয়ে ঘন্টা দুয়েক ‘ মাইক্রো থেকে নামতে নামতে বললাম।

লঞ্চের উপরতলাটা, আমাদের জন্য রির্জাভ করা পূর্ব থেকেই। সবাই দ্রুত উঠে পড়লাম । ডিসেম্বরের শেষ বলে কুয়াশা পরিমাণটা বেশী। ছোট মামা চায়ের ব্যবস্থা করে রেখেছে। কেবিনে বসতেই ফ্ল্যাক্স রেখে গেছে মামা। আমাদের দুজনকে একা ছেড়ে দিয়ে সবাই যে যার কেবিনে গেছে। হুট করে কেমন একটা নিরবতা নেমে এলো কেবিন জুড়ে।কত জলদিই না আমাদের বিয়ে হয়ে গেলো। বিয়ের আগে মাত্র কয়েকবার ইলার সাথে কথা বলার সুযোগ হয়েছে।

‘ঐ জানালাটা খুলে দিবেন? দমবন্ধ লাগছে আমার।’ নিরবতা ভেঙে ইলা বলে উঠলো। আমি লেটার-সুটকেস ডিঙিয়ে নিঃশব্দে ছোট্ট জানালাটা খুলে দিলাম।
‘ চা খাবে?’ কি বলবো বুঝে উঠতে পারছি না।
‘উহু লঞ্চ ছাড়লে। ‘
‘ তুমি চাইলে এই ভারী শাড়ি পাল্টে অন্য শাড়ি পরতে পারো।কষ্ট হচ্ছে তো তোমার।’
‘আচ্ছা।’

ইলাকে কেবিনে রেখে, দরজা ভিড়িয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালাম।লঞ্চ ঘাট থেকে নোঙর তুলে, ছাড়ার প্রস্তুতি চলছে।
ঘাটের চিহ্ন হারিয়ে যাচ্ছে ধীরে। আজ পূর্ণিমা জানা ছিলো না আমার। অনেকবছর এভাবে জোছনা দেখিনি, হঠাৎ খেয়াল হলো। ইলা আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। হাতের কাপে চা প্রায় শেষের দিকে। করিডোরে হু হু করে বাতাস ঢুকছে। ইলার চুলগুলো কান-মুখে আছড়ে ফেলছে প্রবলভাবে।বারবার গুছাতে গিয়ে বিরক্তিতে চুল খোঁপা করতে যাচ্ছে ইলা। ‘ থাকুক না ‘ অজান্তেই মুখ থেকে ফস করে বের হয়ে গেলো আমার। একটু যেন লজ্জা পেয়ে, চুল থেকে হাত সরিয়ে নিলো ইলা। চাদরটা আরেকটু জড়িয়ে নিতে নিতে বললো, ‘আপনার ঠান্ডা লাগছে না ? এই পাতলা পাঞ্জাবীতে।’ ‘খানিকটা’

‘একটু দাঁড়ান, লাগেজে বোধহয় ছোট মামা আপনার গরম কাপড় রেখেছে। নিয়ে আসছি। ‘ অস্পষ্ট মাথা নাড়াতেই কেবিনে ঢুকলো ইলা।আমার ভীষণ নার্ভাস অনুভূত হচ্ছে আজ, সিগারেট ধরাতে পারলে বেশ মন্দ হতো না। সবাই যে যার কেবিনে চলে গেছে। করিডোরে আমি একা, ইলার জন্য অপেক্ষায়।

‘দেখুন দেখুন ডলফিন ‘ আঙুল দিয়ে সামনেটা দেখালো ইলা।
‘ ঐ দুটো শুশুক। ডলফিন খুব কমই আসে ‘
‘ আচ্ছা ‘ একদৃষ্টিতে দেখতে দেখতে বললো ইলা। ‘ ওপাশে যে ঘাট দেখা যাচ্ছে নাম কি তার?’
‘ গোয়ালন্দ ‘ বললাম আমি। আবার নিরবতা নেমে এলো।
‘দেখুন দূরের ঐ মাছ ধরা নৌকা দেখে মনে হচ্ছে কেমন জোনাকিপোকা। হ্যারিকেনের আলো যেন জোনাকির আলো।’ নিরবতা ভেঙে অনেকক্ষণ পর বলে উঠলো ইলা। ওর কন্ঠে আমি বালিকা সুলভ উচ্ছ্বাস টের পেলাম।

‘জোনাকি বুঝি খুব পছন্দ তোমার?’
‘ হ্যা খুব। কিন্তু ঢাকায় কোথায় দেখা পাবো বলুন।’ বিষাদ ছুঁয়েছে ইলার গলায়।
‘এক বয়াম জোনাকি তোমায় তবে উপহার দেবো। আগামীকাল সন্ধ্যা।’ ওকে খুশী করতে বলে বসলাম। ইলার চোখে মুখে হাসি দেখতে পেলাম আমি।

‘ একটা প্রশ্ন করি আপনাকে ? ‘
‘ বলো’
‘ আপনার ঝুম বৃষ্টি ভালো লাগে নাকি মেঘ?’
‘বৃষ্টি ‘ একটু সময় নিয়ে জবাব দিলাম।
‘তোমার?’
‘আমার মেঘলা আকাশ। কেনো জানেন?’
‘কেনো ?’ কৌতূহলী চোখে তাকালাম ইলার দিকে।

‘ ঝুম বৃষ্টি মানে তো অঝোর কান্না আর মেঘলা আকাশ মানে তো সেই কান্না চেপে রাখা। কান্না প্রায় সবাই করে কিন্তু কান্না চেপে রাখা একটা শিল্প। সবাই পারেনা।’ অন্যমনস্ক হয়ে নদী দেখতে দেখতে বললো ইলা। “মা কে মনে পড়ছে?’ ইলার বাবার থেকে শুনেছিলাম ছোট বেলায় ওর মা মারা যাবার পর ইলা কান্না করেনি একটুও। কেনো যেনো মনে হলো ইলা মায়ের অস্পষ্ট স্মৃতি আঁতড়াচ্ছে ‘হু। জানেন মায়ের চেহারা ঝাপসা হয়ে গেছে।’ ইলার রেলিং এ রাখা হাত ধরলাম আমি। বহুসময় পর ভাবনায় এলো ওর মন ভালো করা উচিত আমার।

‘ ইলা, তোমার মেঘ পছন্দ?’
‘ হ্যা সুন্দর। ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে।’ ইলা স্মতি কাতরতা কাটিয়ে উঠেছে।
‘ ধর আমার হাত ভর্তি মেঘ। তুমি হাত ধরবে নাকি মেঘ?’ আমার এমন প্রশ্নে ও অপ্রস্তুত হয়ে গেছে। মৃদু আওয়াজে বললো,’ আপনার হাত’
‘ আমার হাত কেনো? তুমি তো মেঘ ছুঁতে চাও।’
‘আপনি যদি মেঘ এনে দিতে পারেন কেনো আমি মেঘ ছুঁয়ে দেখবো? আমি আপনাকে ছুঁয়ে দেখবো যে আমায় মেঘ এনে দিয়েছে। ‘ইলার গলায় লজ্জা নেমেছে।

‘ ধরো, ঐ মেঘটুকু হলো ভালোবাসা। আমি হাতটা আমি। এখন?’
“ভালোবাসা আপনার থেকে চাই। ‘চোখ নামিয়ে বললো ইলা।
‘ভালোবাসি ‘ মনে মনে বললাম আমি।
‘ ইলা পৌঁছাতে আমাদের আর বেশীক্ষণ নেই। চলো একটু বিশ্রাম নেওয়া যাক।’ নিঃশব্দে মাথা নেড়ে ইলা আমার সাথে কেবিনে প্রবেশ করলো। শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ার আগে আমার মাথায় এলো কালকেই ছোটমামাকে বলতে হবে জোনাকি জোগাড়ের কথা।

আমার ঘুম ভাঙার পর, নিজেকে আবিষ্কার করি হাসপাতালের বিছানায়। একটু নড়তেই পুরো মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। জ্ঞান হারিয়ে বসলাম। জ্ঞান আসা-যাওয়া করার মাঝেই সপ্তাহখানেক পার হয়ে গেলো। তারপর যখন এক সকালের দিকে আমার শারীরিক অবস্থা একটু উন্নতির দিকে পৌঁছালো আমি ইলা আর পরিবারের বাকী সবাই এর কথা জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলাম। হাসপাতালে কিভাবে পৌঁছালাম সেটাও নার্সদের জিজ্ঞাস করা শুরু করলাম। বিকালে ডাক্তার এলো, ছোট মামা, ভাই, মাকে দেখলাম সাথে কয়েকজন পুলিশ।আমায় জানালো হলো, মানিকগঞ্জের পর শিবালয়ের কাছে আমাদের বরযাত্রীবাহী মাইক্রোবাস ভয়াবহ এক্সিডেন্টের মুখোমুখি হয়।আমি আর ইলাকে বহনকারী মাইক্রোতে থাকা একমাত্র আমিই বেঁচে আছি। আমার পুরো পৃথিবী টলে উঠলো। এক্সিডেন্টই যদি হয় তাহলে আরিচাতে আমাদের পৌঁছানো, ইলার সাথে আমার করিডোরে কথা বলা, জোছনা দেখা, শুশুক দেখা সমস্ত বিষয়টা কি ছিলো!

চিন্তাগুলো আমায় পাগল করে দিচ্ছিলো। ডাক্তার জানালো, আমি যখন জ্ঞান হারিয়েছিলাম আমার সাব-কনশাশ মাইন্ড সাজিয়েছে দৃশ্যপটগুলো। মনে হচ্ছিলো সবাই আমায় মিথ্যা বলছে। আমি কোনো স্বপ্ন দেখছি, এখনি ভেঙে যাবে। ছোট মামা আমায় ডেকে তুলবে। আমি অপেক্ষা করি ছোট মামার ডাকের।

ইলা যেখানে ঘুমিয়ে আছে, আমার রুমের জানালা থেকে দেখা যায়। আমি এখন ইলার কবরের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আমার হাতে বয়ামভর্তি জোনাকি, ইলার পছন্দ। বয়াম খুলে দিতেই সব জোনাকি আলো জ্বালতে জ্বালতে কবরের চারপাশে উড়তে লাগলো। আমার জিহ্বা ভারি হয়ে উঠেছে। চোখ ঝাপসা বলে অস্পষ্ট চোখে এপিটাফের লেখা দেখতে পাচ্ছি, ‘ইলা, তোমার জন্য ভালোবাসার বিপরীত শব্দটাও ভালোবাসা।’

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত