ঝালমুড়িওয়ালা

ঝালমুড়িওয়ালা

মা বলেছিল, “কখনো কোনো মেয়ের ফাঁদে পা দিস না বাবা। আমরা গরীব। আমাদের বাঁচতে হবে আগে।” আজ যে আমি প্রেমে পড়লাম, মা’কে আমি কী জবাব দেব? মা যদি প্রশ্ন করে কেন আমার কথার অবাধ্য হয়ে এমনটা করলি? কী বলব তখন আমি? মনে মনে গুছিয়ে রাখি, মা’কে বলব “মা, মন তো আর কারো কথা শুনে না। ” আমি এতটা নির্লজ্জ হয়ে এমন কথা বলতে পারব মায়ের সামনে? প্রেমে পড়লে মানুষ নিশ্চয় নির্লজ্জ হয়ে যায়? শিমুকে আমি ভালোবাসি। কতটা ভালোবাসি পরিমাপ করে দেখিনি। তবে অনুভব করতে পারি তাকে একদিন না দেখলে আমার বুকের ভিতরটা কতটা কষ্টে থাকে। কিশোর প্রেম কী সত্যি হয়?

আমি যখন নাইনে পড়তাম তখন শিমু সিক্সে। তখন তাকে ভালো লাগত। ওর মা যখন স্কুলের ছুটির ঘন্টায় টুং টাং শব্দ করতেন কাঠের হাতুরি দিয়ে। তখন দৌড়ে ক্লাস থেকে বাইরে বের হয়ে দেখতাম শিমু তার মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সব ছাত্রছাত্রী বের হয়ে গেলেও শিমু তার মায়ের জন্য দাড়িয়ে থাকত। শিমুর মা স্কুলের মহিলা দপ্তরি। ছুটির ঘন্টা বাজানো, স্কুল ছুটির পর ও স্কুল শুরুর সময় ক্লাসগুলোর দরজা জানালা খোলা ও লাগানো ছিল শিমুর মায়ের কাজ। নবম শ্রেণীতে পড়া সেই আমি অজানা এক ভালোলাগায় বাম দিকের নারকেল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকতাম। শিমু স্কুলের বাড়ান্দায় দাঁড়িয়ে তার মায়ের জন্য অপেক্ষা করত। আমি দাঁড়িয়ে শিমুকে দেখতাম। সিক্সে পড়ুয়া মেয়েটি আমার দাঁড়িয়ে থাকার অর্থ খুঁজে পেতো নাকি আমার জানা হয়নি কখনো। আর আজ চার বছর ধরে সেই একই স্কুলের গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আমি ঝালমুড়ি বিক্রি করি। শিমু আর স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে না। তার মা’কে ঝালমুড়ি খাওয়ার কথা বলে আমার কাছে আসে। তার মা স্কুলে তালা লাগিয়ে বেরিয়ে এলে চলে যায়।

মা একদিন আমার মাথায় হাত রেখে বলেছিল, “তুই আমাকে ক্ষমা করিস বাবা। তোকে আমি আর পড়াতে পারিনি। তোর ছোট দুটি ভাই বোনকে পড়াতে না পারিস, দুই বেলা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দে।” আমি নাইনে পড়তাম, ততটা অবুঝ না। মায়ের হাতের স্বর্ণের চুড়ি বিক্রি করা টাকায় ঝালমুড়ি বিক্রি শুরু করেছি। ঝালমুড়ি বিক্রির টাকাতেই চলে আমাদের সংসার। আমি, মা, ছোট বোন আর ছোট ভাই। এই নিয়ে আমাদের চারজনের সুখী পরিবার। এর মধ্যেই মা আবারো একদিন বললেন, “বাবা, তোর উপর নির্ভর করছে আমাদের পরিবারের বর্তমান। তোর জন্য তোর ছোট ভাই বোনের লেখাপড়া চলছে। কোনো মেয়ের ফাঁদে পা দিস না। আমরা গরীব। আমাদের বাঁচতে হবে আগে।

“কোনো প্রিয়জনের চোখের পানি দেখতে চাও? তাকে কষ্ট দিয়ে না কাঁদিয়ে ঝালমুড়ি খাওয়াও। শুধু মরিচের পরিমান যেন বেশি থাকে।” শিমু এখন নাইনে। এত বড় মেয়েটি যখন স্কুলের নীল ড্রেসে চোখের পানি মুছে তখন সেখানে এক লাবণ্যতা খুঁজে পাই। কাউকে কাঁদিয়ে সুখ পাওয়া যায়? আরে শিমু কাঁদছে না তো, ঝালমুড়ির ঝালে চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। আমি কেবল লাল কাঁচা মরিচের পরিমান একটু বাড়িয়ে দিয়েছি।

তবে একদিন কেঁদেছিল আমার সামনে। চোখের পানি আড়াল করতে চাইলেও আমার কাছে ধরা পড়ে। নিজের বাবাকে হারিয়েছি। তাই মানুষের বাবা সম্পর্কে আমার অনেক আগ্রহ। শিমুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “তোমার বাবা কী করেন?” শিমু বলল, “আমি যখন খুব ছোট তখন বাবা এই স্কুলের দপ্তরি ছিলেন। নরসিংদী ইউএমসি আদর্শ বিদ্যালয়ের দপ্তরি। অনেকে চিনত। তুমি স্কুল মাঠের যে নারকেল গাছগুলোর নিচে দাঁড়িয়ে আমাকে দেখতে, তার আগে থেকে আমি নারকেল গাছের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। সারিবদ্ধভাবে দাড়িয়ে থাকা তিন নাম্বার নারিকেল গাছটি আমার বাবাকে মেরে ফেলে।”

কথাটুকু বলে চোখের পানি মুছল শিমু। আমি তার কান্না থামানোর চেষ্টা করিনি। কেন যেন মানুষের কষ্টে আমি সান্তনা দিতে পারি না। নিজেরই মন খারাপ হয়ে যায়। একটু থেমে শিমু আবার বলা শুরু করল, “নারকেল গাছের উপর দিয়ে বিদ্যুতের লাইন ছিল। বাবা গাছের ঝুলে থাকা ডাল কাটতে উঠেছিলেন। বিদ্যুৎ পিষ্ট হয়ে ছিটকে মাটিতে পড়লে বাবাকে আর বাঁচানো যায়নি। স্কুল কর্তৃপক্ষ আমাদের সহায় হলেন। বাবার দপ্তরির চাকরিটা মা’কে দিলেন। আমিও বিনা বেতনে এই স্কুলে পড়ি। খুব ছোটবেলা দেখেছিলাম তো, বাবার চেহারা মনে আসে না।” শিমুর মা স্কুলে তালা লাগিয়ে বেরিয়ে এল। শিমু চোখের পানি মুছে। তার মা জিজ্ঞেস করল, “কিরে কী হয়েছে? কাঁদিস কেন?”

শিমু হেসে হেসে উত্তর দেয়, “মা কাঁদি না। শ্রাবণ ঝাল বেশি দিছে।” শিমুর মা আমার কাছে জানতে চাইলেন, “শ্রাবণ তোমার মা কেমন আছে?” আমি বললাম, ভালো আছে আন্টি। তিনি হাসিমুখে শিমুকে নিয়ে রিক্সায় উঠলেন। রিক্সার হুড তোলার পর পেছন দিকে ছোট্ট একটি ফাঁকা জায়গা থাকে। শিমু সেখান দিয়ে হাত বাড়িয়ে আমাকে বিদায় জানিয়ে গেল। বাড়ি থেকে বের হবার সময় মা আমার কপালে চুমো দিয়ে দেন। পরক্ষনেই মুখ ঘুরিয়ে আঁচলে চোখ মুছেন। বাবা যদি থাকত তাহলে এমনটা হতো না নিশ্চয়। আমাদের আরো সুন্দর জীবন হতে পারত। ঐসব ভেবেই মায়ের চোখে পানি।

সকাল সকাল স্কুলের গেইটে দাঁড়াতে হয়। নয়তো আচার ওয়ালা আমার জায়গায় বসার পায়তারা করে। যদিও স্কুলের সব স্যার মেডাম আমাকে চিনে। আমার প্রতিদিনের দাঁড়ানোর জায়গা এখানে। কাঠের উপর পিয়াজ রেখে ছুড়ি দিয়ে কাটছি। আগেই সব রেডি করে রাখতে হয়। ফাঁকে ফাঁকে তাকিয়ে দেখি শিমু এল নাকি। সকালে শিমু আসে একা। শিমুর মা তাড়াতাড়ি চলে আসেন। কারণ স্কুলেরর দরজা জানালা খুলতে হবে। তাই শিমু সকালে আমার এখানে একটু দাঁড়িয়ে কথা বলার সুযোগ পায়। দেলোয়ার স্যারকে দেখে সালাম দিলাম। বড্ড ভালো মানুষ। একবার রেগে গেলে খবর আছে। শিমু আমার পাশে এসে বলল, “মুড়ি দেও তাড়াতাড়ি।”

-কী ব্যাপার? রেগে আছো মনে হচ্ছে?
-হ্যাঁ। মা সকালে আসার আগে মন খারাপ করে দিয়েছে।
-কেন কী হয়েছে?
-মা বলেছে, “জানিস? তোর জন্য না পাত্র দেখব ভাবছি। গরীব ঘরে জন্মেছিস, এত পড়ে লাভ নেই।”
-আন্টিকে বলিও দুইটা বছর পর আমিই বিয়ে করব তোমাকে।
-ইস, শখ কত? ঝালমুড়ি ওয়ালার বউ আমি হব না। আমি হব ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারের বউ।

মনটা খারাপ হয়ে গেল। শিমু ঝালমুড়ি খাচ্ছে আর মুচকি হাসছে। আমি অন্যদিকে তাকিয়ে আছি। চোখ ছলছল করছে। চার বছরের ভিতরও কি শিমু বুঝতে পারল না আমি তাকে ভালোবাসি? বুঝেই কী হবে? সে তো ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারের বউ হবে।

শিমুর মা ছুটির ঘন্টা বাজালেন। ছাত্র ছাত্রী বেরিয়ে এল। আমাদের এলাকার রিতা যাবার সময় বলল মুড়ি দিতে। মুড়ি বানাতে বানাতে দুই চার কথা হচ্ছে। একই এলাকায় বাড়ি, দুই চার কথা হতেই পারে। শিমু সেটা দেখে রাগে জ্বলছে। চোখে মুখে তা প্রকাশ পাচ্ছে। রিতা চলে যাবার পরও শিমু কোনো কথা বলে না। আমিও বলি না, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারের বউয়ের সাথে কথা বলে লাভ নেই। শিমুর মা বেরিয়ে এল। তিনিও অবাক। শিমু এই প্রথম ঝালমুড়ি না খেয়েও দাঁড়িয়ে আছে। যে শিমু তার মায়ের কাছে বলত, “শ্রাবণের ঝালমুড়ি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ঝালমুড়ি।” শিমুর মা জানতে চাইল, “কিরে, মুড়ি খাসনি আজ?” শিমু জবাব দিল, “না মা, শ্রাবণের অনেক বড়লোক মেয়ে কাস্টমার আছে। আমার কাছে বিক্রি না করলেও তার চলবে। চলো বাড়ি যাই।” আজ আর রিক্সার হুডের পেছন দিয়ে আমাকে কেউ বিদায় জানায়নি।

ঝালমুড়ির ব্যবসা খারাপ না। অর্ধেকের বেশি লাভ থাকে। বর্তমানে আমাদের সংসারে অভাব নেই। শুধু বাবার অভাব। যা পূরণ হবার নয়। মা যেদিন জানল বাবা আরেকটি বিয়ে করে নিরুদ্দেশ হয়েছেন। আমাদের তিন ভাইবোনকে বুকে জড়িয়ে কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন, “তোদের বাবা মরে গেছে। আজ থেকে আমিই তোদের বাবা, আমিই তোদের মা।” তবে আমি মা’কে বুঝিয়ে দিয়েছি আমি তার বাবা। আমি থাকতে আমার মেয়ে বাইরে কাজ করবে কেন? তাইতো মা’কে কোনো কাজ করতে না দিয়ে সংসারের হাল আমার উপর।

দু’দিন ধরে শিমু স্কুলে আসে না। তৃতীয় দিন শিমুর মায়ের কাছে জানতে পারলাম সে নাকি একটু অসুস্থ। চারদিন পর স্কুলে এসেও যখন আমার সাথে কথা না বলে গেইট দিয়ে ঢুকতে যাবে। তখন আমি শিমুর হাত ধরে ফেলি। শিমু চোখ পাকিয়ে বলছে, “সবাই দেখবে, হাত ছাড়ো।” ছেড়ে দেবার পর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি মুড়ি বানাচ্ছি তার জন্য। আশেপাশে তাকিয়ে শিমু বলছে, “তোমার বড়লোক কাস্টমার কই?” আমি বললাম, “আরে সে হল রিতা। একই এলাকায় থাকি। তাই একটু কথা বলেছি।”

-একই এলাকার হলে কথা বলতে হবে?
-কথা বললে কী হবে?
-না তুমি কথা বলবে না। আমার খারাপ লাগে।
-তোমার খারাপ লাগবে কেন? তুমিতো ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারের বউ।

শিমু রেগে গেছে। রাগলে অসম্ভব সুন্দর লাগে। চোখ মুখ লালচে হয়ে যায়। একহাত কোমড়ে ধরে আঙ্গুল তুলে আমাকে বলছে, “কোনোদিন তুমি আমাকে বুঝবা না। ঠিক আছে যাও, তোমার এলাকার মেয়েকেই ভালোবাসো।”

-আমি তাকে ভালোবাসতে যাব কেন? আমার একজন আছে না?
-একজন আছে মানে? কার সাথে প্রেম করো তুমি?
-আর কার সাথে? তুমি আছো না?

মাথা নিচু করে একটু মুচকি হাসি দিয়ে বলল, “অন্য মেয়েদের সাথে বেশি কথা বলবা না। আমি মা’কে বলেছি স্যারকে বলে নারকেল গাছের নিচে একটি দোকানের ব্যবস্থা করে দিতে। তুমি সেখানে বসে ঝালমুড়ি বিক্রি করবা।”
মনে মনে ভাবছি, ঝালমুড়ি ওয়ালার বউ হয়ে থাকতে পারবে তো? হয়তো পারবে। হয়তো শিমুর এত বড় স্বপ্ন নেই, সব স্বপ্ন আমাকে ঘিরেই।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত