মরণ চিঠি

মরণ চিঠি

২০১৪ সালে আমার বাবাকে একদল লোক তুলে নিয়ে যায়! তাঁর জীবনের বিনিময়ে দাবী করে পঞ্চাশ লাখ টাকা! মেয়ে মানুষ তাই কোনো উপায় না পেয়ে আমি থানাতে ফোন করেছিলাম। খুব ভয় পেয়েছিলাম আমি। একজন পুলিশ অফিসার আসলেন। বাবার রুমটা ভালো করে পরিদর্শন করলেন। তারপর শার্লক হোমসের মতো বাবাকে খুঁজে বের করলেন!

সে থেকে লোকটার সাথে আমার পরিচয়৷ অমায়িক হাসি, লম্বা ভদ্র আর চরম আসামী ধরার ক্ষমতা। চোখ দুটোতে যেন হাজার বছরের সব সাহিত্যের ঘ্রাণ! ঠাণ্ঠা মাথায় খুব গরম বিষয়টাকে সে দারুণ কৌশলে সমাধান করে ফেলে। লোকটার এই গুণটা আমার বেশ ভালো লাগতো। কথা একদম কম বলবে। কিন্তু যখন বলতে শুরু করবে। সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনতে বাধ্য! আমার কলেজ কলাতলী। কলাতলী কলেজে যেতে হলে একটাই রাস্তা। তা থানার সামনে দিয়ে গিয়েছে। যার কারণে প্রায়ই দেখা হয়ে যেতো। দুয়েকবার একসাথে বসে চা খাওয়া হয়েছিলো।

সত্যি বলতে লোকটাকে যখনই দেখি, মনে হয় আমি হাজার বছরের ঋণী তাঁর কাছে। আমার বাবা। আমার পৃথিবীটাকে তিনি ফিরিয়ে এনেছেন মৃত্যুর হাত থেকে! নাম ধরে কখনো ডাকা হয় না। তাই বলতে ভুলেই গিয়েছি, তাঁর নাম শোয়েব আল গাজী। ফোন নাম্বারটা সেদিন থেকেই ছিলো কিন্তু কখনো ফোন করা হয়নি। মাঝে মধ্যে ম্যাসেজ দিতাম। কোনো উত্তর নেই! দরকারী কোনো কথা ছাড়া সে সচারাচর কারো সাথে কথা বলে না।

আমার কলেজ শেষে টিউশনি করতে হয়। বাবার ঔষধপত্রের এতোগুলো টাকা লাগে। আমার পড়ার খরচ আছে। এই ব্যস্ত জীবনের মধ্যে কোনোদিন যদি এক দু’ঘন্টা সময় পেতাম। খুব কাছে কোথাও ঘুরতে যেতাম তাঁর সাথে। যদিও কোনোদিন এক ঘণ্টার বেশি থাকতে পারিনি কোথাও, তাঁর স্যারদের ফোনের কারণে! আমি যে তাঁকে ভালোবাসতাম এমনটা না। শুধুই ভালো লাগতো। ভালো একটা মানুষ, ভালো একজন বন্ধুর মতো। আমি ভাবতাম সে বিবাহিত। যেভাবে নিজেকে সামলে রাখে।

কিন্তু যেদিন উনার বাবার সাথে দেখা হলো, জানতে পারলাম সে এখনো বিয়ে করেনি! সে থেকে তাঁকে আমার মানুষই ভাবতে শুরু করি। লোকটার বাবাকে আমার তাঁর থেকেও বেশি ভালো লেগেছে। ছোট বেলায় মাকে হারিয়েছিলেন। বড় হয়ে তিনি বিশাল এক বৃদ্ধাশ্রম বানিয়েছেন। অবহেলিত মা বাবাদের যত্ন নেয়ার জন্য! আন্তরিকতার সম্পর্কটায় একটু বেশিই মনে হয় মনটা ডুবেছিলো দুজনেরই। সে তো ব্যস্ত মানুষ! কোনোদিন ফোনে তিন মিনিটের বেশি কথাই হয়নি।

কিন্তু মাঝেমধ্যে মাঝ রাত্তিরে ফোন দিয়ে যখন চোর ডাকাত ধরার মজার মজার গল্প বলে, তখন ঘন্টার পর ঘন্টা কীভাবে আমি ঘুম ছেড়ে থাকি আল্লাহ্ জানে! হয়তো ঘুমের চেয়ে বেশি কিছু আমার তাঁর কণ্ঠে আছে! ততোদিনে আমি থানায় রোজ যাই। সবাই আড়চোখে দেখবে দূরের কথা, সালামটা সবার আগে দেয়! সবাই বুঝতে পেরেছিলো, লোকটার মিসেস আমিই হতে যাচ্ছি! ব্যাপারটা আমার কাছে অন্যরকম লাগে। ছোট বেলার অভ্যেসটা আমার আজও আছে। নিজে রান্না করে টিফিন নিয়ে যাওয়া। যার মা নেই, তাঁর রান্নার চিন্তা নিজেরই করতে হয়। এই টিফিন এখন আর আমার কলেজ পর্যন্ত যায় না।

থানা হয়ে তাঁর পেট পর্যন্ত যায়! খাওয়া শেষে যখন বলে দারুণ হয়েছে, তখন আমি হাওয়ায় উড়ি! আসলে প্রিয় মানুষের জন্য কিছু রান্না করলে, সে খেয়ে যদি বলে দারুণ হয়েছে। তখন মনের সুখটা শুধু মেয়েরাই বুঝতে পারে! তাঁর সাথেই আমার প্রথম, রিকশায় চড়ে বিকালের নীল আকাশটা দেখা। সবুজ ঘাসে খালি পায়ে, শীতের সকালে সূর্যটা দেখা। বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে লাগানো। এক চায়ের কাপে দুজনের সন্ধা পার। একদিন তাঁর কোন বড় স্যারের বিবাহ বার্ষিকী। সবাইকে স্ত্রী সহ উপস্থিত হতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। থানায় সব পুলিশই বিবাহিত শুধু শোয়েব নামের লোকটা ছাড়া।

তাঁর সাথে আমি ছাড়া আর কে ই বা যাবে? সেদিনই আমি কী পড়বো, কী পড়বো না করতে করতে রাত করে ফেলেছিলাম। তাছাড়া আমি এমন করি না। ঠাস করে একটা জামা পড়ে ফেলি। চোখের সামনে যেটা থাকে সেটাই। সেদিন একটু বেশিই নিজের চেহারা দেখেছিলাম। অবশেষে গেলাম, পুরো বাড়ি সাজিয়েছেন লোকটা। সবাই উপস্থিত হতে হতেই রাত বারোটা! এরপরে গান, খাওয়া ইত্যাদি ঘরোয়া পার্টিতে যা হয়।

এর মাঝে কীভাবে যে রাত চারটে বেজে গিয়েছে কেউই টের পায়নি! সবাইকেই এই সময় যেতে মানা করেছেন। কমিশনার সাহেবের বাড়িতেই সবাই আলাদা আলাদা রুমে শুয়ে পড়লো! কিন্তু শেষে রুম একটাই আছে, বাকি আমি আর শোয়েব আল গাজী নামের লোকটা! না উপায় পেয়ে দুজনে এক রুমেই কিছু ঘণ্টা অতিবাহিত করার জন্য ঢুকলাম। এর পরে যা হয়েছে তা বলার প্রয়োজন পড়ে না! আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম যে, এখনো আমাদের বিয়ে হয়নি!এরপরে এরকম একটা বিষয় আমাদের কাছে এতোই স্বাভাবিক হয়ে গেলো সে কথাও না বলি!

হঠাৎ আমার মনে হলো, আমরা বিয়ে কেনো করছি না? তাঁর মা বাবার সাথে আমার কয়েকবার দেখা হয়েছে। উনারা নিজেই আমাকে একদিন বাড়িতে ডেকেছিলেন। আমাকে অপছন্দ করেনি। আমার বাবা তো তাঁকে ফেরেশতার মতো মানে। আর আমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসি! বিয়ের কথা তুলতেই সে যে মত উল্টে নিলো তা নয়। সব স্বাভাবিকই ছিলো। একদিন ভোরে সে ফোন দিয়ে ডাকলো।

কলেজ মাঠে তাড়াতাড়ি যেতে। আমি গেলাম। সে একটা মেয়ের দিকে আঙুল তুলে আমাকে বললো, “ মেয়েটার নাম জারা। তোমার থেকে বেশি সুন্দর তো নয়। তবে তোমার থেকে ভালো। আমি সরাসরি কথা বলতে পছন্দ করি তা তুমি জানো। এই মেয়েকেই আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি। আশা করি আজকের পর থেকে আমাকে আর বিরক্ত করবে না! সে মুহুর্তে আমার শরীর থেকে রুহ যেন বেরিয়ে গিয়েছে! শুধুই একটা রুহহীন শরীর নিয়ে আমি কীভাবে যে একথা শুনার পরেও দশ মিনিট দাঁড়িয়ে ছিলাম তা আজও বুঝতে পারছি না! আমার চেয়ে কেমন ভালো জানতে চাইলে সে সুন্দর করে উত্তর দিয়ে দেয়, “ সুন্দর মুহূর্তগুলো মনে রাখতে হয়, জীবনে নয়। তুমি জীবনে রেখে দিতে চাইছো! ”

অনেক বুঝানোর চেষ্টা করেছি। পেটের বাচ্চাটার কোনো অপরাধ নেই। তাঁর অধিকার আছে পৃথিবীতে আসার। সে শুনলো না। তারপর আমি কদিন হাসপাতালে ছিলাম জানি না। যেদিন পুরোপুরি সুস্থ হলাম। জানতে পারি সে বিয়ে করছে! আমি খুব শক্ত একটা মেয়ে। কিন্তু এই ব্যাপারটা আমি মেনে নিতে পারিনি। আমার মাথায় কী যে ঘুরছিলো আমি নিজেই জানতাম না।

শোয়েব সাহেবের বিয়েতে গেলাম কিছু কদম ফুল নিয়ে। লোকটার কদম ফুল খুব পছন্দ। হাতে পেয়ে নিশ্চিত শুঁকবে জানতাম। ঠিক কবুল বলার কিছুক্ষণ আগে তাঁর হাতে ফুলগুলো দিলাম। কে দিলো তা সে খেয়ালই করেনি! আগে শুঁকে কদমের ঘ্রাণ নিয়েছে! তারপর যা হওয়ার কথা। সে অজ্ঞান হয়ে গেলো। এর পরে কীভাবে তাঁকে কিডন্যাপ করলাম তা লিখতে চাইছি না। এটা সাহেবেরই একটা ভয়ানক কৌশল! আমাকে অনেক গল্প শুনিয়েছে এমন। সুতরাং আমার কাছে কাজটা খুব কঠিন কিছু না।

তাঁকে নিয়ে এক জঙ্গলে এলাম। শরীরের কয়েকটা বিভাগ আলাদা করলাম। চোখ দুটো আমার ব্যাগে করে নিয়ে আসলাম। লাশটার সাথে মেয়েটার বিয়ে হয়ে যাক। আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু এই চোখদুটো আমার, শুধুই আমার। আমিই শুধু এই দুচোখে হারাবো! ” শোয়েব সাহেবের লাশটার পাশে এই চিঠিটা পেয়েছিলাম। পুরোটা পড়া শেষ করে বুঝতে পারছি না। লাশটাকে কী আগে থানায় নিবো? না এখানেই পুঁতে রেখে যাবো! এতোগুলো হাড্ডি মানুষের শরীরে থাকে আমার গোয়েন্দাগিরির জীবনে আগে দেখিনি!

লাশটার এরকম নির্মম অবস্থার কথা আমি পুলিশকে বলিনি। অনন্যাকে খুঁজতে খুঁজতে সবাই হয়রান। অবশেষে আমি অনন্যার লাশ শোয়েব সাহেবের টেবিলের ভেতর থেকেই বের করেছি! লাশের বুকে শোয়েব সাহেবের দুটো চোখ! আত্মহত্যা না কেউ তাঁকে মেরে দিয়েছে তা আমি এই মুহূর্তে বুঝতে পারছি না। তবে আরেকটা চিঠি আমি দেখতে পাচ্ছি, শোয়েব সাহেবের চোখের পাশে। “ অপরিষ্কার হাতে চোখ দুটো স্পর্শ করবেন না!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত