তখন খুব ছোট্ট ছিলো আবির।বেশী না, মাত্র ৩/৪ মাস হবে।মৃত্যু কি জিনিস তা বুঝার তো কোনো উপায় এ ছিলো না। সামনে সাদা কাপড়ে জড়িয়ে থাকা একটি বস্তু আর ভেঙে পড়া মা কে দেখেও তার বুঝার কোনো উপায় নেই যে তার বাবা তার থেকে অনেক অনেক দূরে চলে গেছে।
তবে আবির না বুঝলেও সুমি ঠিকই বুঝতো যে বাবাহারা এই সন্তানকে লালন পালন করার দায়িত্ব এখন তার একার। কিন্তু কোনো উপায় দেখছিলো না সুমি। মায়ের কাছে গিয়ে তার কাছে বোঝা হতে চাইছিলো না সুমি।তাই মায়ের কাছে যাবে না।স্বামীর মৃত্যুর পর অনেকের সহানুভূতিই পেয়েছে।কিন্তু কারো কাছ থেকে সাহায্য পায়নি কিংবা তার আশাও রাখে না সুমি। পরিশেষে ঠিক করে যে নিজেই কিছু করবে। তাই তার মামা সাইফুল সাহেবের কাছে যায়।
সাইফুল, পুরো নাম সাইফুল ইসলাম সোহরাব। আল্লাহর রহমতে আর্থিকভাবে অনেক স্বচ্ছল। আর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যেও বিজোড় অতুলনীয়। উনি সুমির আম্মুর খালাতো ভাই।উনি গরিব দুঃখী বাচ্চাদের জন্য একটি ছোট্ট স্কুল চালান।স্কুলটির নাম ‘বিদ্যানিকেতন’। সুমি আবির কে কোলে নিয়ে মামার বাসায় গেলো।আবির তখন ৮ মাসের। সুমি মামার কাছে সব খুলে বললো। এরপর বললো,,,
~মামা তোমার যে একটা স্কুল আছে কী নাম যেন?
~ ‘বিদ্যানিকেতন’?
~হুম।মামা যদি তোমার আপত্তি না থাকে তাহলে আমাকে কি ঐখানে একটা চাকরি দিতে পারবে?আমি শুনেছি তুমি স্কুলটার জন্য কিছু নতুন টিচার নিয়োগ দিবে।
~সুমি কি বলতেছোস এগুলা।তুই এতো ভালো স্টুডেন্ট, এতো উচু ফ্যামিলির সন্তান আর আমি তোকে ঐ স্কুলে চাকরি দিতে যাবো?
~মামা আমার চাকরিটা খুব দরকার গো।
~আচ্ছা শুন, আমি তোকে আমার বিজনেস এর এসোসিয়েট ম্যানেজার হিসেবে নিয়োগ দিয়ে দিই।
~ না মামা, আমি এখনো ঐটার যোগ্য না।আমাকে তুমি ঐ স্কুলটাতেই ছোট-খাট একটা চাকরিতে নিয়োগ দিয়ে দাও।
অনেক বুঝানোর পরেও যখন সুমি মানলো না তখন ভাগ্নির আবদার রাখতে বাধ্য হলেন সাইফুল সাহেব।এক সপ্তাহ পর থেকে সে ঐ স্কুলে ইংরেজির শিক্ষিকা হিসেবে চাকরি শুরু করেন।আর এখান থেকেই সুমি শুরু করে এক নতুন জীবন। সুমি দিনে দিনে ঐ গরিব দুঃখী শিশু গুলোর সাথে আপন হতে থাকে আর এদিকে আবিরও আস্তে আস্তে বড় হচ্ছিলো। আবিরের বয়স তখন ৫ পেরিয়ে ৬ এ পড়েছে।তখন থেকেই শুরু করে দিয়েছে স্কুলে যাওয়ার জন্য বায়না।যখন আবির বলতো যে সে স্কুলে যাবে তখন সুমি হেসে হেসে বলতো,,,
~তুমি স্কুলে গিয়ে কি করবে?
~মা, আমি পড়ালেখা করবো।
~আর পড়ালেখা করে কি করবে?
~অনেক বড় মানুষ হবো।
~আর বড় মানুষ হয়ে কি করবে?
~মা, আমি তোমাকে পৃথিবীর সব সুখ এনে দেবো।তোমার আর কোনো কষ্ট থাকবে না। তোমাকে আর কোনো কাজ করতে হবে না।
এই ছোট্ট আবিরের মুখে এমন কথা শুনে যেন নিজের সব দুঃখ কষ্ট ভুলে যায় সুমি।একরাশ ভালোবাসা নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে আবিরকে। অবশেষে আবির কে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলো সুমি। ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলো আবির। কবে যে সময় ঝড়ের গতিতে হারিয়ে যায় বুঝাও যায় না। আবির এবার উচ্চা মাধ্যমিক পরীক্ষা দিলো। রিজাল্টের অপেক্ষায় আছে।আর সুমি এখন বার্ধক্যে পৌঁছে গেছে।এখন সুমির বয়স ৪৮। আবিরের রিজাল্ট পাবলিশ হলো।সেই জিপিএ-৫ পেয়েছে।ছুটে আসলো মা এর কাছে।
~আন্মু আন্মু আমি জিপিএ-৫ পেয়েছি। আবিরের মুখে এই সুখবর শুনে সুমি আলহামদুলিল্লাহ বলে অজু করে এসে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করলো।এরপর ছেলেকে কাছে টেনে কপালে চুমু দিয়ে বললো,,,
~আলহামদুলিল্লাহ বাবা এবার থেকে পড়ালেখাতে আরো মন দিবে।জীবনের অনেক বড় সাফল্য পেয়েছো।কিন্তু এতে দমিয়ে গেলে চলবে না।আরো এগিয়ে যেতে হবে। মায়ের কথা শুনে আবির কেমন যেন চুপ হয়ে গেলো।কিন্তু ছেলের মুখে হঠাৎ এই নিরবতার কারন বুঝলো না সুমি। কারন জানতে চাইলে আবির বলে,,,
~কিন্তু মা আমাদের যে আর্থিক অবস্থা তাতে তো আমার জীবনের লক্ষ্য পুরণ সম্ভব হবে না। সুমি একটা মৃদু হাসি দিয়ে বললো,,,
~বাবা তুমি কি হতে চাও।
~আম্মু আমার তো স্বপ্ন ছিলো আর্কিটেকচার এ পড়ার।কিন্তু এখন এই বলে আবির চুপ হয়ে গেলো।মুখে একরাশ হতাশা।সুমি বললো,,,
~কিচ্ছু হয়নি এখন।তুমি আর্কিটেকচারে পড়তে চাও তো?ইনশাল্লাহ আম্মু ব্যাবস্থা করছি।তুমি পড়ালেখাতে মন দাও।
যদিও ছেলেকে আশ্বাস দিয়ে দিয়েছে কিন্তু আসলেই সুমি এখন নিরুপায়। কেননা বাবা মা এর মৃত্যুর পর একমাত্র সম্বল ছিলো সাইফুল মামা।কিন্তু ওনার ও এখন আর্থিক অবস্থা ভালো না। আর অন্য কোনো উপায় ও নেই।পরিশেষে সুমি তার স্বামীর কিনা ফ্ল্যাটটি যা কিনা তাদের একমাত্র সম্বল ও বটে তা বিক্রি করে দিলো। আবিরকে এসে বললো,,,,
~বাবা এই নাও তোমার এডমিশন ফী।এরপরে যা যা খরচ লাগে আম্মুকে বলিও। আবির বিস্ময়মাখা কন্ঠে বললো,,,
~আম্মু তুমি এতো টাকা কিভাবে জোগাড় করলে?
~আমাদের ফ্ল্যাট টা বিক্রি করে দিয়েছি।
~কিন্তু মা তুমি থাকবে কোথায়?
~সে এক ব্যাবস্থা আল্লাহ তায়ালা করবেনই।তুমি পড়ালেখাতে মন দাও।
~কিন্তু…
~কোনো কিন্তু মিন্তু না, আমি যেন আমার ছেলেকে একজন আর্কিটেক্ট হিসেবে দেখতে পাই।
মায়ের কথা শুনে আবির মা কে জড়িয়ে ধরলো। আবির পাচ বছরের জন্য ইংল্যান্ড চলে যায়। এই দিকে ধীরে ধীরে বার্ধক্যের ভারে নুইয়ে পড়ছিলো সুমি।এখন সুমির বয়স ৫৩।আবির দেশে ফিরে আসলো আর্কটেক্ট হয়ে।এসেই মায়ের কাছে বলল,,,
~ মা কেমন আছো।
একটু বিস্মিত হলো সুমি।কেননা আবির আগে সর্বদা এসে মায়ের পা ধরে সালাম দিতো।হয়তো এবার ভুলে গেছে ভেবে সুমি বললো,,,
~আলহামদুলিল্লাহ। তুমি কেমন আছো বাবা?
~আম্মু আমি ভালো আছি।জানো আজকে তোমার সাথে দেখার করানোর জন্য কাকে এনেছি?
~কাকে? আবির একটা মেয়েকে বাসায় আনলো।
~আম্মু ও হলো শাহিন।আমরা একই ভার্সিটিতে পড়েছি।আমরা একে অপর কে খুব ভালোবাসি।আমরা বিয়ে করতে চাই।
আবিরের কথা শুনে সম্পুর্ন ভাবে বিস্মিত হলো সুমি।কেননা ও এইটা শুনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। কি বলবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলো না।অতপর সন্তানের ইচ্ছা পুরনের জন্য বিয়েতে রাজি হয়ে গেলো সুমি।
কিন্তু দিনে দিনে কেমন জানি আবির এর ব্যবহার পাল্টে যাচ্ছিলো। আগের মতো মায়ের খোজ খবর নেয় না।বাসায় থাকলেও মায়ের সাথে কথা বলে না।ছোট খাটো বিষয়াদিতেও মায়ের সাথে কর্কশ ভাষায় কথা বলে।কেমন যেন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্ল করে কথা বলে।সুমি এই সবের কারন বুঝতে পারলেও সব সময় নিজে নিজেকে বলতো যে সে যা বুঝেছে তা ভূল বুঝেছে, তার আবির এরকম হতে পারে না। কিন্তু নিয়তি হয়তো সুমার পক্ষে ছিলো না।একদিন আবির এসে বললো,,,
~আম্মু তোমার সাথে একটা কথা আছে।
~কী কথা আবির?
~ঘরের অবস্থা তো তুমি দেখছোই।বাসায় আমি ও থাকি না শাহিন ও থাকে না।তুমি তো পুরোই একা হয়ে যাও। সুমি ভাবলো যে আবির বোধহয় মায়ের কষ্ট বুঝতে পেরেছে। তাই এসেছে একটু মায়ের সাথে কিছুক্ষন কথা বলতে।সুমি বললো,,,
~হুম।
~এখন আম্মু আমি তোমার এই সমস্যার একটি সমাধান বের করেছি। সুমি ভাবলো যে আবির এখন থেকে আবার আগের মতো করে তাকে সময় দিবে।সুমি তো মনে মনে আনন্দে একাকার।সে বললো,,,
~কী সমাধান বাবা?
~আম্মু আমি তোমাকে একটা খুব উন্নতমানের বৃদ্ধাশ্রম এ পাঠাবো।আমি তাদের সাথে কথা বলে নিয়েছি।ওখানে তোমার খাওয়া দাওয়ার সব ব্যবস্থা করে দিয়েছি।খরচ নিয়ে তুমি একটুও চিন্তা করো না। আবিরের কথা শুনে সুমি যেন রীতিমতো জীবন্ত এক লাশ হয়ে গেলো।তার আবির তাকে দূরে পাঠিয়ে দিচ্ছে।তার আবির তাকে বৃদ্ধাশ্রম এ পাঠিয়ে দিচ্ছে।সুমি মনে মনে হাজারো বার বলছে যে
~আবির আমার অন্য কিছু লাগবে না, খাওয়া দাওয়া কিচ্ছু না, আমি শুধু আমার ছেলেটার পাশে থেকে ওকে একটু দেখতে চাই। কিন্তু কথা গুলো সুমির মনের ভিতরেই রয়ে গেলো। বলতে পারলো না আবির কে। পারেনি কেননা হয়তো এখানেও নিজের থেকে ছেলের সুখটাকেই বড় ভেবেছে সুমি।
দুই সপ্তাহ হয়ে গেলো সুমির বৃদ্ধাশ্রম এ আসলো যে।আজো সেই ঐদিন গুলোর কথা ভেবে নিরবে চোখের জল ফেলে যখন আবির বলতো,,”মা, আমি তোমাকে পৃথিবীর সব সুখ এনে দেবো।তোমার আর কোনো কষ্ট থাকবে না। তোমাকে আর কোনো কাজ করতে হবে না।