বউয়ের গায়ে হাত দিতেই ছ্যাত করে বলে উঠলো, ‘আন্নে এহন মোর গায়ে টাচ করবেন না। এত্ত ভালবাসন দেহানের দরকার নাই। আন্নের কি রোজা রমজানের বালাই নাই?’ আপন বউয়ের মুখে এমন কথা শুনে মন খচ খচ করতে লাগলো। একে তো মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে, তারপর ভাষার আঞ্চলিকতার টানে, রাগে পিত্তি জ্বলে গেল। কতবার বলি শুদ্ধ করে কথা বলবি, তাও কথা কানে তুলে না। বিয়ের কয়েকটা মাস পার হল, তারপরও বুঝলো না, কোন স্পর্শ কোন ইঙ্গিতকে ইশারা করে। মন খারাপ করে উল্টো দিকে মুখ ঘুরে শুয়ে পড়লাম। এমন একটা মেয়েকে গলায় ঝুলিয়ে দিলো।’ মাকে মনে মনে দোষারোপ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
মসজিদের মুয়াজ্জিনের কর্কশ কন্ঠে ঘুম ভেঙ্গে গেল। এই মহসীন শাহ লোকটা শুধু আজানটা ঠিকমত দিতে পারে, আর অন্যকিচ্ছু পারে বলে মনে হয় না। কথার মাঝে কোন রসকস নেই। এমন ভঙ্গিতে কথা বলেন, মেজাজ গরম হয়ে যায়। মসজিদের মাইক থেকে ভেসে আসছে, “আল্লার প্রিয় বান্দারা, আন্নেরে হক্কলে উডি যান, খানা পাক করুন, সেহেরি খান, রোজা রাখেন।” কাঁথা মুড়িয়ে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করছি, চোখটা লেগেও আসছিল এমন সময় আবার মসজিদ থেকে মহসীন শাহের গলা খাঁকাড়ি। কাঁচা ঘুম ভাঙ্গিয়ে দেওয়ার রাগে মুখ ফসকে দু চারটা গালি বেরিয়ে গেল। এতে বোধহয় শয়তান খুশিই হল ঘুম আসছে না, বিছানায় এপাশ ওপাশ করছি। সুমু এসে বললো,
-ও মশাই! উঠেন না ক্যান! ব্রাশে পেস্ট লাগায় রাখছি। ফ্রেশ হয়ে খেতে আহেন।
=তুই এখান থেকে যা। বিরক্ত করিস না। মেজাজ খারাপ আছে। আমি রোজাটোজা রাখি না।
-আপ্নে এমন করেন ক্যান? সবাই একলগে খাইতেছে।
=ধর্মকর্ম আমার দ্বারা হবে না। তুই যা তো এখন…
-আপ্নেরে ছাড়া আমার খাইতে ইচ্ছে করে না। আপ্নের রোজা থাওন লাগবো না, চলেন একলগে খামু। পরে রোজা ভাইঙ্গা ফেলবেন।
সুমু হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেল। ওর সাথে যতই তুইমুই করি না কেন মন থেকে অনেক ভালবাসি। আমার তুইমুই করতে ভালোই লাগে। খাবার টেবিলে আমায় দেখে সবাই অবাক। একে অন্যের দিকে চাওয়া চাওয়ি করছে, কেউ কিছু বলছে না। মৌ মুচকি মুচকি হাঁসি চেপে বললো, ভাইয়া তুই..? আগে কত ডাকতাম, উঠতি না। আর এইবার…! সুমু আগবাড়িয়ে বলে উঠলো, ‘আমি তো এতদিন ছিলাম না। তাই যা খুশি করছে। এখন তো পড়ে পড়ে ঘুমানো চলবে না। তোমার ভাই আজ থেকে রোজা থাকবে, নামাজ পড়বে।’ বাবা খাবার টেবিলে ছিল বিধায় কাউকে কিছু বলতে পারলাম না। চুপচাপ সেহেরি শেষ করে ঘুমাতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। তখন সুমু বাবাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলছে, বাবা নামাজে যাওয়ার সময় আপনার ছেলেকে সাথে নিয়ে যাবেন।
সুমু ঘরে এসে ড্রয়ার খুলে নতুন পাঞ্জাবি পায়জামা বের করে আমায় দিয়ে বললো, ‘আমার প্রথম টিউশনের টাকায় কেনা আপনার জন্য এই ছোট্ট উপহার। প্রায়শই আপনাকে দেবার অসিলা খুঁজতাম, কিন্তু যুতসই একটাও পাই নি। তবে আজকের চেয়ে ভালো সুযোগ বোধহয় আর পাবো না। এটা পরে দিন। জানেন, আমার বরকে ঘিরে একগাঁদা লালিত স্বপ্ন ছিল, আমার বরটা হবে পৃথিবীর সেরা বর। কিন্তু আপনি…..। আজ আমায় কথা দেন, আপনি আমার সেরা বর হবেন?
বাবার পিছু পিছু নামাজের উদ্দেশ্যে বের হলাম। না বের হয়ে উপায় নেই। আজ সবকিছুই আমার মতে বিরুদ্ধে হচ্ছে। কোনকিছুই এড়িয়ে যেতে পারছি না। বাবা আর আমি আগাপিছু হয়ে হাটছি, অথচ কেউ কথা বলছি না। দুজনই কেমন অস্বস্তিকর সময় পারছি। আজ থেকে কয়েক বছর আগে বাবার সাথে আমার ভীষণ মনোমালিন্য হয়, এর থেকে একান্ত প্রয়োজন ছাড়া কথা বলি না। আজ কেন জানি বাবার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। মনের মাঝে পুষে রাখা সকল মান অভিমান ভুলে গেলাম। পেছন থেকে কয়েক কদম জোরে হেটে বাবার পাশে এসে বাবার হাতের মধ্যে আঙুল পুরে দিলাম। আমার আঙুল জোড়া বাবা শক্ত করে ধরলেন, হঠাৎ এক শীতল দমকা বাতাস হৃদয় ভেদ করে গেল। মনে হল, শরীর থেকে পাপের বোঝা নেমে যাচ্ছে। মনটা হালকা বোধ করলাম। স্মৃতির পাতা খুলে বিশ বছর পিছনে চলে গেলাম। এক অবুঝ শিশু বাবার হাত ধরে হেলতে দুলতে নামাজ পড়তে যাচ্ছে।
মসজিদে অনেকেই আমায় দেখে বেশ অবাক হলেও কেউ কিছু বললো না। এজন্যই মসজিদকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠঘর বলে এখানে কেউ কাউকে উপহাস করে না, হিংসে করে না। সাদা-কালো, ধনী-গরিবের ভেদাভেদ থাকে না।। মসজিদ থেকে ফেরার পথে আমার গল্পপ্রিয় বাবা আমার হাত ধরে বকবক করতে লাগলেন। কত সাবলীলভাবে কথা বলছেন। অথচ আমি কতগুলো বছর একই ছাদের নিচে থেকেও অসামান্য দুরত্ব তৈরি করে রেখেছি। বাবা আমার সাথে কথা বলতে চাইলেও এড়িয়ে গেছি বহুবার। আজ বাপবেটার মিলনে জয় হল পরের বাড়ির লক্ষ্মী একটা মেয়ের।
বাসায় ফিরে দেখি সুমু সমধুর কন্ঠে কুরআনের তেলাওয়াত করছে। সুমুর মাত্রাতিরিক্ত ইসলাম প্রীতি মনোভাবের জন্য আগে কতবার রাগ করেছি। কিন্তু সে সবকিছু উপেক্ষা করে আমায় মন উজাড় করে ভালবেসেছে। কখন কি প্রয়োজন সবকিছু আগে আগেই গুছিয়ে রাখে। বাবা মায়ের দেখাশোনা, ননদের প্রতি আদর যত্নে পুরো পরিবারটিকে একাই আগলে রেখেছে। সুমু আর মৌ’কে পাশাপাশি দাঁড় করালে কেউ বিশ্বাস করবে না, এ বাড়ির বউ আর ননদ।
সুমু কোরআন পড়ছিল, আমি পাশে গিয়ে বসলাম। সে পড়া থামিয়ে আমার কাঁধে মাথা রাখলো, আমি তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে অনুভব করলাম, আমি পৃথিবীর সেরা বউটা পেয়েছি। কিন্তু সেরা বর হতে পারি নি।
রাগচটা, উগ্র স্বভাব বদলে দিনকে দিন আমার ইসলাম প্রীতি বেড়ে যাচ্ছে। সুমুর জন্যই এই বাড়িতে এত পরিবর্তন। বাবা মাকে নামাজের জন্য ঘুম ভাঙিয়ে দিবে। ননদিনীর সাথে খুনসুটিতে মেতে থাকবে। ফরজের নামাজ শেষে সুমু আমার এক ঘন্টার টিচার। আমাকে রোজ আরবী কায়দা বই পড়ায়। আমার এই অলস মস্তিষ্কে কোরআনের বাণী ডুকানোর নিরন্তর প্রয়াসে আমি অভিভূত হয়ে যাই। একটা মেয়ে কতটা লক্ষ্মী হলে, একটা নতুন পরিবারকে কতটা আপন করে নিতে পারে, তা লিখে প্রকাশ করার সাধ্য আমার কলমের নেই।
আমার অবসর সময়ে ইসলামিক বইগুলো নিয়ে বসি। অজানাকে জানার চেষ্টা করি। তবে আমার বরাবরের মত দুষ্ট বুদ্ধি সবসময় বউ জব্দ করার উদ্বৃতি খুঁজে ফিরে। রমজানের এক বিকেলে বই নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করছি, হঠাৎ চোখে পড়লো বউ জব্দের হাদিস। সুমু তখন ঘরের মধ্যে কাজ করছিল, আমি জোরে জোরে পড়া শুরু করলাম “আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন, যখন কোনো স্বামী তার স্ত্রীকে শয্যা গ্রহণ বা মিলনের জন্য আহবান জানায়, কিন্তু স্ত্রী তা অস্বীকার করায় স্বামী তার ওপর ক্রুদ্ধ হয়ে রাত কাটায়, তখন ফেরেশতাগণ সকাল পর্যন্ত ঐ স্ত্রীর ওপর অভিশাপ দিতে থাকে। (সহীহ বুখারী; সহীহ মুসলিম; মিশকাত, হাদীস নং ৩২৪৬)
সুতরাং স্ত্রীর কর্তব্য হবে স্বামী ডাকামাত্রই তার ডাকে সাড়া দেওয়া। রাসুলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন, যখন কোনো পুরুষ তার স্ত্রীকে মিলনের জন্য ডাকবে, তখনই যেন সে তার ডাকে সাড়া দেয়। এমনকি সে যদি ক্বাতবের পিঠেও থাকে। (যাওয়াইদুল বাযযার ২/১৮১ পৃ; সহীহুল জামে, হাদীস নং ৫৪৭) ‘ক্বাতব’ হচ্ছে, উঠের পিঠে রাখা গদি যা সওয়ারের সময় ব্যবহার করা হয়ে থাকে। স্বামীরও কর্তব্য হবে, স্ত্রী রোগাক্রান্ত, গর্ভবতী কিংবা অন্য কোনো অসুবিধায় থাকলে তার অবস্থা যথাযথভাবে বিবেচনা করা। এতে করে তাদের মধ্যে সৌহার্দ্য বজায় থাকবে এবং মনোমালিন্য সৃষ্টি হবে না।” একটানে পড়া শেষ করলাম, অথচ সুমুর এদিকে নজর নেই। আমি আবার উচ্চস্বরে বললাম, ‘কেউ যদি আমার কথা না শুনে সে কিন্তু স্বামীর অবাধ্য। আর সে জানে না যে, ‘স্বামীর পদতলে স্ত্রীর বেহেশত।’ সুমু এবার জবাব দিল,
-কই পাইছেন এই হাদিস?
=এটা পাওয়ার কি আছে। সবাই তো জানে।
-জি না। ভুল জানেন।
এমন কোন হাদিস নেই। তবে পুরুষের সম্মানার্থে এমন হাদিস আছে যে ” যদি আমি কাউকে নির্দেশ দিতাম আল্লাহ ব্যতীত অন্যকে সিজদা করার, তাহ’লে স্ত্রীকে নির্দেশ দিতাম তার স্বামীকে সিজদা করার জন্য।” (ইবনু মাজাহ হা/১৮৫৩; সহীহাহ হা/১২০৩।) এবার বুঝছেন মশাই??
=হু। বুঝলাম। আমি যেটুকু পড়লাম, সেটুকু তো আর অস্বীকার করতে পারবে না।
-হুম।
=আমার তো ভালবাসার ঘাড়তি শুরু হয়েছে। তো কিভাবে পোষাবে?
-এই যে মশাই। রমজান শেষ হলে ভালবাসা বাড়তি দিয়ে পুষিয়ে দিবো।
সুমু এই রমজানে তিন খতম কোরআন পড়বে নিয়ত করেছে। তাও মনে ভীষণ আপসোস, আগের মত পড়তে পারছে না। সংসারের কাজকর্মের চাপে পড়ার সময় পাচ্ছে না। বিয়ের পূর্বে নাকি পাঁচ খতম কোরআন পড়তো। আমি যেখানে আধাঘন্টা আমপারা পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি, সেখানে সে ঘন্টার পর ঘন্টা কোরআন পড়ে। এই মেয়েটা এত ধৈর্য পাই কি করে, নিশ্চয়ই আমি এক টুকরো জান্নাত পেয়েছি।