বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে চাকুরি করি প্রায় পাঁচ বছর হল।বাসা থেকে অনেক মেয়ে দেখছে আমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য ।আমিও অনেক মেয়ে দেখলাম কিন্তু কোন একটা ঝামেলায় পরে বিয়ে পর্যন্ত এগোয় না।মনে মনে ভাবলাম এবার ঈদের ছুটিতে বাসায় গিয়ে বিয়ে করে আসব।কাঙ্ক্ষিত ছুটিতে বাসায় গেলাম।দুই দিন পর মা বলল কাল একটা মেয়ে দেখতে যাব ।মেয়েটা অনেক সুন্দরী ইন্টারে পড়ে বলে একটা ছবি এনে হাতে ধরিয়ে দিল।আমি অপলক দৃষ্টিতে মেয়েটার ছবির দিকে তাকিয়ে আছি।মায়াভরা মুখে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে।মন্ত্রমুগ্ধের মত অনেকক্ষণ ছবিটা দেখলাম।
পরেরদিন মাকে সাথে নিয়ে চললাম মেয়ে দেখার জন্য।বাসায় গিয়ে দরজায় নক করলাম।সাথে সাথে দরজা খুলে দিল একজন মধ্যবয়সী ভদ্রলোক ।অনেক বড় বাড়ি চারপাশে অনেক গাছ।ড্রয়িং রুমে বসতে দিল আমাদের।একটু পরেই মায়াবী মেয়েটা সবুজ শাড়ি পরে মাথায় ঘোমটা দিয়ে আস্তে আস্তে আমাদের সামনে আসলে মা বসতে বলল।সাথে সাথে মেয়েটা বসে পড়ল। তারপর শুরু হল আমার মায়ের ইন্টারভিউ ।বলল মা তোমার চুল কত বড়?একটু বের করে দেখাও?তারপর দাঁত গুলি বের কর তো ?এসব প্রশ্ন আমার কাছে খুব অমুলক আর অসস্ত্বিকর মনে হল।মাকে বললাম মা এখন একটু মেয়েটাকে মুক্তি দাও।
মা আমার দিকে চোখ কটমট করে বলল তুই চুপ কর।বয়স কম কিছুই বুঝিস না তুই।কোন কথা বলবি না।আমি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে দেখলাম নিরুপায় হয়ে মা এর আদেশ গুলু পালন করে যাচ্ছে ।তারপর মা এক অদ্ভুত কাজ করে বসল একটা প্লেটে পানি নিয়ে মেয়েটার খালি পা ডুবিয়ে তারপর হাটতে বলল ফ্লোরের উপরের পায়ের ছাপ গুলু গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল।আমি মেয়েটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি গভীর কালো দুটি চোখ।হলদে ফর্সা গোলগাল মুখমণ্ডলের উপরে একগুচ্ছ চুল ফ্যানের বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে ।
মুখটাতে এক ধরনের গভীর মায়া মায়া ভাব।দৃষ্টি নিচের দিকে।আগেই জেনেছিলাম নামটা শিশির।মায়ের দিকে তাকাতেই দেখলাম মুখে কালো রেখা।আমি ভাবলাম নিশ্চয়ই মা কোন একটা খারাপ গুন খুজে পেয়েছে ।একজন মহিলা বলল আপা ছেলে মেয়ে দুজন একান্ত কিছু আলাপ করুক।সাথে সাথে মা বলল আরে না আজকে না অন্য একদিন করবে।আমি বললাম না মা আজকেই।দেখলাম মা মুখে একরাশ বিরক্তির ভাব এনে বলল আচ্ছা যা।আমি সোজা গিয়ে বললাম দেখেন আমার বয়স আপনার চাইতে হয়তো পাঁচ বছরের বেশি হবে ।
আর এত ভনিতা করে লাভ নেই ।আমার আপনাকে পছন্দ হয়েছে এখন আপনার কথার উপর সব নির্ভর করবে।আর বললাম নাম্বার দিলে ভাল হত।বাকি কথা ফোনেই বলা যেত।বলার সাথে সাথে বলল ঠিক আছে নাম্বার লিখেন।আমি নাম্বার সেভ করলাম।বললাম এখন যাই মা আবার রাগ করবে।মায়ের কাছে আসা মাত্রই মা সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসলেন।আমরা পা বাড়ালাম বাড়ির দিকে।মা কে দেখলাম বেশ গম্ভীর রাস্তায় কোন কথা হল না।বাড়িতে আসার পর মা বললেন কাল যাব একটা মেয়ে দেখতে তোর খালু খোঁজ দিয়েছে ।
আমি বললাম মানে কি?এই মেয়ের কি ভুল বের করলা?মা বলল আরে মেয়েটা অলক্ষি ।আমি বললাম কেমনে বুঝলা।একটু গলার শ্বাস টেনে নিয়ে বলল দেখলি না পায়ের ছাপ মাঝখানে কাটা?আমি বললাম ও সব কুসংস্কার বাদ দাও তো।আমি অনেক মেয়েকে দেখছি একপা নেই কিন্তু অনেক বড় চাকুরি করে।মা বলল তুই তোর লেখচার বাদ দে।কাল আবার মেয়ে দেখতে যাব ঐ মেয়ের চিন্তা বাদ দে।আমি স্বর কঠিন করে বললাম তুমি বাদ দাও তোমার প্রতিদিন মেয়ে দেখার ব্যাবসা আর তোমার মেয়েকে কেউ এমন অলক্ষি বললে তোমার কেমন লাগত ? প্রতিদিন আমার আর এসব ভাললাগে না বলে মায়ের উত্তরের অপেক্ষা না করে সোজা রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিলাম।
শুয়ে শুয়ে চিন্তা করলাম এ কেমন নিয়ম নীতি একজন মেয়ের পা কে ঘুঘু পা অলক্ষি পা এগুলো বলা।সে কি বাজারের গরু যে কোরবানি দেওয়ার জন্য কিনতে গেছি ।বিন্দুমাত্র খুঁত থাকা যাবে না।সতের আঠারো বছর বয়স্ক একজন গ্রামের মেয়ে কত সংগ্রাম করে বড় হয়েছে তার উপর আবার বাবা মা কেউ নেই মামার বাসায় থাকে ।মামারা উঠেপড়ে লেগেছে বিয়ে দেওয়ার জন্য হয়তো আগে অনেকেই অলক্ষি বলে বিয়ে ভেঙে দিয়েছে । হয়তো অলক্ষি বলে মামির কত গালি হজম করেছে আল্লাহ্ ভাল জানে । মেয়ে টিকে যখন মা প্রশ্ন করছে সাথে সাথে উত্তর দেওয়ার ধরন দেখে আমার মনে হল কতটা সতর্ক হয়ে উত্তর দিল।মনে হয় মাকে খুশি করার জন্য সে জীবন দিবে। পরে ভাবলাম হয়তো আমার দাদি মাকে দেখতে গিয়ে এমন পরিক্ষার মধ্যে ফেলেছিল । রাতে ফোন দিলাম শিশিরের কাছে সাথে সাথে ফোন রিচিভ হল ।ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ শুনলাম।মা হয়তো ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে মেয়ে তাদের পছন্দ না।একটু পর বলল সরি ।আমি বললাম সরি বলার কিছু নেই।আপনাকে একটা প্রশ্ন করছিলাম উত্তর বলেন।
শিশির বলল কি আর বলব জন্মছি গলায় নিয়ে নরকের হার ।আমার কথার কোন মূল্য কেউ কখনও দেয়নি।আমি অলক্ষি সবাই বলে আমার জন্যই আমার বাবা মা মারা গেছে।বলেই অনেক কান্না শুরু করল আমি বললাম আরে থামুন ।আমি বললাম উত্তর টা দিবেন? বলল আসলে আমি প্রথম কাউকে দেখলাম যে আমার কাছে মতামত চেয়েছে। আমাকে কেউ একটু খানি সম্মান করলে মন চায় তার জন্যে নিজের জীবন উৎসর্গ করে দেই। তারপর বলল সব সুতোই চায় তাকে দিয়ে মালা গাঁথা হোক ফুলের সুবাসের অপেক্ষা করে কিন্তু কয়টা সুতোর সে ভাগ্য হয় বলেন? আমি বললাম যদি আমি আপনার সুতো দিয়ে বকুল ফুলের মালা গেঁথে সারা জীবনের জন্য রেখে দিলে আপনার ফুল স্বার্থক হবে?
সে বলল আসলে সেইটা অসম্ভব কারন আপনার মা বলে দিয়েছে ।আমি একটু চিন্তা করে বললাম আচ্ছা মা যদি আবার অসম্ভব টাকে সম্ভব করে তাহলে?সে বলল আরে না আমি বড় অলক্ষি ।জানেন না পাঁচ বছর বয়সে বাবা -মা কে রোড অ্যাকসিডেন্টে এক সাথে হারিয়ে ফেলি ।অলক্ষি বলেই তো সে দিন আমি শুধু একাই বেচেছিলাম।আমি তার কথা নিরবে শুনলাম। বললাম মৃত্যু কখন হবে জানি না তবে বেঁচে থাকলে আপনার সুতোয় আমার ফুল গুলো গাঁথব।প্রতিজ্ঞা করলাম বলে ফোন রেখে দিলাম মা ডাকছে খাওয়ার জন্য ।খাওয়ার সময় আবার মা বলল দেখ বাবা তুই আমার একমাত্র সন্তান ।কিভাবে আমি তোকে অমন অলক্ষির সাথে বিয়ে দেই?আমি বললাম মা তুমি কি তার ভাগ্য গড়ে দিয়েছে?নাকি তার ভাগ্য তুমি দেখতে পাচ্ছ স্পষ্ট? দয়া করে ঐ মেয়ে সম্পর্কে আর খারাপ কথা বলবা না।
পরের দিন ফোন দিয়ে আমি বললাম এক কাজ করেন আপনি আর আমি পালিয়ে যাই।দুজন একসাথে থাকব।সে বলল অসম্ভব ।শুনেন আমি সারাজীবন বাবা মার আদর বা শাসন কোনটায় পাইনি।আমার ইচ্ছে বিয়ের পরে শশুর শাশুড়ির ভিতরে নিজের বাবা মার ছায়া খুজে নিব।আমি বললাম তারা যদি সবসময় বকা দেয় তাহলে কি করবেন? সে বলল সেইটা আমি মেনে নিব বাবা মা তো যা ইচ্ছে করতেই পারে। আমি এক মিনিট নিরব থাকলাম।মেয়ে মানুষ কতটা মমতাময়ী সহ্যশীল হলে বলে শশুর শাশুড়ির মধ্যে বাবা মা কে খুঁজে নিবে।আর এ সমাজ কি দেখে একটা মেয়েকে অলক্ষির কাতারে ফেলে দেয়।
বাবা মাকে গিয়ে কঠিন ভাবে বললাম শিশির ছারা অন্য কোন মেয়েকে আমি বিয়ে করব না।প্রয়োজনে সারা জীবন অবিবাহিত থাকব।আমার কথা শুনে বাবা মা বেশ ভড়কে গেল । তারা জানে আমার মত একগুঁয়ে জেদী ছেলে আর দ্বিতীয়টি নেই।মা কোথায় যেন ফোন দিয়েছে বিয়ের দিন তারিখ নিয়ে কথা বলছে।ভাবলাম জেদ থেকেই যদি একটা কুসংস্কারের পতন ঘটে তাহলে এই জেদ ভাল।একটু পর শিশিরের ফোন ।রিছিভ করতেই কান্নার শব্দ পেলাম।শব্দটা ভালোই লাগছে কারন এটি খুশির কান্না ।এমন কান্না সারাজীবন ই শুনে যেতে চাই।