বিনি সুতোর মুক্তার মালা

বিনি সুতোর মুক্তার মালা

কয়েকদিন ধরে ই খেয়াল করছিলাম ছোট ভাইটা বইয়ের মধ্যে কিছু একটা লুকিয়ে রাখছে আবার সেটা বার বার দেখছে লুকিয়ে লুকিয়ে। বিষয়টা আমার কাছে অদ্ভুত বা সন্দেহজনক হলেও তেমন একটা খেয়াল করলাম না। আসলে খেয়াল করার মত তেমন একটা সময়ও নেই। সকালে নামাজ তিলওয়াত নাস্তা করে কলেজে। কলেজ শেষ হলে কোচিং। এসব করতে করতে বিকেল শেষ হওয়ার পথে বাড়ি আসি। এসে আবার খেয়ে হয় একটু ঘুমাই আর না হলে চাচা তো বোনদের সাথে গল্প আড্ডায় সময় কাটে। আমাদের যৌথ পরিবার। রাতেও পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকি আর ঠিক তখনি খেয়াল করি এসব। কিছু বলতে চাইলে ই বা বললে ই কিরকম এড়িয়ে চলে কথা গুলো। মাত্র ক্লাস সেভেনে পড়ে। সন্ধ্যায় পড়ছিলাম হঠাৎ ভাইটা প্রশ্ন করল আপু, ১৪ ই ফেব্রুয়ারি কি দিবস রে? উত্তর দিতে গিয়ে ই ভ্রু কুচকে বললাম এত জানার দরকার কি না জানলেও চলবে।

আমার কথা শোনে হো হো করে হেসে বলল, জাতীয় সুন্দরবন দিবস এটাও জানো না..! কথাটা শুনার পর ওকে কি বলব আর ভেবে পেলাম না। এমনি তে সে পড়ালেখায় তুখোর ছাত্র মেধাবী কিন্তু কেমন জানি একটু বোকা টাইপ আমার মনে হয়। কিন্তু গত কয়দিনে আমার ধারণাটা পাল্টাতে শুরু করল। প্রথমত, সে স্কুল থেকে এসে ই কখনো ভাত খাওয়ার কথা বলেনা এমনকি মাও জোড় করে খাওয়াতে পারে না। তাকে টিফিনের টাকা দেওয়া হয় সেখানে স্কুল ক্যান্টিনে নাকি ভালো খিচুরি রান্না হয় খায়। কিন্তু এই কয়দিন তার বিপরীত হল। ঘরে এসে ই খিদে লেগেছে বলে ই মায়ের আঁচল ধরে।

সেদিন ক্লাস শেষে বিকেলে বাড়িতে ফিরছি তখন তাদের স্কুলও ছুটি হয়েছে হঠাৎ খেয়াল করলাম সুয়েব একটা মেয়ের সাথে বেশ হাসিখুশি লাজুক ভাবে কথা বলে হেটে হেটে আসছে । হ্যা হতে পারে মেয়েটি তার ক্লাসমিট বা ভালো বন্ধু কিন্তু কেন জানি আমার মাথায় একটা পোকা বাসা বেঁধেছিল তার কথাবার্তা ধরণ কিছুটা অন্যরকম লাগছিল। কারণ অনেক সময় আমার চাচীরা ওকে উনাদের বাবার বাড়ি নিয়ে যেতে চাইলে যায় না। বলে ওখানে বেশি মেয়ে মানুষ লজ্জা করে। বেশ কিছু ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে আমি অনেকটা চিন্তিত হলাম। মা’কে এসব বলে কিছু হবে না শুধু শুধু বাড়তি ঝামেলা। তার উপর আবার সাহেবের বাজারেরও শখ হয়েছে ইদানিং।

মা বা চাচীরা কোনো দরকারে পাড়ার দোকান অব্দি তাকে পাঠাতে পারতেন না সেখানে সে স্বেচ্ছায় বাজারে গিয়ে টুকটাক জিনিষ আনছে। দাদার দরকারী জিনিষ এনে দিচ্ছে অনায়াসে। আর বই বা ব্যাগে কি যেন করছে। আজ আমাদের পরিবারের খুব বড় একটা দিন। বলা যায় উৎসব সরুপ। কারণ দাদা এই দিনটা কে উৎসবের মত ই পালন করেন। আজ আমার ছোট ভাইটার জন্মদিন। আর উৎসব বললাম কারণ আমাদের পরিবারে সোয়েব ই একমাত্র ছেলে। মানে আমার বাবা চাচারা চার ভাই। এই চার ভাইয়ের মধ্যে আর কারো ই ছেলে সন্তান নেই। আমরা সব মিলিয়ে দশজন বোন।

দাদার ভাষ্যমতে একমাত্র বংশের প্রদীপ আমার এই ছোট ভাইটি। তাই তার জন্মদিনে দাদা গ্রামের সবাইকে উপহার সহ কাপড় খাবার দাবার দেন। গ্রামের সবার কাছে দিনটি অনেক বড় উৎসব। যখন সোয়েব এর বয়স একবছর পূর্ণ হয় সেদিন দাদা প্রথম খুশি হয়ে আমাদের বোনদের ডেকে কার কি ইচ্ছা জিজ্ঞেস করেছিলেন। সবাই অনেক কিছু বললেও আমি বলেছিলাম আমি ঐ বড় স্কুলে পড়াশোনা করব। সেই থেকে আমার পড়ালেখা এতদূর না হলে দাদা আমার বোনদের পড়ালেখার প্রতি মোটেও মনযোগী নয়। উনি সেই আগের মানুষ মেয়েদের এত পড়ালেখার দরকার নেই। যখন ই দাদা গ্রামের গরীব দুঃখিদের খাইয়ে তাদের হাতে বাকি জিনিষগুলো তুলে দিবেন তখন ই আমার তের বছরের ভাইটি বলল, দাদা একটু দাড়াও।

এই বলে ই সে ঘরের ভিতর থেকে কি যেন আনল। বেশ বড়সড় একটা ব্যাগ নিয়ে ঢুকল সে। ব্যাগ থেকে একটা একটা প্যাকেট বের করা শুরু করল। দাদা তাকিয়ে আছেন। বাবা জিজ্ঞেস করলেন এগুলা কি? সে বলল, দাদা তুমি সবসময় বাইরের মানুষের খেয়াল রাখো খুব ভালো তুমি। কিন্তু আমাদের ঘরে যে মানুষগুলো আছে একটুও খবর নাও না তাদের। আর কিছু না বলে ই সে এক এক করে প্যাকেট টা দিতে লাগল। বড় আপুকে উনার শখের এমব্রয়ডারি নকশা করা একটা ওড়না, মেজো আপুকে ভাইবোনের সুন্দর একটা শো-পিস দিল।

এভাবে এক এক করে আমাদের দশ বোনকে দশরকম গিফ্ট দিল যার যার পছন্দ মত। দাদা তুমি সবার খেয়াল রাখো ঠিক তবে যারা তোমার খেয়াল রাখে তাদের একটু ভালোবাসো না। আমার আপু গুলো তোমার কত যত্ন করে তোমার মুখ ধোয়ার পানি থেকে রাতের তাহাজ্জুদের নামাজের জায়নামাজ পর্যন্ত উনারা আগলে রাখে। আমার খারাপ লাগে খুব খারাপ লাগে। তাই এ বছর আমি নিজে টাকা জমিয়ে আমার বোনগুলোর জন্য আমার জন্মদিনের উপহার এনেছি। আমার বোনগুলো কেন শুধু চেয়ে চেয়ে দেখবে। আমরা অবাক চোখে তাকিয়ে আছি। আমাদের এই ছোট ভাইটা এত বড় হয়ে গেছে নাকি। আমাদের সবার চোখ ঝাপসা সবাই কান্না লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে মাত্র।

দাদা আমার একেক টা বোন আমার একেকটা তাঁরা কখনো এমন করবে না। এরপরে দাদা আর কিছু ই বললেন না। আমরা সব বোনরা মিলে আমাদের এই এক টুকরো চাঁদ কে ঝাপটে ধরে আছি। সবার চোখ মুছে দিচ্ছে ঐ ছোট্ট ছোট্ট হাতে। আমাদের বাবা মায়েরাও চোখ মুছলেন। আর বললেন, বলি সব মায়া ভালোবাসা কি শুধু বোনদের জন্য ই আমাদের জন্য কি একটু বাকি নেই…! এত ই পর হয়ে গেলাম আমরা। এই কথা শোনার পরপর ই দৌড়ে গিয়ে সবাইকে মা বাবা চাচা চাচি সবাইকে সালাম করল। আর বলল আমার জন্য দোয়া কর শুধু আমি যেন তোমাদের ছেলে আর একটা মানুষ হয়ে উঠতে পারি।

এই কথা শুনতে ই মা চাচীরা সবাই ওকে কপালে মুখে চুমো খেতে লাগল।  চাচী বলছে, কোথায় থেকে শিখলি রে এত কলজা খাওয়া কথা..! এরপর থেকে সবকিছু কেমন জানি পাল্টে যেতে লাগল। দাদার সম্পত্তি নিয়ে আমার বাবা আর চাচাদের মাঝে অনেক মনমালিন্য ঝামেলা ছিল কিন্তু আস্তে আস্তে সব মিলিয়ে গেল। কেমন জানি সবাই সবার আরো আপন হয়ে উঠল। ঐ চোখের মনি টার জন্য। সত্যি সৃষ্টিকর্তা আমাদের জীবনে অনেক সময় এমন কিছু মানুষকে পাঠান যার খুব প্রয়োজন আমাদের। সোয়েব তেমন ই একটা দান আল্লাহর। আমরা অবাক হলাম যখন বড় চাচা তার অংশের সব সম্পত্তি সোয়েবের নামে লিখে দিলেন। সোয়েব অনেকটা বড় হয়েছে। আর বললেন, বাবা আমার মেয়েদের একটু দেখে রাখিস যখন আমরা থাকব না। এই কথা শোনার পর ই চাচাকে জড়িয়ে ধরল আর বলল কখনো এমন কথা বলবে না বললাম।

হ্যা আজ এতটা ই বড় যে আজ আমরা ওর জন্য মেয়ে দেখতে যাচ্ছি। আমাদের বোনদের অনেকের বিয়ে হয়ে গেছে। মেয়েটা বড়দের পছন্দ করা। বড়রা সব এক গাড়িতে আর আমরা অন্যগাড়িতে। আমরা সবাই ওর কান ধরে মজা করছিলাম এবার বউয়ের আঁচলে বাঁধা পড়বে আমাদের এই চাঁদটা। একথা শোনার পর কেমন জানি গোমড়া মুখে বসে রইল সোয়েব। আমরা সবাই বসে আছি। মেয়ে আসল। সবাই বলল সোয়েব তোমার কিছু বলার আছে থাকলে বল। সোয়েব আমাদের ভাইটা আগপিছ বা ভেবে একটা ই প্রশ্ন করল মেয়েকে। পারবেন আমরা চার চারটা বাবা মা’য়ের মেয়ে হয়ে থাকতে…? আমার এই চার চারটা মুক্তার মালা গলায় জড়িয়ে রাখতে..!

আজও কেউ কোনো কথা বলেনি শুধু সুখের অশ্রু চোখ বেয়ে গড়িয়ে পরেছে। আমাদের মুক্তার মালার বিনি সুতো যে এই চাঁদটা আমাদের। হ্যা পেরেছে আমার ভাইটা আমাদের চার চার টা বাবা মায়ের ছেলে হয়ে উঠতে…! শুধু আমার মায়েরা আর বাবারা একে অন্যের হাত ধরে আছেন শক্ত করে আর চোখ দিয়ে যেন পৃথিবীর সকল দোয়া বর্ষন করছেন..! আমাদের তারা’র মাঝে একমাত্র চাঁদ টা যে এমন ই..

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত