আজ একটি বিশেষ দিন

আজ একটি বিশেষ দিন

-“আরে কই? আলুর চপ কই?”
-“এইতো হয়ে গিয়েছে প্রায়। আনছি মা।” ভাবী হন্তদন্ত হয়ে গরম গরম আলুর চপ নিয়ে এলেন। মা কিড়মিড়িয়ে ভাবীর দিকে তাকিয়ে আছেন।

-“তুমি জানোনা? মীরা রোজা ভাইঙ্গাই আলুর চপ খানই একটু মুহে দিব? এত্তদিন পর কাইলকা শওড় বাড়িত্তে আইলো আর তুমি চপের কতা বেমালুম ভুইল্লা গেছো আর আইজ! মাইন্সে ইফতারি খাই উইঠা পরতাসে এইরম সময় লইয়া আইছো। আমার মাইয়াডা এহনো কিছু মুহে লইছে না। বলি শেহেজাদী মন কই থাহে তুমার?”

-“থাক মা এসব কথা। ভাবী যে আমাকে সহ্য করতে পারে না সেটা আবার প্রমাণ হয়ে গেলো। এসেছিলাম তো সেই বড় ঈদের পর। ভাইয়ার বিয়ের পর থেকে আমি বুঝে শুনেই বাড়ি আসি। এখন বছরে আসার ইচ্ছে হলেও বড়জোর দুই থেকে তিন বারের বেশি আসি না। তারপরও তোমাদের সমস্যা। এখন এবাড়িতে আমার এতোটুকুও মূল্য নেই।” বলে আপা নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন। আর মা ভাবির দিকে একবার অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আপার পিছনে ছুটলেন। বড়ভাইয়া ভাইয়া ভাবীকে ধমক দিলেন-

-“কাজ যখন ঠিকমতো করতেই জানোনা তাহলে করতে যাও কেনো? একটু আগে থেকেই কাজ শুরু করলে কি হয়? নাকি তুমি ইচ্ছে করেই এমন করেছো? কি সমস্যা বলতো তোমার?” ভাবী মাথা নিচু করে চুপচাপ দাড়িয়ে আছে। ভাইয়া বিড়বিড় করতে করতে ইফতারের প্লেট সাজিয়ে আপার ঘরের দিকে গেলেন। ভাবী সেই মুহুর্তেই ডাইনিং রুম প্রস্থান করে রান্না ঘরে চলে গেলেন। আব্বা নিরবে হালকা বুট মুড়ি খেয়ে নামাযের জন্য নিজ ঘরের দিকে রওনা হলেন। ছোট ভাইয়া একটা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে নিজের মতো খেয়ে চলেছে। তার ভাবখানা এমন যেনো কিছুই হয় নি। আমি খাবার টেবিলের দিকে তাকালাম। ইফতারের সাধারণ খাবার খেজুর; শরবত; বুট; মুড়ি; ডালের বড়া; বেগুনী; আলুনী থেকে শুরু করে আপার প্রিয় আলুর চপ; ভাইয়ার প্রিয় হালিম আর ভুগনী; মায়ের প্রিয় ভুনা খিচুড়ি এবং আপার ছেলের মামাবাড়ি আসা উপলক্ষে তার জন্য ফ্রাইড রাইস ও চিকেন ফ্রাই করা হয়েছে। মায়ের ভাষ্যমতে ইফতারে কিছু মিষ্টান্ন রাখা মঙ্গল তাই পায়েশ রাখা হয়েছে। সব মিলিয়ে দশ বারোটা আইটেম!

আমি চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছি। এসব ড্রামা এবাড়িতে প্রায় সময়ই হয়। আমরা চার ভাই বোন। দুই ভাই দুই বোন। বড়ভাইয়া আর আপা জমজ সন্তান। বড়ভাইয়া আপার সাত মিনিটের বড়। তাদের ছয় বছরের ছোট আহনাফ ভাইয়া আর আহনাফ ভাইয়ার সাড়ে সাত বছরের ছোট আমি। আপা আর আমার মধ্যে আপাই সকলের কাছে সমাদৃত। নয়নের মণি। মা আপাকে একটু বেশিই আহ্লাদ করেন। জমজ হওয়ার দরুণ বড়ভাইয়ার সাথে আপার জন্মের আগে থেকেই সম্পর্ক। সে হিসেবে দুভাইবোনের টানটা অনেক বেশিই। আমি সকলের ছোট হওয়ায় বাবা মার মনোযোগ বেশি পাইনি।

বিশেষ করে মায়ের। বাবা আমাকে যথেষ্ট স্নেহ করেন কিন্তু স্ট্রোক হবার থেকে তিনি অনেকটা দূর্বল হয়ে পড়েছেন। দরকার ছাড়া এখন তিনি তেমন কথা বলেন না। আর মা আমার ব্যাপারে অন্যান্য ভাইবোনের তুলনায় উদাসীন। পরিবারের মধ্যে আহনাফ ভাইয়ার সাথেই আমার সখ্যতা বেশি। আমার সকল আবদার ঝগড়া খুনসুটি মারামারি সবকিছু ছোট ভাইয়ার সাথেই। এছাড়া বাকীদের সাথে আমি মেপেমেপে কথা বলি। বড়ভাইয়া আর ভাবীর বিয়ের বয়স পাঁচ বছর। সাড়ে তিন বছরের একটি মেয়ে আর দেড় বছরের ছেলে আছে একটি। আপার ছয় বছরের একটি ছেলে।

ইফতারের পর নামায পড়ে আয়াজকে ফোন করলাম। টুকটাক কথা বলে রেখে দিলাম। আয়াজ আহনাফ ভাইয়ার ফ্রেন্ড আবির ভাইয়ার ছোটভাই। বয়সে আমার চার বছরের বড়। দীর্ঘ এগারো মাস ঘুরিয়ে দুই মাস আগে তার প্রোপোজাল এক্সেপ্ট করেছি। আহ্নাফ ভাইয়া ব্যাপারটা জানে না। তারাবীর নামায পরে ছোটভাইয়ার ঘরে গেলাম। অনেকদিন ভাইয়ার সাথে সময় কাটানো হয় না।গিয়ে দেখি ভাইয়া বারান্দায় বসে সিগারেট টানছে।

-“আয়াজ কি আজকে কথা না বলেই ঘুমিয়ে পরেছে?” আমি চমকে উঠলাম!
-“মানে?”
-“মানে তুই তো সেহেরির আগ পর্যন্ত ঘুমের ভান করে রুমে গিয়ে ফোনে প্রেমালাপ করিস। তা আজকে আমার ঘরে কি মনে করে?” আমি বেশ খানিকটা ঘাবড়ে গেলাম।

-“তুমি ব্যাপারটা জানতে! অথচ আমাকে কিছু বললে না?”
– “কি বলবো? আমি যদি কিছু বলতাম তাহলে তো তুই বলতি যে তুমিও তো প্রেম করো তোমার বেলায় যদি সব ঠিক থাকে তবে আমার বেলায় এতো কথা কেনো?” এভাবে সরাসরি বলে দেওয়ায় আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। কিন্তু কথা সত্য। ভাইয়া মুখ খুললো

-“আমি কিছুই বলবো না। তোমার লাইফ তোমার ইচ্ছা।” আমি বুঝলাম ভাইয়া রাগ করেছে কেননা আমাকে তুই বাদ দিয়ে তুমি করে বলছে। আমি মিনমিনিয়ে বললাম

-“ভাইয়া আয়াজ বলেছে মাস্টার্স কম্পলিট করে চাকরি হলেই আমার বাড়িতে প্রস্তাব দিবে। তারপর বাড়িতে মেনে নিলে বিয়ে করে ফেলবে।”

-“আর মেনে না নিলে তোমরা পালিয়ে যাবে কয়েকদিন পর সবাই মেনে নিবে এই তোমার ধারণা তাইতো?”
-“আপার বেলাতেও তো তাই হয়েছিলো!” ভাইয়া সিগারেটে লম্বা একটা টান দিলো।
-“কাজ করছো ভাবীর মতো আর লাইফস্টাইল আশা করছো তোমার আপার মতো? বাহ!” আমার কথাটা বোধগম্য হলো না।

-“তোমার আপা সবসময় নিজের প্রোফিট বুঝে কাজ করে। কলেজ লাইফে আবেগের বশে করা তিন বছরের রিলেশন ব্রেক আপ করেছিলো কেননা তখন সে বুঝতে পেরেছিলো এই বেকার ছেলে কোনোরকম চাকরী পেলেও তাকে লাক্সারিয়াস লাইফ দিতে পারবে না। সে নাকী হাই সোসাইটি বিলং করে। অতপর ফারহান ভাইয়ের মতো লাখপতি হাই সোসাইটির ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে বিয়ে করলো। শুধু তাই নয়! বাবা মার একমাত্র ছেলে। বয়স্ক মা বাবা তাদের গ্রামে থাকে। কোনো ঝামেলাই নেই।

সবকিছু নিজের হুকুমে চলে। সে মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে অথচ কত সহজে বড়লোক হয়ে গেলো। কি আশ্চর্য তাইনা! আর ভাবীকে দেখো। বিশিষ্ট শিল্পপতির উচ্চবিত্ত পরিবারের সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম হওয়া একমাত্র মেয়ে কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে কিভাবে হয়ে গেলো মধ্যবিত্ত পরিবারের বউ! শুধুমাত্র তোমার বড়ভাইয়ের মুখের দিকে চেয়ে সব ছেড়ে চলে এসেছিলো। যার কারণে বাবামার কাছেও ত্যাজ্য কন্যা হয়ে গেলো।” খানিকটা সময় পর আবার ভাইয়া বলা শুরু করলেন

-“আবিরের বাবা মারা গেছেন চার বছর আগে। মা দুবছর ধরে প্যারালাইজড হয়ে বিছানায় পরে আছেন। নড়াচড়া করতে পারেন না। উনার দেখাশুনা আবিরের দুইবোন মিলে করে। বড়বোন বিয়ে করে বেকার জামাইসহ এখানে থাকে। প্রেমের বিয়ে ছেলের বাড়িতে মেনে নেয় নি। এদিকে আবির তার গার্লফ্রেন্ডকে লুকিয়ে বিয়ে করে ফেলেছে। একথা কেউ জানেনা। স্রেফ আমরা বন্ধুমহলের দুয়েকজন ছাড়া। সেই মেয়ে আলালের ঘরের দুলাল। পানি পর্যন্ত নিজে ঢেলে খায় না। আবিরের প্ল্যান তার বউয়ের বাপের ব্যবসা নিজের হাতে তুলে নিয়ে আলাদা হয়ে যাওয়া।

আয়াজ আবিরের মতো এতো ধুরন্ধর না আবার এতো সহজ সরলও না। বাইরে থেকে তাদের দেখে যতই স্মার্ট মনে হোকনা কেন দেখা যাবে বিয়ের পর ওর মায়ের সমস্ত সেবাযত্নসহ সংসারের সমস্ত দায়িত্ব তোর হাতে দিয়ে দিয়েছে। বিয়ের প্রথম প্রথম জামাইয়ের কাছ থেকে সাপোর্ট পাবে কিন্তু কয়েকবছর যেতে না যেতেই সেও তোমাকে দুরছাই করবে। যেমনটা আজ তোমার বড়ভাইয়া করে। আগে আমি ভাবীকে বড় বোনের মতো সাপোর্ট করায় উনার নান কাজে সাহায্য করায় উনার প্রতি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় তোমার আপা জ্বলে গিয়ে আমাকে মিশিয়ে ভাবীর চরিত্র নিয়ে কথা বলেছে। এরপর থেকে ভাবীর কাছে আমি সহজ হতে পারিনা।

ঠিক সেরকমভাবে আয়াজের সহজ সরল বোন জামাই তোমার পক্ষে কথা বলতে নিলে বাড়ির জামাইকে নিয়ে তোমার চরিত্র সম্পর্কে কথা বলতে তারা দুবার ভাববে না। নিজের বাড়িতেই সব দেখছো। এর থেকে বড় উদাহরণ তোমাকে আমি আর কিভাবে দিব? আর ভেবো না যে আয়াজের সাথে পালিয়ে তোমার বিয়ে হলে এবাড়িতে মেনে নিবে। কারণ তারা বড়লোক নয়। ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড ও তেমন সুবিধার না। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার। আয়াজকে নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিলে তোমার অবস্থা হবে ভাবীর থেকেও করুণ।” বিছানায় শুয়ে আছি। এতোটা গভীরভাবে কখনো ভেবে দেখিনি। ঘড়িতে ২.৩৮ বাজে। সেহেরির জন্য কেউ এখনো উঠেনি। রান্নাঘরে যেয়ে দেখি ভাবি মাছ ভাজি করছে। আমাকে দেখে একটা মলিন হাসি দিয়ে বললো

-“ননদিনী আজকে এতো তাড়াতাড়ি জেগে গেলে যে!”
-“এমনি।”

একবার পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলালাম ভাবীর। যেদিন প্রথম বাড়িতে এসেছিলো পরণে ছিল নীল জামদানী শাড়ি। ফর্সা মুখটায় লালিমা গাল। লালচে গোলাপি ঠোঁট। মাথায় ঘন চুলের খোপা। একেবারে শোকেসে রাখা পুতুলের মতো ছিলো। আর আজ! ফর্সা মুখ হয়ে গিয়েছে শ্যামবর্ণের। চোখের নিছে কালি। হাতের বেশ কিছু জায়গায় কালো দাগ। বোধ হয় রান্না করতে গিয়ে পোড়ার দাগ। গালে এখন আর লালিমা পড়ে না। ঠোঁটটা আগের মতো গোলাপি নেই। শোকেসে সাজিয়ে রাখা লাল টুকটুকে বউয়ের সাথে কোনো মিল নেই এই গৃহীনির। সেহেরি খেয়ে দাঁত ব্রাশ করে পানি খেতে এসেছি। দেখি ভাবি মাত্র খেতে বসেছে। খাবারের মাঝখানে সাইরেন বেজে গেল আর সাথে ভাবি উঠে থালার বাকী খাবার গুলো ডাস্টবিনে ফেলে দিলো।

পরদিন সকালে উঠে শুনি আপার নাকি খুব মন খারাপ। এই লকডাউনের জন্য এবারের ঈদের শপিং করতে পারছেন না। কেননা প্রতিবারই এসময়টাতে ঈদের শপিং করে সময় কাটান। বিকেলে দেখলাম ভাবি রান্নাঘরের দিকে টলতে টলটে যাচ্ছেন। প্রায় পড়ে যাচ্ছেন এরকম সময় আমি ধরে ফেললাম। দেখি গায়ে প্রচুর জর! কাল রাত থেকেই নাকি এমন। আমি কাজ করতে মানা করলাম কিন্তু ভাবী মানতে নারাজ। শেষমেষ আমিও তার সাথে হাত লাগালাম। ইফতার পরিবেশন করতে সাত মিনিট লেট হলো। এনিয়ে আজ আবারো ভাবীকে বকাঝকা করলেন ভাইয়া। বাবা আমাকে বসে যেতে বলায় আমি বললাম

-“থাক বাবা! এখন থেকে আমি তোমাদের সার্ভ করে পরে খাব। আমাকেও তাও একদিন পরের ঘরে যেতে হবে তখন যদি বউদের পরে খাবার নিয়ম থাকে তাই অভ্যস করে নিচ্ছি।” আমার একথা শুনে আপা বলল

-“তুই ঐরকম বাড়িতে যাবি কেন? একটু চালাক হো বুঝলি। আমার বোন হয়ে তোকে ভাবীর মতো এরকম কথা বলা মানায় না।” আমি একটা বিদ্রুপের হাসি দিলাম।

– “তোমার বোন! তবে একটা কথা একদম ঠিক। তুমি খুবই চালাক আর ভাবী খুবই বোকা। একজনের সাথে প্রেম করে নিজের আয়েশী জীবনযাপনের লক্ষ্যে প্রেমিককে লাথি মেরে টাকাওয়ালা ছেলের সাথে পালিয়ে গিয়েছো। মাকে ম্যানুপ্লিয়েট করে ভাবিকে একদম নিজের পায়ের নিচে রেখেছো। নিজের শশুর শাশুড়ীকে গ্রামে রেখে স্বামীর সাথে আলিশান ফ্ল্যাটে থাকছো। মোট কথা বাপের বাড়ি আর জামাই বাড়ি দুটোই খুব ব্যালেন্স করে চলছো। অথচ ভাবী কে দেখো।

শিল্পপতির মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও সে একজন মধ্যবিত্ত পরিবারের সাধারণ গৃহীনি। ইন ফ্যাক্ট গৃহীনিও এর থেকে ভাল অবস্থানে থাকে কিন্তু তোমরা তো রীতিমতো ওকে কাজের বুয়া বানিয়ে দিয়েছো!কাল রাত থেকে ভাবীর জ্বর অথচ সেটা কেও জানেইনা। সকালে ঘুম থেকে উঠে বাড়িঘর পরিষ্কার করে বাচ্চাদের নাস্তা বানিয়ে দেওয়া; গোসল করিয়ে দুপুরে তাদের মুখে তুলে খাইয়ে দেওয়া; ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া; বিকেলের শুরু থেকেই তোমাদের জন্য দশ বারো রকমের ইফতারের আইটেম করা; কোনোরকম পানি নিয়ে তোমাদের প্লেটে প্লেটে খাবার বেড়ে দেওয়া; সবার খাওয়া শেষ হলে খেয়ে তোমাদের ঝুটা বাসন মাজা; সেহেরিসহ রাতের খাবার রান্না করা; রাতে আবার বাচ্চাদের খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া; দুয়েক ঘন্টা না ঘুমাতেই সবাইকে সেহেরির জন্য ডেকে তোলা;

তোমাদের সেহেরি খাওয়া শেষ হলে শেষ সময়ে খেতে বসা যখন পেট ভরে খাওয়ার কোনো উপায় থাকে না। এরপর সব গুছিয়ে নামায পরে ভোর পাচটায় ঘুমিয়ে সকাল সাড়ে সাতটায় উঠা। এতোগুলো কাজ একসাথে মেইনটেইন করতে গিয়ে যখন একটা ভুল হয়ে যায় তখনই তোমরা জ্বলে উঠে অকথ্য ভাষায় বক্তে থাকো। বাপের বাড়িতে যাওয়া তো দূরে থাক বাবামার খোজ পর্যন্ত নিতে পারেন না। আর যার মুখ দেখে এবাড়িতে এতোদিন পরে ছিল সে স্বামিও তাকে এখন মানুষ বলে গণ্য করে না।” ভাবী আমাকে থামানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু তা উপেক্ষা করে আমি আবার বলতে শুরু করলাম;

-“গত ঈদে সাতটা সেট হবার পরেও ভাবির জন্য আনা ফিরোজা কালারের শাড়িটা তোমার পছন্দ হয়ে গেল অতচ সেটাই ভাবির ঈদের একমাত্র কাপড় ছিলো। তোমরা বরং এক কাজ করো। আহনাফ ভাইয়াকেও এরকম বোকা মেয়ে দেখে বিয়ে দিয়ে দিয়ো। ও তোমাদের তো আবার যেমন তেমন না উচ্চশিক্ষিত কাজের বুয়া চাই যাকে পায়ের তলায় রাখা যাবে। কি আশ্চর্য তাইনা! একই বাড়ি একই জাতি তফাৎটা শুধু একজন মেয়ে আরেকজন বউ!”
ভাইয়া কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু আপা রীতিমতো গর্জে উঠলেন।

-“মা তোমার ছেলের বউ একদম ব্রেন ওয়াস করে দিয়েছে তোমার ছোট মেয়ের। বড় বোনের সাথে কিরকম ভাষায় বেয়াদবী করছে আর তুমি কিছু বলছো না!” মা আমাকে ধমকে মারতে আসছিলেন কিন্তু আহনাফ ভাইয়া আমাকে মায়ের থেকে আড়াল করল। তৎক্ষনাৎ বাবা মাকে ধমকে উঠলেন। মা থেমে গেলেন। বাবা বললন

-“আজ থেকে বউমা আমাদের সাথে খাবে। একই টেবিলে। সে কোনো কাজের বুয়া নয়। আর প্রতিদিন যার যার প্রিয় খাবার করা যাবে না। কাল থেকে শুধু বুট বড়া বেগুনি আর খিচুড়ি হবে। এতে যদি কেউ খেতে পারে তবে খাবে আর যার সমস্যা সে নিজে রান্না করে খেতে পারে। আর আজ থেকে বউমা অনুর সাথে ঘুমাবে। ঘরে একসাথে থেকেও যদি পাশের মানুষের অসুস্থতা ধরতে না পারে তাহলে সে মানুষের সাথে থাকার কোনো প্রয়োজন নেই।” পাশের ঘর থেকে আপার কান্নার আওয়াজ আসছে।তিনি শুধু লকডাউনের জন্য নাকি এক্ষুনি এখান থেকে যেতে পারছেন না। মা উনাকে সামলাচ্ছেন।

-“আসার সময়ও তো লকডাউন ছিলো। আমরা তো আর ধরে বেধে আনিনি। যাওয়ার ইচ্ছা থাকলে ঠিকি যাবে।” বিড়বিড়িয়ে বললেন আহনাফ ভাইয়া। বাবা নিজের হাতে ভাবিকে খাইয়ে দিচ্ছেন। আর ভাবী কেদে কেদে খেয়ে যাচ্ছেন। বড় ভাইয়া অপরাধীর মতো বসে সেদিকে চেয়ে আছেন।

মাঝরাত। ঘড়িতে ১টা বেজে ৫৭মিনিট। একটু পর সেহেরির সময় হবে। আজ একটি বিশেষ দিন। আজ ভাবীর জন্মদিন। আজ ভাবী পড়েছে ভাইয়ার দেওয়া সেই বিশেষ নীল জামদানী শাড়িটি যেটা পড়ে ভাবী এবাড়িতে বউ হউএ এসেছিল। আজ বিয়ের পর প্রথম ভাবী তার বাবা মার সাথে কথা বলেছেন। আজ ভাবী দুঃখে নয়; আনন্দে কেদেছেন।

ওপাশের বারান্দায় বড়ভাইয়া আর ভাবী আর এপাশের বারান্দায় আমি আর আহনাফ ভাইয়া। বড়ভাইয়া গিটার বাজাচ্ছেন আর ভাবী গান গাইছেন। আমার তরফ থেকে আয়াজের সাথে আর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব না তা ভালো করে বোঝানোর সত্ত্বেও আয়াজ বারবার ফোন করছে মেসেজ দিছে। আর আমি বিরক্ত হয়ে কেটে চলেছি। আহনাফ ভাইয়া সিগারেটে টান দিচ্ছে আর বলছে লকডাউন শেষ হলেই ভাবীকে কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী জোগার করে দিবেন গান শেখানোর জন্য। আমি আয়াজের নাম্বারটা ব্লকলিস্টে নিতে নিতে বললাম;”দিয়ো।” আর সেই সাথে কান পেতে শুনছি “এখন অনেক রাত তোমার কাঁধে আমার নিঃশ্বাস, আমি বেঁচে আছি তোমার ভালোবাসায়……. “

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত