-বাবা ওঠ বেলা তো অনেক হয়ে গেছে আর কত ঘুমাবি?তোর না আজ ইন্টারভিউ আছে। “মা আর একটু ঘুমাতে দাও না-
-বাবা বেলা অনেক হয়ে গেছে তুই তারাতারি ওঠ ৯টা তো বেজে গেল।
-কিহ নয়টা বেজে গেছে,তুই আমায় আগে ডাকিস নি কেন মা????
বিছানা ছেড়ে এই বলেই দৌড় দিল মামুন।মামুনের মা আমেনা বড় সাধ করে ছেলেকে পড়িয়েছে,তাও আবার যেমন তেমন ভাবে না দেশের নাম করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। নিজে অপরের বাড়ি বুয়ার কাজ করেছে।এক বেলা খেয়ে না খেয়ে মামুন কে টাকা দিয়েছে পড়ার খরচ বহন করার জন্য,কখনো নিজের শখ আহ্লাদ মেটাতে একটি টাকাও আমেনা বিবি নষ্ট করেনি সর্বদা নামাজ পড়েছে আর ছেলে মামুনের জন্য দোয়া করেছে।
মামুন লেখাপড়ায় বেশ ভালো ছিল। ছেলেটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লেও গ্রামের রিতিনীতি ভুলে যায়নি।ভোলেনি তার অতীত গুলোকে,বড়ই সাদাসিদে ছিল তার ভার্সিটির জীবন।পড়াশুনার বাইরে কখনো যায়নি।আধুনিকতার ছোয়া এখনো তাকে নষ্ট করতে পারেনি।সবে এবার পড়াশুনা শেষ করেছে মামুন।এখনো ঢাকাতে থাকে আর মা আমেনা লোকের বাসায় কাজ করে।আজ মামুনের চাকরির পরিক্ষা তাই সকাল সকাল মা আমেনা মামুনকে ডাকছিল।
ফ্রেশ হয়ে এসে মামুন রেডি হচ্ছিল ইন্টারভিউ এর জন্য।মায়ের কাছে দোয়া নিয়ে চলে যায় মামুন ইন্টারভিউ দিতে।আর মা আমেনা চলে যায় তার কাজের বাড়িতে।মনেমনে আশা করে ছেলেকে পড়ড়িয়েছে তিনি হয়তো ছেলেটা চাকরি পেলে তার সারাজীবনের দুঃখ ঘুচে যাবে।সারাটা জীবন একবুক আশা নিয়ে আমেনা বেচে আছে তো ঐ ছেলের দিকে চেয়েই।
মামুনদের একসময় সংসার ছিল গ্রামে একটা বাড়িও ছিল।তার বাবা করিম মিয়া রিক্সা চালাত,কোন মতে দিন এনে দিন খেত,বেশ ভালোই চলত। মা আমেনার তখন অন্যের বাসায় কাজ করতে হত না।একদিন রিক্সা নিয়ে করিম মিয়া এক্সিডেন্ট করে।বাড়ি ভিটা রিক্সা বিক্রি করে করিম মিয়ার চিকিৎসা করা হয়। কিন্তু এতেও কোন লাভ হয়নি,করিম মিয়া একমাত্র ছেলে মামুনকে এতিম আর বৌ আমেনাকে বিধবা করে চলে যায় না ফেরার দেশে। আর তারপর গ্রামে একটা বছর অনেক কষ্টে কাটায় আমেনা ও মামুন।
তারপরে আমেনা তার ছেলে মামুনকে নিয়ে ঢাকা চলে আসে,মানুষের বাড়ি আমেনা কাজ শুরু করে।পাশাপাশি মামুনকে স্কুলে ভর্তি করে দেয়।এভাবেই চলতে থাকে মা আমেনার অক্লান্ত পরিশ্রম আর মামুনের মন দিয়ে পড়াশুনা। কাজ করতে করতে আমেনা অনেকটা রুগ্ন হয়ে গেছে।শরিরটাও ভেঙ্গে পরেছে। হয়তো আর বেশি দিন কাজ করতে হবেনা আমেনাকে। মামুন একটা চাকরি পেলেই তো তার সব দুঃখ কষ্ট ঘুচে যাবে।এখন শরিরটাও মাঝে মাঝে অকারনে অসুস্থ হয়ে পড়ে। আজ আমেনা বেশ অসুস্থ, তবে ছেলে চিন্তা করবে এই ভেবে তাকে কিছুই বলেনি। আর বল্লেই বা কি হত,ঔষধ কেনার মত কোন টাকা ছিলনা বাসায়। মামুনকে বললে হয়তো ইন্টারভিউ দিতে যেতনা। ওই টাকা দিয়ে ঔষধ কিনে দিত মামুন। তাইতো মামুনকে বুঝতে দেয়নি আমেনা।কিন্তু কাজে গিয়ে অনেকটা অসুস্থ হয়ে পড়ে আমেনা, তাই বাড়ি চলে আসে।
ঐ দিকে মামুনের ইন্টারভিউ ভালো হয় মা আমেনার দোয়ায় ও আল্লাহর রহমতে মামুনের একটা ভালো চাকরিও হয়ে যায়।মাসে বেতন প্রায় ৫০ হাজার এর উপরে মুখে বিষ্ময়ের হাসি। সে পেরেছে তার মায়ের কষ্টের মূল্য রাখতে।মায়ের স্বপ্ন আর সারাজীবনের কষ্টকে লাঘব করতে সে এখন পারবে।মাকে আর কথার খোটা শুনে পরের বাড়ি কাজ করতে হবেনা। বাসাটা এবার পরিবর্তন করতে হবে।প্রথম মাসের বেতন পেলে মাকে একটা নতুন কাপড় কিনে দিতে হবে, মায়ের হাতে একজোড়া বালা ছিল মাধ্যমিক পরিক্ষার রেজিস্টেশন এর সময়কার ফিস দিতে গিয়ে সেটা বিক্রি করতে হয়েছিল।মাকে একজোড়া হাতের বালা গড়িয়ে দিতে হবে। এসবই ভাবছিল আর মুচকি মুচকি হাসছিল মামুন গাড়িতে বসে। মনে মনে মামুন আজ অনেক খুশি।
বাসায় গিয়ে আজ মাকে একটা সালাম করবে মামুন।হাসি খুশি মুখ নিয়ে বাসায় ঢুকছে মামুন,কিন্তু বাসায় ঢুকে সে তার মাকে অসুস্থ দেখল। তাড়া হুরো করে মেডিকেলে নেওয়া হল। শুরু হল ধীর গতির সরকারী চিকিৎসা।
গরিবদের বেলায় সরকারী মেডিকেলে যা হয় আর কী!! কী আর করার ক্লিনিক এ ভালো চিকিৎসা করে এসব ডক্টররাই। কিন্তু ওখানে ভিজিট দিতে হয়। মামুন তো সবে চাকরি পেয়েছে। এখনো তার কাছে টাকা নেই।তার তেমন কোন বন্ধু বা আত্মীয় স্বজনও নেই যে তাকে টাকা দিয়ে এই বিপদ থেকে বাচাবে।
তাই সরকারি মেডিকেল ছাড়া ভালো কোনো ক্লিনিকে রেখে চিকিৎসা সে করাতে পারবে না। নতুন চাকরি তাই মাকে মেডিকেলে রেখে অনিচ্ছুক হলেও সে ডিউটি করতে থাকে।প্রতিদিন মায়ের খোজ খবর নিতে সে মেডিকেল যায় আর মাকে বলে বেতন পেলে তাকে ওখান থেকে উন্নত চিকিৎসালয়ে নিয়ে যাবে। চিকিৎসার অবহেলা আর সব ঔষধ ঠিকমত না পেয়ে আমেনার শরীরের অবস্থা দিন দিন খারাপ হতে থাকে।এদিকে মাস ও প্রায় শেষ। মামুন তার প্রথম উপার্জনের টাকা পায় অনেক খুশি হয়ে টাকা নিয়ে মেডিকেল এর দিকে যায়। মনে মনে ভাবে আজকেই মাকে ভালো কোন ক্লিনিক এ নেবে।
যাতে ভালো চিকিৎসা করতে পারে। এখন আর মামুনের কাছে টাকার সমস্যা নাই।খুব জোর পায়ে মিডিকেলের রাস্তা পেরিয়ে ওয়ার্ডের দিকে যাচ্ছিলো মামুন।ওয়ার্ডে ঢুকতেই তার মায়ের বেডের পাশে অনেক মানুষকে দেখতে পেল মামুন।ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো মামুনের। দৌড়ে গেল মায়ের বেডের কাছে। মায়ের অনেক কষ্ট হচ্ছে। ঠিকমতো শ্বাস নিতে পারছেনা। ডাক্তাররা কি কি যেন শরিরে পুষ করছে শরীরে কলকব্জা ধরে দেখে নিজেরাই ইশারায় কি কি যেন বলছে। মা আমেনা বলতে শুরু করলো, “দেখ মামুন আমি হয়তো আর বাচবোনা তুই ভালো থাকিস বাবা। আমি যেখানেই থাকি তোকে ঠিক দেখবো তোর সুখ দেখব।ভালো থাকিস”।
এটা বলেই চোখ বুজে নিলেন চিরতরের মত মামুনের মা আমেনা। শুরু হয়ে গেল মামুনের বুক ফাটা কান্না। পাগলের মত হাউমাউ করে কাঁদছিল মামুন। “মা তুই একবার চোখ খুলে দেখ আমি আজ টাকা পেয়েছি আমার ১ম মাসের বেতন। তোরে নতুন কাপড় কিনে দেব। হাতের বালা গড়িয়ে দেব আর ভালো ক্লিনিকে নিয়ে চিকিৎসা করবো।একবার চোখ খোল না মা,তোর কাছে যে আমি অনেক ঋনীরে মা।
তোর কোন সেবা আমি করতে পারলাম না একবার চোখ খুলে দেখ মা আমি যে ঋনীই রয়ে গেলাম তোর কষ্টের টাকায় পড়াইলি সে ঋন এখন শোধ করবার সময় এসেছে মা। এত কষ্টের জীবন পার করলি যে সময় কিনা তোর সুখ আসতেছে সেই সময়ে তুই ফাকি দিয়ে আমায় ঋনী করে চলে গেলি”। এরকমই পাগলের প্রলাপ বকতে বকতে কাঁদতে থাকে মামুন তার মায়ের পা ধরে তার কান্না যেন থামেই না।