সিগারেট

সিগারেট

তোরাই তো আমায় সিগারেট খাওয়া শিখিয়েছিস না,নে নে একটা টান দে” আজ বৈশাখের প্রথম দিন,ভার্সিটির মাঠে এক কোনে বসে আমি পেন্সিল চালাচ্ছি। আমার সব চেয়ে বড় গুন হলো,সে যেকোন মানুষের স্ক্রেস তৈরি করতে পারি। ক্লাসের অন্যদের সাথে তেমন একটা মিশি না আমি। কারন, আমার একা থাকতেই ভাল লাগে।

— কিরে রাজ আজকের দিনও কি পেন্সিল আর কাগজ নিয়ে পড়ে থাকবি। চল আমাদের সাথে…

আমি উপরের দিকে তাকাতেই দেখি তুহিনকে। একটা বন্ধু সুলভ হাসি দিয়ে আমার দিতে তাকিয়ে আছে। আমিও তার হাসির উত্তর হাসি দিয়ে ফেরত দিয়ে উঠে দাড়ালাম।

— না আসলে তোদের কাউকেই তো ভার্সিটি এসে দেখতে পাই নি তাই একটু আকাঁআকি করছিলাম।
— হুমম এবার চল,সবাই বটতলায় অপেক্ষা করছে।
— হুমম চল।

আমি তুহিনের পিছু নিলাম। আমি আসলে সময়ের সাথে নিজেকে মানিয়ে চলতে পারি না। যেমন বলতে গেলে আমার পোশাক বা কথা বার্তা সব কিছুতেই গ্রামের একটা ছাপ রয়েই গেছে। তাই নিজেকে সব কিছু থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখি। কিন্তু আমি অনেকটাই আবেগ প্রবন। তুহিনের সাথে বটতলায় পৌছাতেই দেখলাম আজ দল বেধেঁ সবাই শাড়ী আর পাঞ্জাবীতে সেজেছে। বিশেষ করে তনুকে দেখে আমার মুখটা লাজুক হয়ে গেল। এই গ্রুপের সবাই ভাল করে জানে, তনুকে আমি পছন্দ করি।

— কিরে রাজ আজ বৈশাখের দিন পাঞ্জাবী পড়লি না যে তোর তনু তো ঠিকই শাড়ী পড়ে আসছে।

কথাটা রোদ্র বলল আর সবাই হাসতে শুরু করলো আর তনুর দিকে তাকাতে মনে হলো সেও মুচকি হাসছে। আসলে আমি তো বুঝতেই পারি নি তনু আমার জন্য শাড়ী পরবে।আমার চোখটা বারবারই তনুর দিকেই চলে যাচ্ছে। হঠাৎ তনু আমায় বলল…

— এই যে বৈশাখের ছুটি শেষেই কিন্তু আমাদের মিডট্রাম পরীক্ষা। তোমার পড়া গুছানো হয়েছে তো।
— হ্যা তনু সব শেষ,তুমি না পড়লেও চলবে।
— এই তো মিষ্টি ছেলে।

তনু আমার সামনের সিটে বসে আর আমার পিছনে বসে রোদ্র। তারপর ক্রমানুযায়ী তুহিন আর বাকিরা বসে। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আমার ভাল রেজাল্টের জন্য সবাই আমার সাথে কথা বলে কিন্তু তবুও ভার্সিটিতে ওরাই আমার এক মাত্র ফ্রেন্ড।

সবার সাথে দাড়িয়ে দাড়িয়ে মজা করছিলাম। তখনই তনু সবার আড়াল করে আমার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিলো। ওর দিকে তাকাতে ও কিছু না বলে, সবার সাথে হাসিঁ ঠাট্টায় মন দিলো। যখন আমি কাগজটা খুলতে যাবো তখন তনু আমার কানে কানে বলল “এটা বাসায় গিয়ে খুলে দেখবে। “তাই আমি আর খুলে দেখি নি। সবার সাথে মজা শেষ করে বাড়ির পথ ধরলাম। বাসায় এসেই রুমে ডুকে কাগজটা পকেট থেকে বের করলাম। কাগজে লেখা ছিল, “বোকা একটা, আমার চোখ দেখেও কিছু বুঝো না। অল্প কিছু লেখা গুলো যেন মন ছুয়ে গেলো। আচ্ছা তনু কি বুঝে ফেলেছে আমি তাকে ভালবাসি। ইশশ,আমার যে কি পরিমান ভাল লাগছে। কালকেই তনুকে প্রপোজ করতে হবে। রাতে খাওয়া দাওয়ার পর বসে বসে বই পড়ছিলাম তখনই ফোনটা বেজেঁ উঠলো। তাকিয়ে দেখি রোদ্র ফোন দিয়েছে। ঘড়িতে তখন প্রায় ১১টা বাজতে চলল।

— হে রোদ্র বলল।
— আরে কই তুই?
— এই তো বাসায়। কেন?
— তোদের এলাকার মোড়ে আয়। কিছুক্ষন আড্ডা দে এসে আমাদের সাথে।
— অনেক রাত হয়েছে তো ভাই।
— বোকা ছেলে নাকি রে, ভার্সিটির ছেলেদের জন্য এটা কোন রাত হলো নাকি।
— ওকে আসছি।

ফোনটা রেখে ড্রয়িং রুমে যেতে দেখি আলো নিভানো। মানে বাবা মা হয়ত ঘুমিয়ে গেছে। তাহলে সমস্যা নেই,ভেবেই বের হয়ে গেলাম। এলাকার মোড়ে যেতেই দেখি তুহিন রোদ্র সবাই আসছে। আর সাথে বাইক নিয়েই আসছে। তখন তুহিন বলল…

— কিরে তনুর লাভার, এত পড়াশোনা করে কি হবে? একটু আমাদেরও সময় দে।
–কি যে বলিস না।
— ওরে ছেলে যে লজ্জা পাইছে। সবাই হাসি শুরু করলো। তখন তুহিন আমার দিকে সিগারেট এগিয়ে দিলো..
— না দোস্ত আমি সিগারেট খাই না।
— আরে এক টান দে। আর আমি তো তোকে কিনে খেতেও বলছি না।
— না রে, আমার অভ্যাস নেই।
— আরে এক টান দে, অভ্যাস এমনি এমনি হয়ে যাবে। ভার্সিটিতে পড়িস আর সিগারেট খাস না এটা কেমন হলো বল?

মনটা যদিও না না করছিল কিন্তু সবার মুখের দিকে তাকিয়ে আর না করতে পারি নি। একটান দিতেই কাশতে শুরু করলাম। এরপর আর দুই তিনবার টান দিতেই মোটামোটি ভিতরে একটা ভাল লাগা কাজ করলো। এরপর সবাইকে বিদায় দিয়ে রুমে চলে আসলাম। রুমে এসেই ঘুমে চোখ দুটো বিছানা খুজে নিলো।

সকালে ঘুম ভাঙ্গলো মায়ের ডাকে। মাথাটা কেমন যেন ভার ভার লাগছিল। আমার যেন ঘুম পূরন হয় নি। কাল রাতে আমি সিগারেটই খেয়ে ছিলাম নাকি সিগারেটের মাঝে অন্য কিছু ছিল, বুঝতেই পারছি না। যাক গে, বিছানা ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বের হলাম। ক্লাসে প্রবেশ করতেই দেখি পিছনে রোদ্রের কাধেঁ মাথা দিয়ে তনু কথা বলছে। আমাকে দেখেই সরে বসলো। আমি কোন কথা না বলে চুপচাপ একটা বেঞ্চে গিয়ে বসলাম। তখন তনু আমার পাশে এসে বসলো।

— রাজ তুমি যা ভাবছো সবই ভুল। আমি কি তোমার সাথে চিট করতে পারি। রোদ্র আমার জাস্ট ফ্রেন্ড।
— তনু আমি কি তোমাকে কিছু বলতে বলছি। নিজের চোখকে তো আর অবিশ্বাস করতে পারবো না।
— দেখো রাজ বেশি বেশি কিন্তু হয়ে যাচ্ছে।

আমার আর কোন উত্তর না দিয়ে তনুর গালে চড় বসিয়ে দিলাম। সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। রোদ্র এসে আমাকে কলার ধরে দাড় করালো। আর আমাকে কিছু বলতে না দিয়ে আমাকে মারতে শুরু করলো। এদিকে আমি নিজেকে সেভ করতে চাইলেও তুহিন আর বাকিরাও মারতে শুরু করলো। এক পর্যায় রোদ্র বলল…

— নিজেকে কি রোমান্টিক হিরো ভাবিস নাকি। তুই তো শুধু আমাদের পরীক্ষায় পাশ করানোর একটা মাধ্যম মাত্র। নয়ত তনু তোর সাথে প্রেমের নাটক করতো। তনু হলো আমার গার্লফ্রেন্ড গাধা। আজকে তোকে ছেড়ে দিলাম। আগামীতে মেপে কথা বলবি নয়ত এখন তো ঠিক মত হাটতে পারতেছিস। পরে হুইল চেয়ারেও জায়গা পাবি না,সোজা হাসপাতালের বেডে পাঠাবো।

সব গুলো আমাকে ক্লাসে রেখেই চলে গেলো। কিছু আমজনতা হয়ত মজা লুটছিল। সাহায্য করতে কেউ এগিয়ে আসি নি। আমি নিজেই নিজের ভার বয়ে বাড়ির পথ ধরলাম। আজ প্রায় ২ সপ্তাহ হতে চলল, কিন্তু আমি আর ক্লাসে যাই নি। বরং নিজেকে চার দেয়ালের মাঝেই আটকে রেখেছি। এখন সিগারেট যেন আমার রোজকার নেশায় পরিনত হয়েছে। সিগারেটের ধুয়া যেন নিজের ভিতরের ভালবাসা,মায়া,মমতা সব কিছুই পুড়িয়ে দিয়েছে। এখন শুধু কিছু অমানুষের বাচ্চাদের বুঝানো উচিত, একটা ভাল মানুষকে যদি অমানুষ বানায় তাহলে সে কি পরিমান ভয়ংকর হতে পারে। আজ আমার সব চেয়ে খুশির দিন, যে আমার ভালবাসা স্বপ্ন সব কিছু নষ্ট করেছে সে আজ আমার সামনে চেয়ারে বাধাঁ অবস্থায় আছে।গতকাল রাতে ওকে তুলে এনেছি।

— রাজ আমাকে মাফ করে দাও,আমি সব রোদ্র আর তুহিনের কথাই করেছি। প্লিজ

— একটা কথা কি জানিস, বেইমান বন্ধুর থেকে বেইমান ভালবাসার মানুষ সবচেয়ে বিষধর হয়।যার বিষের প্রভাবে পুরো জীবনটাই ধ্বংস হয়ে যায়। আমি পারছি না বাসায় থাকতে, আর না পারছি ভার্সিটিতে যেতে। ও আচ্ছা, তোরাই তো আমায় সিগারেট খাওয়া শিখিয়েছিস না,নে নে একটা টান দে

— আরে দে না। জলন্ত সিগারেট টা তনুর হাতে লাগাতেই চিৎকার দিয়ে উঠলো।

— ওরে আমার বাবুটা খুব যন্ত্রনা হচ্ছে বুঝে, আরে একটু সহ্য করো। এবার একদম ব্যাথা কমিয়ে দিবো। উপরওয়ালার কাছে গেলে একটুও কষ্ট হবে না।

— রাজ প্লিজ আমায় মাফ করে দাও। আমি সিগারেট টা ফেলে দিয়ে তনুর পায়ের কাছে গিয়ে বসলাম।
— পাগলের মত ভালবেসেছি কিন্তু বলতেই পারি নি তোমায়। আর তনু আমাকে সবসময় ব্যবহার করেছো।
–সরি (কান্না করতে করতে)
— খুব ছোট্টো একটা শব্দ এই সরি কিন্তু একটা মন ভাঙ্গার পর এই সরি কোন কাজেই আসে না।

এতক্ষণে হয়ত তোমার বাপ পুলিশকেও জানিয়েছে তার মেয়ে মিসিং। আপসোস একটাই এই পৃথিবীতে কোথাও মন ভাঙ্গার বিচার হয় না। যদি মন ভাঙ্গার বিচার হতো না,তাহলে তোমাদের মত পাপী পৃথিবীর বুকে থাকার অধিকার নেই। আর এক ঘন্টা পর আমার ট্রেন। আমি কোথায় যাচ্ছি কাউকেই বলবো না। তোদের কারনে আজ আমি পরিবারের কাছে নেশাখোর। ভার্সিটিতে লুজার আর তোর রোদ্রের কাছে পানিতে ভিজে যাওয়া কাগজ মাত্র। প্রথমে ভেবে ছিলাম তোকে মেরে নিজেই পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করবো কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম সামান্য মিথ্যা একটা মেয়ের ভালবাসার জন্য নিজের রক্তের ভালবাসার সাথে অপমান করা হবে। যা তুই, ছেড়ে দিলাম তোকে। ভাল থাক তোর রোদ্রকে নিয়ে।

তনুর বাধন খুলে দিতেই ও দৌড়ে পালিয়ে গেলো আর আমি কাধেঁ ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে গেলাম। একটু পরই আমার ট্রেন। একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে বাসায় ফোন দিতেই মা বলল,”বাসায় নাকি পুলিশ এসে ছিল।”আমি কোন কিছু না ভেবে আমার নতুন গন্তব্যের দিকে রওনা দিলাম। আরে এদেশে খুন আর ধর্ষনের বিচারই হয় না আর সাধারন কিডন্যাপের কিসের বিচার।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত