শুকরিয়া

শুকরিয়া

একজন খুব আস্তে বলছে,মেয়ের পায়ের রঙ দেখেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে,মেয়ের গায়ের রঙ আসলে কালো তার পাশের জন্য আরো আস্তে বলে উঠলো– হ্যাঁ.. আমারও তাই মনে হয়েছে এই মেয়ে হাতে আর মুখে সাদা সাদা পাউডার মেখে এসেছে. এবার দুজনে আরো সাবধানে বলে উঠলো– একারণেই মুরুব্বিরা বলে পাত্রী দেখতে হলে আগে পায়ের রং দেখতে হয় তাহলে বোঝা যায় আসল কাহিনি পাত্রী কিন্তু আমিই যারা আলোচনা করছেন,তারা পাত্রের সাথে এসেছেন..আমি যেহেতু উনাদের ঠিক পাশের সোফাতেই বসে আছি,আমি তাদের ফিসফিস করে করা গোপন আলোচনা শুনতে পারছি..

আমার প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছিলো তাদের কথা শুনতে আমার সামনে বসে,বাইরের মানুষেরা আমার দুর্বলতা নিয়ে খুঁত বের করছে..আর সেটা চুপচাপ সহ্য করছি,এটা যে একটা মেয়ের জন্য কতটা কষ্টের সে কেবল একটা মেয়েই জানে তবুও মেয়েদের নাকি সব হজম করতে হয় হাসি মুখে…আমিও তো তার ব্যতিক্রম নই হঠাৎ করেই,উনাদের একজন মিষ্টি ভাষায় আমাকে উঠে দাঁড়াতে বললো এটা শোনার সাথে সাথে আমার বুঝতে বাকি রইলো না যে,তাদের আলোচনার বিষয়টা টা চূড়ান্তভাবে শিউর করার জন্যই আমাকে দাঁড়াতে বলা।। লজ্জায় আমার চোখের কোণে পানি জমতে শুরু করলো.. উঠে দাঁড়ানোর সময় বোধ হয় এক ফোটা পানি গড়িয়েও পড়লো..আমার ভয় লাগলো না..কারণ,ওটা কেউ খেয়াল করবে না।বাকিরা তো আমার দুর্বলতা গুলোকে খুঁজে বের করতে ব্যস্ত..

আমার ইচ্ছে হলো,এক ছুটে যদি ঘরের ভেতর পালিয়ে গিয়ে নিজেকে এভাবে লজ্জা পাওয়ার দায় থেকে মুক্তি দিতে পারতাম..তবে বোধ হয় শান্তি পেতাম আমি অনেকটা ইচ্ছে করেই শাড়ির কুঁচিটা হালকা উঠিয়ে দু’কদম হেটে দেখালাম,যেন পায়ের রংটা খুব ভালো করে তারা দেখতে পায়…তখন হুট করেই উনারা দুজন ফিসফিস করে আগের থেকেও মিষ্টি ভাষায় বললো– “হেঁটে দেখাতে হবে না মা.. যাও মা..তুমি ঘরের ভেতরে চলে যাও..”

ফিরে যাওয়ার সময় নাকি আবারো সালাম দিতে হয়..কষ্টে-অভিমানে আমার গলা আঁকড়ে আসছিলো..।তাই শুধু মাথা নাড়িয়েই চলে গেলাম তারা চলে গেলেন কিছুক্ষণ পরে বলে গেলেন,খবর ফোনে দেওয়া হবে আমি শিউর বিয়েটা হচ্ছে না..কারণ,ফোনে সংবাদ দেওয়ার কথাতে বেশির ভাগ সময়ই ঘাপলা থাকে তাতে আমার দুঃখ নেই কোন কিন্তু ওখানে কয়েক মিনিট থাকার বিচ্ছিরি অভিজ্ঞতার কথা মনে করে আমি হাউমাউ করে কান্না আসছে বারবার..

কিন্তু সে কান্নারও উপায় নেই,নিজের বাবা মার দিকে তাকিয়ে..রাত হবার পরে,ঘরের দরজা দিয়ে আমি সেদিন খুব কাঁদলাম..মানুষ যত বড় হয়,নিজের আত্মসম্মান এবং লজ্জাবোধ বাড়ে হয়তো সেকারণেই এতো কষ্ট পাচ্ছিলাম ফজরের নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে একটু কান্নার পরে মনটা একটু হালকা হলো স্বাভাবিক ভাবেই চলছিলাম সকাল আটটা,বাজতে না বাজতেই বাবার ফোনে কল আসলো..ওপাশ থেকে একজন কি জানি বললো..আমার বাবা এসে ছুটতে ছুটতে বলে গেলো,ছেলে নাকি আজ একা আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছে কথাটা শুনেই আমার গতকাল থেকে পাওয়া কষ্ট গুলো অভিমানে পরিণত হলো মনে মনে বললাম- “কাল তাদের এতোকিছু করে শান্তি হয়নি, আজ বোধ হয় আবার আলাদা করে নিয়ে আমাকে ছেলে বিচারে বসবে…”

ভাবতেই আমার মনের মধ্যে প্রচণ্ড অশান্তি লাগলো..খুব ইচ্ছে হলো,বাবাকে বলি- “তুমি ওদেরকে না করে দাও বাবা কিন্তু ঐ যে,মেয়ে হয়ে জন্মেছি বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে কষ্ট হজম করতেই হয় আমি ভালো খারাপ কিছুই বললাম না সারাদিন এটা-ওটা চিন্তা করে বেড়িয়ে সময়মত,একেবারে সিম্পল একটা ড্রেস পরে আমি বের হয়ে গেলাম পাত্রের সাথে দেখা করতে..তবে মনে মনে প্রস্তুত হয়ে গেলাম- “আজ যদি আমাকে কোন ভাবে অপদস্ত করা হয়,।আমি সোজা মুখের উপর উত্তর দিয়ে আসবো নির্ধারিত জায়গায় যথাসময়ে গিয়ে উপস্থিত হলাম সামনে পেতে রাখা চেয়ারটা তিনি এগিয়ে দিলেন আমি তাতে খুশি-অখুশি কোনটাই হইনি। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পরে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন—

সেঃ–আপনার কি অস্বস্তি লাগছে???

–জ্বি না..

সেঃ–তাহলে যে কিছু বলছেন না..।একেবারে চুপ করেই আছেন..

–আমি ভেবেছি,আপনারই কথা বলার কথা আচ্ছা..কেমন আছেন?

সেঃ–আমি ভালো আছি..(একটু সহজ গলায় টেনে বললেন..)তারপর সে আমাকে একটু নরম গলায় জিজ্ঞাসা করলো–

–আচ্ছা,আপনি ভালো আছেন তো????

আমি একটু অবাক হলাম উনার প্রশ্নটা শুনে হমআমি কৌতুহল বশত আড়চোখে,তার মুখটা দেখার চেষ্টা করলাম..ওমা,তাকাতেই দেখি সে গভীর মনোযোগ দিয়ে আমার পায়ের দিকে তাকিয়ে আছে. আমি সাথে সাথে আমার নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললাম..আমার এক বিন্দু পরিমাণ ধৈর্য্য ধরতে পারলাম না..যা হয় হবে,আমিও এখন তাকে নিয়ে কিছু একটা বলে,অপমান করে বুঝিয়ে দিবো নিজের দুর্বলতা নিয়ে কেউ হেয় করলে কতটা কষ্ট লাগে আমি চোখ-মুখ কুচড়ে নিয়ে তাকে কিছু বলতে যাবো,ঠিক সেই সময়ে উনি আমার দিকে কেমন জানি একটু মায়া করে তাকিয়ে আলতো গলায় প্রশ্ন করলো—

–আপনি কিছু মনে না করলে,আমি কি জানতে পারি আপনার পায়ে কি হয়েছিলো???

আমি থতমত খেয়ে গেলাম প্রচণ্ড অবাকের থেকেও অবাক হলাম আমি হা হয়ে গেলাম তার প্রশ্ন শুনে “আমার পায়ের রং না বিচার করে, পায়ে কি হয়েছিলো সেটা জানতে চাইলো!!! আচ্ছা,সে কি রঙের জায়গায় কারণ খেয়াল করছিলো?” তার প্রশ্নটার কারণে,আগেই তাকে অপমান না করে,ভালো করে উত্তর দেওয়ার ইচ্ছে করলো তখন আমি মাথাটা নিচু করে আস্তে গলায় উত্তর দিলাম–

–ছোট বেলায় গ্রামের বাড়িতে খেলা করতে করতে চুলায় রাখা হাড়ি থেকে সব গরম পানি আমার দুই পায়ের উপর পড়ে গিয়েছিলো..তখন আমার আশে পাশে কেউ ছিলো না..মা গিয়েছিলো গোসলে..আমার কান্নার চিৎকার শুনতে দেরী হওয়াই আমার কাছে ছুটে আসতে সময় লেগেছিলো..তারপর গ্রামের বাড়ি,সাথে সাথে কোন ব্যবস্থা নিতে দেরী হয়েছিলো..সে কারণেই পুরোটা শেষ করার আগেই সে কেমন জানি মলিন গলায় জিজ্ঞাসা করে উঠলো..

–খুব যন্ত্রণা হচ্ছিলো,তাই না?? আমি এবার একটু সহজ গলায় উত্তর দিলাম–
–অনেক ছোটবেলার কথা তো..

অতো খেয়াল নেই.তবে আম্মুর কাছে শুনেছি,আমি নাকি টানা দুইদিন-দুইরাত শুধু কাঁদতাম যন্ত্রণায় আমার মুখে এটা শোনার পরে মানুষটা মাথা নিচু করে ফেললো..তারপর একটা লম্বা করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো,নিঃশব্দে..আমি তার দিকে আরো অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি..খুব মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করছিলাম..আমার হুট করেই মনে হলো,মানুষটার মনে বোধ হয় মায়া নামক জিনিসটা একটু বেশি তিনি ওভাবেই মাথা নিচু করে বলে উঠলেন–

–গতকালের নীরবে ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্য আমি আন্তরিক দুঃখিত..যতই খারাপ হোক,বড়দের কথার উপরে কথা বলাটা শোভনীয় না।।সে কারণে..আমি সব কিছু শুনতে পেরেও,বুঝতে পেরেও চুপ করে ছিলাম..কিন্তু বিষয়টা আমাকে অনেক অস্বস্তি দিচ্ছিলো..যার কারণে,আজকেই আপনাকে আরেকবার দেখতে চাওয়ার প্ল্যান করতে হলো
যেন আপনার কথা শুনতে এবং আমার কথা বলতে পারি…

আমি একেবারে থ হয়ে তার কথা গুলো শুনলাম আমার ভেতরটা কেমন জানি শীতল লাগলো এই অচেনার মানুষটা কি ভীষণ চেনা মানুষের মতন কথা বলছে..সবাই যেখানে আমার খুঁত পেয়েছে,সেখানে সে আমার ব্যাথার আভাস খুঁজেছে..এটা ভেবেই অন্য রকম একটু শান্তিতে আমার চোখের কোণা ছলছল করে উঠলো মনের অজান্তেই তার উপর অনেকখানি মুগ্ধতা আর অদৃশ্য এক বিশ্বাস জন্ম নিলো আমার মনে হুট করেই মনে পড়লো–উনারা আমাকে দেখতে আসার আগে বাবা আমাকে বলেছিলো, ছেলেটা খুব ভালো মনের ছেলে আমি মুগ্ধতার কারণে তখনও তাকে কোন উত্তর দিতে পারলাম না..আমার কেন জানি মনে হলো, সে আমার দিকে তাকালেই বুঝতে পারবে আমার অনুভুতি টা…আমি তাকে খুব শান্ত আর হাসি কণ্ঠে বলে উঠলাম–

–আমি কি আপনার দিকে একটু তাকাতে পারি???

মানুষটা সাথে সাথে মাথা উঁচু করে তাকালো আমার দিকে..আমিও তার দিকে তাকালাম অন্যরকম ভালো লাগছিলো..আমি জানি না সে আমার মাঝে কি দেখছিলো।।কিন্তু আমি তার মাঝে ভালো একজন মানুষের ছায়া অনুভব করছিলাম বেশ কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে থাকলাম একে অপরের দিকে সে তখন হুট করে এক গাল হাসি মুখে সুন্দর করে বলে উঠলো– “পাত্রী আমার কালই পছন্দ হয়েছিলো কিন্তু পাত্রী বোধ হয় আমাকে এখন পছন্দ করলো…”

আমি ফিক করে হেসে উঠলাম সে তখন আমার দিকে আরো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো– “সংসার মানেই হয়তো অনেকখানি জটিলতা আমি আপনাকে সবসময় ভালো রাখার কথা দিতে পারবো না..তবে আপনার কষ্টের কারণ গুলোতে সবসময় মন দিয়ে বোঝার কথা দিতে পারি তার শেষের এই কথা দুটো আমার অসম্ভব ভালো লাগলো..বিশ্বাস করে নিলাম তাকে..আমার তো এটুকু হলেই চলবে..বাকি অবস্থা গুলো তো,আমি নিজেও বুঝতে পারি..কারণ,একটা মেয়ে যদি তাকে বোঝার মতন মানুষ টাকে পায়..তবে সে সবাইকে বুঝে চলার চেষ্টা করতে পারে….

আমার খুশিতে চোখের কোণ দিয়ে পানি গড়িয়ে গেলো..আমি সাথে সাথে ওটাকে মুছে ফেলতে গেলাম..সে হুট করে আমার হাত চেপে ধরলো আর বললো– “পানিটাকে মুছো না,প্লিজ গতকাল তোমার চোখে কষ্টের পানি হয়েছিলাম, আজ তোমার সুখের অশ্রুফোঁটাতে আমায় আরো কিছুক্ষণ থাকতে দাও আমি তার কথার মায়ায় নিজেকে খুশিতে হারিয়ে দুই হাতে মুখ চেপে কেঁদে উঠলাম আর মনে মনে উপরওয়ালাকে শুকরিয়া জানাতে একটুও ভুল করলাম না..

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত